জীবনী কোষ/ভারতীয়-ঐতিহাসিক/কণিষ্ক


কণিষ্ক—প্রাচীন ভারতের এক সুপ্রসিদ্ধ নরপতি। কিন্তু তাঁহার রাজত্ব কাল, রাজ্যসীমা প্রভৃতি বিষয় এখনও পণ্ডিতগণের বিচার্য্য রহিয়াছে। কয়েকটি অনুশাসনলিপি এবং বিভিন্ন স্থানে সংগৃহীত মুদ্রা হইতে তাঁহার সম্যক্‌ পরিচয় সংকলন করা এখনও সম্ভব হয় নাই। কণিষ্ক শকনামক এক অনার্য্য জাতীরই ‘কুশন’ শাখার অন্তর্গত রাজন্যবর্গের অন্যতম। তাঁহার রাজত্বকাল সাধারণতঃ খ্রীঃ পূর্ব্ব ১ম ও খ্রীঃ ২য় শতাব্দীর মধ্যে গণনা করা হয়, যদিও এই বিষয়ে ঘোরতর মতভেদ রহিয়াছে। কণিষ্কের অব্যবহিত পূর্ব্ববর্ত্তী সম্রাট দ্বিতীর ক্যাডকাইসিস কর্ত্তৃক রোম সম্রাট অগষ্টস সমীপে দূত প্রেরিত হয়। তদনুসারে, কণিষ্ককে, অগষ্টসের পরবর্তী রোম সম্রাট মার্কাস অরেলিয়সের সমকালবর্ত্তী বলিয়া নির্দ্দেশ করা বিশেষ ভ্রমাত্মক হইবে না। সুতরাং কণিষ্কের রাজ্যকাল খ্রীঃ ২য় শতাব্দীর পূর্ব্বভাগে ছিল বলিয়া প্রতিপন্ন হয়।

 কণিষ্কের নামাঙ্কিত মুদ্রা হইতে তাঁহার রাজ্যসীমা, রাজত্বকালের সময়, ধর্ম্মবিশ্বাস প্রভৃতি নানা বিষয় আলোচনা করিবার সুযোগ পাওয়া যায়। ঐ মুদ্রা আলোচনার দ্বারা নিরূপিত হইয়াছে যে মহারাজ কণিষ্কের রাজ্যসীমা পূর্ব্বদিকে বারাণসীর সন্নিকট পর্য্যন্ত; উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্ব্বত ও পশ্চিমে ভারতের বর্ত্তমান ভৌগলিক সীমা পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কাশ্মীরের ইতিহাস ‘রাজতরঙ্গিনীতে’ উল্লেখ আছে যে কণিষ্ক কাশ্মীর বিজয় করিয়া, তথায় কণিষ্কপুর নামক রাজ্য স্থাপন করেন। বর্ত্তমান পেশোয়ারের নিকটবর্ত্তী পুরুষপুর নগরি তাঁহার রাজধানী ছিল। তিব্বতীয় বৌদ্ধ ঐতিহাসিক তারানাথ বলেন যে, কণিষ্ক মগধ রাজধানী পাটলিপুত্র (নামান্তর কুসুমপুর) অধিকার করিয়া, তত্রত্য রাজকবি অশ্বঘোষকে নিজ রাজধানীতে লইয়া যান। ভারতের সিমার বাহিরে চীন সম্রাটের অধিকারভুক্ত স্থানেও তিনি অভিযান করেন এবং তাঁহাকে পরাজিত করিয়া তাঁহার পুত্রকে প্রতিভূস্বরূপ নিজ সকাশে রক্ষা করেন। পার্থীয়গণ যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন, তখন কণিষ্ক তাহাদিগকে পরাজিত করিয়া, পশ্চাদ্ধাবনপূর্ব্বক বহুদূর পর্য্যন্ত তাহাদের রাজ্যাভ্যন্তরে প্রবেশ করেন বলিয়াও কথিত হয়। কণিষ্ক বৌদ্ধমতাবলম্বী হইয়াছিলেন। তাঁহার কতকগুলি মুদ্রাতে গ্রীক অক্ষর খোদিত। পরবর্ত্তী কালের অনেকগুলিতে গৌতমবুদ্ধের মূর্ত্তি এবং গ্রীক অক্ষরে তাঁহার নাম ক্ষোদিত দেখিতে পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া তিনি চৈত্য, বিহার প্রভৃতি নির্ম্মাণ করান। বৌদ্ধধর্ম্মানুরুক্তির ফলস্বরূপ একটি ত্রয়োদশতলবিশিষ্ট, সু-উচ্চ কাষ্ঠ নির্ম্মিত কারুকার্য্যময় সৌধ (tower) নির্ম্মিত হয়। সুপ্রসিদ্ধ চীন পরিব্রাজক ফা-হিয়ান এবং হিউয়েন-সাং ঐ সৌধ দর্শন করিয়া ছিলেন; প্রসিদ্ধ পর্য্যটক আল বেরুণীর ভ্রমণকালেও উহা বর্ত্তমান ছিল। খ্রীঃ নবম ও দশম শতাব্দীতে উহা বৌদ্ধ শাস্ত্রালোচনার একটি প্রসিদ্ধ কেন্দ্র হইয়াছিল। কণিষ্কের রাজ্যকালে একটি বৌদ্ধ ধর্ম্ম সঙ্গীতির অধিবেশন হয়। উহা ইতিহাসে চতুর্থ বৌদ্ধসঙ্গীতি নামে পরিচিত। ঐ সঙ্গীতিতে বৌদ্ধ শাস্ত্রসমুহ সংগৃহীত, পরিশোধিত, পরিমার্জ্জিত ও নূতনভাবে সংকলিত হয়। সর্ব্বাস্তিবাদ ও বৈভাষিক মতানুসারে বৌদ্ধ শাস্ত্র সমূহের যে সকল টীকা রচিত হইয়াছিল, ঐ সঙ্গীতিতে তাহারই সমর্থন করা হয়। হিউয়েন সাং বলেন, “ঐ সঙ্গীতিতে যে সকল ধর্ম্মগ্রন্থ প্রামাণিক বলিয়া গৃহীত হয়, তাহাদের নাম তাম্রফলকে ক্ষোদিত হইয়া স্তূপতলে সংস্থাপিত হয় — বৌদ্ধধর্ম্মাচার্য বসু'মিত্র এই সঙ্গীতির প্রধান অধ্যক্ষতার কার্য্য করেন।”