আঠার

ছেলেবেলা থেকে আমরা রবিমামার গান গাইতুম—

একি অন্ধকার এ ভারতভূমি,
বুঝি পিতা তারে ছেড়ে গেছ তুমি,
প্রতি পলে পলে ডুবে রসাতলে
কে তারে উদ্ধার করিবে।
হীনতা লয়েছে মাথায় তুলিয়া,
তোমারেও তাই গিয়েছে ভুলিয়া।
তুমি চাও পিতা তুমি চাও চাও,
এ দীনতা পাপ এ দুঃখ ঘুচাও,
ললাটের কলঙ্ক মুছাও মুছাও
নহিলে এদেশ থাকে না।

 বড় হয়ে দেখলুম বাঙলার ললাটে প্রধান কলঙ্ক হচ্ছে কাপুরুষতার—সেইটিই মুছতে হবে। হাতে অস্ত্র ধরলেই ভীরুতা যায় না। কিন্তু অস্ত্রচালনার বিদ্যা জানা থাকলে ভরসা থাকে আততায়ীর শরীরে ঠিক কোন জায়গাটি বাঁচিয়ে কোন জায়গায় মারলে সে মরবে না, শুধু ঘা খেয়ে হতবল হবে। হয়ত তাতে মারপিটের দায়ে ধরা পড়তে হতে পারে, কিন্তু খুনের দায়ে নয়। এই ভরসাই সাহস দেয় অস্ত্রবিৎকে অস্ত্র চালাতে। কুকুরেরও দাঁত আছে, বেড়ালেরও নখ আছে, আক্রমণ করলে একটি পোকামাকড়ও কামড়ায়—শুধু বাঙালীই কি সাত চড়েও বা কাড়বে না? এত মনুষ্যত্বের অভাব তার চিরকাল? এত হীনতা?

 আর একটা জিনিস দেখলুম। হাতের ও মনের দুইয়ের একসঙ্গে ক্রিয়া চাই। লাঠি চালাতে শিখলেও মনের muscles-এর অকর্মণ্যতা অনেক দিন ধরে পুরুষানুক্রমে বাঙ্গালীর চলে এসেছে, সেটাকে সরিয়ে ঠেলে ফেলে মনকে কর্মপ্রমুখ করে কাজে ঝাঁপ দেওয়ানর অভ্যেস না করলে মনের হুকুম বিনা দরকারের সময় লাঠিবিদের হাত উঠবে না। বীরেরা বলেছিলেন—“বলং বলং বাহুবলং।” সঙ্গে সঙ্গে ধীরেরা শিখিয়েছিলেন-“ব্রহ্মতেজো বলং বলং।” অর্থাৎ মন ও শরীর পরস্পর পরস্পরের উপর প্রতিক্রিয়া করে। আমি ঝোঁকের মাথায় দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়েই আমার জাতিকে বলবীর্যে বলীয়ান করে গড়ে তোলার তৎপর হইনি। এ বিষয়ে ইংলণ্ডের বড় বড় মনীষী Educationist-দের মতেরও যথেষ্ট অনুসন্ধানপরায়ণ হয়েছিলুম। তাঁদের একজনের পুস্তকে পেলুমঃ—

 Physical weakness is a crime-against yourself and those who depend on you. Weaklings are despised and a weakling nation is doomed. The decline of ancient Greece and Rome which rapidly fell from the pinnacle of supreme civilization was due to physical neglect and abuse of the inflexible laws of Nature. A physically weak nation is drained out mentally, its feet are on the downward path and it will end upon the scrap-heap if it does not act before it is too late. To change from a weakling to a perfect man build yourself up, clear your befuddled brain and develop your muscles. The one great test of manliness is—courage, both mental and physical. Your mind alone is the maker of your physical future and your physical strength insures a high moral standard.  ইংরেজীতে প্রবাদ আছে—

 "The battles of England are fought and won in the fields of Eton."

 Eton-এ ফুটবল ক্রিকেট খেলতে খেলতে একদলের তার বিরুদ্ধ দলের সঙ্গে যে মারপিটের অভ্যাস হয়, সেই অভ্যাস ইংরেজকে স্বদেশরক্ষার্থ বা পরদেশ-বিজয়ার্থ যুদ্ধে তৎপর করে। কলকাতায় মোহনবাগান তখনো ময়দানে নামেনি। সেকালে মেডিক্যাল কলেজের ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে হিন্দু কলেজের ছেলেদেরই খেলা চলত এবং অনেক সময় দুদলে রক্তারক্তি খুনোখনিও হত শোনা যায়—হিন্দু কলেজের ছেলেরা প্রতিবারই পরাস্ত প্রতিপন্ন হত। এবারে আমার ক্লাবের ছেলেদের কাছে গল্প শুনলুম আগের দিন মাঠেতে হিন্দু ছেলেরাই খেলায় জিতেছিল, Umpire-এর অপক্ষপাত নির্ধারণও তাই হয়েছিল, কিন্তু তার পরে ফিরিঙ্গ ছেলেরা আক্রোশে দল বেঁধে একপাল উন্মত্ত ষাঁড়ের মত যেমন তাদের তাড়া করলে তারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচালে—“যঃ পলায়তি স জীবতি’’—এই নীতির অনুসরণে। একটা হিন্দু ছেলেও তাদের সম্মুখীন হল না। আমি বর্ণনাকারীদের জিজ্ঞেস করলুম—“তোমরা কজন ছিলে? কি করলে?” তারা বললে—“আমরা দশবারজন ছিলুম। আমরা কি করতে পারি? আমরাও সরে পড়লুম।”

 আমি তাদের ধিক্কার দিয়ে উঠলাম। বললুম—“বৃথা তোমাদের অস্ত্রবিদ্যা শেখা, বৃথা তোমাদের এখানে লাঠি ঘোরান। কাল থেকে আর এসো না।” তারা লজ্জিত হয়ে অবনত-মস্তকে রইল। তারপরে মাঠে খেলায় জিতেও ফিরিঙ্গির তাড়নায় বাঙ্গালীদের পলায়ন উপলক্ষে ভারতীতে আমার প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ বেরুতে থাকল। মহাভারত থেকে সেই কাহিনী শোনালুম যাতে পাওয়া যায়—শ্রীকৃষ্ণের পুত্র অনিরুদ্ধ রাজা সাম্বর সঙ্গে যুদ্ধে আহত ও সংজ্ঞাশূন্য হলে তাঁর সারথি যখন তাঁকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলাতক হয়, তিনি সংজ্ঞালাভ করে জানতে পেরে তাকে ভর্ৎসনা করে বলেন—“এ কি করলে? আমার নাম চিরকালের জন্যে বীরসমাজ থেকে মুছে দিলে? যদুকুলবৃদ্ধেরা কি বলবেন? আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেছি শুনে আমার পিতা-পিতৃব্যেরা কি মনে করবেন? যদকুলললনারা কি আমায় কাপুরুষ কুলকলঙ্ক বলে ঘৃণা করবেন না? ফিরাও ফিরাও রথ—আমায় যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে চল, ফের সারথি।”

 বাঙ্গালী ছেলেদের বললুম—“তোমরা সেই ভারতের সন্তান, যাদের ধমনীতে আজও তোমাদের পূর্বগত ভারতবালক অনিরুদ্ধের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। সে রক্ত কলঙ্কিত করো না, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিও না। যদি উদারভাবে বল, ক্ষমা করে এসেছ তাদের, তবে জেনো অক্ষমের ধর্ম নয় ক্ষমা। আগে ক্ষমা করবার অধিকারী হও, প্রবল হও, বলবত্তর হও, তবে তোমার চেয়ে যে হীনবল, তার প্রতি দয়া করো, তাকে ক্ষমা করো—তার আগে ক্ষমা করা ভীরুতার কাপুরুষতার নামান্তর।” দুতিন মাস পরে একটি ছেলে আগুয়ান হয়ে—চোরবাগানের বসু পরিবারের শৈলেন বসু—আর পাঁচ-দশটি ছেলের সঙ্গে আমাকে প্রণাম করে বল্লে—মা চল্লুম—ছমাস পরে আবার আসব।”

 “কোথায় যাচ্ছ?’’

 তারা বললে—“কাল আবার মাঠে খেলা আছে। এবার আর ফিরিঙ্গিদের প্রহার-ভয়ে আমরা পলাতক হব না—উত্তম-মধ্যম না দিয়ে ছাড়ব না। তার দরুন যদি জেলে যেতে হয় যাব—আইনেতে ছমাসের বেশি সে ধারায় সাজা নেই—তাই বলছি ছমাস পরে আপনার শ্রীচরণে আবার আসব।”

 তারা গেল, ফিরলেও সমুন্নত মস্তকে পরের দিন, ফিরিঙ্গিরাই এবার পলাতক হয়েছিল, কাউকে জেলে যেতে হয়নি।

 সে সময় স্টেট্‌সম্যানের এডিটর ছিলেন র‍্যাটক্লিফ সাহেব। তাঁর সঙ্গে ডিনারে, ইভনিং পার্টিতে মধ্যে মধ্যে দেখা হত, আমার কার্যকলাপ তাঁর অবিদিত ছিল না, কখনো কখনো সে সম্বন্ধে আমার সঙ্গে তাঁর খোলাখুলি আলোচনাও হত। মোহনবাগান যে বছর গোরাদের বিরুদ্ধে ফুটবল প্রথম জিতলে, সে বছর তিনি বিলাতে ও আমি পঞ্জাবে। “ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান”-এর সম্পাদকপদে অধিষ্ঠিত তখন তিনি। গোরাদের বিরুদ্ধে বাঙালীদের অভূতপর্ব জিতের খবরটা “ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানে” দিয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে লিখলেন—“আমরা জানি এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত যিনি হবেন তিনি হচ্ছেন—সরলা দেবী—বাঙলার একটি নন্দিনী।”

 বলেছি নানা জায়গা থেকে নানা ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত সে সময়। কেউ কেউ বলত তার মধ্যে পুলিসের গুপ্তচরও আছে। তাতে আমি ভয় পেতুম না, কারণ আমার লুকাবার কিছুই ছিল না। একদিন মৈমনসিং থেকে দুটি ছেলে এল—কেদার চক্রবর্তী ও তার সহচর ব্রজেন গাঙ্গুলী—পরে স্বদেশী গায়ক বলে যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। বললে সুহৃদ সমিতি নামে একটি দল বাঁধা তারা কয়েকটি ছেলে একটি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে গবর্নমেণ্টের চাকরি খুঁজবে না, নিজেরা একটা বড় রকম জমি নিয়ে স্বহস্তে চাষবাস করে নিজেদের প্রতিপালন করবে। সে জন্য তাদের পাঁচশ টাকা মূলধনের দরকার। সুরেন বাঁড়ুয্যে প্রভৃতি দেশের অনেক নেতাদের কাছে গিয়ে নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে ঐ পাঁচশ টাকা ধার চেয়েছে—বছর দুয়েকের মধ্যে টাকাটা ফিরিয়ে দিতে পারবে এই আশাও প্রকাশ করেছে। কিন্তু কেউ তাদের বিশ্বাস করে টাকা দেননি। শেষে আমার কাছে এসেছে, যদি আমি দেশের ছেলেদের প্রতি বিশ্বাস রাখি, টাকা দিই। জমি প্রায় যোগাড় হয়েছে—মৈমনসিং গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অনুগ্রহে। তিনি আসাম প্রদেশের পাদতলস্থ তাঁর জমি থেকে প্রায় এক হাজার বিঘা তাদের lease দিতে প্রস্তুত আছেন যদি নিজেরা চাষবাস করে। কিন্তু হাল জোৎ গরু ও বীজ প্রভৃতির জন্যে পাঁচশ টাকা গোড়ায় সংগ্রহ না হলে জমি নেওয়া তাদের বৃথা, তাই এখনো নেয়নি। বড় আশা করে আমার কাছে এসেছে। আমি কি দেব তাদের টাকা? তাদের দলে বিশটি ছেলে আছে যারা এই কাজের জন্যে প্রস্তুত।

 আমি স্থির জেনে নিয়েছিলুম দেশের ছেলেদের মানুষ করে তোলার যে কাজে আমি নেমেছি তাতে ফিরে পাবার আশা না রেখেই অনেক টাকা ঢালতে হবে। সেগুলো হিসেবের খাতাতে bad debts-এর ঘরেই ফেলতে হবে। আমরা অনেকেই অনেকদিন ধরে প্লাটফর্মে প্রেসে অনুযোগ আনছি, চাকরি ছাড়া বাঙালী ছেলেদের কি গত্যন্তর নেই? স্বাধীন জীবিকার কোন পথই নেই? আমাদেরই সকলের অনুপ্রেরণায় এই ছেলেরা একটা পথ খুঁজে নিয়েছে। এখন যদি তাদের নিরুৎসাহ করি, প্রয়োজনকালে টাকার সাহায্য দিয়ে তাদের সেই পথে অগ্রসর করে না দিই, তবে আমাদের নিজেদের উক্তিতে নিজেদেরই অবিশ্বাস প্রমাণ করা হবে না কি? টাকাটা ঋণ বলেই দেব, কিন্তু ঋণ ফিরে পাবার আশা রাখব না—এই মনস্থ করলুম। হতে পারে এই ছেলেরা ঠগ, হতে পারে সরলমনে চেষ্টা করেও এরা কৃতকার্য হবে না—টাকাগুলি জলেই যাবে, তবু এইভাবে কোন কোন দিকে টাকা ডোবানর জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি কেদার চক্রবর্তীকে বললুম—“দেব আমি টাকা, কিন্তু ব্রজেন রায়চৌধুরী যে তোমাদের জমি দিতে প্রস্তুত আছেন, সে বিষয়ে তোমাদের সঙ্গে তাঁর পত্র-ব্যবহার দেখতে চাই।”    এক সপ্তাহ পরে তারা ফিরে এসে বললে—“ব্রজেনবাবু এখন আমাদের নামে জমি দিতে অস্বীকার করছেন। আপনি আমাদের মাথার উপর দাঁড়িয়েছেন জেনে বলছেন আপনাকে দেবেন জমি, আমাদের নয়, সে বিষয়ে আপনার সঙ্গে লেখাপড়া করতে প্রস্তুত আছেন।” তারপরে তাঁর স্বদেশপ্রেমিক সেক্রেটারী মনোমোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে ব্রজেন্দ্রবাবু স্বয়ং এসে আমার সঙ্গে দেখা করে সব ঠিক করলেন। জমি আমার নামেই লেখাপড়া হল। জোৎ হাল সব আমার টাকায় আমার নামেই কেনা হল। ছেলেরা চালাবে ও যে ফসল হবে তার দ্বারা নিজেদের প্রতিপালন করবে। দুই-এক বছরে যখন আমায় টাকাটা ফিরিয়ে দিতে পারবে তখন সব কিছুর মালিক তারাই হবে। এই থেকে সুহৃদ সমিতির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সংযোগ হল।

 এবার আমার দৃষ্টি গেল বাঙলায় একটি জাতীয় উৎসবের দিন নির্দিষ্ট করার দিকে। যেমন মহরমের দিন মুসলমানদের নানারকম অস্ত্রচালনার প্রদর্শনী চলে পথেঘাটে, তার জন্য সারা বৎসর ধরে নানা আখড়ায় নানা নেতার অধীনে নানা দল সেগুলি ভাঁজতে থাকে; যেমন রামলীলা ও দশেরা বা বিজয়া দশমীর দিন বঙ্গেতর হিন্দু-ভারতে বীরোচিত নানা খেলাধূলা চলে, বাঙলায় সেই রকম চালাতে হবে—কোন্‌ দিন? ওসব দেশের দশেরা আমাদের বিজয়া দশমীর মত নয়, তাতে প্রতিমার ভাসানের পর্ব নেই। আমাদের ভাসানের দিন সবাই তারই আয়োজনে ব্যস্ত, সেদিন খেলাধূলার বিশেষ অনুষ্ঠানের অবসর হবে না বাঙালীদের। অথচ ঐ শারদীয় ঋতুতে যে সময়ে শমীবৃক্ষ থেকে তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে পাণ্ডবরা বীরভোগ্যা বসুন্ধরায় অভিযানে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই সময়ই বাঙালীদের বলবীর্য সাধনার জাতীয় উৎসব না হলে বাকী সব হিন্দুদের সঙ্গে তারা ঐক্যসূত্রে বাঁধা হবে না। এইরূপ দ্বিধায় দোদুল্যমান যখন তখন বাঙালীর পঞ্জিকা হলেন আমার সহায়। হঠাৎ একদিন এ বছর দুর্গা পূজার ছুটি কবে থেকে আরম্ভ হবে তাই জানার জন্যে পঞ্জিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখে পড়ে গেল দুর্গাপূজার অষ্টমীর আর একটি নাম ‘বীরাষ্টমী” এবং সেদিন “বীরাষ্টমী ব্রত’’ পালন করা ও ব্রতকথা শোনার বিধান। আমার আর নতুন করে কোন দিন উদ্ভাবন করতে হল না, যা চাচ্ছিলুম পেয়ে গেলুম। বহুকাল ধরে বাঙলা দেশের সংস্কারে যা রয়েছে কিন্তু বাঙালীর ব্যবহার থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে তারই পুনরুদ্ধার করা। বাঙালী মায়েদের বীরমাতা হওয়ার লক্ষ্যপথে আবার নিয়ে আসা, সে বিষয়ে তাদের ব্রতের পুনঃপ্রচলন করা। ভীরু বাঙালী মাদের হাত দিয়েই ছেলের রক্ষাবন্ধন করিয়ে মায়ের নিজমুখে “বীরোভব” বলে ছেলেকে বীরোচিত খেলাধূলায় কাজেকর্মে প্রবৃত্তি দেওয়ান। মাতায় পুত্রে মিলিত হয়ে দেশকে গৌরবশিখরে সমুন্নত রাখার প্রকৃষ্ট সাধনা যে দেশের ধর্মোৎসবের একটি অঙ্গ ছিল—সে দেশ আজ এত হীন এত পতিত হয়ে আছে কেমন করে? আমার প্রাণ কেঁদে উঠল। আজ আমায় দেশের অনেক ছেলে ‘মা’ বলে। না জেনে আগে থাকতেই আমি তাদের কারো কারো হাতে রক্ষাবন্ধন করেছিলুম। এখন যখন জানলুম ঐ দিনে এদেশের দেশাচারই ঐ, মায়ের কর্তব্যই ঐ, তখন ক্লাবে ক্লাবে সকল খেলোয়াড়ের হাতেই ঐ দিন রাখী বেঁধে তাদের লোকসমক্ষে খেলায় প্রবৃত্ত করানই হল আমার ধর্ম—আমার প্রতি দেশমাতৃকার এইটিই আদেশ, নয়ত পঞ্জিকার ঐ পৃষ্ঠাটির প্রতি আমার দৃষ্টি পড়ালেন কেন?

 সেই থেকে আধুনিক বীরাষ্টমী উৎসবের সূচনা হল। সেই বছরই মহাষ্টমীর দিন ২৬নং বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মাঠে ছেলেদের অস্ত্রবিদ্যা-প্রদর্শনী ঘোষণা করা হল। কলকাতায় যত ক্লাব আমার জানা ছিল সকলের কাছে আমন্ত্রণ গেল—তাঁরা যেন উৎসবে যোগদান করেন ও খেলার প্রতিযোগিতায় নামেন। মুর্শিদাবাদের Dowager নবাব-বেগম সাহেবার কন্যা সুজাতালি বেগের পত্নী আমার বন্ধু ছিলেন। লেসের পরদা-ঘেরা একটা প্লাটফর্মের ভিতর আমার মা ও মাসিমাদের সঙ্গে তাঁকে বসিয়ে শেষে পরদার ভিতর থেকে বাড়ান তাঁর হাত দিয়ে উৎসবপ্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করালুম—কাউকে মুষ্টিযুদ্ধের জন্যে দস্তানা, কাউকে ছোরা, কাউকে লাঠি এবং প্রত্যেককেই একটি করে ‘বীরাষ্টমী পদক’—তার এক পিঠে লেখা “বীরোভব’-এক পিঠে “দেবাঃ দুর্বলঘাতকাঃ”। বীরাষ্টমী উৎসবের একটি অনুষ্ঠানপদ্ধতিও প্রস্তুত হল। তার প্রধানাঙ্গ হচ্ছে একটি ফুলের মালায় সজ্জিত তলোয়ারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেশের পূর্ব পূর্ব বীরগণের বন্দনা-স্তোত্র ও তাঁদের নাম উচ্চারণ করে করে তরবারিতে পম্পাঞ্জলি প্রদান। সে স্তোত্রটি এইঃ-

বীরাষ্টম্যাং মহাতিথৌ পূর্ব পূর্বগতান্‌ বীরান্‌
নমস্কুর্য ভক্তিপূর্বং পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্‌॥

বীরকুলাগ্রগণ্যং শ্রীকৃষ্ণ-নন্দননন্দনম্‌
বীরাষ্টম্যা নমস্কুর্য পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্‌॥
সানুজং শ্রীরামচন্দ্রং রঘুকুলপতিশ্রেষ্ঠম্‌
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্য পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম‌্॥
ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণার্জুন-ভীমান্‌ সর্বপিতামহান্‌
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্য পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্‌॥
ইন্দ্রজয়ী মহাশূরং মেঘনাদারিপুত্রাসম্‌
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্য পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম‌্॥
রাজপুতকুলগর্ব প্রতাপমহাপ্রতাপম্‌
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্য পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম‌্॥
ছত্রপতি মহাবীরম্‌, মহারাষ্ট্রকুলনায়কম্‌
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্য পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্‌॥
পঞ্জাবকেশরীং বীরং রণজিৎ ইতি খ্যাতম্‌
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্য পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্‌॥
বঙ্গাধিপং মহাশৌর্যং প্রতাপাদিত্য বীরেশম্‌
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্য পুস্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্‌॥
ক্ষত্রবংশসমুদ্ভূতং বঙ্গজং রায় সীতারামম্‌
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্য পুস্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্‌॥
এতৎ সর্বেষান্‌ পূর্বগতান্‌ পদে পুষ্পাঞ্জলিং দত্বা
বীরাষ্টম্যাং নমঃস্কুর্মঃ বয়ম্‌ অদ্য নমোনমঃ॥

 যখন এক এক জনের নাম উচ্চারণ করে করে পুষ্পাঞ্জলি প্রক্ষেপ হত, একটা ভীষণ উত্তেজনায় সমস্ত সভামণ্ডলী জাগ্রত হত। এই স্তোত্রটির রচয়িতা খিদিরপুরের সেকালের প্রসিদ্ধ স্বদেশী আশুতোষ ঘোষ। বিভিন্ন খেলার মধ্যে মধ্যে এক একটি জাতীয় সঙ্গীতও সকলের উৎসাহ প্রদীপ্ত করে রাখত।

 ‘বীরাষ্টমী’র উৎসব বাঙ্গলায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। যে সব দেশভক্তেরা কলকাতায় এসে যোগদান করতে পারতেন না, তাঁরা স্ব স্ব নিবাস স্থানে এর অনুষ্ঠান আরম্ভ করলেন। আমার উপদেশ ছিল—যে গ্রামে আর কিছু করার সুবিধে নেই, সেখানে এই ‘বীরাষ্টমী’কে উপলক্ষ করে মহাষ্টমীর দিন ছেলেরা যেন গ্রামের পুকুরে শুধু, সন্তরণেরই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। মোট কথা এই তিথিটিতে কোন না কোন রকম শারীরিক বলবীর্যের অনুষ্ঠান চাই, আর মায়ের হাতের রাখী নেওয়া চাই।

 সেই সময় একবার বরোদার গায়কোয়ার ও তাঁর রাণী দার্জিলিঙ থেকে কলকাতা হয়ে বরোদায় প্রত্যাগমন করবেন শুনতে পেলুম। আমি তাঁদের একটি অপরাহ্নে আমাদের বাড়িতে চায়ে নিমন্ত্রণ করলুম। তাঁরা যখন এলেন, আমার ক্লাবের ছেলেরা স্ব স্ব অস্ত্র হাতে তাঁদের guard of honour দিলে এবং চা-পানের পর মাঠে তাদের অস্ত্রখেলা প্রদর্শন করলুম। মহারাজাকে গল্প করলুম প্রায় ৭।৮ বছর আগে সোলাপুরে তাঁর সভাপতিত্বে মহারাষ্ট্রীয় ক্লাবের খেলা দেখে আমার মনে এই ক্লাব খোলার প্রথম সূচনা হয়েছিল। বাড়ির ভিতরে উঠতে প্রথম ঘরেই জাপানী আর্টিস্টের হাতে আঁকা আমার ফরমাসী কালীর একটি অপূর্ব মূর্তি ছিল—সেখানি আজও আছে আমার বাড়িতে। ঘরের অন্যান্য দেওয়ালে আমার মা-বাবার ছবির সঙ্গে সঙ্গে আমারও একখানা বড় ছবি ছিল—খোলা চুলের প্রাচুর্যে বোধহয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা—সে ছবি অনেক জায়গায় বেরিয়েছে, বোধহয় যোগেন গুপ্ত মহাশয়ের “বঙ্গের মহিলা কবি” পুস্তকেও আছে। বরোদা-রাজকে আমি কালীর ছবির দিকে নিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখতে বললুম। তিনি আমার ছবির দিকে ফিরে হেসে বললেন—“কোন্‌ কালী দেখব? এই কালী না ঐ কালী?”