জীবনের ঝরাপাতা/এক
ঝরে গেছে, ফুরিয়ে গেছে যা, তাদেরই কতকগুলি কুড়িয়ে বাড়িয়ে জড় করে একখানা মালা গাঁথা—এ হল আমার জীবনস্মৃতি, জীবনকাহিনী। ঝরা হলেও মরা হয়নি সে পাতাগুলি, মানবপ্রাণের সংস্পর্শে চিরপ্রাণবন্ত হয়ে আছে। আমার জীবনের দীর্ঘপথে দিকে দিকে পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে প্রভাতে সন্ধ্যায়, সজনে নির্জনে, দুঃখ দহনে, উৎসবে আনন্দে কত ঘটনা ও কত অঘটন ঘটেছে ঝরেছে সরেছে। পর পর যাঁদের সংযোগে মূল্যহীন জীবনের মূল্য, এ জীবনকাহিনীর পর্বে পর্বে তাঁরাই আছেন ফুটে।
একদিন ভাদ্রমাসে-ললিতা সপ্তমী তিথিতে মহর্ষির আর একটি দৌহিত্রীর আবির্ভাব হল বাড়ির সূতিকাগহে, বাড়ির ভিতরের তেতালায় একটা রোদফাটা কাঠের ঘরে। তার দরুন বিশেষ কোন সাড়া পড়ল না মহলে মহলে। কারো না কারো জন্ম নিত্য ঘটনা এ বিরাট পরিবারে। নৈমিত্তিক আচরণ সকল বাঁধা দস্তুরমত অনুষ্ঠিত হতে থাকল। ব্রাহ্মধর্মের নূতন পদ্ধতিক্রমে “জাতকর্ম” সংস্কার ও উপাসনাদি হল, আবার আটকৌড়েও হল, ঘরে ঘরে বণ্টিত খইমুড়ি বাতাসাসন্দেশ ও আনন্দ নাড়ুতে ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দধ্বনি নতুন শিশুটিকে স্বাগত করলে।
এদিকে সদ্যোজাত শিশুকে সনাতন সরষে তেলে জবজবে করে রোজ একবার সূতিকাগৃহের বাহিরে আঙ্গিনায় এনে রৌদ্রে রাখা হতে থাকল। যে উদ্দেশ্যে প্রতীচ্যের সৌখীন সাহেবমেমরা বহৎ তরণীযোগে সাতসমুদ্রপারে দেশদেশান্তে উপনীত হয়ে রকমবেরকমের সুগন্ধি মিশ্রতৈলসিক্ত দেহে sunbath বা রৌদ্রস্নান গ্রহণ করেন সেই tanning বা ধূসরত্বকত্ব এই অতীব সহজ পন্থায় ভারতীয় শিশুর অনতিবিলম্বে লাভ হল।
সেকালের ধনিগহের আর একটি বাঁধা দস্তুর যোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল—শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত। ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র মায়ের কোল-ছাড়া হয়ে তারা এক একটি দুগ্ধদাত্রী দাই ও এক একটি পর্যবেক্ষণকারিণী পরিচারিকার হস্তে ন্যস্ত হত, মায়ের সঙ্গে তাদের আর কোন সম্পর্ক থাকত না। আমারও রইল না।
বাড়ির বাঁধ্য নিয়মের একটির কিন্তু আমার মায়ের বেলায় ব্যতিক্রম হয়েছিল। তিনি ঘরজামাই-হওয়া স্বামিসহ পিতৃগৃহবাস করেননি। বিবাহের পূর্বে আমার পিতার সর্ত ছিল ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরগৃহে থাকবেন না। কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করতে যখন যান তখন মাতামহ দেবেন্দ্রনাথের চোখে ইনি পড়েন। সুপুরুষ, শিক্ষিত, নদীয়া জেলার ব্রাহ্মণ জমিদারের পুত্র অথচ কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত উমেশ গুপ্তের সঙ্গগুণে অনেক পুরানো সংস্কার ছিন্ন করা এই ছেলেটিকে দেখে জামাই করার প্রবল ইচ্ছা হয় দাদামশায়ের। বড় মাসিমা সৌদামিনী দেবীর বিবাহ অনেককাল আগে সনাতনী রীতিতেই হয়ে গেছে, কিন্তু মেজ মাসিমা সুকুমারী দেবীর সময় থেকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা দিয়ে জামাইদের বিবাহমন্ত্র উচ্চারণ করান হত, এবং পূর্বাপর প্রথামত কন্যাসহ জামাইরা শ্বশুরগৃহেই স্থায়ী বাসিন্দা হতেন। আমার পিতা এই দুটি রীতিই মানতে অস্বীকৃত হলেন। দৃপ্তপুরুষ তিনি বল্লেন ব্রাহ্মধর্ম ও হিন্দুধর্মে মূলগত কোন ভেদ নেই, নিরাকার বা সাকার ব্রহ্মের উপাসক-দুইই হিন্দু। সুতরাং আলাদা করে ব্রহ্মোপাসক বলে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেওয়া অনাবশ্যক। দ্বিতীয়ত বিবাহের পর তিনি পত্নীকে স্বগৃহে নিয়ে যাবেন, শ্বশুরগৃহে থাকবেন না। দাদামহাশয় তাঁর এই দুই সর্তই মেনে নিলেন। যদিও মা তাঁর পরম আদরের মেয়ে ছিলেন তবু তাঁকে আলাদা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সম্মতি দিলেন। এদিকে আমার পিতৃদেব মহর্ষির কন্যাকে বিবাহ করায় তাঁর পিতা-কর্তৃক ত্যাজ্য হলেন। সে এক বিষম সমস্যা— পিতাপুত্র দুইজনে সমান জিন্দি, সমান ক্রোধালু। তাঁদের দেশে “ঘোষালে রাগ” বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। যেমন বীরপুরুষ তাঁরা ডাকাতদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ করতেন, তেমনি আপোষের রাগারাগিও সহজে মিটত না।
আমার পিতার জ্যৈষ্ঠভ্রাতা থাকায় কনিষ্ঠ তাঁকে তাঁর প্রভূত সম্পত্তিশালী জ্যেষ্ঠতাতের দত্তক করে দেওয়া হয়। কিন্তু বালক জানকীনাথ ছমাসের বেশি সেখানে রইলেন না। দত্তকপুত্র হওয়া অপমানজনক জ্ঞান করে একদিন কাউকে না বলে কয়ে সে গ্রাম থেকে পালিয়ে হেটে নিজেদের বাড়ি ফিরে এলেন। সেখানকার উত্তরাধিকার হারালেন। তাঁর দাদার অনপেক্ষিত হঠাৎ মৃত্যুতে জানকীনাথই পিতা জয়চন্দ্র ঘোষালের একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেন। কিন্তু পিরালী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যাকে বিবাহ করে সে অধিকারও খোয়ালেন। আমার পিতামহ ক্রোধে ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে দুহাতে তাঁর জমিদারী বিষয়সম্পত্তি নষ্ট করতে লাগলেন। যেন কপর্দকও ছেলের হাতে না পড়ে।
এই দুর্জয় ক্রোধ কালক্রমে কিরকমে শমিত হল, পিতাপত্রে বিসম্বাদ যে কেমন করে মিটে গেল আমরা ছোটরা কিছুই জানি না। আমরা যখন একটু একটু বড় হচ্ছি আমাদের স্নেহালু পিতামহের মধ্যে মধ্যে আমাদের গৃহে শুভাগমনে আমরা নানা রকমের আনন্দ-রসাস্বাদী হতে লাগলাম শুধু জানি।
বিয়ের পর মা-রা আলাদা বাড়িতে গিয়ে থাকায় আমার প্রায় পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত যোড়াসাঁকোর বাইরেই আমরা ভাইবোনেরা মানুষ হতে লাগলাম। কিন্তু যোড়াসাঁকোর সঙ্গে মাদের সংস্রব পূরোমাত্রাই রইল। এমন একটি দিন যেত না যেদিন হয় মা-বাবা যোড়াসাঁকোয় না যেতেন, কিম্বা যোড়াসাঁকোর লোকেরা আমাদের বাড়ি না আসতেন।
ছমাস বয়সে খুব ঘটা করে আমার অন্নপ্রাশন হল পেনেটির (পানিহাটির) বাগানবাড়িতে। গঙ্গাধারের সে বাগানবাড়ি তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই সম্পত্তি। সেবার যোড়াসাঁকোর বাড়িশুদ্ধ সকলের সেটা গ্রীষ্মনিবাস হয়। সে বাড়ির বতর্মান স্বত্বাধিকারী মৈমনসিং সেরপুরের জমিদার গোপালদাস চৌধুরী মহাশয়। তিনি ওটি একটি ট্রাস্টের হাতে সমর্পণ করে ওখানে নিজের মাতার নামে “গোবিন্দমোহিনী ভবন” বলে একটি অনাথাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন। কয়েক বৎসর পূর্বে তার দ্বারোদ্ঘাটন উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রিত হয়ে মাতুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমি এখানে আসি। নিজের স্মৃতিবহির্ভূত অন্নপ্রাশনের অর্ধশতাব্দীরও পরে এই প্রথম আমি জ্ঞানগোচরে আবার এ বাগানে এলুম। কি চমৎকার গঙ্গাধারের বাড়িখানি! কি সুন্দর ঘাট! ঘাটের উপরেই নহবৎখানা। কল্পনায় ছমাসের শিশু আমার লালচেলি পরা কপালে চন্দন মাখা চেহারা চোখে জাগল, কল্পনায় সেদিনকার সানাইয়ের বাঁশীর রব কানে শুনতে পেলাম। কিন্তু মাতুল রবীন্দ্রনাথের কল্পনাগত নয়, স্মৃতিগত ব্যাপার। আজ তাঁর হাত দিয়ে উদ্যোক্তারা যে বাড়ির একপ্রান্তে একটি আবক্ষ রোপণ করালেন সেই মনোরম গঙ্গাধারের বাড়িতে তাঁর একাদশবর্ষীয় নিজের জীবনের বহু স্মৃতি উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল। কোথায় পড়ে রইল আজকের মেয়েদের আয়োজন, তাদের পড়া মানপত্র, আর তার বাঁধাগতের উত্তর তাঁর! সেই বাগানবাড়ির এক একটা ঘরে বা বাগানের এক একটা দিকে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে বালক নিজেকে যত খুঁজে পেতে থাকলেন সেদিনের ছমাসের যে শিশু-আত্মীয়া আজ পাকাচুল নিয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে—তাঁর মনে ভরে ওঠা সেদিনের সব কথার একমাত্র দরদী শ্রোতা সেই হল।
অন্নপ্রাশনের ঘটনা প্রায় বিস্মৃতি-নিমগ্ন হলেও প্রায় আড়াই বছর মাত্র বয়সের দুটি ঘটনাকে স্মৃতি আমার মনের উপর আজও তুলে ধরে। দুটিতেই এসেছিল ভাবের চমক—একটা আনন্দের আর একটা ভয়ের। শেয়ালদা বৈঠকখানার যে বাড়িতে আমার মা-রা থাকতেন, সে বাড়ির আশেপাশে ফিরিঙ্গিদের বাস। সেখানে থাকতে একটি স্নানের ঘরের নর্দমার সামনে মেঝেতে উপুড় হয়ে নর্দমার ভিতর দিয়ে টেলিস্কোপের মত চোখ চালিয়ে দেখতুম, সামনের বাড়ির উঠানে একটা টিনের টবে সর্বাঙ্গে সাবান মাখান আমার চেয়েও ছোট একটি নগ্ন সাদা শিশু জলের ভিতর হাত-পা ছুড়ে কিলবিল করছে। তার এই কিলবিলনি দেখে কি পরম বিস্ময়কর আনন্দ লাভ করতুম বলা যায় না। কিন্তু এই মর্ত্যজীবনের কোন আনন্দই যেমন অবাধ নয়, সেটাও অবাধ ছিল না। আমার রক্ষী পরিচারিকা আমাকে এইতে নিমগ্ন দেখলেই বকে-ঝকে টেনে হিঁচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে আনত।
এই বৈঠকখানার বাড়িতে থাকতে থাকতেই—আরও কয়েক মাসের বড় হওয়া আমার জীবনের আর একটি ঘটনা আজও স্মৃতিনিবদ্ধ হয়ে আছে। মনে পড়ে তখন রোজ বিকেলে মুখ-হাত ধুইয়ে, ফরসা কাপড় পরিয়ে শেয়ালদা স্টেশনের বাহিরে রেললাইনের উপর আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হত। তখনকার কালে আদত স্টেশনটি তেমন বড় ছিল না, স্টেশনের বাইরে বড় রাস্তার উপরই কতকগুলো রেল-লাইন পাতা ছিল, shunt-করা খানকতক গাড়ি সারি সারি দাঁড়িয়ে সেখানে বিশ্রাম করত, কখনো কখনো প্রয়োজনমত এদিক-উদিক চলত।
আমাদের দাসীদের সঙ্গে যে দরোয়ান যেত, সে অনেক সময় কিন্তু আমাদের একখানা রেলগাড়ির ভিতরেই বসিয়ে দিত। একদিন দিদি, দাদা ও আমি, তিন ভাইবোনে গাড়িতে বসে আছি, দরোয়ান ও দাসীরা রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এমন সময় হঠাৎ গাড়ি shunt করতে লাগল। দিদি ত বিজ্ঞ আছেনই, দাদাও দিদির সামিল, কিছু ভীত হলেন না; আমি অজ্ঞের একশেষ, গাড়ি যেমন নড়ে উঠল, আর আমাদের নিয়ে চলে পড়ল, আমার বুকে একটা আকস্মিক ভয়ের ধাক্কা লাগল। একি? গাড়ি চলেছে? কোথায়? কোন্ বাড়ি-ছাড়া নিরুদ্দেশে? ঠিক এমনি নিরুদ্দেশ-ভীতির একটা ভাষাহীন অব্যক্ত ভাব শিশুর মনে স্পন্দিত হয়। আর সকলে আমার ভয় দেখে হাসতে লাগল। দরোয়ান হাসতে হাসতে গাড়িতে হাত রেখে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকল। দু-মিনিটেই গাড়ির চলা থেমে গেল, আমার ভয় তখনকার মত নিরস্ত হল; কিন্তু সেটা চিরদিনের জন্য মাথার স্মৃতি-কোটরে দাগ কেটে রইল।
বৈঠকখানা থেকে মা-রা সিমলার বাড়িতে উঠে যান। এখনকার মিনার্ভা থিয়েটারের পাশ দিয়ে একটা গলিতে সে বাড়ি। মনে পড়ে এই বাড়িতে থাকতে বছর চারেক বয়সে একদিন পা ফসকে ছাদের মার্বেল সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে একেবারে নীচের তলায় পড়ে আমার সামনের দুটো দাঁত ভেঙে রক্তারক্তি হয়, হাতে-পায়েও চোট লাগে। কান্নাকাটি বেশি করতে সাহস পাইনি—আমার রক্ষিণী দাসীর ভয়ে। সে জোর গলায় প্রতিপন্ন করলে দোষ তার অমনোযোগের নয়, আমার অসাবধানতার। “আহা”, “উহুঁ” ত পেলুমই না কারো, উল্টে লাঞ্ছনার শেষ রইল না। দিদি খুব বিজ্ঞের মত শোনাতে লাগলেন চিরকাল ফোকলা হয়ে থাকব, লোকের সামনে বেরবার যোগ্য থাকব না। আমার ও দিদিদের দাসীবৃন্দ মিলিত হয়ে তার চেয়েও বড় রকম একটা সুনির্দিষ্ট বিভীষিকা খাড়া করলে—“বর এসে ফোকলা দাঁত দেখে ফিরে যাবে।” মা কোন সাড়াশব্দই করলেন না। বাবামশায় নীচে নেমে আর্নিকাদি লাগিয়ে দিলেন।
বলেছি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই মায়ের সঙ্গে আমাদের আর সাক্ষাৎ-সম্পর্ক থাকত না। তিনি আমাদের অগম্য রাণীর মত দূরে দূরে থাকতেন। দাসীর কোলই আমাদের মায়ের কোল হত। মায়ের আদর কি তা জানিনে, মা কখনো চুমু খাননি, গায়ে হাত বোলাননি। মাসিদের ধাতেও এসব ছিল না। শুনেছি কর্তা-দিদিমার কাছ থেকেই তাঁরা এই ঔদাসীন্য উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। বড়মানুষের মেয়েদের এই ছিল বনেদী পেট্রিশিয়ন চাল। গরীবের ঘর থেকে আসা ভাজেরা কিন্তু তাদের প্লিবিয়ানের হৃদয় সঙ্গে করে আনতেন—ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাঁদের ব্যবহার আর এক রকমের দেখতুম। সে কথা পরে বলব।
পড়ে গিয়ে দাঁতভাঙার ব্যাপারে মা আতুপুতু না করায় কোন অভাব অনুভব করলাম না, কারণ সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু আর এক দিনের বড় রকম এক ব্যাপারে মনের ভিতর দিয়ে বিচারের একটা খটকা বাজল বুকে। শিশুরা শুধু হাসে-কাঁদে না, তাদের মাথায় বিচার-অবিচার বোধের খেলাও অন্তঃসলিলভাবে অনেক সকাল সকালই চলতে আরম্ভ করে।
আমাদের সব ছোট বোন ঊর্মিলা তখনও জন্মায়নি। দিদি হিরন্ময়ী, দাদা জ্যোৎস্নানাথ ও আমি—এই তিনজনে আছি তখন। দিদি আমাদের স্ব-নিয়োজিত সদার। একদিন সর্দারি করে বললেন,—“তোর চুল বড্ড বড় হয়েছে, আয় ছেঁটে দিই।” কোথা থেকে একটা বড় কাঁচি সংগ্রহ করে কচ্ কচ্ করে আমার মাথা-ভরা কোঁকড়া চুল কাটতে লাগলেন। উবরো-খুবরো যেমন-তেমন করে, মাথা প্রায় ন্যাড়া করে কাটা হল চুল। মা-বাবা বাড়ি ছিলেন না, ফিরে এসে যেমনি আমার চুলের দিকে দৃষ্টি পড়ল, বাবামশায় ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন—মা-ও তাতে অমত করলেন না “আজ থেকে সাত দিন পর্যন্ত তোমার বাইরে যাওয়া বা বাড়িতে কেউ এলে তাদের সামনে বেরন বন্ধ। এমনি চুল নিয়ে লোকের সামনে বেরলে লোকে হাসবে।”
শিশু, আমি লোকের হাসির মর্মান্তিকতা কিছু বুঝলাম না, কিন্তু একটি অবিচারবোধের তীব্র শেল আমার বুকের তলায় তলায় বিঁধতে লাগল। দিদি, যিনি আমার চুল বিশ্রী করে কাটলেন, আসল দোষ করলেন যিনি, তাঁর কোন শাস্তিই হল না। তিনি আগেকারই মত দিব্যি ফিটফাট হয়ে বুক ফুলিয়ে রোজ বিকেলে দাসীদের হাত ধরে হাওয়া খেতে যেতে লাগলেন। দাদাও তাঁর সঙ্গী হলেন—যদিও মা-বাবার বিনা অনুমতিতে দাদাও তাঁর চুলটা দিদির হাতে সমর্পণ করেছিলেন, দাদারও মাথায় দিদির হাতের কারিগরির নমুনা কিছু কিছু পরিদৃশ্যমান হয়েছিল। কিন্তু ব্যাটাছেলে তিনি, তাঁর চুল একটু-আধটু খারাপ দেখানতে আসে যায় না বোধ হয়, মেয়েদেরই শ্রীশালীনতার দিকে দৃষ্টি রাখার দরকার। তাই তিনজনের দোষের জন্য আমি একাই দায়ী হলুম। সাত দিন ধরে একলাটি ছাদের উপর একটা ঘরে আবদ্ধ রইলুম-একলা একলা সঙ্গিহীন, কাঁদিকাটি, কি করি সে আমিই জানি।
দিদি প্রথম সন্তান বলে মা-বাবার আদুরে মেয়ে, দাদা প্রথম পুত্র বলে আদুরে, আমি আর একটি অধিকন্তু অপ্রার্থিত মেয়ে মাত্র। তাই বৈদিক ঋষিকুমার শুনঃশেফের মত আমার জীবনের পৃষ্ঠপটে (background-এ) একটা অনাদরের পরদা টানা। সে পরদাখানা উঠে গেল অল্পে অল্পে শুনঃশেফেরই মত বাইরের সংস্পর্শে।
শাসনে শাসনেই গড়ে উঠেছি আমি, আদরে স্নেহে নয়। কিন্তু সিমলে বাড়ির সঙ্গে শাসনাতিরিক্ত একটি সরস স্মৃতিও জড়িত আছে—সেটি আমাদের পিতামহ জয়চন্দ্র ঘোষালের স্মৃতি। বলেছি তিনি একজন প্রবল-প্রতাপী পল্লী-জমিদার। যখনই আসতেন আমাদের বাড়িতে, পাড়াগাঁয়ের একটা নূতন হাওয়া নিয়ে আসতেন। তাঁর আগমন কদমা-কাসুন্দী-কুলকুটো ও বিশেষ চাষের খাজা কাঁঠালের সহাগমন সূচনা করত, শীতকাল হলে খেজুর গুড়ের পাটালী ও কলসী কলসী গুড়। তাঁর আগমন তৈলসিক্ত দেহে জলচৌকিতে বসে ঘরের বাইরে খোলা হাওয়ায় স্নানের দৃশ্য খুলে দিত। তাঁর আগমন বাড়ি ছেড়ে ডাকাতদের সম্মুখীন হয়ে যুদ্ধ-কাহিনীতে কর্ণকুহর ভরিয়ে দিত। তাঁর আগমন পুলিসের পেয়াদাকে ফাঁকি দিয়ে খাল-বিল থেকে খাল-বিলান্তরে নৌকাযোগে বিচরণ করে তাঁর জমিদারীতে খুনের মকদ্দমায় কাছারীতে হাজির হওয়ার সমন এড়ানর বিপুল বিস্ময়কর কথায় শরীরকে রোমাঞ্চিত করত। কিন্তু যেখানে সবচেয়ে বেশি তিনি আমাকে স্পর্শ করতেন, সেটি হচ্ছে আমার মর্মকোণের একটি শুষ্ক নিভৃতে। তাঁর স্নেহবিগলিত “দিদি, দিদি” সম্ভাষণটি সেইখানে ছুয়ে মধু-প্লাবন করত। বাড়ির মরু হাওয়ায় যেন একটি অদ্ভুত ওয়েসিসের সমাচার আনত। এখন চিরে চিরে বিশ্লেষণ করে বর্ণনা করছি। তখন কোনই বিশ্লেষণীশক্তি ছিল না—শুধু একটি স্নিগ্ধতার সরস অনুভূতি মাত্র ছিল।
আর একজন আত্মীয় আসতেন ঐ বাড়িতে—তিনি আমাদের পিসেমশায়—পরেশনাথ মুখোপাধ্যায়, ত্রিপুরা স্টেটের ডাক্তার। তাঁর সঙ্গে মধ্যে মধ্যে তাঁর ভ্রাতুষ্পত্র ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় আসতেন। এঁরই সঙ্গে দিদি হিরন্ময়ীর পরে বিবাহ হয়।
একবার পিসেমশায় আসার পর, আমি পাঁচ বছরে পড়তে আমার হাতেখড়ি হল। বাড়িতেই একজন পণ্ডিত থাকতেন, পিসেমশায়দের দেশেরই লোক, সতীশ মুখুয্যে। তাঁর কাছে একদিনেই আমার বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগ শেষ হয়ে গেল। পিসেমশায়ের হুঁকোর খোলের ভিতর পয়সা ও দু-আনা চার-আনার রেজকি ভরা থাকত। তার থেকে আমাদের প্রায়ই কিছু না কিছু বিতরণ করতেন। তাঁর এক-একগাছি পাকা চুল তুলে দিয়ে দিদি-দাদা দু-চার আনা পুরস্কার প্রায়ই অর্জন করতেন। আমার সে বিষয়ে পটতা ছিল না, তাই সে রকম কিছু রোজগার হত না। কিন্তু সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে প্রথমভাগখানা আদ্যোপান্ত শেষ করার খবরটা রটায় সেদিন পিসেমশায়ের হুঁকোর খোল খালি হয়ে আমার হাত বেশ খানিকটা ভরল। অর্থাৎ আমার দাসীর ভাগ্যি সেদিন খুলে গেল—এতদিন দিদি-দাদার দাসীরাই ভাগ্যিমন্ত হত। কেননা, আমাদের রোজগার আমাদের কোন কাজে লাগত না, তাদের দ্বারা বাজেয়াপ্ত হয়ে তাদেরই ভোগে আসত।