জীবনের ঝরাপাতা/পঁচিশ
॥ পঁচিশ॥
তৃতীয় পর্যায়
বিবাহ
কোন মানুষের জীবনের প্যাটার্ন কোন আর একটা জীবনের সঙ্গে এক নয়। বিধাতার যে তিনটি কন্যার উপর জীবনবয়নের ভার দেওয়া আছে, তাঁদের হাতে মাকুর ফেরফারে এ জীবনে সে জীবনে নব নব প্যাটার্ন ফুটতেই আছে। প্রত্যেকটিতে স্বভাবগত ও ঘটনাগত সূক্ষ্ম ইতরবিশেষ ও বৈচিত্র্য দেখা দেবেই। অচেতন মেশিনের মুখ থেকে বেরন অবিকল একই রকমের রাশি রাশি বস্তুর মত প্রাণের সময় আদিশিল্পীর বুক থেকে বেরন জীবননামীয় শিল্পখণ্ডগুলির ভিতর একঘেঁয়েত্ব একেবারে নেই। বাইরে থেকেই দেখতে পাওয়া যায় মানুষের কররেখায়, পদরেখায়, আঙুলের ডগার অনন্ত বিভিন্নতায় জীবনসমূহের অন্তহীন বৈচিত্র্য চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। কোন মানুষের সঙ্গে কোন আর একজন মানুষের অক্ষরে অক্ষরে, পদে পদে, সেণ্টেন্সে সেণ্টেন্সে বা সুচির ক্ষেপে ক্ষেপে মিল নেই। কেউ কারো অবিকল নকল নয়। এক জাতীয় বলে দেখতে অনেকটা এক হলেও প্রত্যেকেরই স্বাতন্ত্র্য আছে। যেখানে স্বাতন্ত্র্য বা অভিনবত্য খুব ডবডবে সেখানেই সকলের দৃষ্টি সহজে আকর্ষণ করে, নয়ত সাধারণ বলে দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। জীবনখানার বুনোনি আরম্ভ হয় মাতৃগর্ভে থাকতেই, শেষ হয় জীবনলীলাবসানে। আমার জীবনের প্যাটার্নখানা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নানা ফুলপাতা কেটে কেটে দেখা দিতে লাগল। সে আস্তরণখানি যাঁর চরণের আসন তিনিই তার বিরচক হয়ে চলবেন। তাঁর হাতের মাকু হঠাৎ বাঙলা দেশ থেকে ছুটে গেল দূরে সুদূরে—পঞ্চনদের কূলে, সেখান থেকে টানা-পোড়েনের খেলা চালাতে লাগলেন।
আমি গিয়েছিলুম তখন হিমালয়ের উপর স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত মায়াবতী আশ্রমে। সেখানে দেখলুম সেই ‘‘অক্ষর চুম্বিত ভাল হিমাচল” ভারতবর্ষকে আমার, সেই “শুভ্র তুষার কিরীটিনী” মাকে আমার। আহা কি সুন্দরী! চোখের সামনে ঝকঝক ঝকমক করছে কেদার ও বদ্রিনারায়ণের শৃঙ্গ। এই তুষার প্রাচীরের ওপারে অন্যান্য বর্ষ, অন্যান্য সভ্যতা; এপারে চিরসনাতন ভারতবর্ষ ও ভারত সভ্যতা, যা বেদমন্ত্রে মুখরিত হয়ে ভারতের গগন আচ্ছন্ন করেছিল, ঐ পর্বতমালার কন্দরে কন্দরে আজও কি তার প্রতিধ্বনি গুঞ্জরিত হচ্ছে না? ঐ উপত্যকাক্রোড়োত্থিত মেঘপুঞ্জ চিরঞ্জীব ঋষিদের হোমাগ্নিধূমে কি আজও ধূমায়িত নয়?
আমি এখানে বিবেকানন্দের গুরু-ভ্রাতা স্বামী তুরীয়ানন্দের নিকট প্রতিদিন উপনিষদ অধ্যয়নে ব্যাপৃত হলুম। ভগবদ্গীতার সঙ্গে পরিচয়সাধনও এখানে আরম্ভ হল। রাত্রে কোন কোনদিন যাজ্ঞবল্ক্য ও নারদ ঋষি এসে আমায় উপদেশ দিচ্ছেন এই সুস্পষ্ট স্বপ্ন দেখতুম।
আশ্রম যে শুধু একটি আধ্যাত্মিক ভূমি নয়, তার ভৌতিক স্তরও যে একটি আছে—কারণ যেখানেই মানুষের নিবাস সেখানেই তার দেহধারণের উপকরণাদির সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রয়োজন এবং সে জন্যে বিধিব্যবস্থার একান্ত আবশ্যক—সে দিকটা আমার মনে ইতিপূর্বে কখনো উদ্ভাসিত হয়নি। এতদিনে সেকালের আরণ্যকদের সলিল-প্রচুর ও মানব পল্লী থেকে অনতিদূর কুটীর নির্মাণ করে বসবাস বিধানের মর্ম হৃহয়ঙ্গম হল। এখানে দেখলুম আশ্রমাধ্যক্ষ স্বামী স্বরূপানন্দ—যাঁর সঙ্গে বেলুড়ে প্রথম সাক্ষাৎ হয়—“প্রবুদ্ধ ভারত” নামীয় অতি উচ্চাঙ্গের একখানি ইংরেজী পত্রিকা সম্পাদন করছেন, ব্রহ্মচারীদের জন্য বেদান্ত ক্লাসে নিয়মিত অধ্যাপকতা করছেন, আবার তিনিই অন্য সময় অতিথি-অভ্যাগতদের সৎকারের ত্রুটি না হয় বলে আশ্রমের ভাণ্ডার-গৃহ থেকে চাল, ডাল, আটা, কিসমিস, পেস্তা, বাদাম প্রভৃতি বের করে রৌদ্রে শুখতে দিচ্ছেন, নিজের হাতে পোকা বেছে ঝেড়ে ঝুড়ে আবার ভাঁড়ারে তুলছেন। কোন কর্মই তাঁদের পক্ষে অবহেয় নয়। ধীরে ধীরে আমার মনে অনুপ্রবেশ করলে যে এই হল জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের সমন্বয়; এঁদের এই গৃহস্থতুল্য কর্মের ভিতর গৃহস্থের স্বার্থপরবশতা নেই, শুধু কর্তব্যের ও পরসেবার অনুপ্রেরণা রয়েছে। আশ্রমবাসী প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন নিয়তকর্ম। শীতকালে এঁদের পথঘাট বরফে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, আশ্রমেরই এক অংশ থেকে আর এক অংশে গতিবিধি দিনের পর দিন বন্ধ থাকে। শীতাগমের পূর্বেই তাই নিজেদের গাছ থেকে কাঠ কেটে স্তূপীকৃত করে রাখার একান্ত দরকার। এই আশ্রম এমন জায়গায় সন্নিবিষ্ট যার তিন মাইলের মধ্যে কোন লোকালয় নেই, পোস্টাপিসও নেই, আবার এরই ভিতর দিয়ে পাক-দণ্ডি অর্থাৎ shortcut করে সাধু-সন্ন্যাসীরা ক্রমাগত বদরিকেদারাভিমুখে যাত্রা করেন—তাঁদের শীত-গ্রীষ্ম ঋতুভেদ নেই। আমাদের মত সৌখীন আগন্তুকেরা যদিও বেছে বেছে ভাল সময়েই আসেন তবু তাঁদের আতিথ্যের জন্যেও সর্বপ্রকার উপকরণ সকল সময় প্রস্তৃত রাখার দরকার হয়—কেউ কেউ হয়ত শীত পর্যন্ত থেকে যান। যাঁরা সক্ষম, তাঁদের এখানে অবস্থান ও পান-ভোজনের জন্য একটা মাসিক হার নির্ধারিত আছে। মাদার সেভিয়ার যিনি এই বিভাগের অধিষ্ঠাত্রী তাঁর কাছে শুনলুম এ বিষয়ে তাঁদের কঠোর নিয়ম অবলম্বন করতে হয়েছে, কারণ ইতিপূর্বে এমন অনেক আগন্তুকেরা মাস মাস এখানে কাটিয়ে গেছেন যাঁরা সম্পূর্ণ সক্ষম হলেও বিনা পয়সায় খাওয়া-দাওয়াটাই পছন্দ করেছেন, আশ্রমের পরিচালনার্থে যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য বলেও কিছু দিয়ে যান নি, ‘ফ্রি হোটেল’ ও স্যানেটোরিয়াম স্বরূপ এটাকে ব্যবহার করেছেন। আশ্রম এভাবে কতদিন অতিথি-সৎকার চালাতে পারে? সেইজন্যে তাঁরা আজকাল পানাহারের জন্য আগন্তুকদের কাছ থেকে একটা খরচ নেওয়া তাঁদের নিয়মাবলীর অঙ্গ করেছেন। সাধুসন্ন্যাসীরাই আশ্রমের যথার্থ অতিথি—যাঁরা “ন তিধি দ্বিতীয়া” অতিবাহিত করেন। কিন্তু যে গৃহস্থেরা পয়সা দেন ও দুচার মাসের জন্য থাকেন তাঁদের প্রতিও আশ্রমাধ্যক্ষদের সৌজন্যের কোন ত্রুটি হয় না।
দুটি পাহাড়ের উপর দুটি বাংলো, উপরটিতে সাধুদের নিবাস, নীচে থাকেন কর্নেল ও মিসেস সেভিয়ার। কর্নেল সেভিয়ার সম্প্রতি দেহরক্ষা করেছেন, আশ্রমের সকলের মাতৃস্বরূপিণী বৃদ্ধা মিসেস সেভিয়ার এখন একাকীই আছেন। তাঁরই টাকায় এ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত ও এর খরচ নির্বাহিত হয়।
একজন আমেরিকান সাধু ও একজন আমেরিকান ব্রহ্মচারী উপরের আশ্রমে সন্ন্যাসীদের সঙ্গেই থাকেন। সাধুটি কেবল আধ্যাত্মিক পথের পথিক। ব্রহ্মচারীটির রাজসিক প্রকৃতি তাঁকে কর্মবহুলতার সিঁড়ি দিয়েই আধ্যাত্মস্তরে ক্রমে ক্রমে উন্নীত করছে। আমি থাকতে একজন আমেরিকান শিষ্যা এলেন সন্ন্যাস বেশধারিণী। তাঁর একমাত্র পুত্রস্নেহে তিনি পাগল ছিলেন। পুত্রের কুব্যবহারে তিনি মর্মাহত হয়ে পড়েন। সেই সময় বিবেকানন্দ স্বামী গিয়ে একদিন তাঁকে ‘মা’ বলে সম্ভাষণ করায় তাঁর প্রাণের ভিতর থেকে সাড়া উঠল—স্বামীজীকে ও তাঁর উপদেশকে তিনি আঁকড়ে ধরলেন। এতদিন পরে ভারতবর্ষে এসে তিনি পূর্ণ শান্তি পেলেন।
পাহাড়ের শ্যামল বনানীতে সন্ন্যাসীদের গেরুয়া বস্ত্রের রঙ মিলিত হয়ে একটি অপূর্ব সৌন্দর্য বিকশিত করত। কোন চিত্রকর সেখানে থাকলে তার রসভোগের শেষ থাকত না।
সেই সময় একটি মারাট্টী যুবক সেখানে এসেছিল, সে হঠযোগপন্থী। হঠযোগের নানারকম মুদ্রা আমাদের দেখিয়েছিল। কিন্তু আমায় বিশেষ লাভবান করেছিল কতকগুলি বিশিষ্ট মারাহাট্টী গান শিখিয়ে। ‘মায়াবতী’র ভিতর দিয়ে পথ-চল্তি সন্ন্যাসী পথিকদের কাছে মীরাবাঈয়ের গানও আমার এখানেই প্রথম শোনা ও সংগ্রহ করা হয়। আর আশ্রমের দুই-একজন বাঙালী সুগায়ক সন্ন্যাসীদের কাছে রামপ্রসাদী ও শ্যামাবিষয়ক নানা গানে ভরপুর হলুম। মিসেস সেভিয়ার ও আমার সঙ্গে কোন কোন সাধুরা রোজ সায়াহ্নে ভ্রমণে বেরতেন। কোন একটা বসবার মত স্থানে পৌঁছলে সেখানে সকলে মিলে বসতুম ও সাধুরা গান গাইতেন, আমাকেও মাঝে মাঝে গাইতে হত। তাঁদের কাছে শোনা গানের মধ্যে দুই-একটি এখনো মনে বেজে উঠে—“কেন মা তোর পাগলিন বেশ!"
অস্তমান সূর্যের আলো সম্মুখের পাহাড়ে প্রতিফলিত হত। সেই আলোর ভিতর যেন এই ধরাতলের কাণ্ডকারখানার ভিতর পাগলিনীর মত ছোটা মা ফুটে উঠতেন। আমার বুকের ভিতর কি একটা ঝনঝনা জাগত। মারাট্টা ছেলেটি একদিন বললে সে এখান থেকে তিব্বত যাত্রা করবে। পথে মানস-সরোবর, কৈলাস প্রভৃতি পড়বে। ‘পরাও পরাও' করে যাবে, রাস্তার মধ্যে মধ্যে ‘চটি' আছে, সেখানে খাওয়া-দাওয়া পাবার কোন কষ্ট হবে না। তার আয়োজন ও দৃঢ়তা দেখে আমারও মন নেচে উঠল—আমিই বা কেন না যাব এই সুযোগে? মিসেস সেভিয়ার কিন্তু অনুমোদন করলেন না। মাকে চিঠি লিখে খবর দিলেন বোধ হয়। দিদির কাছ থেকে পত্রপাঠ লম্বা চিঠি এল মায়ের শরীর একেবারে ভেঙ্গে গেছে, কখন কি হয় ঠিক নেই। মায়ের শেষ ইচ্ছা যে আমি বিয়ে করি। নিশ্চয়ই আমি তাঁর এ ইচ্ছা পূর্ণ করতে বাধা দেব না। তাঁরা জানেন আমি যে সে বিয়েতে মত করব না, কি সিভিলিয়ন কি রাজারাজড়া যার সঙ্গে সম্বন্ধ করুন আমার মনের মত না হলে রাজী হব না। তাই তারা এবার এমন পাত্র ঠিক করেছেন যে, মনের মত হবেই, যাকে বিয়ে করলে আমার জীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে একে- বারে মিলবে। ইনি পঞ্জাবের বড় ঘরের ব্রাহ্মণ। সমস্ত ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপিত হয়ে ঐক্য সাধিত হোক—কর্তাদাদা মহাশয়ের এই ইচ্ছা ছিল সকলে জানে। দাদার কুচবিহার রাজগৃহে অসবর্ণ বিবাহে দাদামশায় মর্মাহত হয়েছিলেন সবাই জানে। আজ তিনি বেচে থাকলে আমার এ বিবাহ সম্বন্ধে কত উল্লসিত হতেন। তার উপর ইনি আর্যসমাজের একজন বড় নেতা, যে আর্য সমাজের সঙ্গে আদি ব্রাহ্ম- সমাজের যোগ স্থাপনের জন্য বলুদাদাকে পঞ্জাবে দৌত্যে পাঠিয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনি একজন ন্যাশনাল পেট্রিয়ট, সুবক্তা, সুপুরুষ।
কোনদিক থেকেই আমার আপত্তি করবার মত নয়। অবশ্য তাঁর পূর্বে বিবাহ হয়েছিল, এখন তিনি বিপত্নীক। আমি যেন তাঁকে না দেখে-শুনে, তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় না করে, গোড়া থেকেই নামঞ্জুর না করি। “তুই একবারটি আয়, দেখ, তারপরে শেষ যা বলবার বলিস। একেবারে গোড়াতেই বেকে বসিসনে, মার বুকে মৃত্যুশেল হানিসনে।” এই কাতর অনুনয় দিয়ে দিদি চিঠি শেষ করেছিলেন। অনিচ্ছুক ছেলেকে ঠিক যে রকম করে বিয়েতে প্রবৃত্ত করাতে হয়, সহজে সম্মত না হলে মাতা বা পিতার প্রাণসংশয়ের ভয় দেখিয়ে সেইটিই বিয়ের পক্ষে শেষ বড় যুক্তি- রূপে পেশ করা হয়, এ স্থলে আমার সম্বন্ধেও তাই করা হল। আমায় নামতেই হল। হিমালয়ের অরণ্যবাসে দাঁড়ি পড়ে গেল।
মা-রা তখন শরীর শোধরাবার জন্যে বৈদ্যনাথে আছেন। আমার গন্তব্য হল সেইখানে, কলকাতায় নয়। পথে লক্ষ্ণৌ আসে, গাড়ি বদলাতে হয়। অতুলপ্রসাদকে খবর দিলম কয়েক ঘণ্টার জন্যে সেখানে থামব। তিনি এলেন স্টেশনে আমায় নিতে। শুধু নিতে এলেন না। জানালেন আমার জন্যে লক্ষ্ণৌবাসী বাঙালীদের তরফ থেকে একটা বৃহৎ সভার আয়োজন হয়েছে, তাঁদের মানপত্র গ্রহণ করে তবে দেশে যেতে পাব আমি, সেজন্যে দু-একদিন তাঁর বাড়িতে থাকতে হবে। তাই হল। প্রবাসী বাঙালীদের স্নেহ ও সম্মান-ভাজন হয়ে নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করলুম। আমি যে কতদুর প্রবাসী হতে চলেছি তা তখনো কেউ জানেন না। অতুলের বাড়িতে হিন্দুস্থানী কংগ্রেস-ভক্তদের খুব সমাগম ছিল। তার মধ্যে গঙ্গাপ্রসাদ বা সেকালের একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ও আমার পরিচিত। তিনি অতুলের বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমি তাঁকে বললুম—“আপনার সঙ্গে আমার একটি বিশ্বস্ত কথা আছে, একটি পরামর্শ চাই।” তাঁকে আমার ভাবী স্বামী সম্বন্ধে প্রশ্ন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম তাকে জানেন কি না ও তাঁর সঙ্গে আমার বিবাহ বিষয়ে তাঁর কি মত?
তিনি বললেন—খুব জানেন তাঁকে। যদি আমার বিবাহিত জীবন গ্রহণ করতেই হয় তবে এমন উপযুক্ত জীবন-সঙ্গী দুর্লভ। সঙ্গে সঙ্গে বললেন-“এ কথাও বলি, আপনার বিবাহ-বার্তায় দেশের লোক খুশী হবে না, দেশ একজন পূর্ণমাত্রার আত্মোৎসর্গীকে হারাবে এই ভয় করবে।”
বৈদ্যনাথে পৌঁছিবার আগেই দিদি ষড়যন্ত্র করে বিয়ের সব আয়োজন একেবারে পাকা করিয়েছেন–আমার হাত-পা একেবারে বেধে দিয়েছেন–নড়চড় করবার আর উপায় রাখেননি। স্টেশনে দেখি আমি ‘কনে’ হয়ে এসেছি। রেলগাড়ি থেকে একেবারে পাল্কীতে পদার্পণ করলুম, ভূমিতে পা পড়ল না। বিবাহের দিনলগ্ন পর্যন্ত সব ঠিক করে রেখেছেন। বরযাত্রীদের জন্যে একটি বাড়ি নির্দিষ্ট করে সেখানে তাঁদের আনিয়েছেন। নিমন্ত্রণপত্র গেছে চতুর্দিকে। সবই আমার অগোচরে—যাতে আমি আর টুঁ শব্দটি মাত্র করার সময় না পাই—বুঝি যেন এখন কিছু করতে গেলেই মা-বাবাকে অপদস্থ করা হবে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলুম। পরের দিনই আমার গায়ে হলুদ। বরপক্ষের কর্তা ভবানীপুরের শঙ্কর পণ্ডিতের কাছে ফর্দ পাঠিয়ে দিদি দস্তুরমাফিক সব জিনিস সেখান থেকে সকালে হাজির করিয়েছেন। সেদিন ভোরে রাঁচী থেকে নতুন মামা মেজমামা মেজমামী এসেছেন, বোলপুর থেকে রবি মামা বড় মামা, মধুপুর থেকে বড় মাসিমা কৃতী ও সুকেশী বৌঠান, কলিকাতা থেকে ইন্দিরা প্রমথবাবু ও সুরেন। বাড়ি আত্মীয়-স্বজনে ভরে গেছে, উৎসবের সানাই বাজছে। বিকালে ক্ষণিকের জন্য বরকে দেখলে কনে—চেহারায় চোখ ঝলসায় বটে। মন যাই বলুক। তারপর দিন সন্ধ্যাবেলা বিয়ে। পালাবার পথ নেই আর, ছাড়াছাড়ি নেই।
আমায় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বিবাহের অনুষ্ঠানটি যদি আর্যসমাজের পদ্ধতি অনুসারে হয়—যাতে আদি ব্রাহ্মসমাজে ব্যবহৃত সমস্ত বৈদিক মন্ত্রই আছে, উপরন্তু হোমের মন্ত্রও আছে ও হোম আছে—তাতে আমার আপত্তি হবে কি না? আমি বলেছিলাম-“না, হোমে আমার আপত্তি নেই, বরঞ্চ বিশেষ সম্মতিই আছে।”
সে সময় মধুপুর ও বৈদ্যনাথে যে সকল পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা হাওয়া বদলের জন্য এসেছিলেন তাঁদেরও অনেকে সস্ত্রীক আমার বিবাহ-সভায় উপস্থিত হলেন। বিয়ে হয়ে গেল। একেবারে অমোঘ বন্ধন—জন্মজন্মান্তরের কর্মবন্ধন। দুচারদিন পরে সবাই মিলে কলিকাতায় ফিরে যাওয়া হল। সেখানে গিয়ে আমার বিবাহ উপলক্ষে ধুমধাম করে একদিন সান্ধ্য ভোজনে কলিকাতার বন্ধু-বান্ধবীদের নিমন্ত্রণ করলেন বাবামশায় ও মা। বরপক্ষ থেকে অনেক আর্যসমাজী বড়লোক এলেন, দীপচাঁদ পোদ্দার, স্যার ছাজুরাম, এ বি রেলওয়ের প্রধান ম্যানেজার রায় বাহাদুর বলেয়ারাম প্রভৃতি। সেই সময় ‘বীরাষ্টমীর’ দিনও সমুপস্থিত। ক্লাবের ছেলেরা আমার অনুপস্থিতিতে আমাদের বাড়িতেই পূর্ববৎ সব আয়োজন করেছে। ‘বীরাষ্টমীর’ দুই-একদিন পরেই লাহোর যাত্রা করতে হল। স্টেশনে আর্যসমাজী বন্ধুরা তাদের প্রথামত নানা রকম ফল, মিষ্টান্ন ও মাল্য নিয়ে আমাদের সম্বর্ধনা করতে এলেন। সারাপথ—পাটনা, মির্জাপুর, কানপুর, এলাহাবাদ, সাহারাণপুর, আম্বালা, জলন্ধর, অমৃতসরে এইরূপ অভ্যর্থনা চলতে থাকল। লাহোর স্টেশনে ভীষণ ভিড়। আর সবাইকে টপ্কে স্যার মহম্মদ শফি আমার গাড়িতে পৌঁছে আমায় সর্বপ্রথম মাল্যভূষিত করলেন। তাঁর গাড়িতে করেই আমি আমার নতুন গৃহে পৌঁছুলুম—এ গৌরব তিনি আজীবন করতেন।