জীবনের ঝরাপাতা/বিবাহোত্তর জীবন-কথা

বিবাহোত্তর জীবন-কথা

সরলা দেবী আত্মজীবনীতে পঞ্জাব গমন পর্যন্ত বিবৃত করেন। রামভজ দত্তচৌধুরী পঞ্জাবের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যৌবনে ‘আর্যসমাজে’ প্রবিষ্ট হন; এই সময় পিতৃকুলের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হইয়াছিল। সময়ান্তরে এই সম্পর্ক পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। রামভজ দত্তচৌধুরী, দ্বিতীয়া পত্নীর বিয়োগের পর, তৃতীয় বার দারপরিগ্রহ করেন। পঞ্জাবের আর্যসমাজের সঙ্গে কলিকাতার আদি ব্রাহ্মসমাজের ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপিত হইয়াছিল। আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সময়ে আর্যসমাজের কর্তৃপক্ষের সহিত পত্র ব্যবহার দ্বারা উভয়ের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে প্রয়াসী হইয়াছিলেন। সুতরাং আর্যসমাজী রামভজ দত্তচৌধুরীর সঙ্গে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দৈৗহিত্রী সরলা দেবীর পরিণয়ে সকলেরই আন্তরিক সমর্থন ছিল। সরলা দেবীও অভিভাবক-অভিভাবিকাদের অভিমতকে সসম্ভ্রমে মানিয়া লন।

 রামভজ দত্তচৌধুরীর কর্মস্থল ছিল লাহোরে। তিনি ঐ সময়েই ব্যবহারাজীবরপে বেশ নাম করিয়াছিলেন। উপরন্তু, তিনি আর্যসমাজী নেতা এবং বিবিধ সমাজকর্ম ও সমাজসেবায় উদ্যোগী; সরলা দেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইয়া তাঁহার কর্মৈষণা দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল; সরলা দেবীও পতির প্রতিটি কর্মে যোগ্য সহযোগী হইয়া উঠিলেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে আর্যসমাজের কেন্দ্র ছিল; এইসব কেন্দ্রে পুরুষ ও নারীদের বিবিধ অনুষ্ঠান-উৎসবে এই বিদগ্ধ দম্পতি যোগ দিতেন। সরলা দেবীর সময়োপযোগী ভাষণে আর্যসমাজী নরনারী চমৎকৃত হইতেন। এই-সকল সামাজিক মেলামেশা এবং নারীজাতির অনুন্নত অবস্থা প্রত্যক্ষ করার ফলেই সরলা দেবীর মনে একটি নিখিলভারতীয় মহিলা-সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার কম্পনা উদ্রিক্ত হইয়া থাকিবে। গার্হস্থ্যধর্ম পালনের সঙ্গে সঙ্গে সরলা দেবী বিবিধ সমাজকর্মেও লিপ্ত হইয়া পড়েন। ১৯০৭ সনের ৩রা জানুয়ারী তাঁহাদের একমাত্র পুত্র পণ্ডিত দীপক দত্তচৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন।  ১৯০৫-১৯২৩, এই আঠার-উনিশ বৎসর কাল সরলা দেবী পঞ্জাবে প্রবাস-জীবন যাপন করেন। এই সময়ে তিনি বহু সমাজহিতকর কার্যে লিপ্ত হইয়াছিলেন। এসব কার্য শুধু আর্যসমাজীদের মধ্যে নিবদ্ধ ছিল না; বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের গণ্ডী ছাড়িয়া সমগ্র ভারতীয় জনগণের উদ্দেশ্যেই ইহা প্রযুক্ত হইত। সরলা দেবীর সাহিত্যচর্চা বরাবর অব্যাহত ছিল। ‘ভারতী’ মাসিকে এ সময়ও প্রবন্ধ, কবিতা প্রভৃতি প্রকাশিত হইয়াছে। সরলা দেবীর সমাজকর্ম নানা দিকে প্রসারিত হয়, এবং তাঁহার কার্যে স্বামী রামভজের সমর্থনও ছিল যথেষ্ট।

 ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডল: সরলা দেবীর সমাজসেবার প্রধান অভিব্যক্তি—ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডল। তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যটন করিয়া নারীজাতির অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। ইতিপূর্বে বাংলায় যুবশক্তির উদ্বোধনকল্পে তিনি যাবতীয় শক্তি নিয়োজিত করিয়াছিলেন। কিন্তু এককভাবে নারীদের উন্নতিপ্রয়াস তাঁহার এই প্রথম। মাতা স্বর্ণকুমারীর ‘সখি সমিতি’ এবং দিদি হিরন্ময়ীর ‘মহিলা শিল্পাশ্রম’ এই প্রতিষ্ঠান দুইটির আদর্শ তাঁহার সম্মুখে। এই প্রতিষ্ঠানদ্বয়ের যে যে অভাব ছিল তাহা পূরণকল্পেই এই ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলের প্রতিষ্ঠা। ১৯১০ সনে এলাহাবাদে ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। এই সময়ে সরলা দেবীর উদ্যোগে একটি নিখিল ভারতীয় মহিলা সম্মেলনের অধিবেশন হইল জাজিরার মহারাণীর সভানেত্রীত্বে। অধিবেশনে সরলা দেবী ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডল স্থাপনকল্পে একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি উক্ত মহামণ্ডলের উদ্দেশ্য বিবৃত করিয়া বলেন যে, ভারতের পর্দানশীন নারীদের শিক্ষার কোনরূপ ব্যবস্থা নাই। গৌরীদানের প্রথা তখনও বলবৎ থাকায় অন্তঃপুরে স্ত্রী-শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। কাজেই এ নিমিত্ত একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানের আবশ্যকতা সর্বত্র অনুভুত হইতেছে। বেতন দিয়া শিক্ষয়িত্রী নিয়োগ করিতে হইলে অর্থের খুবই প্রয়োজন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলের শাখা স্থাপন দ্বারা এই উদ্দেশ্য সাধন করিতে হইবে। সরলা দেবীর এই সুচিন্তিত ভাষণটির প্রিয়ম্বদা দেবী কৃত অনুবাদ ‘ভারতী’তে (চৈত্র, ১৩১৭) প্রকাশিত হইয়াছিল। সরলা দেবী ইহা পুস্তিকার আকারেও প্রকাশিত করেন।

 এই সম্মেলনে বিজয়নগর, প্রতাপনগর, কর্পূরতলার রাণীগণ এবং ভূপাল ও ক্যাম্বের বেগম সাহেবারা উপস্থিত ছিলেন। সরলা দেবী তখন

লাহোরের বাসিন্দা। তাঁহার চেষ্টায় সেখানে ইহার একটি শাখা গঠিত হয়, এবং উক্ত উদ্দেশ্যে কার্য হইতে থাকে। ক্রমে অমৃতসর, দিল্লী, করাচী, হায়দরাবাদ, কানপুর, বাঁকীপুর, হাজারীবাগ, মেদিনীপুর, কলিকাতা এবং আরও কয়েকটি স্থানে ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলের শাখা সমিতি স্থাপিত হইল।

 কলিকাতার ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলের শাখার কার্যকলাপ সম্বন্ধে এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করি। কৃষ্ণভাবিনী দাসের চেষ্টাযত্নে ইহা একটি প্রকৃত সমাজহিতৈষী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অন্তঃপুরে বিধবা, কুমারী ও অনাথা নারীগণকে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পশিক্ষা দানেরও ব্যবস্থা হয়। তিনি ছিলেন বৌবাজারনিবাসী কলিকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত ব্যবহারাজীব শ্রীনাথ দাসের পুত্র অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ দাসের সহধর্মিণী। পতি এবং একমাত্র কন্যার প্রাণবিয়োগের পর কৃষ্ণভাবিনী বিধবা অবস্থায় ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলের কার্যে নিজেকে একেবারে সঁপিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার ত্যাগপূত জীবন সকলেরই আদর্শস্থল। ১৯১৯ সনের প্রারম্ভে তাঁহার মত্যু হয়। তাঁহার মত্যু হইলে কবি প্রিয়ম্বদা দেবী ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলের সম্পাদিকা হইলেন। কয়েক বৎসর যাবৎ তিনিও ইহার কার্য সুচারূরূপে সম্পাদন করিয়াছিলেন। সরলা দেবী বঙ্গদেশে ফিরিয়া আসিলে ইহার পরিচালনাভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। এ সম্বন্ধে পরে বলিতেছি।

 পত্রিকা সম্পাদন ও পরিচালন: ‘ভারতী’ সম্পাদনে প্রযত্নের কথা সরলা দেবী আত্মজীবনীতেই বিবৃত করিয়াছেন। সাময়িক পত্র সম্পাদনে তাঁহার সাফল্যপূর্ণ বহুমুখী প্রয়াস সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকামাত্রেই হয়ত অবগত হইয়াছেন। সরলা দেবী রাজনীতিতে ছিলেন উগ্রপন্থী; বিপ্লবযুগের প্রথম দিকে বিপ্লবী ভাবধারার পরিপোষক কার্যেও নিজেকে নিয়োজিত করিয়াছিলেন। পণ্ডিত রামভজ দত্তচৌধুরীও উগ্রপন্থী রাজনীতিক ছিলেন। কাজেই এদিকেও উভয়ের যোগাযোগ পূর্ণমাত্রায় ঘটিয়াছিল। পণ্ডিত রামভজও গতানুগতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না। রাজনীতি-ক্ষেত্রে নবভাব প্রচারের নিমিত্ত তিনি হিন্দুস্থান নামক উর্দু সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। ইহার সম্পাদকও ছিলেন তিনি। এই সময় সরলা দেবীর পূর্ব অভিজ্ঞতা রামভজের বিশেষ কাজে আসে।

 ‘হিন্দুস্থান’ পত্রিকায় উগ্র রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের নিমিত্ত সরকার চটিয়া আগুন। লাহোরের চীফ কোর্ট আদেশ দিলেন যে, পত্রিকার সম্পাদক এবং স্বত্বাধিকারী হিসাবে রামভজের নাম প্রকাশিত হইলে তাঁহার ব্যবহারাজীবের ‘লাইসেন্স’ বা অনুমতিপত্র বাতিল করিয়া দেওয়া হইবে। কিন্তু সহধর্মিণী সরলা দেবী এই সময়ে আসিয়া স্বামীর সম্মুখে দাঁড়াইলেন। পণ্ডিত রামভজের পরিবর্তে তাঁহারই নাম প্রকাশিত হইল হিন্দুস্থানের সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী রূপে। সরকারী অপচেষ্টা এইভাবে ব্যাহত হইল। সরলা দেবী প্রকাশ্যে পত্রিকার ভার লইয়া ইহার একটি ইংরেজী সংস্করণও বাহির করিলেন। বলা বাহুল্য, সরলা দেবী ইংরেজী রচনায় সুপটু ছিলেন। প্রাক্‌-বিবাহ যুগে ‘ভারতী’ সম্পাদনাকালে তিনি ‘হিন্দুস্থান রিভিয়ু’র মাধ্যমে কংগ্রেসী রাজনীতি এবং হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক বিষয়ক প্রবন্ধ লিখিয়া লালা লাজপৎ রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নিকট হইতেও প্রশংসালাভ করিয়াছিলেন। এ কথা হয়ত অনেকে জানেন না যে, মহাবোধি সোসাইটির জর্ন্যালের দুই সংখ্যায় সরলা দেবী রচিত স্ত্রীশিক্ষাবিষয়ক একটি পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। ইহা বিদগ্ধজনের এত সমর্থন লাভ করে যে, তিনি ইহা পরিবর্তিত করিয়া পুস্তিকাকারে ছাপাইয়াছিলেন ১৯০১ সনে। রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশে তাঁহার মৌলিকতা ও রচনাশৈলী ছিল অপূর্ব। বিলাতের বিখ্যাত উদারনৈতিক পত্রিকা ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ হিন্দুস্থানের (ইংরেজী সংস্করণ) বিশেষ প্রশংসা করিতেন। ‘হিন্দুস্থানে’ প্রকাশিত কোন কোন রচনা র‍্যামজে ম্যাকডোনালড তাঁহার ‘Awakening of India’ পুস্তকে উদ্ধৃত করিয়াছেন।

 পঞ্জাবের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবন: ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলের আদিকল্পক এবং অধিনায়ক ছিলেন সরলা দেবী। লাহোরের বিভিন্ন পল্লীতে নারীদের শিক্ষার ব্যবস্থা তিনি করিয়াছিলেন। অন্ততঃ পঞ্চাশটি স্থলে এইরূপ আয়োজন করেন বলিয়া প্রকাশ। লাহোরের নারীসমাজে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রবর্তনে তিনি অগ্রণী হন। বাংলা সঙ্গীতের হিন্দী ও পঞ্জাবী অনুবাদ করাইয়া তাহাতে সুর সংযোগ করেন তিনি। পর্দানশীন নারীদেরও সমাজসেবায় তিনি উদ্বুদ্ধ করিতে থাকেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও উৎসবে পুরুষের মত নারীরাও যাহাতে যোগদান করিতে পারেন তাহার ব্যবস্থা ও আয়োজন করিতেন। লাহোরে সরলা দেবীর কার্যকলাপ পঞ্জাবের অন্যান্য মফস্বল শহরেও অনুসৃত হয়। এইসব অঞ্চলের মহিলারা আত্মোন্নতির জন্য উদ্‌গ্রীব হইয়া উঠেন।

 আর্য সমাজীদের একটি প্রধান কার্য—অনুন্নতদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার দ্বারা তাহাদের উন্নতিসাধনের প্রচেষ্টা। পণ্ডিত রামভজ এই কার্যটির ভার নিজে লইয়াছিলেন। সরলা দেবী নারীজাতির মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে যেমন একদিকে লিপ্ত ছিলেন অন্যদিকে স্বামীর অনুন্নত জাতিদের উন্নতিপ্রচেষ্টারও বিশেষ সহায় হইলেন। সরলা দেবীর প্রগতিমূলক কার্যসমূহের দ্বারা বিশেষভাবে লাহোরে এবং সাধারণভাবে পঞ্জাবে এক নতন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি এখনও অনেকের স্মৃতিপথে জাগরূক রহিয়াছে।

 প্রথম মহাসমর ও বাঙালী সেনাদল: সৈন্য বিভাগে প্রবেশে বাঙালীদের পক্ষে লিখিত ও অলিখিত বহু বাধানিষেধ ছিল। প্রাক্‌বিবাহ যুগে সরলা দেবী ‘ভারতী’র মাধ্যমে এই বাধা বিদূরণের নিমিত্ত লেখনী পরিচালনা করেন। আবার, বঙ্গসন্তানদের শারীরিক শক্তি ও মানসিক বল উদ্বোধনের জন্য সভা-সমিতি এবং অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। প্রথম মহাসমরের ঘোর সঙ্কট সময়ে, ১৯১৭ সনে, বাঙালী সন্তানদের সৈন্যবিভাগে প্রবেশের বাধা তিরোহিত হয়। তখন তাহারা দলে দলে যাহাতে সৈন্যদলে ভর্তি হয় সেজন্য স্বদেশীয় নেতারা আন্দোলন উপস্থিত করেন। তাঁহারা নানা স্থানে সাধারণ সভার আয়োজন করিয়া যুবকগণকে সৈন্যবিভাগে প্রবেশ করিতে আবেগপূর্ণ ভাষায় উপদেশ দিতেন। আমাদের কৈশোরেও এই উপদেশ শুনিবার সুযোগ ঘটিয়াছিল।

 সরলা দেবী ১৯১৭ সনে লাহোর হইতে বাংলা দেশে আসিলেন এবং এখানে কিছুকাল থাকি তাঁহার প্রচারিত পূর্বাদর্শ-মত বাঙালী যুবকদের সৈন্যদলে ভর্তি হইতে আবেদন জানাইলেন। তিনি কলিকাতা হইতে হুগলি, চুঁচুড়া, চন্দননগর, উত্তরপাড়া প্রভৃতি স্থানে উক্ত উদ্দেশ্যে গমন করেন। তিনি এই সময় প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, যুদ্ধকার্যে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য তিনি সঙ্গীতাদিও রচনা করেন। ইহাতে তৎকর্তৃক সুর সংযোজিত হইয়া এই-সকল সাধারণ সভায় গীতও হইতে লাগিল। তাঁহার ‘যুদ্ধসঙ্গীত’ ১৩২৪ সনের ফাল্গুন সংখ্যা ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয়। উক্ত সভাগুলিতে প্রদত্ত বক্তৃতাসমূহের সারাংশও এই সময়কার ‘ভারতী’তে স্থান পাইয়াছিল। ‘আহ্বান’ (চৈত্র ১৩২৪), ‘উদ্বোধন’ (বৈশাখ ১৩২৫), ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৫) প্রভৃতি রচনাগুলি এখানে উল্লেখযোগ্য। সরলা দেবী নিতান্ত কর্তব্যবোধেই প্রথম মহাসমরকালে বাঙালী যুবকদের রণবৃত্তি গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেন।

 পঞ্জাৰেৱ হাঙ্গামা-মহাত্মা গান্ধী-রাজনৈতিক কার্য: যে আশা- ভরসায় সরলা দেবী ও অন্যান্য নেতারা বাঙালী যুবকদের সৈন্যদলে ভর্তি হইতে উদ্বুদ্ধ করেন তাহা অকস্মাৎ বিলুপ্ত হইয়া গেল। সর্বত্র বিপ্লবী সন্দেহে ভারতবাসিগণকে আটকবন্দী করিবার ব্যাপক ক্ষমতা লইয়া রৌলট আইন বিধিবদ্ধ হইল। ইহ্যর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভকে মহাত্মা গান্ধী প্রকাশ্য রূপ দিলেন ‘সত্যাগ্রহ' কথাটির মধ্যে। বিক্ষোভের ফলে নানা স্থানে হাঙ্গামা উপস্থিত হইল। বিক্ষুব্ধ জনতাকে দমন করিতে গিয়াই সরকারী ধুরন্ধরগণ এই হাঙ্গামা বাধাইল। পঞ্জাবে এই হাঙ্গামা চরমে উঠিল। ইহার পরিণতি হয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে। দত্তচৌধুরী পরিবারের উপর সরকারের কোপ পড়িল বিশেষ করিয়া। ‘হিন্দুস্থান’ উর্দ, ও ইংরেজী সংস্করণ দুই-ই সরকার বন্ধ করিয়া দিলেন। ‘হিন্দুস্থান' প্রেসও বাজেয়াপ্ত হইল। পঞ্জাবের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পণ্ডিত রামভজও অনির্দিষ্ট কালের জন্য নির্বাসিত হইলেন। সরলা দেবীর এই সময়কার তেজস্বিতা সকলকেই চমক লাগাইয়া দেয়। তাঁহাকেও গ্রেপ্তার করিবার প্রস্তাব হইয়াছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে কোন মহিলাকে আটক করার রীতি এদেশে তখনও চালু হয় নাই; একারণ কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা হইতে নিরস্ত হন। পঞ্জাবে ব্রিটিশের অকথ্য অত্যাচারের আভাস পাইয়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সরকার-প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করিলেন।

 ভারতীয় নেতৃবৃন্দের পঞ্জাব প্রবেশে বাধা উঠিয়া গেলে তাঁহারা একে একে তথায় গমন করেন। সরলা দেবীর গৃহে মহাত্মা গান্ধীর আবাসস্থল স্থিরীকৃত হইল। সরলা দেবীর সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর পরিচয় কুড়ি বৎসরেরও পুরানো। তিনি স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও কর্ম- পন্থায় বিশ্বাসী। পুত্র দীপক গান্ধীজীর সবরমতী আশ্রমে অধ্যয়নরত। সত্যাগ্রহ প্রচেষ্টায়ও তাঁহার সমর্থন ষোল আনা। মহাত্মা গান্ধীকে এই সময় বেশ কিছুকাল সরলা দেবীর গহে অবস্থান করিতে হয়। কারণ তখন কংগ্রেস তরফে যে কমিটি পঞ্জাবের অনাচার, মায় জালিয়ানওয়ালা- বাগের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে লিপ্ত ছিল, তিনি ছিলেন তাহার একজন সদস্য। ব্রিটিশের অত্যাচার-অনাচারের গুরুত্ব ও ব্যাপকতা দেশ-বিদেশে জানাজানি হইতে বাকী রহিল না। ১৯১৯ সনে অমৃতসর কংগ্রেস; কংগ্রেস অধিবেশনের পূর্বেই পঞ্জাবের নির্বাসিত নেতাদের মুক্তি দেওয়া। হইল; রামভজও স্বগৃহে ফিরিয়া আসিলেন।

 ভারতীয় রাজনীতিতে নতন কর্মধারার প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হইল। মহাত্মা গান্ধী অহিংস অসহযোগের প্রস্তাব আনিলেন। ১৯২০ সনে কলিকাতার ন্যাশনাল কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন, সভাপতি-লালা লজপৎ রায়। ইতিমধ্যে ৩১শে জুলাই নিশীথে অকস্মাৎ লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক মত্যুমুখে পতিত হইলেন। বাংলা ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক যোগাযোগ স্থাপিত হইয়াছে গত শতাব্দীর শেষ দশকেই। লোকমান্য তিলক এবং সরলা দেবীর ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের কথা আত্মস্মৃতিতে পাওয়া যাইবে। তিলকের মৃত্যুতে সরলা দেবী স্থির থাকিতে পারিলেন না। তিনি ছুটিয়া গেলেন বোম্বাইয়ে তিলকের বিরাট শব-শোভাযাত্রায় যোগদানের জন্য। তিলকের স্মৃতিরক্ষায় একাধিকবার নিজের মনোবেদনা অনবদ্য ভাষায় তিনি ব্যক্ত করিয়াছিলেন।

 ‘শহীদ’ কথাটির আজকাল খুবই চল। ইংরেজী ‘martyr' শব্দের বাংলা ‘শহীদ’। কিন্তু দৈহিক মত্যু না ঘটিলেও কোন বিশেষ আদর্শ বা মতবাদের জন্য যিনি আত্মবলি দৈন তাঁহাকেও ‘শহীদ’ বলা যায়। ঠিক এই অর্থেই সরলা দেবী চৌধুরাণী মহাত্মা গান্ধী প্রবর্তিত অহিংস আন্দোলনের প্রথম মহিলা ‘শহীদ'। তিনি মনপ্রাণ দিয়া অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়াছিলেন। চরখা-খদ্দরের প্রবর্তনে তিনি মহাত্মা গান্ধীর দক্ষিণহস্তস্বরূপ ছিলেন। অসহযোগ প্রচেষ্টার প্রথম দিকে তিনি ছিলেন গান্ধীজীর একান্তই সমর্থক। পণ্ডিত রামভজ ছিলেন ক্ষাত্রতেজো- দীপ্ত। তিনি অহিংসা তথা অহিংস আন্দোলনের তেমন পক্ষপাতী ছিলেন না, হয়ত এই কারণে উভয়ের মধ্যে খানিক মতানৈক্য উপস্থিত হইয়াছিল।

 হিমালয়-বাস—পণ্ডিত রামভজের মৃত্যু—লাহোর ত্যাগ: সরলা দেবী প্রাক-বিবাহ যুগে স্বামী বিবেকানন্দ তথা রামকৃষ্ণ মিশনের ঘনিষ্ঠ সংস্রবে আসিয়াছিলেন। কিছুকাল হিমালয়ে মায়াবতী অদ্বৈতাশ্রমে গীতা, উপনিষদ প্রভৃতি শাস্ত্রচর্চায়ও তিনি মন দেন। বিবাহিত জীবনে তিনি সম্পূর্ণ গার্হস্থ্য জীবন যাপন করেন। কিন্তু এই সময়ে আবার হিমালয়ের আহ্বান আসিল। তিনি স্থির থাকিতে পারিলেন না। শাস্ত্রে পুরুষের যেমন ‘বানপ্রস্থ' অবলম্বনের বিধি আছে, তেমনি নারীর কেন থাকিবে না? আর্যসমাজ-কর্তৃপক্ষ এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে বিলম্ব করেন নাই। পুরুষের মত নারীরও বানপ্রস্থ অবলম্বনে বাধা নাই— তাঁহারা এইরপ অভিমত প্রকাশ করিলেন। পণ্ডিত রামভজও ইহাতে বাদ সাধেন নাই। তাঁহার নিকট হইতেও সম্মতি পাইয়া সরলা দেবী সুস্থ চিত্তে হিমালয়ে হৃষিকেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

 কিন্তু তাঁহার এবারকার হিমালয়-জীবন দীর্ঘায়ত হইল না। কারণ পণ্ডিত রামভজ দত্তচৌধুরী হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। সেবাপরায়ণা সরলা আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। অসুস্থতার সংবাদে তিনি স্বামীর নিকট ছুটিলেন। চিকিৎসা, সেবা-শুশ্রষার সুব্যবস্থা সত্ত্বেও পণ্ডিত রামভজ ১৯২৩ সনের ৬ই আগস্ট মুশৌরীতে মারা গেলেন। সরলা দেবীর পক্ষে হিমালয়ে ফিরিয়া যাওয়া আর সম্ভব হইল না। পুত্র দীপক ১৯১৮-১৯ সনে বোলপুর-শান্তিনিকেতনে অধ্যয়ন করেন। মার্শাল ল’র পরে তিনি লাহোরে ফিরিয়া গেলেন। মহাত্মা গান্ধী তাঁহাকে অতঃপর সঙ্গে করিয়া সবরমতী আশ্রমে যথোপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্য লইয়া গেলেন। কলিকাতা পুনরায় সরলা দেবী চৌধুরাণীর কর্মস্থল হইল। এখানেই তিনি আমত্যু বাস করেন।

 ভারত-সম্পাদনা—সাহিত্যক—সাংস্কৃতিক সভা-সমিতি: পঞ্জাব- বাসকালে নানা রকমের কর্মপ্রচেষ্টার মধ্যেও সরলা দেবীর বাংলা সাহিত্যচর্চা যে অব্যাহত ছিল তাহার উল্লেখ ইতিপূর্বে করিয়াছি। তিনি কলিকাতায় প্রত্যাবৃত্ত হইয়া পুনরায় সাহিত্যসেবায় মনঃসংযোগ করিলেন। 'ভারতী'র সম্পাদনা-ভার স্বতঃই তাঁহার উপর পড়িল। তিনি ১৩৩১ সালের বৈশাখ মাস হইতে ‘ভারতী’-সম্পাদনা শুর করিলেন। তিনি আড়াই বৎসর পর্যন্ত একাদিক্রমে ‘ভারতী'-সম্পাদনায় লিপ্ত ছিলেন। এই সময়ে তাঁহার সাহিত্যচর্চা পুনরায় পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ হইল। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ সর্ববিধ রচনায়ই তিনি হস্তক্ষেপ করিলেন। এ সময়ে তাঁহার বড়মামা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দিদি হিরন্ময়ী দেবী পরলোকগমন করেন। তাঁহাদের উপরে লিখিত সরলা দেবীর প্রবন্ধ দুইটিতে অনেক নূতন কথা জানা যাইতেছে।

 তাঁহার কৃতি শুধু ‘ভারতী'র পৃষ্ঠায়ই নিবদ্ধ রহিল না। তিনি এই সময় কলিকাতা ও বিভিন্ন অঞ্চলে সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক সভা- সমিতিতে আহুত হইতে লাগিলেন। তাঁহার ভাষণসমূহ ‘ভারতী'তে যথাসময়ে প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার ভাবধারণা এই-সকল পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় আমাদের পক্ষে জানিয়া লওয়া আজও সম্ভব। এই প্রসঙ্গে তাঁহার শ্রমিক প্রবন্ধটি (ফাল্গুন ১৩৩২) এখনও শ্রমিক আন্দোলনের দিগদর্শন হইয়া আছে। প্রেস-কর্মচারীদের সভায় সভানেত্রীরূপে তিনি যে ভাষণ দেন, তাহাই ‘শ্রমিক’ নামে ভারতীতে প্রকাশিত হয়। ১৩৩২ সালের ২০-২১ চৈত্র বীরভূম-সিউড়ীতে বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মেলনের সপ্তদশ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইল। এই অধিবেশনে সাহিত্য-শাখার সভাপতিরূপে সরলা দেবী একটি সুচিন্তিত ভাষণ প্রদান করেন। এই অভিভাষণে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক, সমস্যা ও সুকৃতির কথা অতি প্রাঞ্জল ভাষায় বিবৃত হইয়াছে। ইহা ‘ভাষার ডোর’ শীর্ষে ১৩৩৩, বৈশাখ সংখ্যা ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয়।

 ভারত মহামণ্ডল—ভারত শ্রী-শিক্ষাসদন: সরলা দেবী কলি- কাতা ফিরিয়া ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলকে পুনরায় সক্রিয় করিতে প্রয়াসী হইলেন। কবি প্রিয়ম্বদা দেবীর হস্তে মহামণ্ডলের কার্য পরিচালনার ভার অর্পিত ছিল। তিনি ‘ভারতী’তে (বৈশাখ ১৩৩২) ভারত স্বী- মহামণ্ডলের উদ্দেশ্য ও নিয়মাবলী পুনঃপ্রচার করিলেন। অন্তঃপুরে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারকল্পে মহামণ্ডলের কৃতিত্বের কথা পর্বে কতকটা বলা হইয়াছে। কয়েক বৎসরের মধ্যে শুধু কলিকাতায় পাঁচ শত গৃহে অন্ততঃ তিন হাজার অন্তঃপুরস্থ মহিলাকে শিক্ষাদানে এই মণ্ডল সমর্থ হন। বাংলা দেশে, বিশেষতঃ কলিকাতায়, পর্দাপ্রথা দ্রুত উঠিয়া যাইতে থাকে। বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হইল, ছাত্রীরাও দলে দলে স্কুলে ভর্তি হইতে লাগিল। ভারত স্বী-মহামণ্ডলের কার্য ‍নূতনভাবে পরিচালিত করা আবশ্যক বোধ হয়।

 মহামণ্ডল পূর্ব পদ্ধতি পরিত্যাগ করিয়া সাধারণ এবং চারু-শিক্ষা- দানের নিমিত্ত একটি প্রকাশ্য শিক্ষাসদন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হইলেন। ইহার উদ্যোগে ১৯৩০ সনের ১লা জুন ভবানীপুরে এই শিক্ষাসদন প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে উপযুক্ত শিক্ষয়িত্রীর অধীনে প্রবেশিকা পরীক্ষার মান পর্যন্ত ছাত্রীগণকে পড়াইবার ব্যবস্থা করা হইল। সরলা দেবী ছাত্রীগণকে গীতার মর্ম বুঝাইয়া দিতেন। মহামণ্ডল শিক্ষাসদনের অন্তর্গত একটি শিশু-সংরক্ষণকেন্দ্র খুলেন। মহামণ্ডলের গাড়ি এইসব শিশুকে বাড়ি হইতে আনয়ন এবং ফেরত পাঠানোয় ব্যবহৃত হইত। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার দুই মাসের মধ্যেই ইহার সুনাম ছড়াইয়া পড়িল। শিক্ষয়িত্রীগণ অনেকে প্রীশিক্ষাসদন হইতে স্বতন্ত্র হইয়া নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করিলেন। ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডল অতঃপর নিজ শিক্ষাসদনটি ১৯৩০ সনের ৭ই আগস্ট তারিখে কলেজ স্কোয়ারস্থিত এলবার্ট হলে স্থানান্তরিত করেন। এখানেও একদল ত্যাগী কর্মী ও শিক্ষাব্রতী পাওয়া গেল। সকল শ্রেণী ও ধর্মসম্প্রদায় হইতেই ছাত্রীরা এখানে ভর্তি হইতে পারিত। ছাত্রীসংখ্যা ক্রমশঃ বাড়িয়া চলিল। শিক্ষাসদনের ছাত্রীদের লইয়া ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডল একটি ছাত্রীনিবাসও খুলিলেন। শিক্ষাসদন এবং ছাত্রীনিবাস পরিচালনার জন্য মহামণ্ডল একটি স্বতন্ত্র অধ্যক্ষ-সভার উপরে ভার দিলেন। অধ্যক্ষ-সভা গঠিত হয় কলিকাতার বহ গণ্যমান্য সমাজকর্মী মহিলা ও পুরুষকে লইয়া। অধ্যক্ষ-সভার শীর্ষস্থানে রহিলেন ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডলের প্রতিষ্ঠাত্রী সরলা দেবী চৌধুরাণী। ভারত স্ত্রী-মহামণ্ডল ক্রমে ভারত স্ত্রী-শিক্ষাসদনে রূপায়িত হইল। সরলা দেবীও ইহার সংস্রব ত্যাগ করিয়া অধ্যাত্ম-জীবনের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। নিজ ভবনে অধ্যাত্ম-সঙ্ঘ স্থাপন করিয়া নিয়মিত শাস্ত্র-চর্চারও ব্যবস্থা করিলেন তিনি। তাঁহার জীবনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসিল ১৯৩৫ সনের মাঝামাঝি।

 গোত্রান্তর: সরলা দেবী হাওড়ার আচার্য শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মার সঙ্গে পরিচিত হন ১৯৩৫ সনে। তিনি আচার্যের সঙ্গে আলাপে এবং তাঁহার শাস্ত্রব্যাখ্যায় এতই মোহিত হন যে, তিনি তাঁহাকে গুরুপদে বরণ করিয়া লইলেন। শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ “দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমায় যেসব উপদেশ দিয়েছেন, যাতে করে আমার মনের অন্ধকার কেটে গিয়ে আমি আলোকের নিকটস্থ হচ্ছি বলে মনে করি”- সেই-সব উপদেশ যথাযথ লিপিবদ্ধ করিয়া সরলা দেবী পুস্তকাকারে গ্রথিত করিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর ১৩৫৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাস (১৯৪৭, মে-জুন) হইতে এই-সকল ‘বেদবাণী' নামে প্রকাশিত হইতে থাকে। তাঁহার আধ্যত্ম-জীবনের কিরূপ আমূল পরিবর্তন (যাহা তিনি ‘গোত্রান্তর' কবিতায় প্রকটিত করিয়াছেন) ঘটিল তাঁহার নিজের ভাষায়ই এখানে বলিতেছি:

 “নকিপুরের বন্ধুবর যতীন রায় চৌধুরী আমার বাড়িতে অধ্যাত্ম- সন্ধে কোন পণ্ডিতপ্রবরের উপনিষদ ব্যাখ্যানে তৃপ্তি না পেয়ে হাওড়ায় তাঁর ঠাকুরের কথামৃত শোনাতে আমায় একদিন নিয়ে যেতে চাইলেন। শনিবার, ২১শে জুন, ১৯৩৫ সনের সকালে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম।

 “সেখানে বিজয়কৃষ্ণ নামধেয় পুরুষটির দেহমন্দিরে যে ঠাকুরের বাস, প্রথম দিনই তাঁর সমীপস্থ হওয়া মাত্র তিনি পোঁ করে তার সানাইয়ে একটি সুর ধরে শুনিয়ে দিলেন। বৈকু রাজার গল্পচ্ছলে গুরুকে শ্রদ্ধায় সর্বষ অর্পণ করার কথাটা কানে তুলে দিলেন।

 “আমি গুরুবরণের জন্য যাইনি। শুধু যতীনবাবুর কথায় প্রখ্যাত বিজয় চাটুজ্যের উপনিষদের রসাত্মক ব্যাখ্যান শোনবার প্রলোভনে গিয়েছিলাম, যদি আমার বাড়ির স্মধ্যায়মণ্ডলীতে উপনিষদতত্ত্ব শোনাতে মাসে এক-আধবার আমায় কৃপা করেন। একটা সিংহকে ধরতে গিয়েছিলাম—নিজে বাঁধা পড়ে গেলুম।...

 “বাড়ি ফিরে একটা ভাব মনের ভিতর আলোড়ন করতে থাকল। সেটা দুদিন পরে কবিতাকারে ফুটলো। যাঁকে উপদেষ্টা বলে, জ্ঞানী বলে শরণ নিয়েছি, যাঁর উপদেশ শুনতে আনাগোনা করছি, তাঁকে একে- বারে ‘গুরু' বলে কবুল সম্বোধনের সঙ্কোচ ধুলিসাৎ করলম এত দিনে। দৃঢ়ভূমি, বদ্ধভূমি, বদ্ধমূল সংস্কারের এক একটা প্রাচীর অতি কষ্টে, অতি অনিচ্ছায় যেন একে একে পড়ে যেতে লাগল।...সে কবিতাটি এইঃ

“গাত্রান্তর

গুরো!

চৈতন্যে কর সম্প্রদান।
গোত্রান্তর কর মোরে
হে মঙ্গলনিদান।

জন্ম যার ঘোর মৃত্যুগৃহে,
নিরানন্দের কূলে,
অমৃত-পাত্রস্থ কর তারে,
দাও আনন্দ-গোত্রে তুলে।
ভয়েতে বিমূঢ় যেই চমকায়
প্রতি বায়ুহিল্লোলে,
স’পো তারে ভয়ানা ভয়ে,
অন্তর গোত্রে যাক সেই চলে।

নাহি যার শক্তি সাধ্য লেশ,
অন্তর শক্তির সনে
বাঁধ তার দক্ষিণ পাণি,
শক্তি গোত্র হোক শুভখনে!

অহংনিলয়ে ভেদভাবে করে
আপন পর যে জান,
আত্মা-আবাসে নিবাসিয়ে
তারে, রাখ সব ভূতগত প্রাণ!

গুরো!

আমার আমিরে দেখাও দেখাও!
করাও অভিজ্ঞান!
আনন্দ, অভয়, শক্তি, প্রেম
হউক নিত্য তব অবদান!”

 শেষ জীবন—মৃত্যু: ইহার পর মৃত্যুকাল পর্যন্ত, সরলা দেবী কায়মনে ধর্মচর্চায় মন দেন। তিনি ১৯৪১ সনে ‘শ্রীগুরু বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মানুষ্ঠিত শিবরাত্রি পূজা’ প্রকাশিত করেন। ‘বেদবাণী’ প্রথম খণ্ড হইতে এই মাত্র উদ্ধৃত করিয়াছি। তৎ-লিখিত গুরুর উপদেশাবলী একাদশ খণ্ড (পৌষ ১৩৫৭) পর্যন্ত বাহির হয়। ১৯৪৫ সনের ১৮ই আগস্ট এই বিরাট কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে। এই কর্মময় জীবনের একটি বিশেষ দিকের প্রতি শিক্ষিত সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ‘সাহিত্যিক’ সরলা দেবীর সাহিত্য-সাধনার নিদর্শন মাসিকপত্রের পৃষ্ঠায়ই আত্মগোপন করিয়া আছে। বিবিধ বিষয়ের উপরে লিখিত তদীয় সারগর্ভ রচনাবলী পুস্তকাকারে গ্রথিত হইলে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হইবে, একথা নিঃসন্দেহে বলিতে পারা যায়।

 সরলা দেবীর একমাত্র পুত্র শ্রীদীপক দত্তচৌধুরী বর্তমানে আইন ব্যবসায়ে লিপ্ত আছেন। বিভিন্ন সামাজিক কর্মেও তাঁহার সবিশেষ অনুরাগ পরিদৃষ্ট হয়।