পিতৃদেব

 আমার জন্মের কয়েক বৎসর পূর্ব হইতেই আমার পিতা প্রায় দেশভ্রমণেই নিযুক্ত ছিলেন। বাল্যকালে তিনি আমার কাছে অপরিচিত ছিলেন বলিলেই হয়। মাঝে মাঝে তিনি কখনো হঠাৎ বাড়ি আসিতেন; সঙ্গে বিদেশী চাকর লইয়া আসিতেন; তাহাদের সঙ্গে ভাব করিয়া লইবার জন্য আমার মনে ভারি ঔৎসুক্য হইত। একবার লেনু বলিয়া অল্পবয়স্ক একটি পাঞ্জাবি চাকর তাহার সঙ্গে আসিয়াছিল। সে আমাদের কাছে যে সমাদরটা পাইয়াছিল তাহা স্বয়ং রণজিত সিংহের পক্ষেও কম হইত না। সে একে বিদেশী তাহাতে পাঞ্জাবি-ইহাতেই আমাদের মন হরণ করিয়া লইয়াছিল। পুরাণে ভীমার্জনের প্রতি যে রকম শ্রদ্ধা ছিল, এই পাঞ্জাবি জাতের প্রতিও মনে সেই প্রকারের একটা সম্রম ছিল। ইহারা যোদ্ধা—ইহার কোনো কোনো লড়াইয়ে হরিয়াছে বটে কিন্তু সেটাকেও ইহাদের শত্রুপক্ষেরই অপরাধ বলিয়া গণ্য করিয়াছি। সেই জাতের লেকে ঘরের মধ্যে পাইয়া মনে খুব একটা স্ফীতি অনুভব করিয়াছিলাম। বউঠাকুরানীর ঘরে একটা কাচা-বরণে ঢাকা খেলার জাহাজ ছিল, তাহাতে দম দিলেই রং-করা কাপড়ের ঢেউ ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিত এবং জাহাজটা আর্গিন বাদ্যের সঙ্গে দুলিতে থাকিত। অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া এই আশ্চর্য সামগ্রীটি বউঠাকুরানীর কাছ হইতে চাহিয়া লইয়া প্রায় মাঝে মাঝে এই পাঞ্জাবিকে চমৎকৃত করিয়া দিতাম। ঘরের খাঁচায় বদ্ধ ছিলাম বলিয়া যাহা কিছু বিদেশের যাহা কিছু দূরদেশের তাহাই আমার মনকে অত্যন্ত টানিয়া লইত। তাই লেনুকে লইয়া ভারি ব্যস্ত হইয়া পড়িতাম। এই কারণেই গাব্রিয়েল বলিয়া একটি য়িহুদি তাহার ঘুণ্টি দেওয়া য়িহুদি পােষাক পরিয়া যখন আতর বেচিতে আসি আমার মনে ভারি একটা নাড়া দিত, এবং ঝােলাঝুলিওয়ালা ঢিলাঢালা ময়লা পায়জামাপরা বিপুলকায় কাবুলিওআলাও আমার পক্ষে ভীতিমিশ্রিত রহস্যের সামগ্রী ছিল।

 যাহা হউক, পিতা যখন আসিতেন আমরা কেবল আশ-পাশ হইতে দূরে তাঁহার চাকরবাকরদের মহলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কৌতূহল মিটাইতাম। তাহার কাছে পৌঁছানো ঘটিয়া উঠিত না।

 বেশ মনে আছে আমাদের ছেলেবেলায় কোনাে এক সময়ে ইংরেজ গর্মেণ্টের চিরন্তন জুজু রাশিয়ান কর্তৃক ভারত আক্রমণের আশঙ্কা লােকের মুখে আলােচিত হইতেছিল। কোনাে হিতৈষিণী আত্মীয়। আমার মায়ের কাছে সেই আসন্ন বিপ্লবের সম্ভাবনাকে মনের সাধে পল্লবিত করিয়া বলিয়া-ছিলেন। পিতা তখন পাহাড়ে ছিলেন। তিব্বত ভেদ করিয়া হিমালয়ের কোন একটা ছিদ্রপথ দিয়া যে রুশীয়ের। ধূমকেতুর মতো প্রকাশ পাইবে তাহা তাে বলা যায় না। এই জন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাহার এই উৎকণ্ঠার সমর্থন করেন মা সেই কারণে পরিণত বয়স্ক দলের সহায়তালাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালককে আশ্রয় করিলেন। আমাকে বলিলেন—“রাশিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে এক-খানা চিঠি লেখাে তো।” মাতার উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কি করিতে হয় কিছুই জানি না। দফ্তরখানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হইলাম। পাঠ যথাবিহিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু ভাষাটাতে জমিদারি সেরেস্তার সরস্বতী যে জীর্ণ কাগজের শুষ্ক পদ্ম দলে বিহার করেন তাহারই গন্ধ মাখানো ছিল। এই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম। তাহাতে পিতা লিখিয়াছিলেন—ভয় করিবার কোনো কারণ নাই, রাশিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন। এই প্রবল আশ্বাসবাণীতেও মাতার রাশিয়ানভীতি দূর হইল বলিয়া বােধ হইল না—কিন্তু পিতার সম্বন্ধে আমার সাহস খুব বাড়িয়া উঠিল। তাহার পর হইতে রােজই আমি তাহাকে পত্র লিখিবার জন্য মহানন্দের দফতরে হাজির হইতে লাগিলাম। বালকের উপদ্রবে অস্থির হইয়া কয়েক দিন মহানন্দ খসড়া করিয়া দিল। কিন্তু মামুলের সংগতি তো নাই। মনে ধারণা ছিল মহানন্দের হাতে চিঠি সমর্পণ করিয়া দিলেই বাকি দায়িত্বের কথা আমাকে আর চিন্তা করিতেই হইবে না—চিঠি অনায়াসেই যথাস্থানে গিয়া পৌছিবে। বলা বাহুল্য মহানন্দের বয়স আমার চেয়ে অনেক বেশি ছিল এবং এ চিঠিগুলি হিমাচলের শিখর পর্যন্ত পৌছে নাই।

 বহুকাল প্রবাসে থাকিয়া পিতা অল্প কয়েক দিনের জন্য যখন কলিকাতায় আসিতেন তখন তাহার প্রভাবে যেন সমস্ত বাড়ি ভরিয়া উঠিয়া গম গম করিতে থাকিত। দেখিতাম গুরুজনেরা গায়ে জোব্বা পরিয়া, সংযত পরিচ্ছন্ন হইয়া, মুখে পান থাকিলে তাহা বাহিরে ফেলিয়া দিয়া তাহার কাছে যাইতেন। সকলেই সাবধান হইয়া চলিতেন। রন্ধনের পাছে কোনাে ত্রুটি হয় এই জন্য মা নিজে রান্নাঘরে গিয়া বসিয়া থাকিতেন। বৃদ্ধ কিছু হরকরা তাহার তকমাওঅলা পাগড়ি ও শুভ্র চাপকান পরিয়া দ্বারে হাজির থাকিত। পাছে বারান্দায় গােলমাল দৌড়াদৌড়ি করিয়া তাহার বিরাম ভঙ্গ করি এজন্য পূর্বেই আমাদিগকে সতর্ক করিয়া দেওয়া হইয়াছে। আমরা ধীরে ধীরে চলি, ধীরে ধীরে বলি, উকি মারিতে আমাদের সাহস হয় না।

 একবার পিতা আসিলেন আমাদের তিন জনের উপনয়ন দিবার জন্য। বেদান্তবাগীশকে লইয়া তিনি বৈদিক মন্ত্র হইতে উপনয়নের অনুষ্ঠান নিজে সংকলন করিয়া লইলেন। অনেক দিন ধরিয়া দালানে বেচারামবাবু প্রতাই আমাদিগকে ব্রাহ্ম-ধর্মগ্রন্থে সংগৃহীত উপনিষদের মন্ত্রগুলি বিশুদ্ধরীতিতে বারংবার আবৃত্তি করাইয়া লইলেন। যথাসম্ভব প্রাচীন বৈদিক পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া আমাদের উপনয়ন হইল। মাথা মুড়াইয়া বীরবেইলি পরিয়া আমরা তিন বটু তোলার ঘরে তিনি দিনের জন্য আবদ্ধ হইলাম। সে আমাদের ভারি মজা লাগিল। পরস্পরের কানের কুণ্ডল ধরিয়া আমরা টানাটানি বাধাইয়া দিলাম। একটা বাঁয়া ঘরের কোণে পড়িয়াছিল-বারান্দায় দাঁড়াইয়া যখন দেখিতাম নিচের তলা দিয়া কোনাে চাকর চলিয়া যাইতেছে ধপাধপ শব্দে আওয়াজ করিতে থাকিতাম—তাহার উপরে মুখ তুলিয়াই আমাদিগকে দেখিতে পাইয়া তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করিয়া অপরাধ-আশঙ্কায় ছুটিয়া পলাইয়া যাইত। বস্তুত গুরুগৃহে ঋষিবালকদের যেভাবে কঠোর সংযমে দিন কাটাইবার কথা আমাদের ঠিক সেভাবে দিন কাটে নাই। আমার বিশ্বাস, সাবেক কালের তপােবন অন্বেষণ করিলে আমাদের মতো ছেলে যে মিলিত না তাহা নহে; তাহারা খুব যে বেশি ভালােমানুষ ছিল তাহার প্রমাণ নাই। শারদ্বত ও শারবের বয়স যখন দশ বারে ছিল তখন তাহারা কেবলই বেদমন্ত্র উচ্চারণ করিয়া অগ্নিতে আহুতিদান করিয়াই দিন কাটাইয়াছেন এ কথা যদি কোনো পুরাণে লেখে তবে তাহা আগাগােড়াই আমরা বিশ্বাস করিতে বাধ্য নই—কারণ শিশুচরিত্র নামক পুরাণটি সকল পুরাণের অপেক্ষা পুরাতন! তাহার মতো প্রামাণিক শাস্ত্র কোনো ভাষায় লিখিত হয় নাই।

 নূতন ব্রাহ্মণ হওয়ার পরে গায়ত্রী মন্ত্রটা জপ করার দিকে খুব একটা ঝোঁক পড়িল। আমি বিশেষ যত্নে এক মনে ওই মন্ত্র জপ করিবার চেষ্টা করিতাম। মন্ত্রটা এমন নহে যে সে বয়সে উহার তাৎপর্য আমি ঠিকভাবে গ্রহণ করিতে পারি। আমার বেশ মনে আছে আমি “ভূভুর্বঃস্বঃ” এই অংশকে অবলম্বন করিয়া মনটাকে খুব করিয়া প্রসারিত করিতে চেষ্টা করিতাম। কি বুঝিতাম কি ভাবতাম তাহা স্পষ্ট করিয়া বলা কঠিন, কিন্তু ইহা নিশ্চয় যে, কথার মানে বােঝাটাই মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড়ো জিনিস নয়। শিক্ষার সকলের চেয়ে বড়াে অঙ্গটা-বুঝাইয়া দেওয়া নহে,——মনের মধ্যে ঘা দেওয়া। সেই আঘাতে ভিতরে যে জিনিসটা বাজিয়া উঠে যদি কোনাে বালককে তাহা ব্যাখ্যা করিয়া বলিতে বলা হয় তবে সে যাহা বলিবে সেটা নিতান্তই একটা ছেলেমানুষি কিছু। কিন্তু যাহ! সে মুখে বলিতে পারে তাহার চেয়ে তাহার মনের মধ্যে বাজে অনেক বেশি। যাহারা বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করিয়া কেবল পরীক্ষার দ্বারাই সকল ফল নির্ণয় করিতে চান তাহারা এই জিনিসটার কোনাে খবর রাখে না। আমার মনে পড়ে ছেলেবেলায় আমি অনেক জিনিস বুঝি নাই কিন্তু তাহা আমার অন্তরের মধ্যে খুব একটা নাড়া দিয়াছে। আমার নিতান্ত শিশুকালে মুলাজোড়ে গঙ্গার ধারের বাগানে মেঘেদয়ে বড়দাদা ছাদের উপরে একদিন মেঘদূত আওড়াইতেছিলেন, তাহা আমার বুঝিবার দরকার হয় নাই এবং বুঝিবার উপায়ও ছিল না—তাহার আনন্দআবেগপূর্ণ ছন্দ-উচ্চারণই আমার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ছেলেবেলায় যখন ইংরেজি আমি প্রায় কিছু জানিতাম না তখন প্রচুর ছবিওয়ালা একখানি Old Curiosity Shop লইয়া আগাগােড়া পড়িয়াছিলাম। পনেরাে আনা কথাই বুঝিতে পারি নাই-নিতান্ত আবছায়া গোছের কী একটা মনের মধ্যে তৈরি করিয়া সেই আপন মনের নানা রঙের ছিন্ন সূত্রে গ্রন্থি বাঁধিয়া তাহাতেই ছবিগুলা গাঁথিয়াছিলাম,—পরীক্ষকের হাতে যদি পড়িতাম তবে মস্ত একটা শূন্য পাইতাম সন্দেহ নাই— —কিন্তু আমার পক্ষে সে পড়া ততবড় শূন্য হয় নাই। একবার বাল্যকালে পিতার সঙ্গে গঙ্গার বােটে বেড়াইবার সময় তাহার বইগুলির মধ্যে একখানি অতি পুরাতন ফোর্ট উইলিয়ামের প্রকাশিত গীতগােবিন্দ পাইয়াছিলাম। বাংলা অক্ষরে ছাপা; ছন্দ অনুসারে তাহার পদের ভাগ ছিল না; গদ্যের মতো এক লাইনের সঙ্গে আর এক লাইন অবিচ্ছেদে জড়িত। আমি তখন সংস্কৃত কিছুই জানিতাম না। বাংলা ভালাে জানিতাম বলিয়া অনেকগুলি শব্দের অর্থ বুঝিতে পারিতাম! গীতগােবিন্দখানা যে কতবার পড়িয়াছি তাহা বলিতে পারি জয়দেব যাহা বলিতে চাহিয়াছেন তাহা কিছুই বুঝি নাই, কিন্তু ছন্দে ও কথায় মিলিয়া আমার মনের মধ্যে যে জিনিসটা গাঁথা হইতেছিল তাহা আমার পক্ষে সামান্য নহে। আমার মনে আছে “নিভৃত নিকুঞ্জগৃহং গত নিশি রহসি নিলীয় বসন্তং” এই লাইনটি আমার মনে ভারি একটি সৌন্দর্যের উদ্রেক করিত—ছন্দের ঝংকারের মুখে “নিভৃত নিকুঞ্জগৃহং” এই একটিমাত্র কথাই আমার পক্ষে প্রচুর ছিল। গদ্যরীতিতে সেই বইখানি ছাপানো ছিল বলিয়া জয়দেবের বিচিত্র ছন্দকে নিজের চেষ্টায় আবিষ্কার করিয়া লইতে হইত। —সেইটেই আমার বড়ো আনন্দের কাজ ছিল। যেদিন আমি-~- অহহ কলয়ামি বলয়াদিমণিভূষণং হরিবিরহ- দহনবহনেন বহুদূষণঃ—এই পদটি ঠিকমতো যতি রাখিয়া পড়িতে পারিলাম সেদিন কতই খুশি হইয়াছিলাম। জয়দেব সম্পূর্ণ তাে বুঝি নাই, অসম্পূর্ণ বােঝা বলিলে যাহা বােঝায় তাহাও নহে, তবু সৌন্দর্যে আমার মন রিয়া উঠিয়াছিল যে আগাগােড়া সমস্ত গীতগােবিন্দ একখানি খাতায় নকল করিয়া লইয়াছিলাম। আরও একটু বড়ো বয়সে কুমারসম্ভাবের——

মন্দাকিনীনিঝরশীকরণাং
বোঢা মুহুঃ কম্পিদেবদারুঃ
যদ্বায়রন্বিষ্টমুগৈঃ কিরাতৈ
রাসেব্যতে ভিন্ন শিখণ্ডিবর্হঃ—

এই শ্লোকটি পড়িয়া একদিন মনের ভিতরটা ভারি মাতিয়া উঠিয়াছিল। আর কিছু বুঝি নাই—কেবল “মন্দাকিনীনিক-শীকর” এবং “কম্পিতদেবদারু” এই দুইটি কথাই আমার মন ভুলাইয়াছিল। সমস্ত শ্লোকটির রস ভােগ করিবার জন্য মন ব্যাকুল হইয়া উঠিল। যখন পণ্ডিতমহাশয় সবটার মানে বুঝাইয়া দিলেন তখন মন খারাপ হইয়া গেল। মৃগ-আন্বেষণ- তৎপর কিরাতের মাথায় যে ময়ূরপুচ্ছ আছে বাতাস তাহাকেই চিরিয়া চিরিয়া ভাগ করিতেছে এই সুক্ষ্মতায় আমাকে বড়ােই পীড়া দিতে লাগিল। যখন সম্পূর্ণ বুঝি নাই তখন বেশ ছিলাম।  নিজের বাল্যকালের কথা। যিনি ভালাে করিয়া স্মরণ করিবেন তিনিই ইহা বুঝিবেন যে আগাগােড়া সমস্তই সুস্পষ্ট বুঝিতে পারাই সকলের চেয়ে পরম লাভ নহে। আমাদের দেশের কথকেরা এই তত্ত্বটি জানিতেন—সেইজন্য কথকতার মধ্যে এমন অনেক বড়াে বড়ো কানভরাট-করা সংস্কৃত শব্দ থাকে এবং তাহার মধ্যে এমন তত্ত্বকথাও অনেক নিবিষ্ট হয় যাহা শ্রোতারা কখনােই সুস্পষ্ট বােঝে না কিন্তু অভাসে পায়—এই আভাসে পাওয়ার মূল অল্প নহে। যাহারা শিক্ষার হিসাবে জমাখরচ খতাইয়া বিচার করেন তাহারাই অত্যন্ত কষাকষি করিয়া দেখেন যাহা দেওয়া গেল তাহা বুঝা গেল কি না। বালকেরা, এবং যাহারা অত্যন্ত শিক্ষিত নহ তাহার জ্ঞানের যে প্রথম স্বর্গলােক বাস করে সেখানে মানুষ না বুঝিয়াই পায়—সেই স্বর্গ হইতে যখন পতন হয় তখন বুঝিয়া পাইবার দুঃখের দিন আসে। কিন্তু একথাও সম্পূর্ণ সত্য নহে। জগতে, না বুঝিয়া পাইবার রাস্তাই সকল সময়েই সকলের চেয়ে বড়াে রাস্তা। সেই রাস্তা একেবারে বন্ধ হইয়া গেলে সংসারের পাড়ায় হাটবাজার বন্ধ হয় না বটে কিন্তু সমুদ্রের ধারে যাইবার উপায় আর থাকে না, পর্বতের শিখরে চড়াও অসম্ভব হইয়া উঠে।

 তাই বলিতেছিলাম, গায়ত্রীমন্ত্রের কোনাে তাৎপর্য আমি সে বয়সে যে বুঝিতাম তাহা নহে কিন্তু মানুষের অন্তরের মধ্যে এমন কিছু একটা আছে সম্পূর্ণ না বুঝিলেও যাহা চলে। তাই আমার এক দিনের কথা মনে পড়ে আমাদের পড়িবার ঘরে শানবাঁধানো মেজের এক কোণে বসিয়া গায়ত্রী জপ করিতে করিতে সহসা আমার দুই চোখ ভরিয়া কেবলই জল পড়িতে লাগিল। জল কেন পড়িতেছে। তাহা আমি নিজে কিছুমাত্র বুঝিতে পারিলাম না। অতএব কঠিন পরীক্ষকের হাতে পড়িলে আমি মূঢ়ের মতো এমন কোনো একটা কারণ বলিতাম গায়ত্রীমন্ত্রের সঙ্গে যাহার কোনোই যোগ নাই। আসল কথা, অন্তরের অন্তঃপুরে যে কাজ চলিতেছে বুদ্ধির ক্ষেত্রে সকল সময়ে তাহার খবর আসিয়া পৌছায় না।