জীবন-স্মৃতি (১৯৪১)/বাংলাশিক্ষার অবসান
বাংলাশিক্ষার অবসান
আমরা ইস্কুলে তখন ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের এক ক্লাস নিচে বাংলা পড়িতেছি। বাড়িতে আমরা সে ক্লাসের বাংলা পাঠ্য ছাড়াইয়া অনেকদূর অগ্রসর হইয়া গিয়াছি। বাড়িতে আমরা অক্ষয়কুমার দত্তের পদার্থবিদ্যা শেষ করিয়াছি, মেঘনাদবধও পড়া হইয়া গিয়াছে। পদার্থবিদ্যা পড়িয়াছিলাম, কিন্তু পদার্থের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না, কেবল পুঁথির পড়া—বিদ্যাও তদনুরূপ হইয়াছিল। সে সময়টা সম্পূর্ণ নষ্ট হইয়াছিল। আমার তো মনে হয় নষ্ট হওয়ার চেয়ে বেশি; কারণ, কিছু না করিয়া যে সময় নষ্ট হয় তাহার চেয়ে অনেক বেশি লোকসান করি কিছু করিয়া যে সময়টা নষ্ট করা যায়। মেঘনাদবধ-কাব্যটিও আমাদের পক্ষে আরামের জিনিস ছিল না। যে জিনিসটা পাতে পড়িলে উপাদেয় সেইটাই মাথায় পড়িলে গুরুতর হইয়া উঠিতে পারে। ভাষা শিখাইবার জন্য ভালো কাব্য পড়াইলে তরবারি দিয়া ক্ষৌরী করাইবার মতো হয়—তরবারির তো অমর্যাদা হয়ই, গণ্ডদেশেরও বড়ো দুর্গতি ঘটে। কাব্য জিনিসটাকে রসের দিক হইতে পুরাপুরি কাব্য হিসাবেই পড়ানো উচিত, তাহার দ্বারা ফাঁকি দিয়া অভিধান ব্যাকরণের কাজ চালাইয়া লওয়া কখনোই সরস্বতীর তুষ্টিকর নহে।
এই সময়ে আমাদের নর্মাল ইস্কুলের পালা হঠাৎ শেষ হইয়া গেল। তাহার একটু ইতিহাস আছে। আমাদের বিদ্যালয়ের কোনো একজন শিক্ষক কিশোরীমোহন মিত্রের রচিত আমার পিতামহের ইংরেজি জীবনী পড়িতে চাহিয়াছিলেন। আমার সহপাঠী ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ সাহসে ভর করিয়া পিতৃদেবের নিকট হইতে সেই বইখানি চাহিতে গিয়াসে মনে করিয়াছিল সর্বসাধারণের সঙ্গে সচরাচর যে প্রাকৃত বাংলায় কথা কহিয়া থাকি সেটা তাঁহার কাছে চলিবে না। সেই জন্য সাধু গৌড়ীয় ভাষায় এমন অনিন্দনীয় রীতিতে সে বাক্যবিন্যাস করিয়াছিল যে পিতা বুঝিলেন আমাদের বাংলাভাষা অগ্রসর হইতে হইতে শেষকালে নিজের বাংলাত্বকেই প্রায় ছাড়াইয়া যাইবার জো করিয়াছে। পরদিন সকালে যখন যথানিয়মে দক্ষিণের বারান্দায় টেবিল পাতিয়া দেয়ালে কালো বোর্ড ঝুলাইয়া নীলকমলবাবুর কাছে পড়িতে বসিয়াছি এমন সময় পিতার তেতালার ঘরে আমাদের তিনজনের ডাক পড়িল। তিনি কহিলেন, আজ হইতে তোমাদের আর বাংলা পড়িবার দরকার নাই। খুশিতে আমাদের মন নাচিতে লাগিল।
তখনো নিচে বসিয়া আছেন আমাদের নীলকমল পণ্ডিতমহাশয়; বাংলা জ্যামিতির বইখানা তখনো খোলা এবং মেঘনাদবধ কাব্যখানা বোধ করি পুনরাবৃত্তির সংকল্প চলিতেছে। কিন্তু মৃত্যুকালে পরিপূর্ণ ঘরকন্নার বিচিত্র আয়োজন মানুষের কাছে যেমন মিথ্যা প্রতিভাত হয়, আমাদের কাছেও পণ্ডিতমহাশয় হইতে আরম্ভ করিয়া আর ওই বোর্ড টাঙাইবার পেরেকটা পর্যন্ত তেমনি এক মুহুতে মায়ামরীচিকার মতো শূন্য হইয়া গিয়াছে। কি রকম করিয়া যথোচিত গাম্ভীর্য রাখিয়া পণ্ডিতমহাশয়কে আমাদের নিষ্কৃতির খবরটা দিব সেই এক মুশকিল হইল। সংযতভাবেই সংবাদটা জানাইলাম। দেয়ালে টাঙানো কালো বোর্ডের উপরে জ্যামিতির বিচিত্র রেখাগুলা আমাদের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিল;— যে মেঘনাদবধের প্রত্যেক অক্ষরটিই আমাদের কাছে অমিত্র ছিল সে আজ এতই নিরীহভাবে টেবিলের উপর চিত হইয়া পড়িয়া রহিল যে তাহাকে আজ মিত্র বলিয়া কল্পনা করা অসম্ভব ছিল না।
বিদায় লইবার সময় পণ্ডিতমহাশয় কহিলেন-কর্তব্যের অনুরোধে তোমাদের প্রতি অনেক সময় অনেক কঠোর ব্যবহার করিয়াছি সেকথা মনে রাখিয়ো না; তোমাদের যাহা শিখাইয়াছি ভবিষ্যতে তাহার মূল্য বুঝিতে পারিবে।
মূল্য বুঝিতে পারিয়াছি। ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল। শিক্ষা জিনিসটা যথাসম্ভব আহার-ব্যাপারের মতো হওয়া উচিত। খাদ্যদ্রব্যে প্রথম কামড়টা দিবমাত্রেই তাহার স্বাদের সুখ আরম্ভ হয়—পেট ভরিবার পূর্ব হইতেই পেটটি খুশি হইয়া জাগিয়া উঠে-—তাহাতে তাহার জারক রসগুলির আলস্য দূর হইয়া যায়। বাঙালির পক্ষে ইংরেজি শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই। তাহার প্রথম কামড়েই দুই পাটি দাত আগাগোড়া নড়িয়া উঠে-মুখবিবরের মধ্যে একটা ছোটোখাটো ভূমিকম্পের অবতারণা হয়। তার পরে সেটা যে লোষ্ট্রজাতীয় পদার্থ নহে, সেটা যে রসে পাক-করা মোদক বস্তু তাহা বুঝিতে বুঝিতেই বয়স অর্ধেক পার হইয়া যায়। বানানে ব্যাকরণে বিষম লাগিয়া নাক চোখ দিয়া যখন অজস্র জলধারা বহিয়া যাইতেছে অন্তরটা তখন একেবারেই উপবাসী হইয়া আছে। অবশেষে বহু কষ্টে অনেক দেরিতে খাবারের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটে তখন ক্ষুধাটাই যায় মরিয়া। প্রথম হইতেই মনটাকে চালনা করিবার সুযোগ না পাইলে মনের চলৎশক্তিতেই মন্দা পড়িয়া যায়। যখন চারিদিকে খুব কষিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে তখন যিনি সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘকাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন সেই আমার স্বর্গগত সেজদাদার উদ্দেশে সকৃতজ্ঞ প্রণাম নিবেদন করিতেছি।
নর্মাল স্কুল ত্যাগ করিয়া আমরা বেঙ্গল একাডেমি নামক এক ফিরিঙ্গি ইস্কুলে ভর্তি হইলাম। ইহাতে আমাদের গৌরব কিছু বাড়িল! মনে হইল আমরা অনেকখানি বড়ো হইয়াছি- অস্তৃত স্বাধীনতার প্রথম তলাটাতে উঠিয়াছি। বস্তুত এ বিদ্যালয়ে আমরা যেটুকু অগ্রসর হইয়াছিলাম সে কেবলমাত্র ঐ স্বাধীনতার দিকে। সেখানে কী যে পড়িতেছি তাহা কিছুই বুঝিতাম না, পড়াশুনা করিবার কোনো চেষ্টাই করিতাম না, না করিলেও বিশেষ কেহ লক্ষ্য করিত না। এখানকার ছেলেরা ছিল দুর্বত্ত, কিন্তু ঘৃণ্য ছিল না, সেইটে অনুভব করিয়া খুব আরাম পাইয়াছিলাম। তাহারা হাতের তেলোয় উলটা করিয়া ass লিখিয়া “হেলো” বলিয়া যেন আদর করিয়া পিঠে চাপড় মারিত, তাহাতে জনসমাজে অবজ্ঞাভাজন উক্ত চতুষ্পদের নামাক্ষরটি পিঠের কাপড়ে অঙ্কিত হইয়া যাইত; হয়তো বা হঠাৎ চলিতে চলিতে মাথার উপরে খানিকটা কলা থেতলাইয়া দিয়া কোথায় অন্তর্হিত হইত ঠিকানা পাওয়া যাইত না; কখনো বা ধা ঁকরিয়া মারিয়া অত্যন্ত নিরীহ ভালোমানুষটির মতো অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া থাকিত, দেখিয়া পরম সাধু বলিয়া ভ্রম হইত। এ সকল উৎপীড়ন গায়েই লাগে মনে ছাপ দেয় না,—এ সমস্তই উৎপাতমাত্র, অপমান নহে। তাই আমার মনে হইল এ যেন পাঁকের থেকে উঠিয়া পাথরে পা দিলাম—তাহাতে পা কাটিয়া যায় সেও ভালো, কিন্তু মলিনতা হইতে রক্ষা পাওয়া গেল। এই বিদ্যালয়ে আমার মতো ছেলের মস্ত সুবিধা এই ছিল যে, লেখাপড়া করিয়া উন্নতি লাভ করিব সেই অসম্ভব দুরাশা আমাদের সম্বন্ধে কাহারও মনে ছিল না। ছোটো ইস্কুল, আয় অল্প, ইস্কুলের অধ্যক্ষ আমাদের একটি সদগুণে মুগ্ধ ছিলেন—আমরা মাসে মাসে নিয়মিত বেতন চুকাইয়া দিতাম। এইজন্য ল্যাটিন ব্যাকরণ আমাদের পক্ষে দুঃসহ হইয়া উঠে নাই এবং পাঠচর্চার গুরুতর ক্রটিতেও আমাদের পৃষ্ঠদেশ অনাহত ছিল। বোধ করি বিদ্যালয়ের যিনি অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি এ সম্বন্ধে শিক্ষকদিগকে নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন—আমাদের প্রতি মমতাই তাহার কারণ নহে।
এই ইস্কুলে উৎপাত কিছুই ছিল না, তবু হাজার হইলেও ইহা ইস্কুল। ইহার ঘরগুলা নির্মম, ইহার দেয়ালগুলা পাহারাওআলার মতে,—ইহার মধ্যে বাড়ির ভাব কিছুই নাই—ইহা খোপওয়ালা একটা বড়ো বাক্স। কোথাও কোনো সজ্জা নাই, ছবি নাই, রং নাই, ছেলেদের হৃদয়কে আকর্ষণ করিবার লেশমাত্র চেষ্টা নাই। ছেলেদের যে গেলো মন্দ লাগা বলিয়া একটা খুব মস্ত জিনিস আছে বিদ্যালয় হইতে সে চিন্তা একেবারে নিঃশেষে নির্বাসিত। সেইজন্য বিদ্যালয়ের দেউড়ি পার হইয়া তাহার সংকীর্ণ আঙিনার মধ্যে পা দিবামাত্র তৎক্ষণাৎ সমস্ত মন বিমর্ষ হইয়া যাইত—অতএব ইস্কুলের সঙ্গে আমার সেই পালাইবার সম্পর্ক আর ঘুচিল না।
পলায়নের একটি সহায় পাইয়াছিলাম। দাদারা একজনের কাছে পারসি পড়িতেন—তাঁহাকে সকলে মুনশি বলিত নামটা কি ভুলিয়াছি। লোকটি প্রৌঢ়—অস্থিচর্মসার। তাঁহার কঙ্কালটাকে যেন একখানা কালো মোমজামা দিয়া মুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে; তাহাতে রস নাই, চর্বি নাই। পারসি হয়তো তিনি ভালোই জানিতেন, এবং ইংরেজিও তাঁর চলনসই রকম জানা ছিল, কিন্তু সেক্ষেত্রে যশোলাভ করিবার
৫ চেষ্টা তাঁহার কিছুমাত্র ছিল না। তাঁহার বিশ্বাস ছিল লাঠি খেলায় তাঁহার যেমন আশ্চর্য নৈপুণ্য, সংগীতবিদ্যায় সেইরূপ অসামান্য পারদর্শিতা। আমাদের উঠানে রৌদ্রে দাড়াইয়া তিনি নানা অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাঠি খেলিতেন—নিজের ছায়া ছিল তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী। বলা বাহুল্য তাঁহার ছায়া কোনো দিন তাঁহার সঙ্গে জিতিতে পারিত না—এবং হুহুংকারে তাহার উপরে বাড়ি মারিয়া যখন তিনি জয়গর্বে ঈষৎ হাস্য করিতেন তখন ম্লান হইয়া তাঁহার পায়ের কাছে নীরবে পড়িয়া থাকিত। তাঁহার নাকি বেসুরের গান প্রেতলোকের রাগিণীর মতো শুনাইত—তাহা প্রলাপে বিলাপে মিশ্রিত একটা বিভীষিকা ছিল। আমাদের গায়ক বিষ্ণু মাঝে মাঝে তাহাকে বলিতেন মুনশিজি, আপনি আমার রুটি মারিলেন।—কোনো উত্তর না দিয়। তিনি অত্যন্ত অবজ্ঞা করিয়া হাসিতেন।
ইহা হইতে বুঝিতে পারিবেন মুনশিকে খুশি করা শক্ত ছিল না। আমরা তাঁহাকে ধরিলেই তিনি আমাদের ছুটির প্রয়োজন জানাইয়া ইস্কুলের অধ্যক্ষের নিকট পত্র লিখিয়া দিতেন। বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এরূপ পত্র লইয়া অধিক বিচার বিতর্ক করিতেন না—কারণ তাঁহার নিশ্চয় জানা ছিল যে আমরা ইস্কুলে যাই বা না যাই তাহাতে বিদ্যাশিক্ষা সম্বন্ধে আমাদের কিছুমাত্র ইতরবিশেষ ঘটিবে না।
এখন আমার নিজের একটি স্কুল আছে এবং সেখানে ছাত্রের নানাপ্রকার অপরাধ করিয়া থাকে—কারণ, অপরাধ করা ছাত্রদের, এবং ক্ষমা না করা শিক্ষকের ধর্ম। যদি আমাদের কেহ তাহাদের ব্যবহারে ক্রূদ্ধ ও ভীত হইয়া বিদ্যালয়ের অমঙ্গল আশঙ্কায় অসহিষ্ণু হন ও তাহাদিগকে সদ্যই কঠিন শাস্তি দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠেন, তখন আমার নিজের ছাত্র অবস্থার সমস্ত পাপ সারি সারি দাঁড়াইয়া আমার মুখের দিকে তাকাইয়া হাসিতে থাকে।
আমি বেশ বুঝিতে পারি, ছেলেদের অপরাধকে আমরা বড়োদের মাপ-কাঠিতে মাপিয়া থাকি, ভুলিয়া যাই যে, ছোটো ছেলেরা নির্ঝরের মতো বেগে চলে;—সে জলে দোয যদি স্পর্শ করে তবে হতাশ হবার কারণ নাই, কেননা সচলতার মধ্যে সকল দোষের সহজ প্রতিকার আছে; বেগ যেখানে থামিয়াছে সেইখানেই বিপদ,—সেইখানেই সাবধান হওয়া চাই। এইজন্য শিক্ষকদের অপরাধকে যত ভয় করিতে হয় ছাত্রদের তত নহে।
জাত বাঁচাইবার জন্য বাঙালি ছাত্রদের একটি স্বতন্ত্র জলখাবারের ঘর ছিল। এই ঘরে দুই একটি ছাত্রের সঙ্গে আমাদের আলাপ হইল। তাহাদের সকলেই আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো। তাহাদের মধ্যে একজন কাফি রাগিণীটা খুব ভালোবাসিত এবং তাহার চেয়ে ভালোবাসিত শ্বশুরবাড়ির কোনো একটি বিশেষ ব্যক্তিকে—সেই জন্য সে ওই রাগিণীটা প্রায়ই আলাপ করিত এবং তাহার অন্য আলাপটারও বিরাম ছিল না।
আর একটি ছাত্রসম্বন্ধে কিছু বিস্তার করিয়া বলা চলিবে। তাহার বিশেষত্ব এই যে, ম্যাজিকের শখ তাহার অত্যন্ত বেশি। এমন কি, ম্যাজিক সম্বন্ধে একখানি চটি বই বাহির করিয়া সে আপনাকে প্রোফেসার উপাধি দিয়া প্রচার করিয়াছিল। ছাপার বইয়ে নাম বাহির করিয়াছে এমন ছাত্রকে ইতিপূর্বে আর কখনো দেখি নাই। এজন্য অন্তত ম্যাজিকবিদ্যা সম্বন্ধে তাহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা গভীর ছিল। কারণ, ছাপা অক্ষরের খাড়া লাইনের মধ্যে কোনোরূপ মিথ্যা চালানো যায় ইহা আমি মনেই করিতে পারিতাম না। এ পর্যন্ত ছাপার আমাদের উপর গুরুমহাশয়গিরি করিয়া আসিয়াছে এইজন্য তাহার প্রতি আমার বিশেষ সম্ভ্রম ছিল। যে কালি মোছে না, সেই কালিতে নিজের রচনা লেখা-এ কি কম কথা! কোথাও তার আড়াল নাই, কিছুই তার গোপন করিবার জো নাই—জগতের সম্মুখে সার বঁধিয়া সিধা দাঁড়াইয়া তাহাকে আত্মপরিচয় দিতে হইবে—পলায়নের রাস্তা একেবারেই বন্ধ, এতবড়ো অবিচলিত আত্মবিশ্বাসকে বিশ্বাস না করাই যে কঠিন। বেশ মনে আছে ব্রাহ্মসমাজের ছাপাখানা অথবা আর কোথাও হইতে একবার নিজের নামের দুই একটা ছাপার অক্ষর পাইয়াছিলাম। তাহাতে কালি মাখাইয়া কাগজের উপর টিপিয়া ধরিতেই যখন ছাপ পড়িতে লাগিল তখন সেটাকে একটা স্মরণীয় ঘটনা বলিয়া মনে হইল।
সেই সহপাঠী গ্রন্থকার বন্ধুকে রোজ আমরা গাড়ি করিয়া ইস্কুলে লইয়া যাইতাম। এই উপলক্ষ্যে সর্বদাই আমাদের বাড়িতে তাহার যাওয়াআসা ঘটিতে লাগিল। নাটক-অভিনয় সম্বন্ধেও তাহার যথেষ্ট উৎসাহ তাহার সাহায্যে আমাদের কুস্তির আখড়ায় একবার আমরা গোটাকত বাঁখারি পুঁতিয়া তাহার উপর কাগজ মারিয়া নানা রঙের চিত্র আঁকিয়া একটা স্টেজ খাড়া করিয়াছিলাম। বোধ করি উপরের নিষেধে সে স্টেজে অভিনয় ঘটিতে পারে নাই।
কিন্তু বিনা স্টেজেই একদা একটা প্রহসন অভিনয় হইয়াছিল। তাহার নাম দেওয়া যাইতে পারে ভ্রান্তিবিলাস। যিনি সেই প্রহসনের রচনাকর্তা পাঠকেরা তাঁহার পরিচয় পুর্বে কিছু কিছু পাইয়াছেন।
তিনি আমার ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ। তাঁহার ইদানীন্তন শান্ত সৌম্য মূর্তি যাহারা দেখিয়াছেন তাঁহারা কল্পনা করিতে পারিবেন না। বাল্যকালে কৌতুকচ্ছলে তিনি সকল প্রকার অঘটন ঘটাইবার কিরূপ ওস্তাদ ছিলেন।
যে সময়ের কথা লিখিতেছিলাম ঘটনাটি তাহার পরবর্তী কালের। তখন আমার বয়স বোধ করি বারো তেরো হইবে। আমাদের সেই বন্ধু সর্বদা দ্রব্যগুণসম্বন্ধে এমন সকল আশ্চর্য কথা বলিত যাহা শুনিয়া আমি একেবারে স্তম্ভিত হইয়া যাইতাম—পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য আমার এত ঔৎসুক্য জন্মিত যে আমাকে অধীর করিয়া তুলিত। কিন্তু দ্রব্যগুলি প্রায়ই এমন দুর্লভ ছিল যে সিন্ধুবাদ নাবিকের অনুসরণ না করিলে তাহা পাইবার কোনো উপায় ছিল না। একবার নিশ্চয়ই অসতর্কতাবশত প্রোফেসর কোনো একটি অসাধ্যসাধনের অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থা বলিয়া ফেলাতে আমি সেটাকে পরীক্ষা করিবার জন্য কৃতসংকল্প হইলাম। মনসা-সিজের আঠা একুশবার বীজের গায়ে মাখাইয়া শুকাইয়া লইলেই যে সে-বীজ হইতে এক ঘণ্টার মধ্যেই গাছ বাহির হইয়া ফল ধরিতে পারে একথা কে জানিত। কিন্তু যে প্রােফেসর ছাপার বই বাহির করিয়াছে তাহার কথা একেবারে অবিশ্বাস করিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে না।
আমরা আমাদের বাগানের মালীকে দিয়া কিছুদিন ধরিয়া যথেষ্ট পরিমাণে মনসাসিজের আঠা সংগ্রহ করিলাম এবং একটা আমের আঁটির উপর পরীক্ষা করিবার জন্য রবিবার ছুটির দিনে আমাদের নিভৃত রহস্য-নিকেতনে তেতালার ছাদে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
আমি তো একমনে আঁটিতে আঠা লাগাইয়া কেবলই রৌদ্রে শুকাইতে লাগিলাম—তাহাতে যে কিরূপ ফল ধরিয়াছিল নিশ্চয়ই জানি বয়স্ক পাঠকেরা সে সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করিবেন না! কিন্তু সত্য তেতালার কোন একটা কোণে এক ঘণ্টার মধ্যেই ডালপালাসমেত একটা অদ্ভুত মায়াতরু যে জাগাইয়া তুলিয়াছে আমি তাহার কোনাে খবরই জানিতাম না। তাহার ফুলও বড়ো বিচিত্র হইল।
এই ঘটনার পর হইতে প্রােফেসর যে আমার সংস্রব সসংকোচে পরিহার করিয়া চলিতেছে তাহা আমি অনেকদিন লক্ষ্যই করি নাই। গাড়িতে সে আমার পাশে অল্প বসে না, সর্বত্রই সে আমার নিকট হইতে কিছু যেন দূরে দূরে চলে। একদিন হঠাৎ আমাদের পড়িবার ঘরে মধ্যাহ্নে সে প্রস্তাব করিল, এস, এই বেঞ্চের উপর হইতে লাফাইয়া কাহার কি রূপ লাফাইবার প্রণালী। আমি ভাবিলাম সৃষ্টির অনেক রহস্যই প্রােফেসরের বিদিত, বােধ করি লাফানো সম্বন্ধেও কোনো একটা গুঢ়তত্ত্ব তাহার জানা আছে। সকলেই লাফাইল আমিও লাফাইলাম। প্রোফেসর একটি অৱরুদ্ধ অব্যক্ত হুঁ বলিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িল। অনেক অনুনয়েও তাহার কাছ হইতে ইহা অপেক্ষা স্ফুটতর কোনাে বাণী বাহির করা গেল না।
একদিন জাদুকর বলিল, কোনো সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলেরা তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিতে চায় একবার তাহাদের বাড়ি যাইতে হইবে। অভিভাবকেরা আপত্তির কারণ কিছুই দেখিলেন না, আমরাও সেখানে গেলাম।
কৌতূহলীর দলে ঘর ভরতি হইয়া গেল। সকলেই আমার গান শুনিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিল। আমি দুই একটা গান গাহিলাম। তখন আমার বয়স অল্প, কণ্ঠস্বরও সিংহ-গর্জনের মতো সুগভীর ছিল না। অনেকেই মাথা নাড়িয়া বলিল—তাইতো, ভারি মিষ্ট গলা!
তাহার পরে যখন খাইতে গেলাম তখনাে সকলে ঘিরিয়া বসিয়া আহার-প্রণালী পর্যবেক্ষণ করিতে তৎপূর্বে বাহিরের লােকের সঙ্গে নিতান্ত অল্পই মিশিয়াছি,সুতরাং স্বভাবটা সলজ্জ ছিল। তাহা ছাড়া পূর্বেই জানাইয়াছি আমাদের ঈশ্বর চাকরের লােলুপ দৃষ্টির সম্মুখে লাগিল। খাইতে খাইতে অল্প খাওয়াই আমার চিরকালের মতো অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে। সেদিন আমার আহারে সংকোচ দেখিয়া দর্শকেরা সকলেই বিস্ময় প্রকাশ করিল। যেরূপ সুক্ষ্মদৃষ্টিতে সেদিন সকলে নিমন্ত্রিত বালকের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল তাহা যদি স্থায়ী এবং ব্যাপক হইত তাহা হইলে বাংলা দেশে প্রাণিবিজ্ঞানের অসাধারণ উন্নতি হইতে পারিত।
ইহার অনতিকাল পরে পঞ্চমাঙ্কে জাদুকরের নিকট হইতে দুই একখানা অদ্ভুত পত্র পাইয়া সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিতে পারিলাম। ইহার পরে যবনিকা পতন।
সত্যর কাছে শােনা গেল একদিন আমের আঁটির মধ্যে জাদুপ্রয়ােগ করিবার সময় সে প্রােফেসরকে বুঝাইয়া দিয়াছিল যে বিদ্যা শিক্ষার সুবিধার জন্য আমার অভিভাবকেরা আমাকে বালকবেশে বিদ্যালয়ে পাঠাইতেছিলেন কিন্তু ওটা আমার ছদ্মবেশ। যাহার স্বকপােলকল্পিত বৈজ্ঞানিক আলােচনায় কৌতূহলী তাহাদিগকে একথা বলিয়া রাখা উচিত, লাফানাের পরীক্ষায় আমি বঁ পা আগে বাড়াইয়া-ছিলাম—সেই পদক্ষেপটা যে আমার কত বড়াে ভুল হইয়াছিল তাহা সেদিন জানিতে পারি নাই।