জীবন বীমা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
জীবন বীমা কি, তাহা কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে প্রায় সকলেই অবগত আছেন ও তাহাদিগের মধ্যে অনেকেরই জীবন যে বীমা করা আছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু মফস্বলের পাঠকগণের মধ্যে অনেকে ইহা অবগত নহেন বলিয়া, জীবনবীমার ব্যাপার যে কি, তাহা এই স্থানে সক্ষেপে একটু বলিতে হইল। এই কলিকাতা সহয় ও প্রধান প্রধান নগরীতে জীবন বীমার অনেক অফিস আছে, ইহাদিগের নাম ইংরা Life Insurance office কহিয়া থাকে। ইহা আজ-কাল একটা প্রধান ব্যবসা কার্যের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে। এই ব্যবসা পূর্বে আমাদিগের দেশে ছিল না, সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উহা পাশ্চাত্য প্রদেশ হইতে ক্রমে এদেশে আসিয়া উপনীত হইয়াছে, ও সেই সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোক ঐ কার্য্যে দালালরূপে নিযুক্ত হইয়াছে। ঐ কার্য্যের যতগুলি অফিস আছে, প্রত্যেক অফিসের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র বিস্তর দালাল আছে। তাহারা প্রত্যেকের বাড়ীতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া প্রত্যেককে তাহার জীবন বীমা করাইবার প্রবৃত্তি দিয়া থাকে, ও যাহারা তাহাদিগের কথায় সম্মত হইয়া আপনাপন জীবন বীমা করাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাঁহাদিগকে তাহারা তাহাদিগের অফিসে জীবন বীমা করাইয়া দেয়। মনে করুন, আপনি হাজার টাকায় আপনার জীবন বীমা করিতে ইচ্ছা করিয়া দালালকে কহিলেন। দালাল তাহার অফিস হইতে অমনি কয়েক খানি ফরম আনিয়া উপস্থিত করিল, আপনি ঐ ফরমে যে কথা লিখিবার প্রয়োজন তাহা লিবিয়া পাঠাইয়া দিলেন। ইহার পরেই সেই অফিসের নিয়োজিত ডাক্তারের দ্বারা আপনাকে পরীক্ষা করা হইল। ঐ ডাক্তার আপনাকে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া আপনার বয়ঃক্রম ও আপনার স্বাস্থ্য প্রভৃতি কিরূপ, তাহা লিখিয়া দিলেন। ঐ ডাক্তারের মতের উপর নির্ভর করিয়া অফিস উহা সাব্যস্ত করিলে, আপনাকে মাসে মাসে বা প্রত্যেক তিন মাস; অন্তর কিছু কিছু টাকা জমা দিতে হইবে। আপনি উহাতে সম্মত হইয়া ঐরূপ স্থিরীকৃত টাকা নিয়মমত জমা দিতে লাগিলেন। আপনি যে সহস্র মুদ্রা পাইবার নিমিত্ত টাকা জমা দিতে লাগিলেন, ঐ সহস্র মুদ্রা পাইবার জন্য দুইটা নিয়ম আছে;— অর্থাৎ আপনি আপনার যে বয়ঃক্রমে উপনীত হইলে ঐ টাকা পাইতে ইচ্ছা করেন, আপনি আপনার সেই বয়সে সেই টাকা পাইতে পারেন, অথবা আপনি আপনার জীবিত অবস্থায় ঐ টাকা গ্রহণ না করিয়া উহা আপনার উত্তরাধিকারীর নিমিত্ত রাখিয়া যাইতে পারেন। আপনি যদি প্রথম নিয়মের বশীভূত হইয়া টাকা জমা দিতে প্রবৃত্ত হন, তাহা হইলে, আপনি আপনার সেই নির্দিষ্ট বয়সে উপনীত হইলেই ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবেন, আর যদি উহার মধ্যেই, এমন কি, এক মাস টাকা জমা দেওয়ার পরেই আপনার পরলোকপ্রাপ্তি হয়, তাহা হইলে আপনার মৃত্যুর পরই আপনার উত্তরাধিকারী ঐ সহস্র মুদ্রা প্রাপ্ত হইবেন। এইরূপ নিয়মে ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত যে টাকা জমা দিতে হয়, হিসাব করিয়া দেখিলে, যে সহস্র টাকা প্রাপ্ত হওয়া যাইবে, তাহার সংখ্যা কোনক্রমেই অতিক্রম করে না, অধিকন্তু টাকা জমা দিতে আরম্ভ করিবার পরেই মৃত্যু হইলে উত্তরাধিকারীর বিশেষরূপ লাভ হইয়া থাকে। আর যদি আপনি দ্বিতীয় নিয়মের বশীভূত হইয়া, মাসে মাসে সামান্য অর্থ জমা দেন, তাহা হইলে আপনার লাভ লোকসান আপনার পরমায়ুর উপর নির্ভর করিবে; অর্থাৎ একমাস বা দুইমাস অথবা কিছুদিবস পর্যন্ত টাকা জমা দেওয়ার পর যদি আপনার মৃত্যু হয়, তাহা হইলে আপনার মৃত্যুর পরেই আপনার উত্তরাধিকারী ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবেন। মাসিক চাঁদা অল্পদিন দিবার পরেই যাহার মৃত্যু হয়, তাহার উত্তরাধিকারীর পক্ষে বিশেষরূপ লাভ হইয়া থাকে। আর যিনি দীর্ঘকাল বঁচিয়া মাসে মাসে বা নিয়মিত রূপে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করিয়া থাকেন, তাহার সমস্ত জীবনে তিনি যে টাকা জমা দেন, সময় সময় তাঁহার প্রাপ্ত টাকা অপেক্ষা চাঁদা জমা দিবার টাকার সংখ্যা অধিক হইয়া যায়। এরূপ অবস্থায় তাঁহার ওয়ারিশনগণ তাহার জমা দেওয়া টাকা অপেক্ষা কম পাইলেও, অর্থ টা একেবারে প্রাপ্ত হয়েন বলিয়া বিশেষ লাভ মনে করিয়া থাকেন। কারণ সেই সময় যত গুলি টাকা একেবারে প্রাপ্ত হওয়া যায়, এতগুলি টাকা একস্থানে জমা করা অনেকের পক্ষে সহজ হয় না।
আমি হাজার টাকায় জীবন বীমা রাখার উদাহরণ প্রদান করিলাম। কিন্তু পাঠকগণ মনে করিবেন না যে, হাজার টাকার অধিক জীবন বীমা হয় না, বা এক অফিসে একজনের জীবন বিমা থাকিলে অপর অফিসে তাঁহার জীবন পুনরায় বীমা হয় না। যে কোন ব্যক্তি যত টাকায় ও যত অফিসে আপনার জীবন বীমা করিতে ইচ্ছা করেন, তিনি তত টাকায় ও তত অফিসে ইচ্ছামত আপনার জীবন যে কোন নিয়মে বীমা করিতে পারেন। দেখা গিয়াছে, এই কলিকাতা সহরের মধ্যে অনেকের জীবন হাজার, অনেকের দুই হাজার, অনেকের পাঁচ হাজার, অনেকের দশ হাজার, অনেকের পঁচিশ হাজার, অনেকের পঞ্চাশ হাজার ও অনেকের লক্ষ মুদ্রা পর্যন্ত যে কয় অফিসে ইচ্ছা, সেই কয় অফিসে পৃথক পৃথক রূপে বীমা করা আছে ও তাহারা সেইরূপ পরিমাণে চাদার টাকা কেহ মাসিক, কেহ ত্রৈমাসিক, কেহ ছয় মাস অন্তর ও কেহ বা বৎসর বৎসর জমা দিয়া আসিতেছেন।
এইরূপ জীবন বীমার কেনা-বেচা ও বন্দক দেওয়ার কারবারও বাজারে চলিয়া থাকে। যদি কোন ব্যক্তির হঠাৎ কিছু টাকার প্রয়োজন হয়, তিনি ইচ্ছা করিলে তাহার সেই জীবন বীমা সেই অফিসে বন্দক রাখিয়া অনায়াসেই কিছু টাকা পাইতে পারেন, কিন্তু ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবার একটা নিয়ম আছে অর্থাৎ যে জীবন বীমা তিনি বন্ধক দিতেছেন, তাহার নিমিত্ত এ পর্যন্ত তিনি যত টাকা ঐ অফিসে জমা দিয়াছেন, তাহারই একটা অংশ তিনি কর্জ্জ স্বরূপ পাইতে পারেন, ইহা ব্যতীত ঐ জীবন বীমা বিক্রয়ও হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি উহা খরিদ করেন, তাঁহাকে ঐ বীমার নিয়মিত চাদা যত দিবস পর্যন্ত যাহার জীবন বীমা আছে, বা যত দিবস তিনি জীবিত থাকেন, তত দিবস তাহাকে অর্থাৎ জীবন-বীমা-খরিদকারীকে জমা দিয়া আসিতে হয়। বীমার সময় উত্তীর্ণ হইলে অথবা বিমাকারীর মৃত্যু হইলে ঐ বীমা অনুযায়ী সমস্ত টাকা যিনি উহা খরিদ করিয়াছেন, তিনি উহা প্রাপ্ত হন।
পাঠকগণের মধ্যে অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, অরের জীবন বীমা খরিদ করিয়া লাভ কি? উত্তরে ইহা অনায়াসেই বলা যাইতে পারে যে, এরূপ খরিদ বিক্রয় একটা ব্যবসা। ইহাতে সময় সময় লাভালাভও অনেক হইয়া থাকে। মনে করুন, দশ হাজার টাকায় একজনের জীবন বীমা আমি খরিদ করিলাম। খরিদ করিবার অল্প দিন পরেই বীমাকারীর মৃত্যু হইল। মৃত্যুর পর ঐ দশ হাজার টাকা আমি অনায়াসে প্রাপ্ত হইলাম। মনুষ্যের মৃত্যু অনিবার্য; তবে সময়ের কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। সুতরাং ইহাও একটা প্রধান ব্যবসায়। সকল ব্যবসাতেই লাভ ও লোকসান আছে। লাভ ও লোকসান আছে বলিয়াই, ব্যবসা কার্য্য চলিয়া থাকে, ইহাও তাহাই। যাহাদিগের জীবন বীমা খরিদ করাই ব্যবসা, তাঁহারা সময় সময় (যেখানে বীমাকারীর অল্প পরমায়ু বিস্তার লাভ করিয়া থাকেন। আর যে সকল বীমাকারী দীর্ঘায়ু, তাহাদিগের জীবন বীমা খরিদ করিয়াও যে তিনি একেবারে লোকসান দিয়া থাকেন, তাহা নহে। পূর্বে বলিয়াছি যে, মনুষ্যজীবন চিরস্থায়ী নহে; এক দিবস তাহাকে নিশ্চয়ই মরিতে হইবে, তাহার মৃত্যুর পর তাহার জীবনবীমার টাকা আদায় হইয়া আসিবে। যিনি জীবনবীমা খরিদ করিলেন, তিনি সেই সময় জীবিত থাকেন ভালই, নচেৎ তাহার উত্তরাধিকারীগণ যদি ঐ ব্যবসা চালান, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবেন, সুতরাং এ ব্যবসায় লোকসান প্রায়ই হয় না।
জীবন বীমা করিলে বা ঐ জীবনবীমা খরিদ করিলে যে একেবারে কখনও লোকসান হয় না তাহাও নহে। যাহারা অন্ধপ্রতিষ্ঠ ও উত্তম অফিসে জীবন বীমা করিয়া থাকেন, তাহাদিগকে কোনরূপে বঞ্চিত হইতে হয় না। কিন্তু এরূপ বীমা অফিসও দেখিতে পাওয়া যায় যে, টাকা প্রদান করিবার সময় উপস্থিত হইলে, কোন না কোন অপত্য উত্থাপন করিয়া যাহাতে ঐ টাকা প্রদান করিতে না হয়, প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিতেও এটা করেন না।
যে সকল ব্যবসায়ে লাভালাভ আছে, সেই সকল কার্য্যে জুয়াচুরিও অনেক সময় হইয়া থাকে। বীমা অফিস খুলিয়া যাহারা বিস্তার লাভ করিয়া থাকেন, সময় সময় জুয়াচোরের হস্তে পড়িয়াও তাহাদিগকে বিস্তর ক্ষতি সহ করিতে হয়।