জীবন বীমা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 সাহেব আমাকে যে পত্রখানি প্রদান করিলেন, তাহার মােরক দেখিয়া বুঝিলাম, উহা ডাকে আসিয়াছে; কারণ উহার উপর ডাকের মোহর বর্তমান। পত্রখানি পাড়িলাম, উহাতে লেখকের নাম নাই। পত্রখানি ইংরাজিতে লেখা; উহার সার মর্ম এইরূপ,

 “আমি জানি, আপনাদিগের অফিসে একটা ভয়ানক জুয়াচুরি হইয়াছে। কেবল আপনাদিগের অফিসই বা বলি কেন, কলিকাতায় যে কয়টা প্রধান প্রধান বীমা অফিস আছে, তাহার মধ্যে প্রায় সমস্ত অফিসেই ঐরূপ জুয়াচুরি হইয়াছে। কোন এক অজানিত ব্যক্তির জীবন, ঐ সকল বীমা অফিসে, ব্রজবন্ধু নামক এক ব্যক্তির দ্বারা বীমা করান হয়, ও ঐ বীমাকারী ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে বলিয়া, যত টাকায় তাহার জীবন বীমা করান হইয়াছিল, তাহার সমস্ত এখন ঐ ব্রজবন্ধু লইবার চেষ্টা করিতেছে, ও শুনিলাম, প্রায় কৃতকার্য্যও হইয়াছে। কোন এক বিশ্বাসী কর্মচারী দ্বারা অনুসন্ধান করিলেই জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা সত্য কি না? ব্রজবন্ধু টাকাগুলি প্রাপ্ত হউক বা না হউক, তাহাতে আমার লাভ বা লােকসান কিছুই নাই, তবে একজন জুয়াচুরি করিয়া নিরর্থক অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে বসিয়াছে দেখিয়া, ভাবিলাম, এই সংবাদ আপনাদিগকে প্রদান করা আমার কর্তব্য কর্ম; এই নিমিত্তই আমি আপনাকে এই সংবাদ প্রদান করিতেছি, এখন যেরূপ সঙ্গত মনে করেন, সেইরূপ করিবেন। আমি ব্রজবন্ধুর নিকট পরিচিত বলিয়া আমার নাম এই পত্রে প্রকাশ করিলাম না, একটু বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলেই জানিতে পারিবেন, আমার কথা কতদূর সত্য।”

 আমি ঐ পত্রখানি পাঠ করিয়া সাহেবকে কহিলাম, “এই পত্র পাইয়াই কি আপনার সন্দেহ হইয়াছে যে, ব্রজবন্ধু জুয়াচুরি করিয়া এতগুলি টাকা আপনাদিগের অফিস হইতে বাহির করিয়া লইতে বসিয়াছে?”

 সাহেব। হাঁ।

 আমি। এই পত্র ব্যতীত বােধ হয় আর কোন কারণ নাই, যাহাতে আপনি মনে করিতে পারেন, এ সমস্তই জুয়াচুরি কাণ্ড?

 সাহেব। না।

 আমি। পত্রের লিখিত সমস্ত বিষয়গুলি বােধ হয় সত্য হইলেও হইতে পারে।

 সাহেব। সত্য বলিয়াই আমার অনুমান হয়।

 আমি। মিথ্যা হইলেও হইতে পারে।

 সাহেব। মিথ্যা সংবাদ দেওয়ার কারণ?

 আমি। শত্রুতা।

 সাহেব। চিঠির তাবে ত বােধ হয় না যে, লেখকের সহিত ব্রজবন্ধুর কোনরূপ শ্ত্রুতা আছে।

 আমি। শত্রুতা দেখাইয়া প্ত্র লিখিলে আপনি সে পত্র বিশ্বাস করিবেন কেন? আমাদিগের দেশে এরূপ ঘটনা হইয়াই থাকে। কাহার সহিত কাহারও যদি কোনরূপ শত্রুতা থাকে, তাহা হইলে সুযোগ পাইলেই পরম্পর শত্রুতা করিতে কেহই ত্রুটী করে না। তৎব্যতীত আয় এক প্রকৃতির লােক সচরাচর এই দেশে দেখিতে পাওয়া যায়, তাহারা কোন ব্যক্তিকে কোনরূপে উপার্জন করিয়া নিজের অন্নকষ্ট দুর করিতে সমর্থ দেখিলেই, তাহাদের চক্ষুশূল হইয়া উঠে ও যাহাতে তাহার সেই উপার্জ্জিত অর্থ কোন না কোনরূপে ব্যয়িত হইয়া যায়, তাহার নিমিত্ত স্বতপরতঃ নানারূপ চেষ্টা করিয়া থাকে ও তাহাকে নিরর্থক বিপদে নিক্ষিপ্ত করিতে কোনরূপে পরান্মুখ হয় না। এই নিমিত্তই আমি বলিতেছি যে, এই পত্রের লিখিত বিষয়গুলি সম্পূর্ণরূপ সত্য হইলেও হইতে পারে অথবা মিথ্যা হইলেও হইতে পারে। সে যাহা হউক, ইহার অনুসন্ধানে যখন হস্তক্ষেপ করিয়াছি, তখন ইহার প্রকৃত তথ্য নিশ্চয়ই বাহির হইয়া পড়িবে।

 সাহেব। এই বিষয় উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া যদি দোষী ব্যক্তিকে আপনি দণ্ড প্রদান করাইতে পারেন, তাহা হইলে জানিবেন, আমি আপনাকে বিশেষরূপ পারিতােষিক প্রদান করিব।

 আমি। পারিতােষিকের বিষয় আমাকে বলা আপনার কর্তব্য নহে, সে সম্বন্ধে আপনার যদি কোন কথা বলিবার ইচ্ছা থাকে, আপনি আমার সর্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট বলিতে পারেন এখন আমাকে অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে দিউন যে, বেনামা পত্রে যাহা বর্ণিত আছে, তাহা সত্য-কি ব্রজবন্ধু বাবু প্রকৃতই টাকা পাইবার অধিকারী।

 আমার কথা শুনিয়া সাহেব যেন একটু অপ্রতিভ হইলেন, ও কহিলেন, “আমার নিকট আপনার আর কোন বিষয় জিজ্ঞাস্য আছে কি?”  আমি। আমি এখন সামান্য আর দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি।

 সাহেব। কি?

 আমি। ব্রজবন্ধু বাবুকে আপনার অফিসের কোন লােক চিনে কি?

 সাহেব। চিনে।

 আমি। কে চিনে?

 সাহেব। আমি নিজে তাহাকে দুই তিনবার দেখিয়াছি, সুতরাং তাহাকে দেখিলেই চিনিতে পারি।

 আমি। আর কেহ চিনে?

 সাহেব। অফিসের আরও দুই চারিজন কর্মচারী তাহাকে চিনে॥

 আমি। তাহার কি সূত্রে ব্রজবন্ধুকে চিনে?

 সাহেব। ব্রজবন্ধু নিজে দুইবার অফিসে আসিয়া প্রিমিয়মের টাকা জমা দিয়া গিয়াছিল, সুতরাং যে সকল কর্মচারীর নিকট টাকা জমা দিতে হয়, তাহারা সকলেই উহাকে চিনে। হরে কৃষ্ণ মরিয়া যাইবার পর, টাকা বাহির করিবার নিমিত্ত ব্রজবন্ধু অনেকবার অফিসে আসিয়াছে, সেই সময় প্রায় সকলেই তাহাকে দেখিয়াছে।

 আমি। হরেকৃষ্ণকে কি কেহ চিনিত?

 সাহেব। উহার জীবনবীমা যে দালালের মারফৎ হয়, সে উহাকে চিনিত। যে ডাক্তার উহার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়াছিল, সে উহাকে চিনিত, জীবন বীমা করিবার সময় সে অফিসেও দুই চারিবার আসিয়াছিল, সেই সময় যে যে কর্মচারী তাহাকে দেখিয়াছে, তাহারা সকলেই তাহাকে চিনিত; এবং ঐ জীবনবীমা ব্রজবন্ধুকে বিক্রয় করিবার সময় উহারা উভয়েই অফিসে আসিয়াছিল, সেই সময়ও যে যে কর্মচারী উহাদিগকে দেখিয়াছিল, তাহারাও অনায়াসে চিনিতে পারে।

 সাহেবের নিকট কেবল মাত্র এই কয়েকটা বিষয় অবগত হইয়া আমি সে দিবস বিদায় গ্রহণ করিলাম। যাইবার সময় বলিয়া গেলাম, আবশ্যকমত আসিয়া তাঁহার সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিব।