জীবন বীমা/প্রথম পরিচ্ছেদ

জীবন বীমা।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 প্রায় দশ বার বৎসর অতীত হইল, এক দিবস দিবা ২টার সময় আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী সাহেব আমাকে তাঁহার অফিসে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁহার নিকট গমন করিলাম। তিনি, সেই সময় আমাকে অধিক কিছু না বলিয়া, কেবলমাত্র একখানি পত্র আমার হস্তে প্রদান করিলেন, ও কহিলেন, “এই পত্রখানি পাঠ করিয়া ইহার লেখকের সহিত একবার সাক্ষাৎ করিবেন এবং তাঁহাকে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে চেষ্টা করিবেন।”

 প্রধান কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া ঐ পত্রহস্তে তাঁহার অফিস হইতে বাহিরে আসিলাম। পত্রখানি খোলাই ছিল, উহা কোন বিমা আফিসের প্রধান ইংরাজ-কর্ম্মচারী কর্ত্তৃক ইংরাজীতে লেখা। পত্রখানি ভাল করিয়া পাঠ করিলাম। উহাতে অধিক কথা লেখা ছিল না। যাহা লেখা ছিল, তাহার সার মর্ম্ম এইরূপ;—

 “হরেকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তি আমাদিগের অফিসে দশ হাজার টাকায় তাহার জীবন বীমা করে ও কিছুকাল পরে তাহার জীবনের বীমা-সত্ত্ব ব্রজবন্ধু নামক এক ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করে। ইহার কিছু দিবস পরেই হরেকৃষ্ণ মরিয়া যায়, সুতরাং তাহার জীবন বীমার দশ হাজার টাকা এখন ব্রজবন্ধুর প্রাপ্য। ব্রজবন্ধু ঐ টাকা পাইবার নিমিত্ত অমাদিগের অফিসে আবেদন করিয়াছে ও সার্টিফিকেট প্রভৃতির যাহা কিছু আবশ্যক, তাহাও দিয়াছে; আমরাও তাহাকে ঐ টাকা প্রদান করিতে এক রূপ সম্মতও হইয়াছিলাম; কিন্তু এখন এরূপ প্রকাশ যে, ব্রজবন্ধু জুয়াচুরি করিয়া ঐ টাকা গুলি হস্তগত করিবার চেষ্টায় আছে। আরও শুনিতে পাইতেছি যে, আমাদিগের বীমা অফিসের ন্যায় আরও কয়েক টী বীমা অফিসেও ঐ হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল। ব্রজবন্ধু ঐ সকল অফিস হইতেও অনেক টাকা আদায় করিয়া লইবার চেষ্টায় ছিল। এই সকল কারণে আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি। আপনি একজন উপযুক্ত ও বিশ্বাসী কর্ম্মচারীর দ্বারা এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিয়া দেখুন যে, ব্রজবন্ধু ঐ সকল টাকা প্রাপ্ত হইবার প্রকৃত পাত্র, কি সে প্রকৃতই জুয়াচুরি করিয়া ঐ সকল অর্থ হস্তগত করিতে বিশেষ চেষ্টা করিতেছে। আপনার কর্ম্মচারীর অনু- সন্ধানের উপর নির্ভর করিয়া আমরা কার্য করিব, জর্থাৎ তাহার অনুসন্ধানে যদি সাব্যস্ত হয় যে, ব্রজবন্ধু অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া আমাদিগের নিকট হইতে ঐ টাকা আদায় করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহা হইলে আমরা তাহার উপর ফৌজদারী মােকদ্দমা চালাইয়া যাহাতে ঐরূপ জুয়াচোর বিশেষ দণ্ডে দণ্ডিত হয়, সাধ্যমতে তাহার চেষ্টা করি। আর অনুসন্ধানে যদি ইহাই সাব্যস্ত হয় যে, ব্রজবন্ধু বিধান অনু- সারে ঐ টাকা প্রাপ্ত হইবার প্রকৃত অধিকারী, তাহা হইলে তদণ্ডেই আমরা তাহাকে সমস্ত অর্থ এককালীন প্রদান করিব।”

 প্ত্রখানি পাঠ করিয়া সর্ব্বপ্রথমেই ঐ পত্র-লেখকের সহিত সাক্ষাৎ করিবার আমার প্রয়ােজন হইল। কিন্তু তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইবার পূর্বেই আমার মনে হইল যে, ব্রজবন্ধু যখন ঐ টাকা পাইবার নিমিত্ত যে সকল প্রমাণ প্রয়োগের প্রয়োজন, তাহার সমস্তই প্রদান করিয়াছে, এবং যখন বীমা অফিসও ঐ টাকা প্রদান করিতে প্রস্তুত ছিলেন বলিতেছেন, তখন ইহা যে জুয়াচুরি ঘটনা, তাহা এখন তারা কিরূপ জানিতে পারিলেন। অনেকে বলিয়া থাকেন যে, যখন বীমা অফিসকে একেবারে অনেক টাকা প্রদান করিতে হয়, সেই সময় কিছু না কিছু গােলযোগ বাহির করিয়া যাহাতে ঐ টাকা প্রদান করিতে না হয়, তাহার চেষ্টা করিতে তাহারা ত্রুটী করেন না। দশ হাজার টাকা নিতান্ত কম নহে। এ দেশের কয়জন ব্যক্তি তাহার সারা জীবন উপার্জন করিয়া চরমে দশ হাজার টাকার সংস্থান রাখিয়া যাইতে পারেন! সহস্রের মধ্যে এক ব্যক্তি পাবেন কি না সন্দেহ। 'এত গুলি টাকা একজন দেশীয় লোক সহজে পাইতে বসিয়াছে বলিয়া ত, বিমা কোম্পানি তাহাকে ঐ অর্থ হইতে বঞ্চিত করিবার জন্য আমাদিগের সাহায্য গ্রহণ করিতেছেন না? মনে মনে এইরূপ ভাবেরও একবার উদয় হইয়াছিল, কিন্তু মনের সে ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, আপন মনে রাখিয়াই ঐ অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম, ও পরিশেষে দেখিলাম, আমার মনে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণরূপে ভ্রমাত্মক। পাঠকগণও তাহার প্রমাণ কমে প্রাপ্ত হইবেন।

 আমি পূর্ব্বকথিত বিমা অফিসের প্রধান ইংরাজ-কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, ও তাহাকে তাহার লিখিত পত্রখানিও দেখাইলাম। তিনি পত্র দেখিয়া ও আমার কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার প্রার্থনামত পুলিসের প্রধান সাহেব আমাকেই তাঁহার প্রস্তাবিত বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত প্রেরণ করিয়াছেন। তখন তিনি আমাকে সঙ্গে করিয়া তাঁহার অফিসের একটা নির্জ্জন প্রকোষ্ঠে, প্রবেশ করিলেন, ও ঐ বিষয় সম্বন্ধে যাহা কিছু তাহার বক্তব্য ছিল, তাহার সমস্তই আমাকে কহিলেন। আমি তাঁহার নিকট হইতে সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে অবগত হইয়া, পরিশেষে ঐসম্বন্ধে যে সকল কাগজ পত্র ছিল, তাহা তাহার নিকট হইতে চাহিলাম। সাহেবও সমস্ত কাগজ আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি সেই স্থানে বসিয়াই ঐ সমস্ত কাগজ এক একখানি করিয়া পড়িয়া দেখিলাম, ও উহার মর্ম্ম উত্তমরূপে অবগত হইলাম। ঐ সমস্ত কাগজ বা তাহার মর্ম্ম কি, তাহারও পরিচয় আমি পাঠকগণকে বিস্তারিতরূপে পরে প্রদান করিব।

 ঐ সমস্ত কাগজপত্র দেখিয়া সমস্ত বিষয় অবগত হইলাম সত্য, কিন্তু ব্রজবন্ধু জুয়াচুরি করিয়া ঐ টাকা বাহির করিয়া লইবার চেষ্টা করিতেছে, তাহার কোনরূপ নিদর্শন ঐ সকল কাগজ-পত্র হইতে কিছুমাত্র প্রাপ্ত হইলাম না।

 তখন আমি সাহেবকে কহিলাম, “আপনি আমাকে যে সকল কাগজপত্র প্রদান করিলেন, তাহা দেখিয়া বেশ অনুমান হইতেছে যে, ইহার ভিতর কোনরূপ জুয়াচুরি কাণ্ড নাই। কিন্তু ইহা জুয়াচুরি বলিয়া আপনার বিশ্বাস হইল কি প্রকারে?”

 আমার কথা শুনিয়া, সেই বীমা অফিসের বড় সাহেব আমার হস্তে আর একখানি পত্র প্রদান করিলেন।