জীবন বীমা/দশম পরিচ্ছেদ
দশম পরিচ্ছেদ।
আমি কলিকাতায় আসিয়া জমিদার মহাশয়ের সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিলাম। কৃষ্ণরামকে নানাস্থানে অনুসন্ধান করিয়াও তাহাকে প্রাপ্ত হই নাই শুনিয়া, তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন, ও কহিলেন, তিনিও উহাদিগের অনুসন্ধান পরিত্যাগ করেন নাই, কিন্তু অনুসন্ধান করিয়াও উহারা যে এখন কোথায় আছে, তাহার ঠিক সংবাদ জানিতে পারেন নাই; তবে উহারা যে পশ্চিমের কোন স্থানে অবস্থিতি করিতেছে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তিনি আরও কহিলেন, উহারা যেখানেই থাকুক, দুই দিনে হউক, দশ দিনে হউক, তাহার সন্ধান তিনি পাইবেনই, ও যখন যেরূপ সংবাদ তিনি প্রাপ্ত হইবেন, তখনই সেই সংবাদ তিনি আমাকে প্রদান করিবেন। এই বলিয়া জমিদার মহাশয় সেই দিবস আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।
চারি পাঁচ দিবস মধ্যেই তিনি পুনরায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ও কহিলেন, কৃষ্ণরাম যে এখন কোথায় আছে, তাহা তিনি জানিতে পারেন নাই, কিন্তু তাহার জামাতা যাহাকে তিনি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, তিনি গত কল্য একাকী ফিরিয়া আসিয়াছেন। অপর লোক দ্বারা তিনি তাহার নিকট হইতে কৃষ্ণরামের সংবাদ গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। তাহার জামাতা এখন যে স্থানে অবস্থিতি করিতেছেন, তাহা তিনি অবগত আছেন।
জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আমার মনে অনেক আশার সঞ্চার হইল। ভাবিলাম, তাহার জামাতাকে এখন কোনরূপে হস্তগত করিতে পারিলেই আমদিগের কার্য্য অনায়াসেই সিদ্ধ হইবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, আমি তথনই সেই জমিদার মহাশয়ের সঙ্গে তাহার উদ্দেশে গমন করিলাম। ব্রজবন্ধুর বাড়ীর নিকটেই কৃষ্ণরামের জামাতা অবস্থিতি করিতেছিলেন, সেইস্থানে গমন করিয়া তাহাকে প্রাপ্ত হইলাম; ও তাহাকে কৃষ্ণরামের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সে প্রথমত, কৃষ্ণরাম সম্বন্ধে সমস্ত কথাই অস্বীকার করিল, পরে কহিল, তাহার শ্বশুর যে কোথায় আছেন, তাহা তিনি অবগত নহেন। অনেক দিবস তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। যে স্থানে তিনি কর্ম্ম করেন, সম্ভবত সেই স্থানেই তিনি আছেন। কারণ সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া কেবলমাত্র তাহার মনিবের বাড়ী ভিন্ন অপর কোনও স্থানে প্রায়ই তিনি গমন করেন না।
জামাতার কথা শুনিয়া বুঝিলাম যে, তিনি আগাগোড়া সমস্তপই মিথ্যা কথা কহিতেছেন। সুতরাং ঐ স্থানে তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত নহে, মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, তাহাকে আমার সঙ্গে থানায় আসিতে কহিলাম। বলা বাহুল্য, প্রথমতঃ তিনি আমার সহিত আসিতে অসম্মত হইলেন, কিন্তু যখন তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, যদি সহজে তিনি আমার সহিত আগমন না করেন, তাহা হইলে আমি তাহাকে ধৃত করিয়া অনায়াসেই লইয়া যাইব, তখন তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, আমার সহিত থানায় আগমন করিলেন।
থানায় অসিয়া আমি তাহাকে অনেক বুঝাইয়া বলিলাম, কিন্তু তিনি আমার কোন কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিলেন না। পরিশেষে পুষ্কর ও নৈমিষারণ্যের যে যে স্থানে তাহারা অবস্থান করিয়াছিলেন, কহিলাম। আরও কহিলাম, ইহাতেও যদি তিনি অস্বীকার করেন, তাহা হইলে তাহাকে সঙ্গে করিয়া পুনরায় সেই সেই স্থানে লইয়া যাইব। এই কথা শুনিয়াও তিনি স্পষ্ট কোন কথা কহিলেন না, কখন একেবারে অস্বীকার করিলেন, কখন বা ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন, কিন্তু সমস্ত দিবসের মধ্যে তাহার নিকট হইতে স্পষ্ট কোন কথা প্রাপ্ত হইলাম না।
যে সময় প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল যে, কৃষ্ণরাম এই জুয়াচুরির প্রধান অভিনেতা ও তিনি পলায়ন করিয়া কোন স্থানে লুকাইয়া আছে, সেই সময় তাহাকে ধরাইয়া দিবার নিমিত্ত বীমা অফিস এক সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক প্রদান করিতে সম্মত হইয়া আমাদিগের সর্ব প্রধান কর্মচারীকে পত্র লিখিয়াছিলেন। তিনি ঐ মর্ম্মে এক বিজ্ঞাপন বাহির করিয়া দেন। যখন দেখিলাম, জামাতাকে কোনরূপেই হস্তগত করিতে পারিলাম না, তখন তাহাকে ঐ সহস্র মুদ্রার লোভ প্রদর্শন করিলাম ও কহিলাম, কৃষ্ণরাম পলায়ন করিয়া যে স্থানেই থাকুক না কেন, তিনি নিশ্চয়ই ধৃত হইবেন ও উপযুক্ত দণ্ডও প্রাপ্ত হইবেন। কিন্তু লাভের মধ্যে এই হইবে যে, কৃষ্ণরামকে পলায়ন করিবার সহায়তা করা অপরাধে তোমার উপরও এই মোকদ্দমা রুজু হইবে, ও যে যে স্থানে তুমি তাহার সহিত অবস্থিতি করিয়াছিলে, সেই সেই স্থানের সাক্ষ্য দ্বারা অনায়াসেই প্রমাণ করিতে পারি যে, তুমি তাহার সহিত স্থানে স্থানে গুপ্তভাবে বাস করিয়াছ ওতাহাকে গুপ্তভাবে রাখিবার চেষ্টা করিয়াছ; সুতরাং তুমিও নিষ্কৃতি পাইবে না। কিন্তু তুমি অবগত আছ যে, যে ব্যক্তি কৃষ্ণরামকে ধরাইয়া দিবে, সেই ব্যক্তি সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইবে। যখন তুমি জানিতে পারিতেছ যে, কৃষ্ণরাম ধৃত হইতে বাকী থাকিবে না, তখন হেলায় ঐ সহস্র মুদ্রা পরিত্যাগ করা তোমার কর্তব্য নহে। তোমার অবস্থা আমি বিশেষ অবগত আছি। কাল কি খাইবে তাহার সংস্থান তোমার নাই। এরূপ অবস্থায়, আমার বিবেচনায় তোমার এই সহস্র মুদ্রা পরিত্যাগ করা কোনরূপেই কর্ত্তব্য নহে। তদ্ব্যতীত আমি নিশ্চয়-বলিতে পারি যে, যদি তুমি আমাদিগকে সাহায্য কর, তাহা হইলে আমরাও তোমার নামে কোন মোকদ্দমা রুজু করিব না। তোমার জেল হবে না, অথচ এককালীন সহস্র মুদ্রা পাইলে তোমার কত উপকার হইবে।
আমি উহাকে উপরোক্ত রূপ বুঝাইলে পর, সেই গুণধর জামাতা সহস্র মুদ্রার লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া, সমস্ত কথা আমার নিকট স্বীকার করিল, ও যে যে স্থানে উহারা গমন করিয়া, ছিল, তাহা সমস্তই আমাকে বলিল। আমি দেখিলাম, যে যে স্থানে আমি উহাদিগের সন্ধান পাইয়াছিলাম, উহারা প্রকৃতই সেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিল। উহাদিগের যাতায়াতের সমস্ত খরচ ব্রজবন্ধু অর্পণ করিয়াছিলেন, কিন্তু সেই খরচ ফুরাইয়া যাওয়ায়, কৃষ্ণরামকে এক স্থানে রাখিয়া টাকার নিমিত্ত তিনি এই স্থানে আগমন করিয়াছেন। ব্রজবন্ধুর নিকট হইতে উপযুক্ত পরিমাণে অর্থ লইয়া, তাহারা আরও দূরদেশে গমন করিয়া, সেই স্থানে কিছু দিবস লুকাইতভাবে বাস করিবেন, এইরূপ স্থির করিয়াছেন।
জামাতার নিকট এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া, তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেই রাত্রেই আমরা পুনরায় পশ্চিমাভিমুখে গমন করিলাম। গুণধর জামাতা আমাদিগের সহিত আর কোনরূপ কপটতা না করিয়া, অর্থলোভে আমাদিগকে যথাস্থানে লইয়া গিয়া, কৃষ্ণরামকে দেখাইয়া দিল। এটোয়া নামক স্থানের এক প্রান্তে একখানি ঘরভাড়া লইয়া, সেই স্থানে তিনি অপেক্ষা করিতেছিলেন। বলা বাহুল্য, কৃষ্ণরামকে দেখিবামাত্রই তাহাকে ধৃত করিলাম ও আমার সহিত, অফিসের যে লোক গমন করিয়াছিলেন, তিনি তাহাকে হরেকৃষ্ণ বলিয়া সনাক্ত করিলেন ও সেই স্থান হইতে আমাদিগের প্রধান কর্মচারীর নামে তার প্রেরণ করিলে অপর কর্মচারীর দ্বারা তিনিও ব্রজবন্ধুকে ধৃত করইলেন।
সময় মত আমিও হরেকৃষ্ণ ওরফে কৃষ্ণরামকে লইয়া কলিকাতায় উপস্থিত হইলাম। অফিসের সকলেই, ও যে ডাক্তার তাহাকে চিকিৎসা করিয়াছিলেন ও জানবাজারের যে বাড়ীতে তিনি বাস করিতেন সেই বাড়ীর সরকার প্রভৃতি সকলেই তাহাকে হরে, কৃষ্ণ বলিয়া চিনিতে পারিলেন ও অফিসের সকলেই মৃত হরেকৃষ্ণকে জীবিত অবস্থায় দেখিতে পাইয়া বিস্মিত হইলেন।
বলা বাহুল্য, ব্রজবন্ধু ও কৃষ্ণরাম এই ভয়ানক জুয়াচুরি মোকদ্দমায় আসামী হইয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলেন, তিনিও উহাদিগকে দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেই স্থান হইতে জুরির বিচারে তাহার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন। গুণধর জামাতা এই মোকদ্দমায় শ্বশুরের বিপক্ষে অর্থলোভে সাক্ষ্য প্রদান করিতে ক্রটা করিলেন না। বলা বাহুল্য, মোকদ্দমা শেষ হইলে, তিনি প্রস্তাবিত পারিতোষিক প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ধন্য অর্থ।
সমাপ্ত।
- অগ্রহায়ণ মাসের সংখ্যা
"ছবি”
যন্ত্রস্থ।