জীবন বীমা/নবম পরিচ্ছেদ

নবম পরিচ্ছেদ।


 আমরা প্রথমতঃ বৈদ্যনাথে গমন করিলাম। সেই স্থানে দুই তিন দিবস এক পাণ্ডার বাটীতে যাত্রীভাবে অবস্থান করিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোথাও কৃষ্ণরাম ও তাহার জামাতার সন্ধান পাইলাম না। অগত্যা সেই স্থান ত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম।

 বৈদ্যনাথ হইতে কাশীধামে যাত্রা করিলাম। কাশধাম বাঙ্গালী পাঠকগণের নিকট যেরূপ পরিচিত, তাহাতে ঐ স্থানের বিস্তৃত বিবরণ এই স্থানে বর্ণনা করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। আমি ঐ স্থানের জনৈক পাণ্ডার সাহায্য গ্রহণ করিয়া বাঙ্গালীটোলা প্রভৃতি যে যে স্থানে বাঙ্গালীগণ বাস করিয়া থাকে, সেই সেই স্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম। দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকা, কেদারের প্রভৃতি যে সকল ঘটে সকলকেই স্নান করিবার জন্য আসিতে হয়, যে সকল স্থানে সন্ন্যাসী সাধুগণ অবস্থান, কবিয়া থাকেন, বিশ্বনাথ, অন্নপুর্ণা, কালভৈরব প্রভৃতি যে সকল দেবতা স্থানে হিন্দুমাত্রেই গমন করিয়া থাকেন, সেই সকল স্থান তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলাম, কোথাও, তাহাদের সন্ধান পাইলাম না। ক্রমাগত চারি পাঁচ দিবস অনুসন্ধানের পর বুঝিতে পারিলাম, তাহারা ঐ স্থানে আসে নাই। সুতরাং ঐ স্থান হইতে বহির্গত হইয়া অযোধ্যায় উপস্থিত হইলাম।

 শ্রীরামচন্দ্রের লীলাভূমি পুণ্যময় অযোধ্যাধামে উপস্থিত হইয়া, যে যে স্থানে শ্রীরামচন্দ্রের কীর্তিকলাপ এখনও বর্তমান রহিয়াছে, যে যে স্থানে তীর্থযাত্রী-হিন্দুগণ গমন না করিয়া সেই স্থান হইতে প্রত্যাগমন করিতে পারেন না,—যে যে স্থানে অপরদেশবাসীগণ অবস্থিতি করিয়া থাকেন, সেই সকল স্থান তত্রত্য পাণ্ডাগনের সাহায্যে তিন দিবস কাল উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোথাও তাহাদের সন্ধান পাইলাম না। অগত্যা সেই স্থান। হইতে প্রয়াগতীর্থে গমন করিলাম।

 প্রয়াগে উপস্থিত হইয়া, যেখানে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থল সেই স্থানে ও তাহার কিয়ৎ দূরবর্তী এলাহাবাদ সহরের যে যে স্থানে বাঙ্গালীগণের বাস করিবার সম্ভাবনা, সেই সেই স্থানে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কোথাও তাহাদের সন্ধান পাইলাম না। প্রয়াগ হইতে পুষ্কর তীর্থে গমন করিতে মনস্থ করিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। ঐ স্থানে গমন করিতে হইলে অগরা হইয়া যাইতে হয়। ঐ আগরায় মুসলমান রাজত্বের চিহ্ন প্রস্ত-নির্ম্মিত কেল্লা, জুম্মা মসজিদ ও দুগ্ধ-ফেমির খেত-প্রস্তর নির্ম্মিত তাজমহল এখনও বর্তমান। ঐ স্থান অতিক্রম করিয়া ক্রমে আজমির সহরে উপনীত হইলাম। আজমির হইতে পুর পাঁচ ক্রোশ ব্যবধান মাত্র-পাহাড়ের উপর দিয়া গমন করিতে

হয়। ঐ স্থানে গমন করিবার পথ পূর্বে যেরূপ দুষ্কর ছিল, এখন সেরূপ নাই। ইংরাজ রাজের অনুকম্পায় ঐ পাহাড়ের উপর দিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া-নামিয়া উঠিয়া এক রাস্তা প্রস্তুত হইয়াছে। ঐ রাস্তা দিয়া এক টাঙ্গা ও ঘোড়ার গাড়ী গমনাগমনের বেশ সুবিধাও হইয়াছে। আজমিরের যে স্থানে একা ও ঘোড়ার গাড়ী প্রভৃতি পুষ্করে যাইবার নিমিত্ত পাওয়া যায়, সেই স্থানে গমন করিয়া একটু অনুসন্ধান করিলাম ও একজন এক্কা-চালকের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, কৃষ্ণরামের আকৃতির ন্যায় একটা লোক অপর আর একজনের সহিত তাহার এক্কায় উঠিয়া কিছু দিবস হইল পুস্করে গমন করিয়াছিল, কিন্তু তাহাদিগকে প্রত্যাগমন করিতে আর সে দেখে নাই। যে স্থানে তাহারা তাহার একা হইতে অবতরণ করে, সে তাহাও দেখাইয়া দিতে পারে।

 ঐ এক্কা-চালকের নিকট হইতে এই সংবাদ পাইয়া, তাহারই একা ভাড়া করিয়া উহাতে আরোহণ পূর্বক আমরা পুষ্কর তীর্থে উপস্থিত হইলাম। যে স্থানে ঐ এক-চালক পূর্ব্বকথিত লোকদিগকে নামাইয়া দিয়াছিল, আমাদিগকেও সেই স্থানে নামাইয়া দিল। একা হইতে অবতীর্ণ হইবার পূর্বেই, তীর্থ স্থানের নিয়মানুযায়ী অনেক পাণ্ডা আসিয়া আমাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিল ও সকলেই আমাদিগের পরিচয় লইতে আরম্ভ করিল। আমি তাহাদিগকে কহিলাম, কিছু দিবস পূর্বে আমার পরিচিত দুই ব্যক্তি এই স্থানে আসিয়াছিলেন, তাহারা এখন এই স্থানে আছেন, কি এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না। তাহার এই স্থানে আসিয়া যে পাণ্ডার বাটীতে অবস্থিতি করিয়াছিলেন, আমরাও সেই পাণ্ডার বাড়ীতে অবস্থিতি করিব। এই বলিয়া, কৃষ্ণরাম ও তাহার জামাতার যেরূপ আকৃতি তাহা তাহা, দিগের নিকট বর্ণন করিলাম, কিন্তু ঐরূপ ব্যক্তি ঐ স্থানে আসিয়া যে কোন স্থানে অবস্থিতি করিয়াছিলেন, তাহা তাহাদিগের মধ্যে কেহই স্থির করিয়া বলিতে পারিল না।

 যখন দেখিলাম, ঐ সকল পাণ্ডাগণের নিকট হইতে তাহা দিগের কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গেল না, তখন আমার পূর্ব পরি চিত এক পাণ্ডার বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বলা বাহুল্য, সরকারী কার্য্য উপলক্ষে ঐ স্থানে আমি ইতিপূর্বে আরও দুই একবার আসিয়াছিলাম ও ঐ পাণ্ডার বাটীতেই অবস্থিতি করিয়াছিলাম। যে বাড়ীতে আমাদিগের বাসা ঠিক হইল, তাহা পুষ্কর কুণ্ডের পার্শ্বেই অবস্থিত। |

 যে গ্রামখানি পুষ্কর গ্রাম বলিয়া বিখ্যাত, তাহার মধ্যে একটা বৃহৎ পুষ্করিণী অথবা ক্ষুদ্র সরোবর আছে। উহাকেই পুরকুণ্ড কহিয়া থাকে। কথিত আছে, ব্রহ্মার যজ্ঞকালীন এই কুণ্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ও এই স্থানে বসিয়াই ব্রহ্মা তাঁহার মহা যজ্ঞ সমাপন করেন—এখন ইহাই একটা হিন্দুদিগের মহৎ তীর্থরূপে পরিগণিত। এই কুণ্ডে অবগাহন করিয়া মান তর্পণাদি করাই হিন্দু দিগের প্রধান কার্য্য। কিন্তু আজকাল ঐ কুণ্ডের মধ্যে যেরূপ শত সহস্র কুম্ভিরের বাসস্থান হইয়াছে, তাহাতে নির্ভিক চিত্তে ঐ কুণ্ডে অবগাহন করা বড়ই দুঃসাধ্য। যাহা হউক, ঐ স্থানে অবস্থিতি করিয়া আমার পুরাতন পাণ্ডার সাহায্যে কৃষ্ণরাম ও তাহার জামাতার অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। দুই তিন দিবস অনুসন্ধান করিবার পর জানিতে পারিলাম, তাহারা ঐ স্থানে একটা পাণ্ডার গৃহে কয়েক দিবস বাস করিয়াছিল, ও সেই পাণ্ডার নিকট হইতে মথুরা, বৃন্দাবন, ও নৈমিষারণ্যের অবস্থা জানিয়া লয়, কিন্তু তাহারা যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহা কেহই বলিতে পারিল না; এমন কি, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় তাহারা পাণ্ডাকেও কোন কথা বলিয়া যায় নাই। হঠাৎ এক রাত্রে সেই স্থান হইতে নিরুদ্দেশ হয়। অনুসন্ধান করিয়া ইহাও জানিতে পারা যায় না যে, তাহারা পুষ্কর হইতে বহির্গত হইয়া পুনরায় অজমীরের দিকে গমন করিয়াছে কি না? কারণ, যে সকল ব্যক্তি তীর্থ বা অপর কোন উপলক্ষে দূরদেশ হইতে পুষ্করে গমন করিয়া থাকেন, তাহাদিগকে আজমীর হইয়া যাইতে হয় ও পুনরায় সেই রাস্তা দিয়া প্রত্যাগমন করিতে হয়। কারণ ঐ রাস্তা ভিন্ন সুবিধাজনক আর রাস্তা নাই। পুষ্কর হইতে তাহাদিগের প্রস্থানের কোনও সংবাদ প্রাপ্ত না হইয়া, উহার নিকটবর্তী স্থান সমুদয় অর্থাৎ যে যে স্থানে সন্ন্যাসী প্রভৃতি মহাত্মাগণ অবস্থান করিয়া থাকেন, সেই সকল স্থানে একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম; কোনও ফল হইল না।

 নিকটেই সাবিত্রী পাহাড়। ঐ পাহাড়ের উপর মন্দির মধ্যে সাবিত্রী দেবীর মূর্তি স্থাপিত আছে। ঐ পর্বতারোহণ করিয়া সেই স্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না।

 ঐ সাবিত্রী পর্বতের সন্নিকটে গৌতম আশ্রম ও তাহার নিকটবর্তী গঙ্গাকুণ্ড, নাগকুণ্ড, সূর্যকুণ্ড প্রভৃতি স্থান সকলে তাহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম, সমস্তই বৃথা হইল। ঐ সমস্ত স্থান হইতে বহির্গত হইয়া জমদগ্নি আশ্রম, বামদেব আশ্রম, অগস্ত্য অশ্রম, দধিচি অশ্রম, লোমশ আশ্রম, প্রভৃতি স্থান সকল দেখিলাম! ঐ সকল পুরাতন আশ্রম গিরিগুহার মধ্যে স্থাপিত। ঐ সকল স্থান দেখিলে বোধ হয়, অতি অল্প দিবস পূর্বে ঐ সকল গুহা মহাত্মাদিগের আশ্রমরূপে পরিগণিত ছিল।

 সাবিত্রী পাহাড়ের কিয়দ্দুর দক্ষিণে অজগধেশ্বর মহাদেবের মন্দির। উত্তরে বৈজনাথ মহাদেব। পশ্চিমে নন্দকেশৱ মহাদেব। এই সকল স্থানও উত্তমরূপে দেখিলাম, নিকটবর্তী নন্দিগ্রাম গকুল প্রভৃতি স্থানেও অনুসন্ধান করিলাম। পাপমোচিনি পাহাড়ের উপর উঠিয়াও তাহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোন স্থানেই তাহাদিগের কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না।

 পুষ্কর গ্রামের মধ্যবর্তী বাদশা আরঙ্গজেবের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের নিকটবর্তী স্থান সকল, গোয়ালিয়র রাজের প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মা মন্দিরের নিকটবর্তী স্থান সকল, বরাহমূর্ত্তি মন্দির ও বদরিনারায়ণ মন্দির প্রভৃতি অপরাপর দেবালয় সকলের সন্নিকটবর্তী প্রদেশ সকলও তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোন স্থানে তাহাদিগের সন্ধান না পাইয়া ক্ষুন্নমনে আপন স্থানে প্রত্যাবর্তন করিলাম।

 ঐ স্থানে আর অধিক কাল বিলম্ব করা নিষ্প্রয়োজন মনে করিয়া, সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম ও ক্রমে মথুরা ও বৃন্দাবনে গমন করিলাম। ঐ সকল স্থানে আমরা সাধ্যমত অনুসন্ধান করিলাম সত্য, কিন্তু কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। ইহার পর গমন করিলাম নৈমিষারণ্যে। শাণ্ডিল ষ্টেশনে অবতরণ করিয়া, শকটজানে দুর্গম রাস্তা অহিবাহিত করিয়া, সেইস্থানে গমন করিতে হয়। এইস্থানে চক্রপাণী তীর্থ স্থাপিত আছে। কথিত আছে, জগতের সমস্ত ঋষির একত্র সমাগম হইয়া যে সময় এর

মহা সভা হইয়াছিল, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ তাহাদিগের পাণীয় জলের সংস্থানের নিমিত্ত পৃথিবী ভেদ করিয়া এই চক্রপাণী জলাশয় প্রস্তুত করিয়া দেন; ঐ স্থান হইতে এখনও প্রস্রবণের ন্যায় শীতল জল বহির্গত হইয়া, অনবরত প্রবাহিত হইতেছে ও উহা হইতে একটা নদীর সৃষ্টি হইয়াছে। ঐ স্থানের পাণ্ডাগণের নিকট হইতে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, কৃষ্ণরাম ও তাহার জামাতার আকৃতি অনুযায়ী দুই ব্যক্তি সেইস্থানে আসিয়া পাঁচ, সাত দিবস অতিবাহিত করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছে। ঐ স্থান হইতে যে তাহারা কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত বিস্তর অনুসন্ধান করিলাম কিন্তু কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত না হইয়া নিতান্ত ক্ষুন্নমনে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম ও পথিমধ্যে নানাস্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করিয়া পরিশেষে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।