জীবন বীমা/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।


 ব্রজবন্ধুর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, আমি সে দিবসের মত তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। পরদিবস বীমা অফিসে গিয়া অনুসন্ধান করিয়া আমি জানিতে পারিলাম যে, হরেকৃষ্ণের জীবন বীমা করা ও পরিশেষে তাহা ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করা সম্বন্ধে ব্রজবন্ধু আমাকে যাহা যাহা বলিয়াছিল, তৎসমস্তই প্রকৃত অর্থাৎ তাহার জীবন বীমা করিবার সময় অফিসের অনেকেই তাহাকে দেখিয়াছিল, অফিসের ডাক্তার তাহার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়াছিল, ইহাদিগের অনেকের স্বাক্ষর ঐ বীমাপত্রে ও তাহার সংসৃষ্ট কাগজপত্রে আছে। হরেকৃষ্ণ যে ব্রজবন্ধুর নিকট তাহার বীমা-পত্র বিক্রয় করে, তাহাও ঐ অফিসের কর্মচারীগণের জ্ঞতানুসারে হয় ও অফিসের প্রধান ইংরেজ কর্মচারী ও এই জীবনবীমা বিক্রয়ের একজন সাক্ষী। অফিসের প্রধান ইংরেজ কর্মচারী ও অপরাপর কর্মচারিগণ শপথ করিয়া এখনও বলিতে প্রস্তুত রে, যে হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই হরেকৃষ্ণই ঐ জীবন-বীমা ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করিয়াছে।

 এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে অনুসন্ধেয় বিষয়টা আমাকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া লইতে হইয়াছিল। প্রথম যে হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই হরেকৃষ্ণ অর্থাৎ সেই ব্যক্তি ব্রজ বন্ধুর নিকট জীবন-বীমা বিক্রয় করিয়াছিল কি না? অফিসে অনুসন্ধান করিয়া আমার অনুসন্ধানের প্রথম অংশ শেষ হইয়া গেল; বুঝিতে পারিলাম, ইহাতে কোনরূপ জুয়াচুরি নাই।

 এখন আমি আমার অনুসন্ধানের দ্বিতীয় অংশে হস্তক্ষেপ করিলাম। উহা আর কিছুই নহে, হরেকৃষ্ণ নামে যে ব্যক্তি তাহার জীবন-বীমা করিয়া পরিশেষে ব্রজর নিকট ঐ জীবন-বীমা বিক্রয় করে, সেই ব্যক্তিই প্রকৃত মরিয়াছে কি না? আর যদি সে প্রকৃতই মরিয়া না থাকে—তাহা হইলে সে এখন কোথায় আছে?

 আমার অনুসন্ধানের দ্বিতীয় অংশে হস্তক্ষেপ করিয়া প্রথমেই জানবাজারের যে বাড়ীতে হরেকৃষ্ণ বাস করিত, সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, ঐ বাড়ীতে তালা বন্ধ ও উহাতে লেখা আছে যে, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, ঐ বাড়ীর সত্বাধিকারী একজন হাইকোর্টের উকিল, ঐ বাড়ীর সন্নিকটেই তাঁহার বাড়ী। তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি নিজে আমার জিজ্ঞাস্য বিষয় কিছুই বলিতে পারিলেন না। কহিলেন, তাঁহার সরকারের সহিত সাক্ষাৎ করিলে তিনি সমস্ত কথায় উত্তর দিতে সমর্থ হইবেন। সে দিবস তাহার সরকারের সহিত সাক্ষাৎ হইল না, কিন্তু পরিশেষে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে জানিতে পারিলাম যে, হরেকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তি ছয় মাসের এগ্রিমেণ্ট লিখিয়া দিয়া-ঐ বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন, পরে ব্রজবন্ধু নামক এক ব্যক্তি কখন কখনও ঐ বাড়ীতে হরেকৃষ্ণের নিকট আসিত, ইহাও তিনি দেখিয়াছেন। তিনি শুনিয়াছিলেন, হরেকৃষ্ণ ঐ বাড়ীতে পীড়িত হন, ডাক্তার আসিয়া তাহার চিকিৎসা করেন ও পরিশেষে ব্রজন্ধু তাহাকে ঐ বাড়ী হইতে লইয়া যান, কিন্তু তিনি হরেকৃষ্ণের পীড়িত অবস্থায় তাহাকে দেখেন নাই, ডাক্তার আসিবার সময় বা স্থানান্তরিত করিবার সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। হরেকৃষ্ণ ঐ বাড়ী হইতে স্থানান্তরিত হইবার তিন চারি দিবস পরে ব্রজবন্ধুর নিকট হইতে তিনি জানিতে পারেন যে, হরেকৃষ্ণ মরিয়া গিয়াছে। যে ঘরে হরেকৃষ্ণ বাস করিতেন, সেই ঘরে তাহার অতি সামান্যই জিনিস পত্র ছিল, ঐ সমস্ত জিনিস ঐ বাড়ী ভাড়ার নিমিত্ত আটক করিয়া রাখা হইয়াছে।

 হরেকৃষ্ণের দুইজন ভৃত্য সদা সর্বদা ঐ বাড়ীতে বাস করিত। হরেকৃষ্ণের সঙ্গে সঙ্গে তাহারাও ঐ বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহার পর উহাদিগকে আর তিনি দেখেন নাই।

 সরকারের নিকট হইতে এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া ঐ বাড়ী ভাড়া লইবার কালীন হরেকৃষ্ণ যে এগ্রিমেণ্ট লিখিয়া দিয়াছিল, তাহা তাহার নিকট হইতে চাহিয়া লইলাম। দেখিলাম, উহাতে হরেকৃষ্ণের সহি আছে। তাহার জীবন-বীমা ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করিবার কালীন তাহাতে তিনি যে সহি করিয়াছিলেন ও বীমা অফিসের অপরাপর কাগজ পত্রে তাহার যে সকল স্বাক্ষর ছিল, তাহার সহিত উহা মিলাইয়া দেখিলাম। দেখিলাম, উহা এক জনেরই সহি সুতরাং বুঝিতে পারিলাম, যে হরেকৃষ্ণ আপন জীবনবীমা করিয়া পরিশেষে ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করিয়াছিল, সেই হরেকৃষ্ণই জানবাজারের ঐ বাড়ী ভাড়া করিয়া তথায় কয়েক মাস কাল অতিবাহিত করিয়াছিল।

 ইহার পর যে ডাক্তার জানবাজারের বাড়ীতে হরেকৃষ্ণের চিকিৎসা করিয়াছিলেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি ব্রজবন্ধুর একজন পরিচিত ডাক্তার, তাঁহার বাড়ীতে মধ্যে মধ্যে তিনি চিকিৎসাও করিয়া থাকিন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম, ব্রজবন্ধু বাবুই তাহাকে ডাকিয়া জানবাজারের বাড়ীতে লইয়া যায়, সেই স্থানে তিনি হরেকৃষ্ণকে দেখেন ও তাহার ঔষধের ব্যাখাও করিয়া দেন। তিনি তিন বার ঐ বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন। ঐ ব্যক্তিকে তিনি ইতিপূর্বে আরও দুই একবার ব্রজবন্ধুর বাড়ীতে দেথিয়াছেন। উহার নাম তিনি পূর্ব হইতে অবগত ছিলেন না, জানবাজারের বাড়ীতেই তিনি প্রথম উহা নাম অবগত হন। হরেকৃষ্ণ তীরস্থ হইবার ঠিক পূর্বে তিনি তাহাকে দেখেন নাই, উহার দুই এক দিবস পরে ব্রজবন্ধু তাহাকে ডাকিয়া গঙ্গাতীরে লইয়া যান, সেই স্থানে তিনি উপস্থিত হইয়া জানিতে পারেন যে, হরেকৃষ্ণ মরিয়া গিয়াছে, তিনি তাহার মৃতদেহ দর্শন করেন, ও পরিশেষে একখানি সাটিফিকেট লিখিয়া দেন।

 ডাক্তার বাবুর নিকট এই সকল কথা অবগত হইয়া তাহাকে বিশেষ করিয়া আরও দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কোন স্থানে গিয়া তাহার মৃতদেহ দর্শন করেন?।

 ডাক্তার। কাশীমিত্রের ঘাটে।

 আমি। কাশীমিত্রের ঘাটের যে স্থানে মৃতদেহ দাহ হয়, সেই স্থানে গিয়া কি আপনি উহার মৃতদেহ দর্শন করিয়াছিলেন?

 ডাক্তার। না।

 আমি। তবে কোথায়?

 ডাক্তার। কাশী মিত্রের ঘাটের একটু দূরে যে একটা ঘর আছে, সেই ঘরের ভিতর।  আমি। সেই স্থানে তো অনেক ঘর আছে। উহার কোন্ ঘরে?

 ডাক্তার। কোন ব্যক্তির মৃত্যু হইবার পূর্বে যদি তাহাকে তীরস্থ করা হয়, ও পরিশেষে দেখা যায় যে, তাহার মরিতে দুই এক দিবস বিলম্ব আছে, তাহা হইলে হিন্দুদিগের মধ্যে প্রায় অনেকেই তাহাকে আর বাড়ীতে ফিরিয়া আনেন না। ঐ সকল ব্যক্তিগণের সেই স্থানে রাখিবার নিমিত্ত একটা ঘর আছে, আমি সেই ঘরের মধ্যেই হরেকৃষ্ণের মৃতদেহ দর্শন করিয়াছিলাম।

 আমি। আপনি কোন সময় ঐ মৃতদেহ দেখিয়াছিলেন? রাত্রিকালে না দিনে?

 ডাক্তার। দিনে নহে, রাত্রিকালে।

 আমি। তখন রাত্রি আন্দাজ কত হইবে?

 ডাক্তার। বোধ হয় ৯টার কম হইবে না।

 আমি। আমি ঐ ঘরটী ইতিপূর্বে দেখিয়াছি, উহা একটা অন্ধকারময় ঘর, না?

 ডাক্তার। সেইরূপ বলিয়াই বোধ হয়, আমি রাত্রিকালে সেই স্থানে গিয়াছিলাম।

 আমি। আপনি যখন সেই স্থানে গমন করেন, সেই সময় ঐ মৃতদেহ কিরূপ অবস্থায় দেখিতে পান?

 ডাক্তার। উহা একখানি চারি পায়ার উপর রক্ষিত ও একখানি বস্ত্র দ্বারা আবৃত ছিল।

 আমি। ঘরে কোন আলো ছিল কি?

 ডাক্তার। একটী মেটে প্রদীপ টিপি টিপি করিয়া জ্বলিতে ছিল

 আমি। ঐরূপ অবস্থায় ও ঐরূপ আলোক সাহায্যে আপনি ঐ মৃতদেহ দেখিয়াছিলেন?

 ডাক্তার॥ আমি। তাহা হইলে আপনি ঠিক বলিতে পারেন কি যে, ইতিপূর্বে আপনি যে হরেকৃষের চিকিৎসা করিয়াছিলেন, ঐ মৃতদেহ সেই হরেকৃষ্ণের?

 ডাক্তার। তাহা ভিন্ন আর কাহার মৃতদেহ হইবে?

 আমি। আপনি মনে করিয়া বলুন দেখি, কাহা কর্তৃক ও কিরূপ ভাবে আপনাকে ঐ মৃতদেহ দেখান হয়?

 ডাক্তার। ব্রজবন্ধু বাবু আমাকে সঙ্গে লইয়া ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করেন ও তিনিই তাহার বস্ত্র উদঘাটিত করিয়া আমাকে কহেন, দেখুন মহাশয়! এই হরেকৃষ্ণের মৃতদেহ। আমি আলোটা যে স্থানে জ্বলিতেছিল, সেই স্থান হইতে আনিয়া আপনি বিশেষরূপ পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন কি?

 ডাক্তার। না, কারণ আমার সন্দেহের কোন কারণ সেই সময় উপস্থিত হয় নাই। বিশেষ ব্রজবন্ধু বাবুর কথায় আমার কোনরূপ অবিশ্বাস করিবার কারণ ছিল না।