জীবন বীমা/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 ডাক্তার বাবুর নিকট হইতে এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া, বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি হরেকৃষ্ণ বা ব্রজ বন্ধুকে পূর্বে হইতে জানিতেন না, হরেকৃষ্ণকে তীরস্থ করা হইলে পর, ব্রজবন্ধু তাহাকে গঙ্গাতীরে ডাকিয়া অনেন ও তাহারই অনুরোধক্রমে তিনি হরেকৃষ্ণকে তিন চারিবার দেখিয়া যান। যে ব্যক্তিকে তীরস্থ করা হইয়াছে, তাহার কোনরূপ বঁচিবার সম্ভাবনা না থাকিলেও, কেবল ব্রজবন্ধুর অনুরোধক্রমে এবং ব্যবসার খাতিরে তিনি হরেকৃষ্ণের জীবিতাবস্থায় ও পরিশেষে তাহার মৃত অবস্থায় তাহাকে দর্শন করেন এবং মৃত্যুর পর ব্রজবন্ধুর অনুরোধে একখানা সাটিফিকেট এই মর্মে প্রদান করেন যে, তিনি হরেকৃষ্ণকে জীবিত অবস্থায় ও মৃত্যুর পর দেখিয়াছেন এবং তিনি শপথ করিয়া বলিতে প্রস্তুত যে, যে হরেকৃষ্ণকে গঙ্গাতীরে তিনি জীবিত অবস্থায় দেখিয়াছেন, সেই হরেকৃষ্ণের মৃতদেহও তিনি তথায় দর্শন করিয়াছেন।

 আমি এ সম্বন্ধে যতদূর অনুসন্ধান করিলাম, তাহাতে আরো বুঝিতে পারিলাম, যে হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই হরেকৃষ্ণই তাহার জীবন বীমা ব্রজবন্ধুর নিকট বিক্রয় করে, সেই হরেকৃষ্ণই জানবাজারের বাড়ীতে বাস করিত ও তিনিই সেই স্থানে পীড়িত হন। আরও বুঝিতে পারিলাম যে, হরেকৃষ্ণনামক যে ব্যক্তিকে তীরস্থ করা হইয়াছিল, সে মরিয়া গিয়াছে।  এখন দেখিতে হইবে যে, জানবাজারের সেই হরেকৃষ্ণ ও গঙ্গাতীরের হরেকৃষ্ণ এক ব্যক্তি কি ভিন্ন ব্যক্তি। এই বিষয়টুকু যে পর্যন্ত ঠিক জানিতে পারা না যাইকে সেই পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান শেষ হইবে না।

 আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, ব্রজবন্ধু সহরতলির একজন ব্যবসায়ী ও জমিদার। আরও বলিয়াছি যে, যে স্থানে তাহার বাসস্থান, তাহার নিকটবর্তী স্থানে আর একজন ব্যবসায়ী ও জমিদার বাস করিতেন। তিনি ব্রজবন্ধুর একজন বিষম শত্রু। সেই জমিদারের সহিত আমি একবার দেখা করিতে বাসনা করিলাম। তাঁহার সহিত আমার দেখা করিবার উদ্দেশ্য এই যে, এই কার্যে যদি ব্রজবন্ধু কোনরূপ জুয়াচুরি থাকে ও সেই জুয়াচুরির কথা যদি এই জমিদার শুনিয়া থাকেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তিনি তাহা আমার নিকট ব্যক্ত করিবেন। আর যদি তিনি ইহার বিষয় কিছুমাত্র অবগত না থাকেন, তাহা হইলে চেষ্টা করিয়া সমস্ত কথা বাহির করিতে ক্রটী করিবেন না। কারণ এই সুযোগে তিনি তাহার চিরশত্রুর সর্বনাশ সাধন করিতে পারিবেন।

 মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, আমি সেই জমিদার মহাশয়ের পহিত সহিত সাক্ষাৎ করিলাম ও তাহাকে আমি সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, “আমি এ সম্বন্ধে এখনও পর্যন্ত কোন কথা শুনি নাই, কিন্তু ব্রজবন্ধুর অবস্থা দেখিয়া আমার মনে হইতেছে, আজকাল সে যেন কোন একটা গুরুতর বিষয় লইয়া ব্যস্ত আছে।”

 আমি। আপনি উহার এমন কি অবস্থা দেখিয়াছেন যে, অনুমান করিতেছেন, উনি কোনরূপ গুরুতর কার্যে ব্যস্ত?  জমিদার। সে কথা আমি আপনাকে ঠিক বুঝাইয়া বলিতে পারিব না। যে স্থানে, যাহাদিগের সঙ্গে তিনি সদাসর্বদা উপবেশন ও গল্প-গুজব করিতেন, সেই স্থানেও এখন প্রায়ই তাঁহাকে উপবেশন ও গল্প-গুজব করিতে দেখিতে পাই না। যে সকল লোক সদাসর্বদা তাঁহার নিকট আসিত, এখন আর তাহাদিগকেও দেখিতে পাই না। ব্যবসা ও জমিদারিকার্য তিনি যেরূপ মনোযোগের সহিত করিতেন, এখন তাহার ও শৈথিল্য হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। আপনি দুই এক দিবস অপেক্ষা করুন, ইহার সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করিয়া আমি আপনাকে বলিব। আরও এক কথা, এই মোকদ্দমার সমস্ত কাগজ-পত্র আপনার নিকট আছে কি?

 আমি। আছে। কাগজ পত্র আপনি কি করবেন?

 জমিদার। ঐ কাগজ-পত্রগুলি আপনি বেশ ভাল করিয়া পড়িয়া দেখিয়াছেন কি?

 আমি।,হ্যাঁ দেখিয়াছি।

 জমিদার। যে হরেকৃষ্ণ জীবন বীমা করিয়াছিল, তাহার শরীরে কোনরূপ চিহ্নাদি ছিল কি?

 আমি। জীবন বীমা করিবার সময় যে ডাক্তার তাহার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়াছিলেন, তিনি উহার আকৃতি সম্বন্ধে দুই একটা কথাও লিখিয়া রাখিয়াছেন।

 জমিদার। ডাক্তার যাহা লিখিয়া রাখিয়াছেন, তাহা আপনি পড়ুন দেখি?

 জমিদারের কথা শুনিয়া আমি কাগজ-পত্রগুলি বাহির করিলাম, ও হরেকৃষ্ণের আকৃতি সম্বন্ধে ডাক্তার যেটুকু লিখিয়া রাখিয়াছিলেন,

তাহা পাঠ করিলাম। উহাতে লেখা ছিল,—বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসর, আকৃতি খর্ব্ব, বাম চক্ষুটি দক্ষিণ, চক্ষু অপেক্ষা অতি সামান্য ছোট বলিয়া অনুমান হয়।

 আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আমাকে কহিলেন, “আপনি এখন নিজ স্থানে প্রস্থান করুন; আমার বোধ হইতেছে, আপনার কার্য্য সফল হইতে আর অধিক বিলম্ব নাই। কল্য প্রত্যুষেই আমি আপনার বাসায় গিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব ও আমি যাহা জানিতে পারিব, তৎসমস্তই আপনাকে বলিয়া আসিব। ইহার মধ্যে আরও একটু কাজ করিয়া রাখিবেন। যে যে ব্যক্তি হরেকৃষ্ণকে ইতিপূর্বে দেখিয়াছে, বীমা অফিসের লোকই হউন, ডাক্তারই হউন বা অপর কোন ব্যক্তিই হউন, তাহাদিগের নিকট হইতে উহার আকৃতি কিরূপ, তাহার বর্ণন যতদূর সম্ভব সংগ্রহ করিয়া রাখিবেন।”

 জমিদারের কথা শুনিয়া আমি সেই স্থানে আর অধিকক্ষণ বিলম্ব করিলাম না। সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া তিনি যে বিষয়টা আমাকে সংগ্রহ করিতে বলিয়াছিলেন, তাহা যতদূর সম্ভব সংগ্রহ করিয়া, আমি আমার বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম।

 জমিদার মহাশয় আমাকে যেটুকু আভাস প্রদান করিলেন, তাহাতে একবার আমার মনে হইল, ব্রজবন্ধুর এই কার্য্যে জুয়াচুরি আছে ও যাহা দ্বারা এই জুয়াচুরি হইয়াছে, তাহা জমিদার মহাশয় বুঝিতে পারিয়াছেন। আবার ভাবিলাম, এ বিষয়ে ব্রজবন্ধু হয় তো সম্পূর্ণরূপে নির্দোষী। জমিদার মহাশয় হয় তো, এই সুযোগে তাঁহার জমিদারি বুদ্ধি খাটাইয়া আমাদিগের সাহায্যে তাঁহার চির শত্রুকে ভয়ানকরূপে বিপদগ্রস্ত করিতে প্রবৃত্ত হইবেন বলিয়াই আমাকে ঐরূপ কহিলেন। এই বিষয় ভাবিতে ভাবিতে সমস্ত রাত্রি বিনা নিদ্রায় অতিবাহিত হইয়া গেল।