জীবন বীমা/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 জমিদার মহাশয় যেরূপ বলিয়াছিলেন, ঠিক সেই সময়ে তাহার অধীনস্থ অপর আর এক ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলা বাহুল্য, আমি তাঁহাদিগকে বিশেষ সম্ভ্রমের সহিত বসাইলাম।

 জমিদার মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি যাহা বলিয়াছিলাম, তাহা আপনি জানিয়াছেন কি?”

 আমি। হুঁ, সমস্তই ঠিক করিয়া জানিয়া রাখিয়াছি।

 জমিদার। উহার আকৃতির বিবরণ ডাক্তার যেরূপ লিখিয়া রাখিয়াছেন, অপরেও কি সেইরূপ বলে?

 আমি। হাঁ, সকলেই ঐরূপ বলিয়াছে। কেবল যে ডাক্তার গঙ্গাতীরে মাত্র দেখিয়াছিলেন, তিনি ঠিক করিয়া কিছুই বলিতে পারেন নাই, তবে ইহা তিনি নিশ্চয়ই বলিয়াছেন যে, যে ব্যক্তিকে তিনি গঙ্গাতীরে দর্শন করিয়াছিলেন, সেই ব্যক্তিই যে মরিয়া গিয়াছে, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

 জমি। তিনি ঠিক কথাই বলিয়াছেন। গঙ্গাতীরে তিনি যাহার চিকিৎসা করিয়াছিলেন, সেই ব্যক্তি যে মরিয়াছে, তাহাতে কোনরূপ সন্দেহ নাই।

 আমি। তাহা হইলে আপনি কি বিবেচনা করেন যে, যে ব্যক্তি মরিয়াছে—সেই ব্যক্তি, এবং যে ব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল সেই ব্যক্তি-এক নহে?

 জমি। এক নহে—ভিন্ন ব্যক্তি।

 আমি। আপনি কিরূপে জানিলেন, উহারা ভিন্ন ব্যক্তি?

 জমি। আমার বোধ হইতেছে যে, যে ব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই ব্যক্তি এখনও জীবিত আছে—মরে নাই।

 আমি। তাহা হইলে কি আপনি জানিতে পারিয়াছেন, যে ব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সে ব্যক্তি কে?

 জমি। আমি যাহা অনুমান করিতেছি, বোধ হয় আমার সেই অনুমান সত্য হইবে।

 আমি। আপনি কি অনুমান করিয়াছেন?

 জমি। আমার বোধ হয়, যে ব্যক্তি তাহার জীবন বীমা করিয়াছিল, সেই ব্যক্তি ব্রজবন্ধু বাবুর একজন কর্মচারী।

 আমি। আপনি উহা কিরূপে জানিলেন?

 জমি। যে সময় হরেকৃষ্ণ তাহার জীবন বীমা করে, সেই সময় ব্রজবন্ধুর এক কর্মচারীকে আমি প্রায়ই ব্রজবন্ধুর বাড়ীতে দেখিতাম। কিন্তু এখন আর তাহাকে দেখিতে পাই না। হরেকৃষ্ণের অবয়বের বিবরণ যেরূপ বর্ণিত আছে, তাহার অবয়বও ঠিক সেইরূপ। সেও খর্বাকৃতি, তাহার বাম চক্ষুটী দক্ষিণ চক্ষু অপেক্ষা কিছু ছোট এবং তাহারও বয়ঃক্রম প্রায় ৪০ বৎসর হইবে।

 আমি। তিনি কি ব্রজবন্ধুর বাড়ীতেই কার্য্য করিতেন?

 জমি। না। তিনি ব্রজবন্ধুর কর্মচারী সত্য, কিন্তু তিনি এই স্থানে থাকেন না, মফস্বলের কোন জমিদারিতে তিনি কর্ম্ম করিয়া থাকেন। বৎসরের মধ্যে দুই একবার জমিদারের বাড়ীতে আসেন, কিন্তু দুই এক দিবস থাকিয়াই চলিয়া যান। এবার কিন্তু তিনি আসিয়া অনেক দিন ছিলেন,

 আমি। তাঁহার নাম কি?

 জমি। তাহার নাম কৃষ্ণরাম।

 আমি। তিনি কোন্ দেশীয় লোক?

 জমি। তাহা আমি বলিতে পারি না, কিন্তু শুনিয়াছি, তাঁহার পুত্রাদি নাই, কেবল একটী জামাই আছে, সেও ব্রজবন্ধুর কোন জমিদারিতে কার্য্য করিয়া থাকে।

 আমি। তাঁহাকে আপনি কতদিন দেখেন নাই।

 জমি। অনেক দিবস পরে তাহাকে এবার ব্রজবন্ধুর বাড়ীতে দেখিয়াছি।

 আমি। সে কত দিবসের কথা?

 জমি। বোধ হয় ১৫/১৬ দিবসের অধিক হইবে না।

 জমিদার মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমার মনে হইল, যদি জমিদার মহাশয়ের কথাগুলি সত্য হয়, তাহা হইলে ব্রজবন্ধু কৃষ্ণরামের সাহায্যে যে ভয়ানক জুয়াচুরি করিয়াছে, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। এখন এ বিষয় একটু বিশেষরূপে অনুসন্ধান করি। দেখিবার প্রয়ােজন হইতেছে। যদি অনুসন্ধান করিয়া কৃষ্ণরামকে বাহির করিতে পারি, ও সেই কৃষ্ণরামকে অফিসের সমস্ত ব্যক্তি ও ডাক্তারদ্বয় যদি হরেকৃষ্ণ বলিয়া চিনিতে পারে, তাহা হইলেই জানিতে পারি যে, ইহা একটা ভয়ানক জুয়াচুরি কাণ্ড। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া জমিদার মহাশয়কে কহিলাম, “ব্রজবন্ধুর কোন্ জমিদারিতে কৃষ্ণরাম কর্ম্ম করে ও তাহার জামাতাই বা কোথায় থাকে, তাহার ঠিকানা আপনি কিছু বলিতে পারেন কি?”

 আমি। এখন বলিতে পারি, কিন্তু উহার সবিশেষ সন্ধান লইয়া দুই এক দিবসের মধ্যে তাহার সংবাদ আপনাকে প্রদান করিব।

 এই বলিয়া জমিদার মহাশয় সে দিবস আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।

 দুই দিবস গত হইয়া গেল, জমিদার মহাশয় আমার নিকট না অসায় আমি পুনরায় তাহার বাড়ীতে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া কহিলেন যে, এখনও পর্যন্ত তিনি তাহাদিগের ঠিক ঠিকানা জানিতে পারেন নাই, কিন্তু আশা করেন, আর দুই এক দিবসের মধ্যে তিনি সমস্তই জানিতে পারিবেন; তখন তিনি আপনাকে সংবাদ প্রদান করিবেন।

 জমিদার মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি সে দিবস সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিলাম সত্য, কিন্তু অপর অপর স্থান হইতে ঐ সংবাদ সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিতেও ভুলিলাম না। কিন্তু কৃষ্ণরাম যে এখন কোথায় আছে, তাহার কোন সংবাদ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না। তবে এই মাত্র জানিতে পারিলাম যে, কৃষ্ণরাম নামক এক ব্যক্তি ব্রজবন্ধুর নিকট চাকরি করিয়া থাকে, ও জমিদার মহাশয় তাহার অবয়বের যাহা বর্ণন করিয়াছেন, তিনি দেখিতে ঠিক সেইরূপ।

 প্রায় এক সপ্তাহ পরে জমিদার মহাশয় জানিতে পারিলেন যে, ব্রজবন্ধুর কোন্ জমিদারীতে কৃষ্ণরাম কর্ম্ম করিয়া থাকেন, ও তাঁহার জামাতাই বা কোথায় কর্ম্ম করেন।  ডায়মণ্ড হারবারের অন্তর্গত সুন্দর বনের মধ্যে বন্ধুর কয়েকটী আবাদ ছিল। উহারই একটী আবাদে কৃষ্ণরাম থাকিতেন। জমিদার মহাশয়ের নিকট হইত এই সংবাদ পাইবামাত্র, কৃষ্ণরামকে চিনে এইরূপ একটী লোক, ঐ জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে লইয়া, ও হরেকৃষ্ণকে দেখিলে চিনিতে পারে, এরূপ একটা লোক বীমা অফিস হইতে লইয়া, আমি সেই আবাদে গমন করিলাম, কিন্তু সহজে সেই অবাদের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। উহার সন্ধান করিতেও দুই এক দিবস অতীত হইয়া গেল। ঐ আবাদের সন্ধান পাইলে আমরা সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, ও জানিতে পারিলাম, কৃষ্ণরাম এই আবাদের প্রধান কর্মচারী, ও সেই স্থানেই তিনি বাস করিয়া থাকেন। কিন্তু আজ ১০/১৫ দিবস হইল তিনি তাঁহার মনিবের বাড়ীতে গিয়াছেন, আজও পর্যন্ত প্রত্যাগমন করেন নাই। তাহার বাসা ঘরখানি খালি পড়িয়া রহিয়াছে।

 এই স্থান হইতে ঐ আবাদে গমন করিবার পূর্বে কৃষ্ণরাম তাঁ হার মনিবের বাড়ীতে আসিয়াছে কি না, তাহার সন্ধান করিয়া ছিলাম ও জানিতে পারিয়াছিলাম যে, তিনি এখানে আসেন নাই। আবাদে গিয়া যাহা জানিতে পারিলাম, তাহাতে মনে দারুণ সন্দেহ উপস্থিত হইল; কারণ কৃষ্ণরামই যদি হরেকৃষ্ণ হন, তাহা হইলে তো ১৫ দিবস পূর্বে তিনি জীবিত ছিলেন। তাহা হইলে যে, হরেকৃষ্ণ মরিয়াছে, সে তো এই হরেকৃষ্ণ বা কৃষ্ণরাম নহে। আরও মনে হইল, বোধ হয় কৃষ্ণরাম জানিতে পারিয়াছে যে, আমরা তাহার কার্য্যকলাপ জানিতে পারিয়াছি, তাই তিনি ঐস্থানে থাকিলে পাছে ধৃত হন, এই ভয়ে ঐ স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। ঐ স্থানে ও উহার নিকটবর্তী স্থানে আমরা কৃষ্ণরামের বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু তাহাকে কোথাও পাইলাম না।

 তাহার জামাতা যে আবাদে কার্য্য করিত, পরিশেষে আমরা সেই স্থানে গমন করিলাম। ঐ স্থান পূর্ব বর্ণিত আবাদ হইতে প্রায় ৩০ ক্রোশ ব্যবধান। ঐ স্থানে গিয়া তাহার জামাতাকেও পাইলাম না; তিনিও ঐ সময় হইতে ঐ স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু কোথায় যে গিয়াছেন, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। সুতরাং তথা হইতে আমরা ক্ষুন্নমনে প্রত্যাগমন করিলাম।