জেবুন্নিসা বেগম/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
জেবুন্নিসা বেগমের পাদপূরণ
কবিতা চর্চ্চার উদ্দেশ্যে জেবুন্নিসা বেগমের মহলে প্রায়ই কবি সম্মেলন হইত। শিক্ষক ব্যতীত অপর কোন পুরুষের সম্মুখে কোন সন্ত্রান্ত মুগল মহিলা বাহির হইতে পারিতেন না। সেই অবরোধ প্রথা অনুসারে জেবুন্নিসা বেগম পরদার অন্তরালে থাকিয়া ঐ সব কবি সম্মেলনে যোগ দান করিতেন।
একদিন নাসিরালী প্রভৃতি কয়েক জন কবিকে লইয়া জেবুন্নিসা বেগম কাব্যালোচনা করিতেছিলেন। এমন সময়ে উপস্থিত কবিগণের মধ্যে একজন নিম্নলিখিত পংক্তি আবৃত্তি করিয়া উহার পাদপূরণ করিতে বলিলেন।
اگر ماند شبی ماند شبِ ديگر نمي ماند
অগর্ মানদ্ শবে মানদ্ শব-এ-দিগর নমে মানদ্
যদি রহে এক রাত্র রহে দ্বিতীয় রাত্র রহে না
নাসিরালী পাদপূরণ করিলেন—
هِلال عيد چون ابرٶان دلبر نمی ماند
اگر ماند شبی ماند شبِ ديگر نمی ماند
হিলাল-এ-ইদ্ চৌঁ অব্রু-এ-আঁ দিলবর নমে মানদ্
অগর মানদ্ শবে মানদ্ শব-এ-দিগর নমে মানদ্
ইদের চন্দ্র (২য়ার চন্দ্র) প্রিয়তমার ভ্রুর মত রহে না
যদি রহে এক রাত্র রহে দ্বিতীয় রাত্র রহে না।
আর একজন এইরূপ পাদপূরণ করিলেন—
ماه دو هفته به روخِ دلبر نمی ماند
اگر ماند شبی ماند شبِ ديگر نمی ماند
মাহ-এ-দুহফ্তা বরুখ্-এ-দিলবর্ নমে মানদ্
অগর মানদ্ শবে মানদ্ শব-এ-দিগর নমে মানদ্
দুই সপ্তাহের চন্দ্র প্রিয়তমার মুখের মত রহে না
যদি রহে এক রাত্র রহে দ্বিতীয় রাত্র রহে না।
সকলের পাদপূরণ করা শেষ হইলে পর জেবুন্নিসা বেগম এইরূপ আবৃত্তি করিলেন।
حجابِ نو عروساں در بر شوهر نمی ماند
اگر ماند شبی ماند شبِ ديگر نمی ماند
হেজাব-এ-নৌ আরুসাঁ দরবর শৌহর নমে মানদ্
অগর মানদ্ শবে মানদ্ শব-এ-দিগর নমে মানদ্
পতির বক্ষে (আলিঙ্গনে) নববধূগণের লজ্জা রহে না
যদি রহে একরাত্র রহে দ্বিতীয় রাত্র রহে না।
আরো কবিগণ যে সব পাদপূরণ করিয়াছিলেন, সেগুলিতে কোন বিশেষত্ব বা তেমন কিছু সৌন্দর্য্য না থাকাতে ঐ সব উল্লেখ করা হইল না।
একদা জেবুন্নিসা বেগম বেড়াইতে বেড়াইতে একটী সুরম্য কাননে উপস্থিত হন। তখন বসন্ত কাল ছিল। বৃক্ষ-ডালে নবীন মুকুল বিকশিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে; কোকিল কূজনে চারিদিক্ গুঞ্জরিত; মৃদুমন্দ মলয় পবন ফুলের সৌরভে সারা কানন সুবাসিত করিতেছে; মধু ঋতুর হেন মনোমুগ্ধকারী সময়ে জেবুন্নিসা বেগম ভাবেতে বিভোর হইয়া যান। এবং স্বতঃ তাঁহার মুখ হইতে নিম্নলিখিত দুই চরণ কবিতা বাহির হয়।
چهار چيز غمِ دل برد كدام چهار
شراب و سبزه و آبِ روان و روۓ نگار
চহার্ চিজ্ গম-এ-দিল বুরদ্—কদাম চহার
শরাব্ ও সব্জা ও আর-এ-রোয়াঁ ও রু-এ-নিগার।
চারিটী দ্রব্য মনের ব্যথা দূর করে—সে চারিটী কি
সুরা, স্যামল মাঠ, ঝরণা ও সুন্দর মুখ।
چهار چيز غمِ دل بود — كدام چهار
نماز و روزه و تسبيح و توبه استغفار
চহার চিজ্ গম-এ-দিলর্বুদ—কদাম চহার,
নমাজ ও রোজা তসবিহ্ ও তোবা ইস্তগফার।
চারিটী দ্রব্য মনের ব্যথা দূর করে—সে চারিটী কি
ঈশ্বরুপাসনা, উপবাস, জপমালা ও পাপক্ষালনের জন্য তোবা করা।
উক্ত কবিতা শুনিয়া ঔরঙ্গজেব্ বাদশাহ প্রফুল্লমনে চলিয়া গেলেন। এইরূপ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব-বলে জেবুন্নিসা বেগম তাঁহার গোঁড়া ও কর্কশ প্রকৃতি পিতার রোষ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছিলেন।
একদিন বাদশাহী দরবারে এক বাজীগর তামাশা দেখাইতেছিল। অন্তঃপুর-মহিলাগণও চিকের অন্তরাল হইতে তাহা দেখিতেছিলেন। বাজীগর তামাশা দেখাইয়া শেষ করিলে পর তাহার সুন্দরী স্ত্রী একটী দীর্ঘ বংশদণ্ডের উপর চড়িয়া উলটিয়া পালটিয়া খেলা দেখাইতে থাকে। স্ত্রীলোকটীর খেলাতে সন্তুষ্ট হইয়া সভাসদ্গণের মধ্যে এক ব্যক্তি তাহার প্রশংসা-সূচক নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করেন।
اين لعبت بود عجب چو ماهے پيداست
يا تازه گلے بر سرِ شاخ رعناست
ইঁ লাবত্ বুদ্ আজিব্ চো মাহে পৈদাস্ত
ইয়া তাজা গুলে বর সর-এ-শাখ্ রানাস্ত।
এই অদ্ভুত পুতুল যেন একটী চন্দ্র উদয় হইয়াছে,
অথবা নূতন একটী ফুল বৃক্ষশাখে শোভা পাইতেছে।
উক্ত কবিতা শুনিয়াই জেবুন্নিসা বেগম এ বিষয়ে আর একটী কবিতা রচনা করিয়া একজন দাসীর দ্বারা তাহা সভায় প্রেরণ করিলেন। কবিতাটী এই:—
نے نے غلط است كه آفتابِ محشر
بر نيزه بر آمد و قيامت برپاست
নে-নে-গল্ত অস্ত, কি আফ্তাব্-এ-মহশর
বর নেজা বর আমদ্ ও কিয়ামত্ বরপাস্ত।
না—না—ভুল হয়েছে, যেন মৃতব্যক্তিগণের পুনরুত্থান দিনের রবি শূলের উপর উদয় হইয়া প্রলয় সৃষ্টি করিয়াছে।
মুসলীম ধর্ম্মমতে “মহশর” অর্থাৎ resurrection দিনে শূলের উপর সূর্য্যোদয় হইবে। সেই সময়ে “ইসা মসীহ” (যীশু খৃষ্ট) “কুম্বেজনী” (আমার আদেশে উঠ) বলিয়া ধরাতলে যষ্টি প্রহার করিলে সমস্ত মৃতব্যক্তি জীবিত হইয়া উঠিবে। তখন পরমেশ্বর তাহাদিগের পাপ-পুণ্যের বিচার করিবেন।