জেবুন্নিসা বেগম/নবম পরিচ্ছেদ
ইরাণের রাজপুত্ত্র শাহজাদা ফরুখ জেবুন্নিসা বেগমকে বিবাহ করিবার উদ্দেশ্যে যে সময় দিল্লীতে আসিয়াছিলেন, সেই সময়ে আকিল খাঁও গোপনে দিল্লীতে আসিয়া এক নির্জ্জন স্থানে বাস করিতে থাকেন। শাহজাদা ফরুখের সহিত জেবুন্নিসা বেগমের বিবাহের প্রস্তাব এবং অবশেষে তাহা ভাঙ্গিয়া যাওয়া—এ সমস্ত সংবাদই তিনি রাখিতেন।
আকিল খাঁ যে দিল্লীতে বাস করিতেছেন এ বিষয় ক্রমে জেবুন্নিসা বেগমও শুনিতে পাইলেন। ইহা জানিলে পর তিনি নিম্নলিখিত কথা এক খণ্ড কাগজে লিখিয়া সাবধানে একজন দাসীর দ্বারা আকিল খাঁর নিকট প্রেরণ করেন।
شنیدم ترک خدمت کرد عاقل خان بنادانی
শুনিদম তর্ক খেদমত কর্দ আকিল খাঁ বনাদানী
শুনিলাম নির্ব্বুদ্ধিতায় আকিল খাঁ খিদমত
অর্থাৎ রাজসেবা ত্যাগ করিয়াছে।
এই লিপি পাইয়া আকিল খাঁ সঙ্ক্ষেপে তাহার এইরূপ উত্তর লিখিয়া পাঠাইলেন।
چرا کارے کند عاقل که باز آید پشیمانی
চির কারে কুনদ আকিল কি বাজ আয়েদ পুশিমানী
আকিল কি এমন কাজ করে যে জন্য পরে
অনুতাপ করিতে হয়।
‘আকিল’ শব্দ দুইটী ভাব প্রকাশ করে। প্রথমতঃ তাহার নাম, দ্বিতীয়তঃ বুদ্ধিমান্।
এইরূপে জেবুন্নিসা বেগম ও আকিল খাঁর মধ্যে পত্রাদি চলাচল হইতে আরম্ভ হয়, এবং কিছুদিন পর আকিল খাঁ আবার ছদ্মবেশে জেবুন্নিসা বেগমের মহলে যাতায়াত করিতে লাগিলেন।
জেবুন্নিসা বেগমের মহলে আকিল খাঁ যে ছদ্মবেশে যাতায়াত করিতেছে এ বিষয় অধিক দিন গোপন রহিল না। বাদশাহী মহলের প্রায় অনেক লোকেই ইহা জানিতে পারিলে একথা লইয়া দুর্গ মধ্যে কানা-ঘুষা হইতে লাগিল এবং তাঁহাদের দুর্ভাগ্যক্রমে এ সংবাদ ঔরঙ্গজেব বাদশাহের কানে পর্য্যন্ত পৌঁছিতে বাকী রহিল না।
আকিল খাঁ ও তাঁহার কন্যার দেখা-সাক্ষাতের বিষয় ঔরঙ্গজেব বাদশাহ জানিতে পারিলে এ সম্বন্ধে তিনি গোপনে অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হন, এবং জেবুন্নিসা বেগমের একজন পরিচারিকাকে কৌশলে বশীভূত করিয়া তাহার মুখে সমস্ত শুনিলে পর সেই দাসীকে বলিয়া দেন—আকিল খাঁ যখন তাঁহার কন্যার নিকট আইসে তখন যেন সে ঔরঙ্গজেব বাদশাহকে একথা জানায়।
তদনুসারে একদিন আকিল খাঁ জেবুন্নিসা বেগমের মহলে উপস্থিত থাকার সময় ঐ দাসী ঔরঙ্গজেব বাদশাহের নিকট যাইয়া একথা বলিয়া দেয়। ইহা শুনিবামাত্র তিনি মহলের চারিদিক্ প্রহরি দ্বারা ঘেরাও করাইয়া স্বয়ং তথায় অনুসন্ধান করিবার উদ্দেশ্যে গমন করেন।
এ সংবাদ জেবুন্নিসা বেগম জানিতে পারিয়া ভয়ে অস্থির হইয়া পড়িলেন এবং সেই মুহূর্ত্তে আকিল খাঁকে তাহার মহল হইতে সরাইয়া দিতে কোন উপায় নির্দ্ধারণ করিতে পারেন নাই। তাঁহার স্নানের জল গরম করিবার বড় একটী দেগ্ মহলের এক কোণে ছিল, অনন্যোপায় হইয়া তিনি তাহারই মধ্যে আকিল খাঁকে লুকাইয়া রাখিলেন।
এদিকে ঔরঙ্গজেব বাদশাহ তাঁহার কন্যার মহলে প্রবেশ পূর্ব্বক সমস্ত স্থান তন্ন তন্ন রূপে অনুসন্ধান করিয়াও আকিল খাঁর কোন চিহ্নই দেখিতে পাইলেন না। যে দেগের ভিতর আকিল খাঁ লুকাইয়াছিলেন তাহার উপর ঔরঙ্গজেব বাদশাহের হঠাৎ চক্ষু পড়াতে তাঁহার মনে যেন কিরূপ এক সন্দেহ জন্মিল। ইহাতে আকিল খাঁ লুকাইয়া থাকা খুব সম্ভব এইরূপ মনে করিয়া তিনি সেই দেগ লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“ইহাতে কি হয়?” উত্তরে জানিতে পারিলেন ইহাতে জেবুন্নিসা বেগমের স্নানের জল গরম করা হইয়া থাকে। এ কথা শুনিয়া তিনি বলিলেন—“জল গরম করা হইতেছে না কেন? এখনই জল গরম কর।” জেবুন্নিসা বেগম তাহার পিতার এই নিদারুণ আদেশ শুনিয়া মৃতপ্রায় হইলেন। রুদ্র প্রকৃতির ঔরঙ্গজেব বাদশাহের আদেশ অমান্য করিতে পারে হেন সাধ্য কার আছে—তাঁহার হুকুম মত সকলে দেগ্টী ধরাধরি করিয়া জ্বলন্ত আগুনে ভরা চুলার উপর চড়াইয়া দিল।
এ দৃশ্য জেবুন্নিসা বেগমের পক্ষে কিরূপ হৃদয়-বিদারক হইয়াছিল ইহা বুঝা কঠিন নহে। জীবন্ত দগ্ধ হইয়া আকিল খাঁর এ ধরা হইতে বিদায় গ্রহণের সময় উপস্থিত, আজ তাঁহার মৃত্যু সুনিশ্চিত, রক্ষার কোন উপায় নাই দৃষ্টে জেবুন্নিসা বেগম আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। পাগলের মত হইয়া তিনি ঐ দেগের নিকট গমন পূর্বক নিম্নলিখিত কথা বলিলেন।
“دم باش مثال کله بارے”
দম্ বাশ মিসাল-এ-কল্লা বারে
একবার মুহুর্তের জন্য মুণ্ডের মত থাক; মুণ্ডের অর্থ এখানে ছেদিত মস্তক বুঝিতে হইবে। অর্থাৎ ছিন্ন মস্তকের মুখ ও জিহ্বা থাকিলেও যেমন কথা বলিতে পারে না, সেইরূপ নীরব থাক।
আকিল খাঁ জেবুন্নিসা বেগমকে প্রাণের অধিক ভাল বাসিতেন। হেন প্রিয় জনের অনুরোধু অবহেলা করা অপেক্ষা স্বয়ং জীবন্ত দগ্ধ হইয়া মরা শ্রেয় মনে করিলেন, এবং তদনুসারে তিনি তিলে তিলে জ্বলিয়া মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে কুণ্ঠিত হইলেন না। মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনি নাকি কেবল এই মাত্র বলিয়াছিলেন—
“بعد مردن ز جفائی تر اگر یاد کنم”
از کفن دست برون آرم و فریاد کنم
বাদ মুর্দন জে জফা-এ-তু অগর ইয়াদ্ কুনম্
অজ্ কফন্ দস্তবরুঁ আরম ও ফরিয়াদ কুনম্
মৃত্যুর পরও যদি তোর উৎপীড়নের কথা মনে করি
শবাচ্ছাদনের ভিতর হইতে হাত বাহির করিয়া
(ভগবানের নিকট) বিচার প্রার্থনা করিব।
উঃ—কি নিষ্ঠর ব্যাপার, ভাবিতেও শরীর কণ্টকিত হয়। এইরূপে একজন লোক যে জীবন্ত জ্বলিয়া মরিতে পারে এবং এপ্রকার যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর সময় সে কবিতা আবৃত্তি করিয়াছিল এই সব শুনিলে অসম্ভব বলিয়াই মনে হয়।
ঔরঙ্গজেব বাদশাহ আকিল খাঁকে এপ্রকার নৃশংস রূপে হত্যা করিবার পর তাঁহার কন্যাকে কোনরূপ লাঞ্ছনা বা তিরস্কার করিয়াছিলেন কি না, যে উর্দু গ্রন্থ অবলম্বনে এই পুস্তিকা লিখিত হইয়াছে, তাহাতে ইহার কোন উল্লেখ নাই। এমনও হইতে পারে—জেবুন্নিসা বেগমের সম্মুখেই তাঁহার প্রণয়-পাত্রকে এ প্রকার অমানুষিক নিষ্ঠুর উপায়ে হত্যা করাই তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট মনোবেদনাদায়ক হইয়াছে, ইহা অপেক্ষা আর অধিক গুরুতর দণ্ড তাঁহার দুহিতার জন্য নাই—এরূপ মনে করিয়া ঔরঙ্গজেব বাদশাহ জেবুন্নিসা বেগমকে আর কোনরূপ লাঞ্ছনা করিতে বিরত ছিলেন।
উক্ত উর্দু পুস্তকে লেখা আছে—আকিল খাঁর সহিত জেবুন্নিসা বেগমের কোনরূপ অবৈধ প্রণয় ছিল না। তাঁহারা পরস্পর যে সরল অন্তঃকরণে মিলামিশা করিতেন, ইহাকেই পাশ্চাত্য লেখকগণ অতিরঞ্জিত করিয়াছে।
উর্দু ভাষায় রচিত জেবুন্নিসা বেগমের আর একখানি জীবন-চরিত আমি পড়িয়াছিলাম—সে আজ অনেক বৎসরের কথা। এখন আমার মনে হইতেছে তাহাতে যেন লেখা ছিল উক্ত বেগম ও আকিল খাঁর প্রেমের কাহিনী পারস্য দেশ হইতেই উদ্ভূত হইয়াছিল।
ইরাণের রাজপুত্ত্র শাহজাদা ফরুখ্ জেবুন্নিসা বেগমকে বিবাহ করিতে না পারিয়া লজ্জিত মনে ফিরিয়া যাওয়াতে পারস্য দেশের অপমান হইয়াছে—এইরূপ ধারণা ঐ দেশবাসিগণের মনে জন্মে। এই কারণেই তাহারা বর্ণিত বেগমের চরিত্রে কলঙ্ক প্রদান পূর্ব্বক ইহার প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে আকিল খাঁর সহিত তাঁহার অবৈধ প্রেমের গল্প রটাইয়া দেয়।