জেবুন্নিসা বেগম/দশম পরিচ্ছেদ
যতদূর পর্য্যন্ত জানা যায়—জেবুন্নিসা বেগমের শেষ জীরন সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয় নাই। মানসিক ক্লেশের দরুণ তিনি নির্জ্জনে বাস করিয়া সাংসারিক সমস্ত কার্য্য এবং চিন্তা বর্জ্জন পূর্ব্বক বিদ্যানুশালনেই নাকি দিন যাপন করিয়াছিলেন।
জেবুন্নিসা বেগমের মৃত্যু হইলে লাহোরে তিনি যে বাগান প্রস্তুত করিয়াছিলেন সেখানেই তাঁহার দেহ সমাহিত করা হয়, এবং তাঁহার বাসনা অনুসারেই এই কার্য্য সম্পাদিত হইয়াছিল—এইরূপ পূর্ব্বকথিত উর্দু পুস্তকে উল্লেখ আছে। কিন্তু কোথায় তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল ইহা লেখা নাই!
পঞ্জাবের অন্তর্গত গুরুদাসপুরের অতিরিক্ত জুডিশিয়েল কমিশনার, ঐ প্রদেশস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য খাঁ বাহাদুর সৈয়দ মহম্মদ লতীফের রচিত সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘লতীফ-এ-লাহোর’ হইতে জানা যায়—লাহোরেই জেবুন্নিসা বেগমের মৃত্যু হইয়াছিল, এবং নিজ দেহ সমাহিত করিবার উদ্দেশ্যে যে মক্বরাটী তিনি ঐ নগরস্থ তাহার বাগানে নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন, সেখানেই তাহাকে গোর দেওয়া হইয়াছে।
ঐ পুস্তকে তাঁহার মৃত্যুর বৎসর যেরূপ উল্লেখ আছে তাহা নিম্নে প্রদত্ত হইল।
آه زیب النسا بحکم قضا
ناگہاں از نگاہ مخفی شد
منبحِ علم و فضل و حسن و جمال
همچو یوسف بچاه مخفي شد
سال تاریخ از خرد جستم
گفت هاتف کہ ماه مخفي شد
আহ্ জেবুন্নেসা বহুকুম কজা
নাগহাঁ অজ্ নিগাহ মখফী শুদ।
সম্বা-এ-ইল্ম ও ফজল ও হুসন ও জমাল
হম্চো য়ুসফ বচাহ্ মখফী শুদ।
সাল তারিখ অজ খিরদ্ জুস্তম
গুফ্ত হাতিফ্ কি মাহ মখফী শুদ।
আহা, জেবুন্নিসা বিধাতার আদেশে
দৃষ্টি হইতে অকস্মাৎ লুকাইয়াছেন।
বিদ্যা, বুদ্ধি, রূপ ও লাবণ্যের ধারা-স্বরূপ তিনি
য়ুসফের ন্যায় কূপের ভিতর লুকাইয়াছেন।
মৃত্যুর বৎসরের কথা বিবেককে প্রশ্ন করিলাম;
অদৃশ্য হইতে বলল “চন্দ্র লুক্কায়িত হইলেন”।
“অব্ জদ্ অর্থাৎ শ্রেণীবিন্যস্ত অক্ষরের দ্বারা সংখ্যা নিরূপণের যে সঙ্কেত আরবী ও ফারসীতে আছে, তদনুসারে উক্ত কবিতা হইতে বুঝা যায় যে ১০৮০ সনে জেবুন্নিসা বেগমের মৃত্যু হইয়াছিল।
যে উর্দু পুস্তক অবলম্বনে জেবুন্নিসা বেগমের কাহিনী লিখিত হইয়াছে, সেই পুস্তকের রচয়িতা উক্ত তারিখ স্বীকার করেন না। ঐ তারিখ ঠিক্ হইতে পারে না এবং সন নির্দ্ধারণে কোনরূপ ভ্রমপ্রমাদ হইয়া থাকিবে—এইরূপ তাঁহার অভিমত।
সৈয়দ মহম্মদ নামক একজন সম্ভ্রান্ত ও সুশিক্ষিত মুসলমান ভদ্রলোক জেবুন্নিসা বেগম সম্বন্ধে একটী মনোরম প্রবন্ধ ‘রূপম’ পত্রিকায় লিখিয়াছেন। তাহাতে উক্ত বেগমের মৃত্যুর কথা যেরূপ বিবৃত আছে, তাহার মর্ম্ম সঙ্ক্ষেপে নিম্নে উল্লেখ করা হইল।
ঔরঙ্গজেব বাদশাহ আকিল খাঁকে দেগের ভিতর দগ্ধ করিয়া চলিয়া যাওয়ার পর জেবুন্নিসা বেগম তাঁহাকে এক নির্জ্জন স্থানে গোপনে সমাহিত করেন, এবং প্রায়ই তিনি সেখানে যাইয়া রোদন করিতেন। এইরূপে জেবুন্নিসা বেগম তাঁহার প্রণয়ীর জন্য সদাসর্ব্বদা অশ্রুপাত করার ফলে ক্রমে তাঁহার শরীর ভাঙ্গিয়া পড়ে। এই কারণবশতঃ স্বাস্থ্যলাভের জন্য তিনি কাশ্মীর যাত্রা করেন; কিন্তু তথায় পৌঁছান তাঁহার ঘটিয়া উঠিল না—লাহোরেই তিনি কাল-কবলে পতিত হন, এবং সেখানে নিজের জন্য যে সমাধি-মন্দিরটী তিনি প্রস্তুত করাইয়াছিলেন, তাহাতেই তাঁহার মৃতদেহ সমাহিত করা হইয়াছিল।
উক্ত প্রবন্ধে একথাও উল্লেখ আছে যে, মৃত্যুর পূর্ব্বে জেবুন্নিসা বেগম পরবর্ত্তী পৃষ্ঠার কবিতাটী রচনা করিয়াছিলেন।بر مزارِما غریباں نے چراغ و نے گلے
نے پرِ پروانۂ و نے صداۓ بلبلے
বর মজার-এ-মা গরীবাঁ নে চেরাগ ও নে গুলে
নে পর-এ-পরওয়ানয়ে ও নে সদা-এ-বুলবুলে।
জন্মভূমিত্যাগী আমাদের সমাধির উপর
একটী প্রদীপও নাই, ফুলও নাই।
একটী পতঙ্গের পক্ষ পর্য্যন্ত নাই ও
বুল্বুল্ পাখীর শব্দ নাই।
জেবুন্নিসা বেগমের মৃত্যুর সম্বন্ধে সুনিশ্চিত রূপে কোন কথা বলা দুষ্কর; যেখানে যেরূপ দেখিয়াছি তাহাই এ পুস্তকে উল্লেখ করা হইল।
জানা যায়—উক্ত বেগমের মকবরাটী অতি দুরবস্থায় রহিয়াছে। প্রবল পরাক্রান্ত মুগল সম্রাট্ ঔরঙ্গজেব আলমগীরের দুহিতা—বিশেষতঃ ভুবনবিখ্যাত এক সুকবি বিদুষী মহিলার সমাধিমন্দিরএই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
যে যত্নের অভাবে ধ্বংসকবলে ধাবিত হইতেছে ইহা অতি দুঃখের বিষয়।
সম্ভবতঃ এক কালে এই সমাধিমন্দিরে রীতিমত সান্ধ্যদীপ দেওয়া হইত এবং জেবুন্নিসা বেগমের মৃত্যু তিথিতে আড়ম্বরের সহিত “উর্স” অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হইত। তদুপলক্ষে তাঁহার স্বর্গকামনায় নমাজ, কুরান পাঠ ও দান, খৈরাত ইত্যাদি না জানি কত কিছুই হইয়া থাকিবে। কালের কুটিলচক্রে সেই স্থানের আজ এই দশা—ইহা শুনিলে অত্যন্ত দুঃখ বোধ হয়।
যে সময়ে ভারতবর্ষে স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ কোন অনুশীলন ছিল না, সেই সময়ের এক প্রতিভাশালিনী বিদুষী মহিলার হেন দুর্দ্দশাগ্রস্ত স্মৃতিচিহ্নটী রক্ষার কি কোন উপায় হইতে পারে না? জানি না—গভর্ণমেণ্টের প্রাচীন স্মৃতি রক্ষণের বিভাগ হইতে উক্ত বেগমের সমাধিটীর জীর্ণ সংস্কার করিয়া তাহা রক্ষা করা হইতেছে কি না। সেরূপ যদি না হইয়া থাকে তাহা হইলে স্থানীয় ব্যক্তিগণের—বিশেষতঃ মুসলমানগণের এ বিষয়ে গভর্ণমেণ্টের দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্ব্বক পরস্পর সহযোগিতায় একজন খ্যাতনামা বিদুষী শাহ্জাদীর স্মৃতিরক্ষা যুক্তিসঙ্গত মনে করি।
জেবুন্নিসা বেগম দুঃখময় এ জগৎ হইতে চিরদিনের তরে বিদায় গ্রহণ করিয়াছেন বটে—কিন্তু যতদিন পর্য্যন্ত তাঁহার রচিত “দিওয়ান-এ-মখ্ফী” বর্ত্তমান থাকিবে ততদিন তাঁহার নামও রহিয়া যাইবে, এ ধরা হইতে মুছিয়া যাইবে না।