জেবুন্নিসা বেগম/সপ্তম পরিচ্ছেদ
জেবুন্নিসা বেগমের বিবাহের প্রস্তাব
জেবুন্নিসা বেগম দিল্লীতে চলিয়া আসিলে পর ঔরঙ্গজেব বাদশাহ তাঁহাকে কোনরূপ শাসন করিলেন না। সুচতুর বাদশাহ ভাবিলেন—তাঁহার কন্যা ও আকিল খাঁর প্রণয়ের সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে বা কিছু করিতে গেলে ইহা সর্ব্বত্র প্রকাশ হইয়া নিজ কুলেই কলঙ্ক স্পর্শিবে। অতএব তিনি এ বিষয়ে কোন উচ্চ-বাচ্য না করিয়া কেবল তাঁহার বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন।
ঔরঙ্গজেব বাদশাহের এই প্রস্তার শুনিয়া জেবুন্নিসা বেগম করজোড়ে শির নত করিয়া কহিলেন—“এ ক্রীতদাসী শাহানশাহ আলমগীরের আদেশ শিরোধার্য্য-পূর্ব্বক গ্রহণ করিতেছে। ধৃষ্টতা বলিয়া যদি মনে করা না হয়, তবে জহাঁপনাহের নিকট দাসী এই স্বাধীনতাটুকু প্রার্থনা করে, এ বিবাহের কথা যেন সর্ব্বত্র প্রচারের আদেশ প্রদান করা হয়। এ সংবাদ শুনিয়া যাহারা বিবাহপ্রার্থী হইবে, দাসী স্বয়ং তাহাদের কুল-শীল পরীক্ষা করিয়া একজনকে পতিরূপে বরণ করিবে।”
জেবুন্নিসা বেগমের প্রার্থনা অনুসারে তাঁহার বিবাহের কথা ঔরঙ্গজেব বাদশাহ সর্ব্বত্র প্রচার করাইলেন। এই বিষয় সকলে জানিতে পারিলে অনেকেই জেবুন্নিসা বেগমের বিবাহ-প্রার্থী হন। তাঁহাদের মধ্যে আকিল খাঁও ছিলেন।
নিজ-বংশমর্য্যাদা বর্ণনাসহ বিবাহপ্রার্থীগণের প্রার্থনী-পত্র আসিয়া পৌঁছিলে, পিতা-পুত্ত্রীর মধ্যে অনেক আলোচনার পর লাহোরের সুবেদার আকিল খাঁর সহিতই জেবুন্নিসা বেগমের বিবাহ নির্দ্ধারিত হয়। তদনুসারে আকিল খাঁকে এ বিষয় জানাইয়া দিল্লীতে আসিবার জন্য ঔরঙ্গজেব বাদশাহ তাঁহার নিকট আদেশ-লিপি প্রেরণ করেন। বাদশাহী ফরমান্ পাইয়া আকিল খাঁ আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন, কিন্তু শীঘ্রই তাঁহার হরিষে বিষাদ ঘটিল।
ঔরঙ্গজেব বাদশাহের দরবারে আকিল খাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব ছিল না। সভাসদ্গণের মধ্যে অনেকেই জেবুন্নিসা বেগমের পরিণয়াকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আকিল খাঁর সহিত যে জেবুন্নিসা বেগমের বিবাহ হইবে, ইহা তাঁহাদের সহ্য হইল না। বাদশাহজাদী—বিশেষতঃ এমন যে একটী রমণীরত্ন তাহা আকিল খাঁ সকলকে ঠকাইয়া লইয়া যাইবে এমন কখনও হইতে পারে না। যে প্রকারেই হউক ইহার বাধা জন্মাইতে হইবে—এরূপ সকলে পরামর্শ করিয়া নিম্নলিখিত মর্ম্মের একখানি পত্র আকিল খাঁর নিকট প্রেরণ করা হইল।
“লাহোরে জেবুন্নিসা বেগমের সহিত তোমার যে গুপ্ত প্রণয় সংঘটিত হইয়াছিল একথা শাহানশাহ্ ঔরঙ্গজেব আলম্গীরের শুনিতে বাকী নাই। তিনি যে কি প্রকৃতির লোক, ইহা তোমার বিশেষরূপই জানা আছে—এ বিষয় অধিক লিখা বাহুল্য। বাদশাহজাদীকে বিবাহ করার প্রকৃত অর্থ যে প্রাণবধ ব্যতীত আর কিছুই নহে, ইহা তোমার মত সুচতুর লোকের বুঝিতে কঠিন হইবে না।”
কুটিল প্রকৃতির ঔরঙ্গজেব বাদশাহ যেমন সকলকেই অবিশ্বাস করিতেন—সেইরূপ তাহার উপরও শত্রু-মিত্র কেহই বিশ্বাস স্থাপন করিত না। সকলেই জানে, তাহার দ্বারা সাধিত হইতে না পারে এমন কার্য্য বিরল। এই সব জানিয়া-শুনিয়া আকিল খাঁ ভাবিলেন—ঔরঙ্গজেব বাদশাহ সরল চিত্তে তাঁহার নিকট ফরমান্ পাঠান নাই, নিশ্চয়ই তাঁহার মনে দুরভিসন্ধি আছে। বিবাহের প্রস্তাব সেই দুরভিসন্ধির আবরণ মাত্র। দিল্লীতে গেলে তাঁহার রক্ষা থাকিবে না—শিরশ্ছেদন বা হস্তিপদতলে বিমর্দ্দিত হইতে যে হইবে তাহার কোন সন্দেহ নাই।
এই সব নানা কারণে আকিল খাঁ মনে করিলেন—বাদশাহজাদীকে লাভ করা প্রাণের নিকট তুচ্ছ। অতএব তিনি জেবুন্নিসা বেগমকে বিবাহ না করাই স্থির করিলেন এবং তদনুসারে নিম্নলিখিত কবিতায় স্বীয় মনের ভাব ব্যক্ত করিয়া তাহা দিল্লীতে প্রেরণ পূর্ব্বক বাদশাহী কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া প্রাণভয়ে লাহোর হইতে সরিয়া পড়িলেন।
نہین هوتي بندہ سے طاعت زیادہ
بس اب خانه آباد و دولت زیادہ
নহিঁ হোতী বন্দাসে তায়েত জিয়াদা
বস্ অব্ খানা আবাদ ও দৌলত জিয়াদা।
দাসের দ্বারা অধিক আদেশ প্রতিপালিত হইতে পারে না। ধন দৌলত ও বাড়ী ঘরের এই শেষ।
জেবুন্নিসা বেগম আকিল খাঁর এই পত্র দেখিয়া অত্যন্ত মর্ম্মাহত হন এবং এ জীবনে আর বিবাহ না করাই মনে মনে স্থির করেন; কিন্তু তাঁহার মনোভাব কাহারও নিকট প্রকাশ করিলেন না।