জেবুন্নিসা বেগম/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
লাহোরের শাসনকর্ত্তা আকিল খাঁ কেবল রাজকার্য্যেই নিপুণ ছিলেন না, কবি বলিয়াও তাঁহার সুখ্যাতি ছিল। স্বীয় কর্ত্তব্য কার্য্যের অবকাশ সময় তিনি কাব্যানুশীলনে কাটাইতেন।
দিল্লীতে জেবুন্নিসা বেগমের সেখানে প্রায়ই যে “মশা’রা” অর্থাৎ কবি সম্মিলন হইত একথা দেশ বিদেশে প্রচার হইলে আকিল খাঁও ইহা শুনিতে পান। এ সংবাদ শুনিয়া তিনিও তাহাতে যোগ দান করিবার জন্য লালায়িত হন; কিন্তু এতদূর হইতে কিরূপে ইহা সংঘটিত হইতে পারে তাহার উপায় ভাবিয়া পান না।
এমন সময় আকিল খাঁর সৌভাগ্যে ঔরঙ্গজেব বাদশাহ অসুস্থ হওয়াতে চিকিৎসকগণের ব্যবস্থা অনুসারে বায়ু পরিবর্ত্তনের জন্য তিনি লাহোরে গমন করেন। সেখানে যাওয়ার পর অবধি ক্রমে তাঁহার স্বাস্থ্যের উন্নতি হইতেছে দেখিয়া তিনি আরও কিছু অধিক কাল লাহোরে বাস করিতে মনস্থ করেন এবং সেই উদ্দেশ্যে তাঁহার পরিজনবর্গকে দিল্লী হইতে লাহোরে আনয়ন করেন।
আকিল খাঁ দেখিলেন—জেবুন্নিসা বেগমের সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় করিবার ইহা এক বিশেষ সুযোগ উপস্থিত। তখন তিনি এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
পারস্যদেশ-নিবাসী সম্ভ্রান্তবংশীয় সুপুরুষ আকিল খাঁ যে সুবিজ্ঞ, এবং কাব্যালঙ্কার শাস্ত্রে তাঁহার বিশেষ অধিকার আছে, এ বিষয় জেবুন্নিসা বেগম অবগত হইয়া তাঁহার সহিত আলাপ করিবার জন্য তিনিও লালায়িত হন। কিন্তু তাঁহার পিতার কঠোর শাসনের আশঙ্কায় এ বিষয়ে কোন উপায় অবধারণ করিতে সক্ষম হন না।
ঔরঙ্গজেব বাদশাহের সহিত জেবুন্নিসা বেগম লাহোরে অবস্থান করিবার কালে তিনি তথায় একটী বাগান প্রস্তুত করেন। তাহার ভগ্নাবশেষ আজও বর্ত্তমান আছে। ঐ বাগান প্রস্তুত হওয়ার সময়ে তাহার কাজ দেখিবার জন্য প্রায়ই তিনি সেখানে থাকিতেন।
আকিল খাঁ ভাবিলেন—জেবুন্নিসা বেগমের সহিত দেখা হওয়ার যদি কোন সম্ভাবনা থাকে তবে তাহার প্রকৃত সময় এই। এ সময় চলিয়া গেলে এ জীবনে আর তাঁহার সহিত দেখা হওয়ার সুযোগ ঘটিবে না; অতএব এই সুযোগ ছাড়িয়া দেওয়া উচিত নহে মনে করিয়া আকিল খাঁ এজন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
জেবুন্নিসা বেগমের যে বাগান প্রস্তুত হইতেছিল তাহার নির্ম্মাণ-কার্য্য দেখার উদ্দেশ্যে তথায় তিনি অবস্থান করিবার কালে একদিন তাহার সহচরীদিগের সহিত চৌসর খেলিতে ছিলেন। এমন সময় আকিল খাঁ জীবন-মরণ পণ করিয়া মজুরের বেশ ধারণ-পূর্ব্বক ইট্, সুরকীর বোঝা মাথায় করিয়া সেখানে প্রবেশ করিলেন। হঠাৎ অজানিত ব্যক্তি উপস্থিত হওয়াতে জেবুন্নিসা বেগম চক্ষু তুলিয়া চাহিবা-মাত্র আকিল খাঁ বলিয়া উঠিলেন—
من در طلبت گردِ جهان می گردم
মন্ দর তলবত্ গির্দ-এ-জহাঁ মে গির্দন্
জেবুন্নিসা বেগম পূর্ব্বেই জানিয়াছিলেন, আকিল খাঁ তাহার সহিত সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল। উল্লিখিত এক চরণ কবিতা শুনিয়া এবং তাহার আকার-প্রকার দেখিয়া সুচতুরা বেগমের বুঝিতে বাকী রহিল না—এ ব্যক্তিই যে আকিল খাঁ। চৌসর খেলিতে খেলিতে তিনি এই উত্তর প্রদান করিলেন।
گر باد شوي بر سِر زلفم نه رسی
গর বাদ শুই বর সর-এ-জুলফম্ নরসী
বায়ুরূপে আসিলেও আমার কেশাগ্র পর্য্যন্ত পৌছিতে পারিবে না।
এই উত্তর শুনিয়া আকিল খাঁ নত শিরে চলিয়া আসিলেন। তাহার পর হইতেই জেবুন্নিসা বেগম ও আকিল খাঁর মধ্যে পত্রাদি চলিতে এবং গোপনে দেখা-সাক্ষাৎ হইতে আরম্ভ হয়।
ইতিমধ্যে ঔরঙ্গজেব বাদশাহ সুস্থ হইয়া দিল্লীতে ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু জেবুন্নিসা বেগমের বাগানের কাজ শেষ না হওয়াতে তিনি তাঁহার পিতার সহিত ফিরিয়া আসিলেন না। ঔরঙ্গজেব বাদশাহের লাহোরে অনুপস্থিতি বশতঃ উক্ত বেগমের সহিত আকিল খাঁর দেখা সাক্ষাতের বিশেষ সুবিধা ঘটে; কিন্তু এই সুযোগ অধিক দিন স্থায়ী হয় নাই।
জেবুন্নিসা বেগম ও আকিল খাঁর প্রণয়ের কথা যে দাসী জানিত, সে কার্য্যে অবহেলা করাতে উক্ত বেগম তাহাকে শাসন করেন। ইহার প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ঐ দাসী দিল্লীতে আসিয়া তাহার কর্ত্রী ও আকিল খাঁর প্রণয়ের কথা ঔরঙ্গজেব বাদশাহের নিকট প্রকাশ করিয়া দেয়।
উক্ত বাদশাহ এই প্রকারে তাঁহার কন্যা ও আকিল খাঁর প্রণয়ের কথা দাসীর নিকট হইতে অবগত হইয়া অত্যন্ত রাগান্বিত হইলেন, কিন্তু স্বীয় মনোভাব কোনরূপে প্রকাশ করিলেন না। জেবুন্নিসা বেগমকে আর লাহোরে থাকিতে দেওয়া কোন মতেই যুক্তিসঙ্গত নহে মনে করিয়া তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁহার কন্যাকে লিখিয়া পাঠাইলেন—পত্র পাওয়া মাত্র যেন তিনি দিল্লীতে চলিয়া আইসেন কোনরূপ বিলম্ব যেন না হয়।
ঔরঙ্গজেব হেন বাদশাহের আদেশ অবহেলা করিতে পারে—এমন সাধ্য কোন্ ব্যক্তির আছে? তাঁহার পিতার আদেশানুসারে জেবুন্নিসা বেগম অগৌণে দিল্লীতে চলিয়া আসিলেন।