জেলের খাতা/আভাস ও আকাঙ্ক্ষা

চতুর্থ চিন্তা

প্রথম অধ্যায়

আভাস ও আকাঙ্ক্ষা

 হে দেব! তোমার তত্ত্ব এ অধমের নিকট কবে সুষ্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করিবে বল। নিরাকারে ভক্তি হয় না। অত্যন্ত ব্যাপকভাবে যখন তত্ত্ববস্তুকে দেখি, তখনও মন ছড়াইয়া যায়, ভাল করিয়া ধরিতে পারি না। পুরুষরূপে যে আমি তোমার ভজনা করিতে চাই। সে পুরুষরূপ তোমার কোথায়? তাহাই আমার নিকট প্রকাশিত কর। তুমি আদ্যাশক্তি ইহা বেশ বুঝি। তুমি করণ-কারণ বেশ ধরিতে পারি। বিশ্বের আশ্রয় তোমার অনন্ত জ্ঞান ইহাও যেন ধরিতে পারি! কিন্তু এ সকলই তোমাকে দূরে, অতি দূরে রাখে। সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম, এতটা মনে হয় যেন ধরিতে পারা যায়। তুমি জগতে পরিবর্ত্তনের মধ্যে নিত্য, তুমিই জ্ঞানজালে বিশ্বের বিচিত্রতাকে ধরিয়া আছে, ফলে এই সত্য ও জ্ঞান অনাদি অনন্ত, সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বগত, বিভু ও মহান্, তুমি ব্রহ্ম, ইহা যেন বুদ্ধিতে কিয়ৎপরিমাণে ধারণা সম্ভব। কিন্তু তুমি আনন্দহেতু, তুমি ভগবান, তুমি আমার সঙ্গে নিত্য লীলা করিতেছ, তুমি পুরুষ, আমি তোমার প্রকৃতি, তুমি নিয়ত দিতেছ আমি নিতেছি, আবার আমি দিতেছি তুমি নিতেছ। এই মধুর আদান প্রদানের সমন্ধ তোমার সঙ্গে আমার,—ইহা বুদ্ধিতে বুঝিলেও ঠিক ধ্যান করিতে পারি না। তোমাকে আংশিকভাবে নানা আধারে ধ্যান করিতে পারি। পিতার আধারে,—পিতৃদেবের দেহে ও চরিত্রে ও কার্য্যে এবং নিজের অন্তরস্থ যে পিতৃভাব যাহা সন্তানকে আশ্রয় করিয়া এ অধমের মধ্যেও প্রকাশিত হইতেছে, তাহাতে তোমাকে পিতারূপে ধ্যান করিতে পারি। মাতৃ-আধারে আমার মাতাঠাকুরাণীর দেহে ও চরিত্রে ও আমার সন্তানগণের মাতৃদেহে ও মাতৃভাবে তোমার মাতৃত্ব ধ্যান করিতে পারি। সখা-দেহে তোমার সখিত্ব, প্রভুদেহে তোমার প্রভুত্ব, পুত্র-কন্যার মধ্যে তোমার পুত্রত্ব ও কন্যাত্ব, মানুষের মধ্যে তোমার মানুষী তনু, এ সকল খণ্ড খণ্ড ভাবে ধ্যান করা সম্ভব। মাঝে মাঝে এ ধ্যান করিয়া পরমানন্দ লাভ করি। কিন্তু দেব! তুমি যে একাধারে পিতামাতা সকলই, পরমপুরুষরূপে তুমি সর্ব্বত্র সর্ব্বদা বিরাজ করিতেছ,—তুমি অন্তর বাহির পূর্ণ করিয়া আমাকে অধিকার ও আচ্ছন্ন করিয়া, আবার আমার বাহিরে পরম-অনাদি-অনন্ত-পুরুষরূপে বিরাজ করিতেছ। তুমি অজর-অমর-নিত্য-নিরাময়-চিদানন্দ-সদানন্দ-ভূমাষড়ৈশ্বর্য্য ও সর্ব্বৈশ্বর্য্যময়, ত্রিগুণাতীত পরম দিব্য পুরুষ—এই সত্য ধ্যানে আনিতে পারি না। গুরুদেহে ও শ্রীগুরুচরিত্রে তোমাকে ধরিতে যাই—সেই দেহের ও সে জীবনের প্রাকৃতভাব আসিয়া দৃষ্টিকে আবৃত করে, চিত্তে সন্দেহ জাগাইয়া দেয়, সেখানেও তোমাকে ভাল করিয়া ধরিতে পারি না। ঠাকুর, একদিন নিরাকারের কল্পিত ভজনায় আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করিতাম। ব্যাপকতা ভাবে তোমার ধ্যান করিয়া, নিজের প্রাণে যে আনন্দ পাইতাম, তারই মধ্যে তোমার অরূপ-মোহিনীমূর্ত্তি কল্পনা করিয়া তৃপ্ত হইয়াছি। সে আনন্দরস—ভোর চক্ষে জড় ও জীবকে দেখিয়া পুলকে পূর্ণ হইয়াছি। কিন্তু এখন আর তাহাতে প্রাণ জুড়ায় না যে প্রভো! এখন তোমাকে আরো নিকটে, আরো ঘনভাবে দেখিতে চাই। তোমার কি কোন রূপ নাই? তবে বিশ্বের এ রূপের ঢেউ কোথা হইতে আইসে? তোমার কি কোন দেহ নাই? তবে বিদেহী আত্মা তোমাকে সম্ভোগ করে কি-রূপে? তুমি যদি একান্ত নিরাকার হও, তবে বেদান্তের সিদ্ধান্তই তো সত্য হইয়া যায়। তবে ব্রহ্মানন্দ প্রগাঢ় সুষুপ্তিতুল্য ভিন্ন আর কি হইতে পারে? যেখানে জ্ঞাতা নাই জ্ঞেয় নাই, কেবলই জ্ঞান আছে, ভোক্তা নাই ভোগ্য নাই, কেবল সম্ভোগ কেবল আনন্দ আছে,—সে তো সুষুপ্তির অবস্থা। ইহাই তো নিরাকারের মীমাংসা। কৈবল্য বা লগ্নমুক্তিই যে নিরাকার-তত্ত্বের পরিণাম। তবে তো মায়াবাদই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আর তাহা যদি সৎ সিদ্ধান্ত না হয়, তাহা হইলে, মহাপ্রভু যাহা বলিয়াছেন, শঙ্কর সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে, আমাদের ব্রাহ্ম সিদ্ধান্ত সম্বন্ধেও তো তাহাই সত্য হয়:—

“ব্রহ্ম” শব্দ মুখ্য অর্থে কহে ভগবান্,
চিদৈশ্বর্য্য পরিপূর্ণ অনূর্দ্ধসমান।
তাঁহার বিভূতি দেহ সব চিদাকার;
চিদ্বিভূতি আচ্ছাদিয়া কহে নিরাকার।

এই চিদ্বিভূতি ও এই চিদ্‌দেহ, এই চিদ্‌রূপ কি প্রভো! তাই যে দেখিবার জন্য প্রাণ সময় সময় লালায়িত হইয়া উঠে। এই রূপ প্রকাশিত কর প্রভো! হে গুরো, পরম দয়াল তুমি, দয়াপরবশ হইয়া, এই অধমকে ঐ চিৎরূপের নিকট লইয়া যাও। সকল সন্দেহ দূর কর গুরো! তোমার চরণ ভিন্ন আর এ সাধন-ভজনহীনের গতি কি আছে বল। তর্কে এ বস্তু লাভ হয় না। গুরুকৃপাই এ পথে সম্বল, শুনিয়াছি। গুরো! আকাঙ্ক্ষা যদি জন্মাইলে, তবে দয়াগুণে তাহা পূর্ণ কর। তোমার শ্রীচরণে এই প্রার্থনা। তুমি ধন্য হে গুরো তুমি ধন্য। তুমি ধন্য। তোমারই জয়। গুরো! তোমারই জয়, তোমারই জয়।

 হে গুরো! আবার এক নূতন প্রভাতে তোমার চরণতলে আসিলাম। ঠাকুর, বড় সাধ যায় জীবনের সকল ভার তোমার চরণে অর্পণ করিয়া তোমার একান্ত অনুগত হইয়া বাকী ক’টা দিন কাটাই। কিন্তু, প্রভো! সময় থাকিতে এ সাধ কেন জন্মাইলে না? যখন সাক্ষাৎভাবে বাঁধিয়া চালাইতে পারিতে, তখন, কেন ঠাকুর, আমার অহঙ্কার অভিমানকে জব্দ করিলে না? আমি যে অবিশ্বাসী, সহজে শ্রদ্ধা জন্মে না, সেই অপরাধেই কি তখন দখল কর নাই? এখনও যে আমার অবিশ্বাস পূরা আছে! তুমি তাহা জান। চাই তোমারে সকল দিতে, কিন্তু তুমিও যে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছ, প্রত্যক্ষভাবে যে তোমায় পাই না। আর মনের ভিতর তোমায় ধরিতে যাই, সন্দেহ অমনি জাগে,—এ আমার কল্পনা, না—সত্য সত্য তোমার প্রেরণা? আমি, নিরাকারে যা কিছু সামান্য আস্থা ছিল, তাও হারাইয়াছি, আর চিদাকার যা—সত্যবস্তু তাহাও ধরিতে পারিতেছি না। আমি যে উভয়ভ্রষ্ট হইয়া পড়িতেছি। বুদ্ধি দিশাহারা হইতেছে। বিশ্বের চরম তত্ত্ব একান্ত নির্গুণ, নির্ব্বিশেষে নিরাকার নহে, এ জ্ঞান ক্রমেই বাড়িতেছে। কিন্তু সগুণ তত্ত্বও তো ভাল করিয়া ধরিতে পারিতেছি না। কখনও ভাবি, গুরুদেহে ও গুরুচরিত্রেই সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম প্রকাশিত, আবার দেহ নশ্বর, মানুষী ভাব সীমাবদ্ধ ও মায়াবদ্ধ,—তার মধ্যেই বা অবিনশ্বর, মায়াতীত, অনন্ত চৈতন্যের প্রকাশ কেমনে হয়, এ সন্দেহ জাগে। গুরুদেহ ও গুরুর মন ভগবদ্‌বিভূতি যদি বলি, তাহা হইলে, সূর্য্যাদির মত তাহা বিভূতির প্রকাশ হয়, স্বরূপ প্রকাশ তো হয় না। আর আমার প্রাণ চাহে সেই স্বরূপ প্রকাশ প্রত্যক্ষ করিতে। বিভূতিতে তাঁহাকে দেখিয়া স্থির-ভক্তি লাভ করা যায় না। স্বরূপ সাক্ষাৎ পাইলে পরে বিভূতি ভক্তি প্রেমের অবলম্বন ও উদ্দীপনা হয় বটে, কিন্তু তার আগে, বিভূতি কেবল মনকে শূন্যে নিক্ষেপ করিয়া খেলিয়া বেড়ায়। সেই স্বরূপ কোথায় দেখিব? আপনার মধ্যে, তাহাও একান্ত অন্তর্মুখীণ (subjective) হইয়া যায়, তাহার বস্তুতন্ত্রতা (objectivity) তো থাকে না। আমি এ বড় বিষম গোলে পড়িয়াছি। কেহ নাই গুরো! এ সমস্যা আমার মীমাংসা করিয়া দেয়। তুমি অন্তর দেখিতেছ, আরো কত কথা যে সেখানে আছে, তাহা তুমি জান। সে সকলের একটা ব্যবস্থা কর। তোমার চরণে এই প্রার্থনা। জয় গুরো! তোমারই জয়। তুমি ধন্য, তুমি ধন্য, তুমি ধন্য।

 হে গুরো! তোমার জয় হউক। তোমার নামের জয় হোক। তোমার প্রেমের জয় হোক। এই বন্ধনের শত দিবস তোমার কৃপায় কাটিল। কত ভয়, কত ভরসা, কত ভাবনা হয়েছিল, কি করিয়া এ ভাবে দিন যাবে, কিন্তু তোমার লীলা কে বুঝিবে প্রভো! তুমি কত নিগূঢ়ভাবে কত কি যে কর, তাহা তুমিই জান। অন্ধ আমি, তোমার লীলা না দেখিয়া কেবল ভয়ে ভয়ে মরি। দয়াল, যে দিন তোমার আশ্রয় দিয়াছ, সে দিন হইতেই যে আমাকে নিরাপদ করিয়াছ, সাধুমুখে এ কথা শুনিতাম। সদ্‌গুরুর আশ্রয় যে পাইয়াছে তার সকল ভয় কাটিয়াছে, সাধুরা বলেন। তাই কি সত্য, প্রভো? আপনা প্রতি নিরখি না দেখি নিস্তার—নিজের পানে তাকাইয়া তো কিছুই ভরসা পাই না। আর দীনবন্ধো! তোমার উপরেও তো একান্ত নির্ভর জন্মে না। যে তোমার পায়ে শ্রদ্ধাভরে সকল ভার অর্পণ করিতে পারে না, মানুষী তনু আশ্রয় করিয়া তাহার নিকট আত্মপ্রকাশ করিয়াছ বলিয়া যে তোমার পরাশক্তি ও জ্ঞানবলক্রিয়াতে একান্ত আস্থা রাখিতে ভয় পায়, পথ দেখে না, অবিপশ্চিৎ, মূঢ়, অন্ধ, অহঙ্কৃত, দেহাভিমানী, জ্ঞানাভিমানী যে, যে ভালমন্দ সত্যাসত্য বিচারও করিয়া উঠিতে পারে না, কোন মীমাংসাতেই সুপ্রতিষ্ঠ হয় না, এমন লোককে তুমি কেমন করিয়া যে অভয় দান কর, তাহা জানিতাম না। এখনো জানি যে, এমন কথা বলিতে পারি না। তবে দেখিয়া শুনিয়া মনে হয়, গুরো! আর ভয় নাই—ইহলোকেও আর ভয় নাই, লোকান্তরেও নাই। সম্পদে তোমায় দেখি না সকল সময়, কিন্তু বিপদে, অসহায়তায়, নিরুপায় হইয়া যখন পড়ি, আপনার বলে যখন আর কুলায় না, আপনার হালে আর যখন পানি পায় না, তখন গুরো! তোমার চরণের দিকে দৃষ্টি পড়ে। এত দিন অনির্দ্দেশ্য ভাবে, দেবতার বা বিধাতার প্রতি মন যাইত, তাহাকেই আশ্রয় করিতে চাহিত, কিন্তু নিরাকারে অজ্ঞাতে, এ অবিশ্বাসীর অন্ততঃ শ্রদ্ধা স্থায়ী হয় না। এবারে, এই কারাগারের নির্জ্জনতার মধ্যে, এই ভীষণ অসহায়তার ভিতরে, প্রভো! তুমি তোমার চরণাশ্রয় একটু খুলিয়া দিলে, এই কি তোমার উদ্দেশ্য ছিল? তুমি জান, ঠাকুর, আমি এখন এই চাই, তোমার বিধানে যা হয়, তাই কর, কিন্তু ঐ আশ্রয় আমার আরো দৃঢ়, আরো সুস্পষ্ট, আরো প্রকাশ কর। ঐ চরণে মনকে দৃঢ় করিয়া বাঁধ।

তোমার চরণে, আমার পরাণে
বাঁধহ প্রেমের ফাঁস,

এম্‌নি করে’ বাঁধ ঠাকুর, যেন আর পালাতে না পারি। আর যেন চিত্ত বিচলিত না হয়। তুমি আমার আশ্রয় তো আছই, প্রকাশিত হও কেবল। সাক্ষাৎ ভাবে, প্রত্যক্ষ প্রভু হইয়া জীবনকে চালাও, মনকে সংযত কর, ইন্দ্রিয় সকলকে নিয়মিত কর, চিত্তকে শান্ত কর, কর্ম্মকে পরিচালিত কর, আর নিগূঢ় তত্ত্ব সকল প্রাণে ফুটাইয়া চিরদিনের জন্য আমাকে তোমার করিয়া রাখ। গুরো! তোমারই জয়, তোমারই জয়, তোমারই জয় হউক। তুমি ধন্য! তোমার প্রেম ধন্য! তোমার লীলা ধন্য। তোমার দয়া ধন্য!

 হে গুরো! এই নূতন দিনের সূচনায় তোমার চরণে প্রণাম করিতেছি। তুমি আমাকে রক্ষা কর। তুমি আমাকে তোমার চরণাশ্রয় দান কর। তুমি আমার ভববন্ধন মোচন কর। তুমি আমাকে দয়া করিয়া সত্যবস্তু, তত্ত্ববস্তু, দেখাইয়া কৃতার্থ কর। আমি যেন, প্রভু, উভয়ভ্রষ্ট না হইয়া যাই। আমি কিছুই তো বুঝি না। কেবল, মাঝে মাঝে একটা লোভ অনুভব করি মাত্র। সে কি দেহবিকার, সে কি কেবল প্রাকৃত রূপলিপ্সা না সত্য সত্য তাহা তোমার লীলা, বুঝি না। নিখিলরসামৃত মূর্ত্তি কথাটা কিছু দিন হইতে অভ্যস্ত হইয়াছে। ইহার সাধারণ ভাবও একটু আধটু মনে জাগিয়াছে কিছু দিন হইতে। এ ভিন্ন যে ভক্তির ও প্রেমের অন্য উপজীব্য নাই, ইহাও বুদ্ধিতে, জ্ঞানেতে, মনে হয় যেন বুঝিয়াছি একটু আধটু। কিন্তু এ বস্তু কি, এ তত্ত্ব কি, ইহা ভাল করিয়া ধরিতে পারিতেছি না। চিদাকার কি, গুরো! আমায় বুঝাইবে কি? দেখিবার অধিকারী নহি, সে আব্দার করি না, সে হবে, যে দিন তোমার কৃপা হইবে সেদিন। আমি কিন্তু এ তত্ত্ব না বুঝিলে কেবল আঁধারে ঘুরিতেছি মনে হয়। “চিৎস্বরূপ আচ্ছাদিয়া কহে নিরাকার” প্রভো! আমি তো আযৌবন ইহাই করিয়া আসিয়াছি। এখন তাতে প্রাণ মানে না, জ্ঞানও তৃপ্ত হয় না যে? ভগবান্ যদি জ্ঞানময় হন, তবে তাঁহাকে আমাদের সর্ব্বপ্রকার বিষয় ভোগ জানিতে হয়, তিনি তাহা জানিয়া থাকেন। ভগবৎ-জ্ঞান কখনো পরোক্ষ হয় না। প্রত্যক্ষ বিষয়জ্ঞান, জীব যে ইন্দ্রিয় ভোগ করে, তার প্রত্যক্ষজ্ঞান ভগবানের তবে কেমন করিয়া হয়? এই জ্ঞানার্থে ভগবানেরও ইন্দ্রিয়বৃত্তি তো থাকা চাই। sensorium মন ষষ্ঠেন্দ্রিয়, যাহা চক্ষুকর্ণের যন্ত্রের চালক ও মাথক,—যাহা সাকার নহে,—তাহা ভগবানের থাকিবে না কেন? সর্ব্বোন্দ্রিয়গুণাভাসং—ইহারই বা অর্থ কি? এ সকল প্রশ্ন উঠে। ভগবানের চিৎস্বরূপ তবে আছে তো মনে হয়। সে রূপ নিরাকার নহে। সে রূপ আমাদেরই স্বরূপের নির্ম্মল সত্তা, আর কি হইতে পারে? তবেই তো অখিলরসামৃত মূর্ত্তি সত্য বস্তু হইয়া দাঁড়ায়। সে মূর্ত্তি চিৎদর্শন গ্রাহ্য চিৎবৃত্তি—ভোগ্য, তার সঙ্গে লীলা সম্ভব হয়। হে গুরো! এ সকল সন্দেহ মনে উঠিতেছে। তুমি দয়া করিয়া, এ সকল তত্ত্ব এ অধমের চিত্তে প্রকাশ করিবে কি? তোমার চরণে এই প্রার্থনা। তোমার জয় হউক গুরো! তোমারই জয় হউক, তোমারই জয় হউক! তুমি ধন্য, তুমি ধন্য, তুমি ধন্য!

 হে গুরো, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছিনা, এই যে ভাব, এই যে আকাঙ্ক্ষা, এই যে পিপাসা প্রাণে জন্মাইতেছে, ইহার প্রকৃত মর্ম্ম কি? এ কি আমার চিত্ত-বিকার, না আমার আজন্ম বা আযৌবন লালিত রূপলিপ্সারই একটা মায়িক খেলা? কেন প্রভো! ঐ রূপ দেখিবার জন্য প্রাণ অস্থির কখন কখন হয়? তোমার মুখে শুনিয়াছি সে অপ্রাকৃত রূপ, শাস্ত্রেও তাই পড়িয়াছি ও পড়িতেছি, কিন্তু আমার মানসপটে যাহা বুঝিতে চায়, তাহা তো ঠিক অপ্রাকৃত বলিতে সাহস হয় না। প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত কি, গুরো! কোন ঐকান্তিক বিরোধ আছে? শাস্ত্রে তো সর্ব্বদাই দেখি প্রাকৃতকে অবলম্বনে অপ্রাকৃতকে নির্দ্দেশ করিয়াছে। এদিকে অপ্রাকৃত মদন নাম দিয়া, প্রাকৃত মদনের ভাবভঙ্গী ও রাগভাসের দ্বারাই যে সে অপ্রাকৃত লীলার ব্যাখ্যা করিয়াছে। কৃষ্ণের নিত্যরূপ কি প্রভো! সে কি মানুষিক রূপ নহে? সে কি দ্বিভুজ প্রেমময় মূর্ত্তি নহে? আর সে রূপ কি এই চাক্ষুষ রূপের সঙ্গে জড়িত নহে? যদি তাহা না হয়, তবে ঘনশ্যাম রূপ যা চক্ষে ভাসে, তা তো মানুষিক রূপেই দেখি ও শুনি। সে কি তবে মায়িক? এ কি তবে আমাদের ইন্দ্রিয়েরই কল্পনা? গুরো! আমি এর কিছুই বুঝিতেছি না, অথচ ঐ রূপেই যেন মন ক্রমে আকৄষ্ট হইতেছে। নিরাকারের উপাসনা আমার অসম্ভব করিয়া তুলিতেছ কেন? বহুদিন হইতেই একান্ত নিরাকারের ধারণার চেষ্টা ছাড়িয়াছি। তাহা তুমি জান। বিশ্বরূপে, বিশ্বেশ্বরকে দেখিতে চেষ্টা করিতেছিলাম। পিতৃরূপে পিতৃবিগ্রহে, তাঁর পিতৃত্ব, মাতৃদেহে তাঁর মাতৃত্ব, সখার দেহে তাঁর সখিত্ব, পুত্র কন্যার মধ্যে পুত্র-কন্যা-রূপে তাঁর বাৎসল্য, প্রভুর মধ্যে প্রভুদেহে তাঁকে প্রভু, আর দাসদাসীর মধ্যে তাঁর সেবা ও পরিচর্য্যা ও দাস্য এবং সতীদেহে ও পতিদেহে তাঁর মাধুর্য্য প্রত্যক্ষ ও আস্বাদন করিতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু, প্রভো! এ সকল যে নশ্বর, আজ আছে কাল থাকে না। এ সকলে তোমার পিতৃত্ব, মাতৃত্ব, সখিত্ব, দাস্য, বাৎসল্য, মাধুর্য্য, প্রকাশ হয় মাত্র, কিন্তু পর্য্যবসিত তো হয় না। এ সকল তো তাঁর নিত্য মূর্ত্তি, নিত্য আশ্রয়, নিত্য আধার ও নিত্য বিগ্রহ নহে, ও হইতে পারে না। আর যদি তোমার এ সকল রসের কোন নিত্য বিগ্রহ, নিত্য মূর্ত্তি, নিত্য আশ্রয় না থাকে, তবে এ সকল অনিত্যেরই বা প্রকাশ সম্ভবে কিসে? তাহা হইলে তো দেখি, এই বলিতে হয় যে তোমার রস জগতের বিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই ফুটিয়া উঠিতেছে। মানুষ যত জ্ঞানে, প্রেমে পুণ্যে, মঙ্গলে, উন্নত ও বিকশিত হইতেছে, ততই তুমিও জ্ঞানে, প্রেমে, পুণ্যে, মঙ্গলে ফুটিতেছ। আদৌ তুমি নির্গুণ, নিরাকার, অচেতনবৎ-চৈতন্যাশ্রিত—Pure Being,—জগৎ-বিপরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে সজ্ঞান, সপ্রেম, সমঙ্গল হইয়া উঠিতেছ। বামমার্গী হিগেলিয়ান সম্প্রদায়, শুনিয়াছি, এই সিদ্ধান্তেরই প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন। ব্রাহ্ম সিদ্ধান্তও তো তবে ইহাই হয়। অন্ততঃ অন্য কোন সিদ্ধান্ত যৌক্তিক ও সুপ্রতিষ্ঠ ও সহজ হয় না। তাই, দেখিতেছি, গুরো! তুমি ক্রমে ক্রমে অপূর্ব্ব কৌশলে অধমকে কোন্ স্থানে আনিয়া ফেলিলে। আগেকার সব সত্য যে কল্পনাতে পরিণত হইতে চলিল। কিন্তু আমি বুঝি না কিছু। প্রকাশিত কর; গুরো! প্রকাশিত কর, সত্য প্রকাশিত কর। বস্তু প্রত্যক্ষ করাও। ধীরে ধীরে যে দিকে চালাইতেছ, সে পথ উজ্বল কর। সকল সন্দেহ ভঞ্জন কর। তোমার শ্রীপাদপদ্মে এই মিনতি। জয় গুরো! জয় গুরো! জয় ধর্ম্মাবতারণ, জয় অদ্ভুতলীলাময় তুমি। তোমার চরণে সহস্র প্রণাম।

 হে দীনদয়াল, তোমার কবে এ দয়া এ অধমের প্রতি হইবে যে আমি সত্য, সবল, প্রেম পাইয়া, সেই প্রেমে, তোমার ভজনা করিতে পারিব। গুরো! তোমার নাম করি, তোমার চরণে আত্মসমর্পন করিতে চাই, নিজের স্বামিত্ব, আমিত্ব তোমাকে দিয়া, তোমার সম্পূর্ণ বশ হইয়া থাকিতে চাই,—ইহার কারণ এই যে আমি আমার ভার আর বহিতে পারি না। তাতে কেবলই যাতনা পাই, কেবলই ক্লেশ নিরাশা ও নিষ্ফলতা ভোগ করি, সুখ আরাম সদ্‌গতি পাই নাই। এই তো আমার ভিতরকার কথা। ইহা তো অতি নীচ ভাব, প্রভো! এ যে কামগন্ধপূরিত। ইহাতে তো ভক্তি লাভ কদাপি হয় না। এই সকাম ভজনা হইতে কবে এ অধমকে মুক্ত করিবে? ফলতঃ এই যে তোমার নাম করি, তাহাও তো নিজের স্বার্থের লোভে। নামের রস তো প্রভো! এখনও প্রাণে জাগিল না। প্রাতঃ সন্ধ্যা যখন তোমার স্মরণ করিতে চেষ্টা করি, তার মধ্যে চক্ষে জল তখনই আসে, যখন নিজের প্রিয়জনের ভিতর দিয়া আশৈশব তুমি কি দিয়েছ তাহা ধ্যান করি, তাতেই প্রাণে আনন্দ হয়। নইলে অন্য সময় পিতৃ মাতৃ ভ্রাতৃ ভগিনী সখা সখী স্ত্রী পুত্র এদের চিন্তা যখন ছাড়িয়া কেবল নাম করি তখন তো কিছুই ভাব জাগে না। ঠাকুর, এ দুর্দ্দশা ঘুচিবে কবে? কেন নামে রস পাই না? এক সময় তো এর চাইতে বেশী পাইতাম। কখনো মনে হয়, এ শুষ্ক জ্ঞানপ্রধান নামে আর বুঝি আমার রুচি হবে না। বরং যখন কৃষ্ণনাম মুখে আসে, আর অন্তরে সে নবদূর্ব্বদলশ্যাম, সে কিশোররূপমাধুরী ভাসিয়া উঠিতে থাকে, তখন শরীর মন এক যেন অপূর্ব্ব রসের আভাস প্রাপ্ত হয়। একি, প্রভো! আমি তো কিছুই বুঝি না। এ কি ইন্দ্রিয়বিকার না অধ্যাত্মসম্পদ? ভোগী প্রকৃতি রসলিপ্‌সু প্রাণ, রূপের পিয়াসু চিরদিন,—তাই কি এই ধর্ম্মের ও সাধনের আবরণের ভিতরে ফুটীয়া উঠিতেছে? আমি কিছু বুঝি না। এই দেখি গুরো! যখন কৃষ্ণহে কৃষ্ণহে, কৃষ্ণহে, রক্ষ মাং কৃষ্ণহে, কৃষ্ণহে, কৃষ্ণহে ত্রাহিমাং বলি,—দু চার বার বলিতে বলিতে চক্ষুজলে হৃদয় ভাসে, শরীর যেন পুলকে পুরিয়া উঠিতে চাহে। আবার যখন হরের্নামৈব কেবলং হরের্নামৈব কেবলং হরের্নামৈব কেবলং—ইহা মুখে উচ্চারণ করিতে থাকি, তখন আপনা হইতে ভিতরে তোমার দত্ত নাম আরত্তি হইতে থাকে। আবার এও বুঝি না, ঠাকুর, যদি কৃষ্ণভজনাতেই আমায় টানিতে চাহ, তবে তোমার ভজনাই বা করি কেমন করিয়া? তোমার সঙ্গে কৃষ্ণের সম্বন্ধ কি? এ কি আমার দৈনন্দিন গীতা ও চৈতন্যচরিতামৃত পাঠের ফল? তাও বুঝি না। এ পাঠে এত আরাম পাইতেছি যে ইহা বন্ধও তো করিতে পারি না। আমি, ঠাকুর কখনো জীবনে এমন সমস্যায় পড়ি নাই। এ সকল তোমারই লীলা। তবে আমায় আর দ্বিধার মধ্যে ফেলিয়া রাখিওনা, এই প্রার্থনা করি। আমার চক্ষু খুলে দাও। তুমি ভিন্ন আমার চক্ষু খুলে এমন আর কাহাকে দেখি না। গুরো! অধমকে শিক্ষা দাও, তোমার চরণে এই ভিক্ষা মাগি।

 হে গুরো! আজ তোমার চরণে বিশেষভাবে আমার এই জন্মভূমি মাতৃভূমির জন্য প্রার্থনা করিতেছি। আজ তোমার বিধানে আমি বন্দী, দেশের ভাইয়েরা যখন মাতৃবন্দনা করিতেছেন, মায়ের দুঃখ শোক মোচনের পন্থা বিচার করিতেছেন, আমি তখন এখানে আবদ্ধ। বড় সাধ ছিল যে তাদের সঙ্গে যাইয়া আবার এ সকল আলোচনা করিব। তুমি অন্য বিধান করিলে। তোমার ইচ্ছারই জয় খুব হইয়াছে—তাই হউক, তাতে মঙ্গল ভিন্ন অমঙ্গল কখনো হবে না। তবে আমার ক্ষুদ্র প্রাণ আজ তোমার চরণে দেশের কল্যাণ ভিক্ষা করিতেছে। প্রভো! কি পাপে বা কি কর্ম্মদোষে যে এমন জগৎকে এত হীন করিয়া রাখিয়াছ, তুমিই জান। দয়াল, আমাদের তাতে প্রাণে বাজে। এও তোমারই কৃপা। তুমি মুখ ফিরাইতেছ, তাই আমাদের প্রাণে এত যুগ যুগান্তর পরে, এই বেদনা অল্পে অল্পে জাগিতেছে। এ বেদনা তোমারই বেদনা, তোমারই অনুকম্পা, তোমারই কৃপা নির্দ্দেশ করিতেছে। আশা হয়, দয়াল, এ দুঃখের নিশ্চয়ই অবসান হইবে। এ দুঃখ নিশ্চয়ই ঘুচিবে। সেই আশায় আজ তোমার চরণে প্রার্থনা করিতেছি, প্রভো, আমার মাতৃভূমির দুঃখ তুমি সত্বর দূর কর। আর, এ অধমের রাত্রিদিন তাঁরই সেবায় নিয়োজিত কর। এই তো তোমারই যজ্ঞ। এতদিন যা কিছু করিতে পারিয়াছি বা করিতে চেষ্টা করিয়াছি, তাও তো তোমারই প্রেরণায়, তোমারই অযাচিত-দত্ত শক্তিগুণে, আমি যে অতি অধম, প্রভো! আমি তাহা জানি। অন্তর্যামী তুমি ত তাহা ভাল করিয়াই জান। আমি তো আজ সকালই তোমার হাতের পুতুল হইয়া, যে ভাবে নাচাইয়াছ, সেই ভাবে নাচিয়াছি। সকল মানুষই তো তাই, এ জগৎ সংসার তোমারই যে বিচিত্র রঙ্গালয়। এতকাল বা কিছু করিয়াছি, তাহা তুমিই করাইয়াছ। এখন যে আরো বাকি দিনও মায়ের সেবায়, জাতির কল্যাণসাধনে, দেশের দুঃখমোচনের চেষ্টায় অতিবাহিত হউক, এই ইচ্ছা করিতেছি। এ বাসনাও তো তুমিই জাগাইয়াছ। তোমার প্রেরণা, তবে প্রভো, তুমি পূর্ণ কর। তোমার চরণে এই প্রার্থনা। সাধুতার মন্ত্রে ভাল করিয়া দীক্ষিত কর। ঐ স্বরূপ প্রকাশ করিয়া, তাহা যে তোমারই বিলাস, তোমারই দয়া, ইহা বুঝাইয়া, প্রভো দেশের হিতে জীবন যাপন করিবার সামর্থ্য ও সুযোগ অধমকে দাও। আমার গুণাগোষ্ঠী সকলে, এই ভাবে তোমার সেবা করুক। তুমি এই আশীর্ব্বাদ কর। তোমারই জয়, গুরো! তোমারই জয়, তোমারই জয় হউক। তুমি ধন্য। তোমার নাম ধন্য! তোমার প্রেম ধন্য। তোমার অপার করুণা ধন্য।

 হে দয়াল, তোমার কৃপায় আর একদিন কাটিয়া গেল। তার জন্য তোমার চরণে শত সহস্র প্রণাম করি। আমি ঠাকুর, কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না। তুমি আমার জ্ঞানগৌরবকে সব ঘুলাইয়া দিতেছ কি? তাও তো বুঝি না। আমার মনে হয় যেন একটা নতুন সত্যের রাজ্যে যাইতেছি, কিন্তু সাহসে তাহাতে নির্ভর করিতে পারি না। আমার অন্তরের অবস্থা তুমি তো সুস্পষ্টই বুঝিতেছ; তাহা দেখিয়া তুমি আমায় চালাইয়া নেও, এই তোমার চরণে আমার প্রার্থনা।

 প্রভো! আজ আবার তোমার চরণে আমার এই পতিত মাতৃভূমির জন্য প্রার্থনা করিতেছি। ইহার দুঃখ যাতনা তুমি দূর কর। যে অলৌকিক অধ্যাত্ম সম্পদ তুমি ইহাকে দিয়াছিলে, তাহা নষ্ট হইয়া যাইতেছে দয়াল, জগতে কি তাহা পাবে না? ইহার ধর্ম্ম কর্ম্ম রক্ষা কর। ইহার সন্তানগণের জীবনে শক্তি, প্রাণে সাহস, হৃদয়ে ভক্তি দাও, যেন ইহারা প্রাণপণে মাতৃসেবায় সমুদায় উৎসর্গ করিয়া তোমার লীলা প্রচার করিতে পারে। প্রভো! কৃপা কর, কৃপা কর।

 আর এ অধমকে এখন কোন্ তালে নাচাইতে চাও, বল দেখি। যদি তোমার ইচ্ছায় এ বন্ধন জীবন মুক্ত হয়, তবে কোন্ কাজে লাগাইবে? আমি তো কিছুই বুঝি না, কিছুই জানি না। আমি বুঝিতে ও জানিতেও চাহি না। কেবল তোমাতে আমার মতি থাকুক এই করিও ঠাকুর। আমাকে আর ভুলাইও না। আমার আমিত্ব, অভিমান, অহঙ্কার, বিষয় পিপাসা, এ সকল নষ্ট কর। করিয়া, লীলাময়, তুমি জীবনের সকল সম্বন্ধের মধ্যে সুপ্রকাশিত হও। তোমার সেবাতে এইরূপে নিযুক্ত কর। আর আমি যেন সত্যভাবে, আপনার সর্ব্বপ্রকারের স্বামিত্ব, কর্ত্তৃত্ব বিসর্জ্জন দিয়া সতত এই বলিতে পারি—

জানামি ধর্ম্মং ন চ মে প্রবৃত্তিঃ
জানাম্যধর্ম্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ।
ত্বয়া হৃষীকেশ, হৃদি স্থিতেন,
যথা নিযুক্তোঽম্মি তথা করোমি॥

 এই আশীর্ব্বাদ এ অধমকে কর। তোমার চরণে এই প্রার্থনা। জয় গুরো! তোমারই জয়, তোমারই জয়, তোমারই জয়। তুমি ধন্য, তুমি ধন্য, তুমি ধন্য। তোমার চরণে শত সহস্র প্রণাম।

 হে প্রভো! তুমি তো অন্তর্যামী, অন্তরের কথা, ভিতরকার অবস্থা, সকলই তো জানিতেছ। আমি নিজে আমাকে তো ভাল করিয়া কিছুই বুঝি না। আমি কেবলই সন্দেহে পড়িয়া ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইতেছি। পড়াশোনা করি, তাতেও যেন, ঠাকুর, এই বিক্ষেপকেই বাড়াইয়া দেয়। এই কি বস্তু, এই কি বস্তু, এই বুঝি সত্য, এই বুঝি তত্ত্ব, কেবল এমনি করিতেছি এমন অন্ধকারে জীবনে আর কখনো আপনাকে অনুভব করি নাই। দয়াল, এ অন্ধকার দূর করিয়া, সত্যে স্থিরমতি জন্মাইয়া দিবে কি? না এইই জীবের উদ্ধারের ও কল্যাণের পথ? আমি বিষয় ছাড়িয়া কিছুতেই তো তত্ত্ববস্তুকে ধরিতে পারিতেছি না। আমার এ কি হইল? নাম যখন করি, অনবরত জপিতেছি, কিন্তু বস্তুজ্ঞান হয় না, ভাবেরও সঞ্চার হয় না। যখন নামের সঙ্গে তোমাকে, গুরো! ধ্যান করিতে যাই, তাও অনেক সময় বড় হাল্‌কা হইয়া পড়ে, ভাবোদয় হয় না। যখন তোমার রূপ ধ্যান করি, তখন মন নরম হয়, কিন্তু প্রেমভক্তি জাগে না। যখন তুমি মাঝে মাঝে যে স্নেহ দেখাইয়াছ, তাহা স্মৃতিতে আনি, তখন চোখ জলে ভরিয়া উঠে। আবার যখন ঐ চরণে নিজের সুখদুঃখ সমর্পণ করি, আপনার হালে পানি পায় না দেখিয়া যখন অসহায় হইয়া, আপনার যোগক্ষেম বহনের জন্য তোমার চরণাশ্রয় লই, তখন মন কতকটা শান্ত হয়। কিন্তু সর্ব্বাপেক্ষা আমার ভাব খোলে, যখন নিজের জীবনের গত সুখ স্নেহ মমতা প্রেমের সম্বন্ধ সকল স্মরণ করি। ঠাকুর, মানুষের মুখ, মানুষের রূপ, মানুষের ভালবাসা, মানুষের দয়া, মানুষের কাজ এ সকল ভাবিলেই আমার ভাব জাগে। মা, বাবা, শৈশবের ধাত্রী, পরিচারক, শৈশবের সহচর, বাল্যের বন্ধু, যৌবনের সখাসখী, সমবয়স্য ও গুরুজন, এ সকলের স্মৃতিতে চোখ জলে, প্রবল ভাবে পূরিয়া উঠে। এ সকলকে ছাড়িয়া আমিতো, দয়াল, ভাবের অবলম্বন আর কিছু পাই না। এ সকল কি? এরা কারা? এদের অনেকেই তো এ লোক হইতে সরিয়া গিয়াছেন,—কোথায় আছেন জানি না। যাঁরা এ জগতে এখনো আছেন, তাঁদেরও তো সান্নিধ্য সম্ভোগ করিতে পারিতেছি না এই নির্ব্বাসনে। অথচ এদের কথাতেই, এদের চিন্তাতেই, এদের ধ্যানেই আমার উপাসনা ও ভজন সবল ও সজীব হয়, এ কি আমার বিষয়লিপ্সার বিকার, দয়াল? এ কি আমার ঘোরতর সাংসারিকতার পরিচয়? এ কি, অন্তর্যামী, কেবল কামের লীলা? আমি এর কিছু বুঝি না। নিরাকারে ভাবনা হয় না, তাতো দেখিলাম। অন্য বস্তুই বা কি? এ সকলে ভগবৎপ্রকাশ হয়, সত্য; কিন্তু স্বরূপ আর প্রকাশ তো এক নহে! এই সকলের ভিতর দিয়াই কি স্বরূপে যাইতে হয়? আর একান্ত বিষয়াশক্তি হইতেই যে এ ভাব জন্মে, তাও বলি কেমন করিয়া? কারণ এ সকল অনিত্য, এ তো আমি জানি। এ গুলিকে যখন ধ্যান করি, তখনো এদের অনিত্যতা যে ভুলিয়া যাই তাহা নহে। তবে আস্বাদন করি কি? না যে সম্বন্ধ এ সকলের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, সেই সম্বন্ধের মাধুর্য্য ও মহিমা। এ সকল রস আস্বাদনের আর অন্য উপায় কি, জানি না। গুরো! আমার এ সন্দেহ দয়া করিয়া দূর কর। আমার সত্য অবস্থা বুঝাইয়া দাও। অথবা, তাই বা চাহি কেন, আজন্মই তো তুমি চালাইয়াছ,—এখনো চালাইতেছ। যে ভাবে হউক, সেই ভাবেই চালাও। তোমার চরণে আমাকে কেবল আশ্রিত রাখ।

 তোমার চরণে, দয়াল, আমার মাতৃভূমির কল্যাণ ভিক্ষা করিতেছি। পুরোহিতদিগকে শুভবুদ্ধি প্রেরণ কর, তাদের স্বদেশপ্রেম নির্ম্মল কর। আর প্রভো। এই প্রেমকে ধর্ম্মপথে পরিচালিত কর। এই প্রার্থনা করি। জয় গুরো! তোমারই জয়, তোমারই জয়, তোমারই জয়! তুমি ধন্য, তুমি ধন্য, তুমি ধন্য!

 হে গুরো, তোমার চরণে শত সহস্র প্রণাম করি। প্রভো! দিনের পর দিন তোমার প্রসাদে একরূপ ভালই কাটিয়া যাইতেছে, কিন্তু মন কেন, ঠাকুর, কিছুতেই অন্তর্মুখীন হইতে চাহে না? তোমার নাম করি, লাগে ভাল, আবার কখনো কখনো নাম তোমার করে রসনা, কিন্তু মন ধ্যান করে নানা বিষয়। এতে কি নামাপরাধ হয় প্রভো! আমি জানি না, যদি অপরাধ হয়, তাহা নিবারণেরও উপায় আমার কাছে নাই। তোমার চরণগুণে যদি তাহা নষ্ট হয়, তবেই সম্ভব। গুরো! তোমার একটা কথার উপরে প্রথমাবধিই একান্ত আস্থা রাখিয়া আসিয়াছি, সে কথা এই যে সময় যখন হয়, তখন আপনা হইতে সকল দিক্ খুলিয়া যায়—ভয় নাই, ভাবনার কারণ নাই। এ কথা গুলো যুগাধিক কাল পরেও আমার কাণে বাজিতেছে। সময় কবে হবে, প্রভো! তারই প্রতীক্ষায় বসিয়া আছি। আমার সাধনভজনের শক্তি নাই।

শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্বূদ্ধিঃধত্যা গৃহীতয়া—

আমি যে এ আদেশ পালনে অসমর্থ। আমি সত্যই বুঝিয়া উঠি না, আমার স্বভাব কিরূপ? আমার প্রকৃতি কি তামসিক, না রাজসিক? তামসিক নহে বলিতে সাহস পাই না, অথচ প্রমাদালস্যনিদ্রাদি তমোলক্ষণও তো তেমন আপনার মধ্যে ধরিতে পারি না। রাজসিক? তাও তো খুব পরিষ্কার রূপে বুঝি না—কর্ম্মসু অশমঃস্পৃহাদম্ভাহঙ্কারসমন্বিতাঃ—এও তো ঠিক নহে। কর্ম্মে প্রবৃত্তি আছে—কিন্তু নিবৃত্তিও আছে। প্রবৃত্তি রজোসম্ভূত, নিবৃত্তি তমোদ্ভূত, তাই কি প্রভো! সাত্ত্বিকতাও যে একেবারে নাই, তাও ঠিক বুঝি না। আমার নিজেকে একটু পরিষ্কারকরিয়া বুঝাইয়া দাও, দেব! নতুবা আমার স্বধর্ম্ম কি, তাহাও তো বুঝিতে পারি না। এই যে আমি বিষয়ের মধ্যে সতত অধ্যাত্মসম্ভোগ অন্বেষণ করি, ইহা কি তমঃ? এই যে ভগবচ্চিন্তা করিতে সেবাই আমার আজীবনের যত স্নেহ প্রেম সেবা দয়া দাক্ষিণ্যাদি সম্ভোগ ও অভিজ্ঞতা, ও যে সকল আধারে এ সকল ভোগ করিয়াছি, তৎসমুদায় আমার প্রাণে জাগিয়া উঠে ও আমার ভাবকে ফুটাইয়া তোলে, শরীর মনকে পুলকিত করে,—ইহার অর্থ কি? এ কি অসারে সারভাবনা, অসত্যে সত্যবুদ্ধি, এ কি তমঃস্বভাব ধর্ম্মাধর্ম্মের অর্থবিপর্যয়বোধ, না, লীলার আস্বাদন, আমি ঠিক করিতে পারি না। এই সকল অবলম্বন, এ সকল রূপ গুণ যদি ছাড়িয়া, এ সকল চিন্তা হইতে ভগবচ্চিন্তা যদি একান্ত বিচ্ছিন্ন করি, তাহা শূন্যগর্ভা, বাক্যময়ী, কল্পনাময়ী, একান্ত নির্গুণ হইয়া পড়ে। আর ভগবান্‌কে ধরিতে পারি না। আমি রূপের ভিখারী, আমি স্নেহ-মমতার কাঙাল। আমি যে আধারে এ সকল পাইয়াছি, তাহাকে ছাড়িয়া কোন তৃপ্তি কোন আরাম চিতে পাই না। পিতার চরণধ্যানে চক্ষে জল আসে, ভক্তি জাগে—পিতা নোঽসি, পিতা নোঽসি বলিয়া শূন্যপানে যত কেন তাকাই না, তাতে চিত্তে ভাব জাগে না। মায়ের চরণধ্যানে—সেই ষোড়শী যুবতী যাঁর কোলে প্রথম ভূমিষ্ট হই, যিনি অপূর্ব্ব, অনাবিল স্নেহদানে প্রাণের মত সযতনে রক্ষা ও পালন করিয়াছেন, যাঁর জীবনফুলের প্রথম ফল আমি,—আর যাঁর নশ্বর দেহ এই অধমের বুকেই শেষে ভাঙ্গিয়া পড়ে—সজ্ঞান শেষ দৃষ্টি যাঁর এই অধমের মুখেই নিবদ্ধ হয়—তাঁর চরণ, তাঁর রূপ, তাঁর গুণ ধ্যান না করিয়া মা, মা, বলিয়া শত চীৎকার করিয়াও তো আমার মাতৃপূজা হয় না, ভগবানের মাতৃভাব উপলব্ধি করিতে পারি না। এইরূপ বন্ধু-বান্ধব, ভাই ভগিনী দাসদাসী, পত্নী, কন্যা, পুত্র, আচার্য্য, শিক্ষক, গুরু,—এদের দেহ, এদের রূপ, এদের গুণ, এদের সঙ্গে আমার দেহের, আমার মনের, আমার হৃদয়ের, আমার প্রাণের, আমার আত্মা যাকে বলি, তার যে সম্বন্ধ, এ সকল ছাড়া আমার তো ভজনা হয় না। অথচ এইই ঠিক ভজনা কি না, তাও বুঝি না। হে দয়াল, এ সমস্যা ভাঙ্গিয়া দাও। তোমার চরণে আমার এই প্রার্থনা।

 হে প্রভো! হে গুরো! হে জীবনাধিপ, তোমার নিয়তিতে এই বন্ধনের আর এক মাস কাটিয়া গেল। এই মাস কাল মধ্যে তোমার অশেষ করুণা উপভোগ করিয়াছি। স্বাস্থ্য দিয়াছ, তাই সুস্থ ছিলাম। স্থৈর্য্য ও ধীরতা প্রতিদিন দিয়াছ, তাই অস্থির ও অধীর হই নাই। তোমার নাম করাইয়াছ, তাই নাম করিয়া কত শক্তি কত আরাম লাভ করিয়াছি। প্রাণে নানা ভাব, নানা চিন্তা, নানা তত্ত্বাভ্যাস প্রকাশ করিয়া মনকে নূতন নূতন সত্যের আস্বাদন দিয়াছ, তাই সে সকল আস্বাদন করিয়া কৃতার্থ হইয়াছি। কত আশা, কত উৎসাহ জাগাইয়াছ, কত সংকল্প ফুটাইয়াছ,—এ সকলের জন্য আজ প্রণত হইয়া তোমাকে অন্তরের কৃতজ্ঞতা অর্পণ করিতেছি। প্রতিদিন স্বল্প বিস্তর পরিমাণে, শাস্ত্রাদি পড়াইয়াছ, আর প্রভো! জ্ঞানপিপাসা, প্রেম লালসা, তোমার আনন্দ সম্ভোগের লিপ্সা, কর্ম্মের প্রবৃত্তি জাগ্রত করিয়া, ও নিত্য নূতন ভাবে চিত্তকে মুগ্ধ ও আন্দোলিত করিয়া এই দৈহিক বার্দ্ধক্যের আক্রমণেও যে অন্তরের যৌবন একরূপ অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছ, তার জন্য তোমাকে অগণ্য ধন্যবাদ দেই। শেষ দিন পর্য্যন্ত ঠাকুর, এটি দয়া করিয়া আমার দিও। নিত্য নূতন জ্ঞান, নিত্য নূতন ভাব নিত্য নূতন রস, নিত্য নিত্য নূতন কর্ম্মে নিয়োজিত করিয়া, অধমকে প্রকৃত পক্ষে বাঁচাইয়া রাখিও, এই চাহি। গাছে যদি ফুল না ফোটে, বসন্তসমীর চুম্বনে যদি বিকচ পল্লব পুলকিত না হইয়া উঠে, নূতন ফল যদি না জন্মে, তবে তার জীবন মরণ সমান হইয়া যায়। মনুষ্যেরও তাহাই। মানবজন্মের মহত্ত্ব ও বিশেষত্বই তার এই অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রেম, অনন্ত কর্ম্ম;— এ যদি ফুরায়, জ্ঞান-প্রেম কর্ম্মের স্রোত যদি একান্ত শুকাইয়া যায়, তবে সে যে জীবন্মৃত হইয়া পড়ে। জীবন্মুক্তি পাবার অধিকার নাই,— ঠাকুর, এ অধম সে আব্দার এখনি তোমার চরণে করে না। কিন্তু দয়াল, দোহাই তোমার প্রেমের, দোহাই তোমার নামের, দোহাই তোমার অযাচিত পতিতপাবনী করুণার,—যখন চরণে অধমকে অঙ্গীকার করিয়াছ,—জীবন্মৃত করিয়া রাখিও না। জ্ঞানপিপাসা, প্রেমলালসা তোমার, সাত্ত্বিক আনন্দ ও তোমার এই যে অনন্ত নিখিলরসামৃতময়ী মানুষী লীলা,—তাহা সম্ভোগের ইচ্ছা ও শক্তি শেষ হইবার পূর্ব্বে, দয়াল, এই বাসা ভাঙ্গিয়া দিও। “বাসাংসি জীর্ণানি তথা বিহার পবানি গৃহ্ণাতি নবোপরাণি তথ্য শরীরাণি বিহার জীর্ণম্যনানি সংযাতি নবানি দেহী”—তখন, প্রভো! এই বিকল সংস্থান ও বিবশ ইন্দ্রিয়কুলকে পরিত্যাগ করিয়া তব শ্রীচরণপ্রসাদাৎ বিশুদ্ধতর, সাধনের অধিকতর অনুকূল, অধিষ্ঠান ইন্দ্রিয়াদি লইয়া, আবার জন্মিয়া, শুদ্ধভাবে, তোমার এই অপূর্ব্ব লীলামাধুরী সম্ভোগ করিব। দয়াল, তাই চাই। আমি তোমার চরণে মুক্তি চাহি না। চাহি ঠাকুর ভক্তি। চাই তোমাকে সর্ব্বদা সম্ভোগ করিতে। চাহি তোমার নিখিলরসামৃতমূর্ত্তির নিরন্তর অর্চ্চনা করিতে। চাই, হে মোহন, আমার শুদ্ধইন্দ্রিয়দ্বারা হৃষীকেশরূপে নিয়ত তোমার ভজনা করিতে। এই লোভ বহুদিনই অন্তরে, অন্তঃশীলার মত, ধীরে ধীরে নড়িতে চরিতেছিল। তাই বন্ধনে আনিয়া, এই এক মাসের মধ্যে বিশেষতঃ ইহাকে তুমি একটু আধটু ফুটাইয়া তুলিয়াছ। অপূর্ব্ব তোমার কৌশল, অদ্ভূত তোমার চেষ্টা। তুমি কি দিয়া যে কি কর, তাহা তুমিই জান। আমরা তার কিছুই বুঝি না, কিছুই জানি না। এই যে এখানে আসিয়া, এ অধমের কি না কল্যাণ করিতেছ। যে সকল ইন্দ্রিয়, রিপুর মত তাড়না করিয়া বেড়াইত, তাদের তুমি অদ্ভুত কৌশলে, ক্রমে শান্ত ও সৌখ্যপূর্ণ করিয়া যেন তুলিতেছ। প্রভো! কখনো ভাবি নাই, এ জন্মে সাত্ত্বিকভাবে রূপ চিন্তা করিতে পারিব,—তারও আভাস তুমি দিতেছ। মা যেমন সন্তানের স্বাস্থ্যের বা পুষ্টির কথা মুখে আনিতে সাহস পায় না,—আমিও ঠাকুর, এ সকল তোমার অদ্ভূত করুণার কথা মুখে আনিতে ভয় পাই, কি জানি তাহাতে অভিমান প্রকাশ পায় ও তোমার করুণা ক্ষুণ্ণ হইয়া আমার কর্ম্ম-বৈগুণ্যে বিমুখী হইয়া যায়। অন্তর্যামি, তুমি সকলই দেখিতেছ। তোমাকে আমি আর কি বলিব? দয়া কর, দেব, দয়া কর। রক্ষা কর, প্রভো, রক্ষা কর। এ ভাব, এ অবস্থা স্থায়ী কর। এই ভাব বাড়িয়ে দাও। নির্ব্বিকার কর, দয়াল, নির্ব্বিকার কর। নতুবা এ অধমের আর গতি নাই। আমাকে এম্‌নি করিয়াই গড়িয়াছ যে প্রবৃত্তির মধ্য দিয়াই আমার গতি, ইহাই তোমার বিধানে, আমার কর্ম্মফলে আমার অনন্যা নিয়তি। তবে প্রভো! এই প্রবৃত্তিকুলকে নির্ম্মল, সাত্ত্বিক, অকামী, তোমার চরণাভিমুখীন যদি না কর, তবে আর আমার গতি কোথায়? দয়াল, রক্ষা কর। পতিতং মাং সমুদ্ধর। পতিতং মাং সমুদ্ধর। পতিতং মাং সমুদ্ধর।

 হে গুরো! আবার এই নূতন প্রভাতে তোমার চরণে অন্তরের একান্ত ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা লইয়া উপস্থিত হইলাম। হে গুরো! এই বন্ধনের মধ্যে প্রতিদিন এ অধমকে কত প্রকারে যে রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছ, শরীর মন প্রাণকে যে কত যত্নে, মায়ের মত বুকে করিয়া যেন রাখিতেছ,—এ ঋণ জন্মজন্মান্তরে কখনো শোধ দিতে পারিব না। কৃপা কর ঠাকুর, যেন তোমার চরণে নিয়ত মগ্ন হইয়া থাকি। তুমি এ সংসারে তো কতই না যশ মান, আনন্দ তৃপ্তি, স্নেহ মমতা দিলে, আর প্রতিদিন কত দিতেছ—এ সকল আমার স্বপ্নের মত বোধ হয়। পণ্ডিত নহি, কিন্তু তুমি রসনায় ও লেখনীতে অধিষ্ঠ হইয়া, তার মধ্য দিয়া কত জ্ঞান, কত ভাব, কত বল, কত উদ্দীপনা ও কত সাধু প্রেরণা প্রকাশ করিতেছ। ভক্ত নহি, অথচ, তোমার আবেশে কত ভক্তি-তত্ত্ব জানিতেছি ও মাঝে মাঝে জানাইতেছি। নিরাকারের নির্ব্বিশেষ জ্ঞানে পথহারা হইয়া বেড়াইতেছিলাম,—আনন্দ, লীলা—এ সকল মানসী, কল্পিতা, মূর্ত্তি রচনা করিয়া বুঝিতে ও ধরিতে চেষ্টা করিতেছিলাম,—কখনো প্রকৃতির শোভাতে, কখনো মানবের চরিত্রে, কখনো সভ্যতা ও সাধনার বিকাশে, কখনো পরিবার ও সমাজের বিবিধ সম্বন্ধের ভিতরে, তোমাকে ও তোমার প্রেম, তোমার আনন্দ, তোমার করুণা, তোমার লীলা অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছিলাম। কিন্তু সকলই আবছায়ার মত দেখিতেছিলাম, সকলই নিতান্ত মানস-তন্ত্র, কল্পনাতন্ত্র,—অধ্যাসিত ও আরোপিত বলিয়া বোধ হইতেছিল, তাহাতে সম্যক প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে কখনো পারি নাই। সর্ব্বদাই ততঃ কিং—তার পর কি, এই প্রশ্ন ভিতরে ভিতরে, নিগূঢ়ভাবে, অলক্ষিতে প্রাণে জাগিয়া, আমার ধর্ম্মকর্ম্ম, আমার সাধন সম্ভোগ—সকলকে যেন ফাঁকা, ভিত্তিহীন করিয়া তুলিত। সন্তানকে বুকে ধরিয়া, চোখ বুজিয়া, তার স্পর্শে তোমার স্পর্শ অনুভব করিতে চেষ্টা করিতাম,—কিন্তু এই নশ্বর সন্তান-দেহ ক’দিন,—তারপর কোথায় বাৎসল্য—এই প্রশ্নের উত্তর পাইতাম না। একটা generalisation করিয়া, সেই generalisation বস্তু ভাবিয়া, মনকে আশ্বস্ত করিতাম। কিন্তু generalisation, হে দেব, কখনো তো বস্তু হয় না। সৌন্দর্য্যের generalisation তুমি, বাৎসল্যের generalisation তুমি, মাধুর্য্যের generalisation তুমি—ইহাতে তো মন তৃপ্ত হয় না। সে তৃপ্তি কোথায়? এই যে রূপ-পিপাসা,—ইহা কি রাবণের চিতার মত চিরকাল কেবল জ্বলিবে ও জ্বালাইবে, তার নিবৃত্তি, তৃপ্তি কি কখনো কোথাও হবে না? যদি না হয়, তবে এ যে মায়ামরীচিকা—আর তবে তোমাকেই বা সুন্দর, বলি কেমনে? আর এ রূপ তো মানুষ ছাড়া আর কোথাও নাই। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আরোপিত; মানুষ আপনার অন্তরের রস প্রকৃতির অঙ্গে ঢালিয়া প্রকৃতিকে সুন্দর করে। তার অন্তরের যে সৌন্দর্য্য ও সম্ভোগ তারই পুটে এই প্রকৃতির শোভা ও মাধুর্য্য ফুটিয়া উঠে। নায়ক নায়িকার অন্তরস্থ প্রেম ও রস এ সকল অবলম্বনে বাহিরে ফুটে। নায়ক নায়িকা যদি না থাকে, প্রকৃতির সত্তা থাকে, সৌন্দর্য্য থাকে না। মানুষে যেমন সৌন্দর্য্য, বাৎসল্য মধুরাদি আস্বাদন করি, সেইরূপ রূপও এই আধারেই পাই। মানুষ ছাড়া আর কোথাও তো প্রাণের তৃপ্তি ও আরাম, আত্মার আশ্রয় ও অবলম্বন দেখি না। অথচ এই মানুষও মর্ত্ত্য মৃত্যুর অধীন, আজ আছে কাল নাই। ঠাকুর! তবে এ সকলই কি কেবল মোহের ছলনা? এ কেবল মায়ার খেলা? কেবল কি দুঃখ-হেতু; জ্বালার নিদান? তাহা হইলে এই জগৎলীলার সত্য ও সার্থকতা যে কিছুই থাকে না। এই সকল ক্রমে অন্তরে প্রকাশিত করিয়া, এই সকল প্রশ্ন তুলিয়া, হে দয়াল, তুমি এমন এক পথে এ মনকে চালাইয়া নিতেছ, যে পথে চালিত হবে কখনো কল্পনাতে মনে করি নাই। চল গুরো! নিয়ে চল,—তোমার হাতখানি যদি দেখাও, তবে আমি অভয়ে যে কোন অজ্ঞাত পথে হউক না কেন, চলিতে পারিব হাতে ধরিয়া লইয়া চল। আর অস্থিরতায়, আর সংশয়ে রাখিও না! শ্রদ্ধা দাও, প্রত্যক্ষ জ্ঞান দাও, প্রভো! তত্ত্ব-বস্তু প্রকাশিত কর। তোমার চরণে এই প্রার্থনা।

 হে গুরো! ক্রমে ক্রমে তুমি কৃপা করিয়া এই বন্ধনের শেষদিনে আনিয়া উপস্থিত করিলে। বাকি যে কয় ঘণ্টা আছে, তোমার যেমন ইচ্ছা হয়, তেমনি করিবে। কত ভয়, কত ভাবনা, কত অশান্তি আবার কত নির্ভয়, কত শান্তি, কত আরাম, কত নূতন নূতন ভাব ও প্রেরণাও, যে এই ছয়মাসকাল পাইয়াছি, তাহা তুমি সকলই জান। কিন্তু এ সকলের মধ্যে তোমার আশ্রয় ও তোমার করুণা, অটল ভাবে আমার সঙ্গে থাকিয়া, আমাকে রক্ষা করিয়াছে। আমি যে কত অক্ষম, কত দুর্ব্বল, কত হীন, কত, অবিশ্বাসী, এই ক’মাসের মধ্যে, মাঝে মাঝে দুঃখ ক্লেশ, অশান্তি ও ভয় ভাবনায় ফেলিয়া তাহা তুমি অতি পরিষ্কারভাবে বুঝাইয়াছ। ঠাকুর! এ শিক্ষা যেন আর কখনো জীবনে ভুলি না। আর যেন কখনো, দেব! অলক্ষিতেও আপনার ’পর ভর করিয়া চলিতে চাহি না। আর যেন, দয়াল! কোন প্রকারে এই আমার অধম আমিত্ব ও স্বামিত্বকে কোনো ব্যাপারে, কোনো ক্ষেত্রে, জীবনের কোনো সম্বন্ধে প্রতিষ্ঠিত করিতে যাই না। মাথা তুলিয়া, আপনার গরবে পূর্ণ হইয়া প্রায় সারা জীবনইতো কাটাইলাম, বাকি যে কটা দিন, তুমি দয়া করিয়া এ সংসারে রাখিবে, সে কটা দিন যেন, প্রভো! লোকের পায়ের কাদা হইয়া কাটাতে পারি। সকল সম্বন্ধের মধ্যে, হে দয়াল! যেন আপনাকে পরের অধীন করিয়া রাখিতে পারি। আমি দাস, সকলে আমার প্রভো; আমি সেবক, সকলে আমার সেব্য; সকলের মধ্যে তুমি আছ, আর সকলের ভিতর হইতে তুমি আমার সপ্রেম সেবা চাহিতেছে,—অনাবিল সেবা চাহিতেছে,—এই জ্ঞান সতত চিত্তে উজ্জ্বল রাখিও। দূর হইতে ভাবিতেছি, এবার যদি তুমি সুযোগ দাও, তবে, ঠাকুর, ভগবদ্ভাবে স্ত্রী পুত্রকন্যা আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সমাজ ও স্বদেশ,—সকলের সেবা করিব। আর কারো উপরে জোর করিয়া, নিজের ইচ্ছা চালাইতে চাহিব না। তুমিই যে সর্ব্বনিয়ন্তা,—

ঈশ্বরঃ সর্ব্বভূতানাং হৃদ্দেশে যচ্চতিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্ব্বভূতানি যন্ত্ররূঢ়েন মায়য়া॥
ত্বমেব শরণং গচ্ছ সর্ব্বভাবেন ভারত।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্‌স্যসি শাশ্বতীম্‌॥

 —এই মহাসত্যে প্রতিষ্ঠিত কর। তুমিই তো, সকলকে, স্ত্রীকে, কন্যাকে, পুত্রকে, ভ্রাতা, সখা, আত্মীয় স্বজন-সকলকে, আপন আপন প্রকৃতি অনুযায়ী পরিচালিত করিতেছ; আমি মোহবশতঃ আপনাকে কর্ত্তা ভাবিয়া, এতকাল ইহাদিগকে চালাইতে চেষ্টা করিয়াছি। ঠাকুর ইহাতে তোমার মর্য্যাদাহানি হয়, এ কথা বুঝি নাই। এখন হইতে প্রভো! এই অপরাধে আর যেন অপরাধী না হই। আমার নিজের প্রতি যখন চাহি, তখনই তো দেখি, ঠাকুর, কোনো লোকের পীড়নে শাসনে, উপদেশে, সাক্ষাৎভাবে, আমাকে এখানে আনে নাই। আমি প্রবৃত্তির বশেই আজন্ম চলিয়াছি, যখন যাহা খেয়াল, তাই করিয়াছি। সদসদ্ বিচার কখনো করি নাই। প্রেমের পথেই বিচরণ করিয়াছি, আর হে পরম দয়াল! ঐ পথের ভিতর দিয়াই তুমি আমাকে প্রেমের দ্বারে আনিয়াছ। আমায় যখন এই কৃপা করিয়াছ, তখন আর অপরের জন্য আমার ভাবনা হবে কেন? যারা সাধন ভজন করিয়া ধর্ম্ম পায়, সাধনবলে তোমার আশ্রয় প্রাপ্ত হয়, তারা অপরকে শাসন করিতেও বা পারে। কারণ তাদের জীবনে অন্য অভিজ্ঞতা নাই। তারা সংযমের ভিতর দিয়া, নিবৃত্তির পথে, প্রেমের সন্ধান পেয়েছে। অন্য পথ তারা জানে না। আমার তো সে অভিজ্ঞতা নাই। আমি তো প্রবৃত্তিরই দাস, ভোগলিপ্সু। আজন্ম কামোপভোগপরায়ণ হইয়া কাটাইলাম। এমন যে আমি, আমাকেও যখন, তুমি, তোমার চরণাশ্রয় দিয়াছ, তখন তর্কনিষ্ঠ, অশ্রদ্ধাবান, অবিশ্বাস প্রবল যে এই মন ও বুদ্ধি, তাহাতেও যখন, অপূর্ব্ব কৌশলে, অলক্ষিতে, কি ইন্দ্রজাল প্রভাবে জানি না,—তাহাতে যখন তিলে তিলে পরমতত্ব গুরুতত্ত্ব ও ভগবতত্ত্ব প্রকাশ করিয়া, অপূর্ব্ব সম্পদের আভাস দিয়াছ,—তখন ভবে আর ভাবনা কার থাকিতে পারে? হয় নিবৃত্তির পথে, না হয় প্রবৃত্তির পথে, যে পথে হউক, তুমি আমার স্ত্রী পুত্র কন্যা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, সকলকেই পরমপথে আনিয়া তুলিবে, তবে আমি ইহাদেরে শাসন করিতে যাইয়া আত্মপ্রতিষ্ঠা করিব কেন? শাসন নহে, প্রভো! আর শাসন নহে, নিত্য সেবা, নিঃস্বার্থ সেবা, অনাবিল সেবা, ভক্তিমাখা সেবা, এই আমার বিধান, এই আমার কর্ম্ম, এই আমার সাধন ভজন হউক। ইহাদের মধ্যে সতত কৃষ্ণস্ফুর্ত্তি কর। কৃষ্ণভাবে তাদের সেবা ও ভজনা করিতে শেখাও! ঠাকুর, পরিবার মধ্যে, আবার সংসারে ফিরিবার মুখে তোমার চরণে এই ঐকান্তিক প্রার্থনা করি।

 আর ঠাকুর! এই বন্ধনের মধ্যে তুমি দয়া করিয়া যে দুইটী তত্ত্বাভাস প্রকাশ করিয়াছ, তাহা সমুজ্জ্বল কর। রাধাকৃষ্ণ তত্ত্বই যে বিশ্বের পরমতত্ত্ব ইহার আভাস পাই নাই। এই তত্ত্বে অচল, অটল, প্রতিষ্ঠা দাও। ঠাকুর, অল্পবয়সে, যৌবনমদে, আপনার খাদ্যোতদ্যূতি দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়া এই পরমতত্ত্বকে অগ্রাহ্য করিয়া পিতা, মাতা, পিতৃলোক সকল হইতে একরূপ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিলাম। আজ এই তথ্য পাইয়া, এই কৃষ্ণনাম করিয়া এই রাধাগোবিন্দ নাম কণ্ঠে লইয়া, ঠাকুর! তোমার অযাচিত করুণাগুণে, পিতা, মাতা, পিতৃকুল, মাতৃকুল, কুলেপুরোহিত, কুলগুরু, সকলের সঙ্গে পুনর্ম্মিলনে সুখ ও সৌভাগ্য অনুভব করিতেছি। ব্রহ্মনামে পিতামাতার প্রাণে সে আনন্দ সঞ্চারিত হইত বলিয়া মনে হয় না, বিশেষ আমার মত সাধন-ভজনহীন লোকের মুখে ঐ সংযমী সন্ন্যাসীদের সেব্য ব্রহ্মনামে, তাঁদের প্রাণে যে আরাম হইত, তাঁহাদের ইষ্টনাম, প্রিয়নাম, সাধিত নাম, এই কৃষ্ণনাম এ অধমের মুখেও শুনিয়া তাঁদের শতগুণ, ও সহস্রগুণ বেশী আনন্দ ও প্রীতি হইতেছে। এতদিন আমি তাঁদের মণ্ডলীর, আপনার পিতৃগোষ্ঠীর বাহিরে ছিলাম, এই মধুরনাম গুণে, তোমার অপার করুণা বলে, মনে হয় যেন, অতি হীন হইয়াও আমার সেই গোষ্ঠীভুক্ত হইয়াছি। এই চিন্তায় প্রাণে অনুপম আনন্দ হয়। ঠাকুর! এ তোমারই করুণার ফল। তবে বড় সাধ প্রভো! আমার গণ-গোষ্ঠী সকলে, আমার স্ত্রী পুত্র কন্যা, জামাতা ও জামাতৃপরিবারবর্গ, আমার বন্ধুবান্ধব, যাদের ভালবাসি, যারা এই হীনজনকে ভালবাসা দিয়া কৃতার্থ করিতেছেন,—তারা সকলে এই নাম আস্বাদন করে। সকলে এই পরমতত্ত্ব লাভ করে। সকলে তোমার গণ হইয়া তোমার চরণাশ্রয় প্রাপ্ত হয়। তুমি ভিন্ন আমার আর কেহ নাই। আদরে চরণে টানিয়া লহ, দয়াল, তোমার শ্রীপাদপদ্মে এই প্রার্থনা।

 ঠাকুর! তুমি এ হীনজনকে যেভাবে লোকচক্ষে বাড়াইয়া তুলিলে, তাতে আমার আনন্দ হয় না, এমন নহে। কিন্তু অন্তর্যামিন, তুমি জানো, এ আনন্দ ভয়বিষাদ মিশ্রিত। ইহা যেন প্রভো! আমার পতনের কারণ না হয়। শেষ রক্ষা করো গুরো! শেষ রক্ষা করো। এতকাল, যখন লোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করিত, তখন অভিমানে আঘাত পড়িত বলিয়া, আত্মপ্রতিষ্ঠার বাসনার উদয় হইলেও, তাহা স্বাভাবিক ছিল। তখন ভাবিতাম, এরা কেন আমায় খোঁচাইয়া, আমার ঘুমন্ত অভিমানকে জাগাইয়া তোলে। ঠাকুর! যা শুনিতেছি ও বুঝিতেছি, তুমি এখন বুঝি এ উত্তেজনা হইতে মুক্তি করিবে। অনেকেই এখন, আমি অকৃতি হইলেও, আমাকে বড় করিয়া তুলিতেছেন। এখন যদি এ মাথা একবারে নিচু না হইয়া যায়; এখনো যদি মাটিতে মিশাইয়া না যাইতে পারি, এখনো যদি, সত্য সত্য বিনয় লাভ না করি, তবে আর কখন করিব? দয়াল, এটা করো, আমাকে মাটীতে মিশিয়ে দাও। দম্ভ অহঙ্কার সব নষ্ট কর। দর্প কি আর আছে, ঠাকুর? অহঙ্কার কি রেখেছ! মাথার এক এক গাছা চুল পর্য্যন্ত এই ছয়মাসে তোমার অদ্ভূত রূপা-লীলাতে যে বিকাইয়া গিয়াছে। দর্পের যে আর কিছুই রাখনি। আমাকে সম্পূর্ণ অসহায়, নিঃসম্বল, শক্তিশূন্য করে, তোমার সাহায্য, তোমার চরণ সম্বল, ও তোমার করুণাশক্তি দ্বারা পূর্ণ করিয়াছ। দয়াল আবার বলি, মুহূর্ত্তের জন্যও এ চিত্তে আমার আমিত্ব ও অভিমান স্থান না পায়। সকলের পায়ের কাদা কর।

 ঠাকুর! তোমার নামে এই ক’মাস যে অভ্যাস জন্মাইয়াছ, তাহাও রক্ষা করিও। তিনসহস্র নাম, দৈনিক, অন্ততঃ যাতে করিতে পারি, সে আশীর্ব্বাদ, সে শক্তি ও সে সুযোগ যেন সর্ব্বদা পাই। ভক্তিভরে,—“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা, অমানীনাং মানদেন কীর্ত্তনীয়া সদা হরিঃ” এই নিয়ম ধারণ করিয়া, দয়াল, যাতে তবদত্ত মহানাম সতত কীর্ত্তন করিতে পারি, দিনের দিন যাতে নামের শক্তি ও তত্ত্ব ফুটিয়া উঠে, এই আশীর্ব্বাদ কর। আর যেন নাম ভুলি না। ভুলাতে অনেক আছে, কিন্তু তুমি কাণ্ডারী হয়ে থে’ক, তাহা হইলে আর ভুলিবার ভয় থাকিবে না।

 ঠাকুর! এই ক’মাস, তোমার প্রসাদে, নামের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধ্যায়ও বেশ চলিয়াছে। এই স্বাধ্যায় যেন ভঙ্গ না হয়। ঠাকুর, এটীও দেখ। এসকলে আমায় এই বন্ধনে জড়াইয়া রাখিয়াছে, এ সকল দিয়া আমার এ বন্ধনকে তুমি অশেষ মঙ্গলের হেতু করিয়াছ; এসকল যাতে আর অবহেলা না করি, এখন সে টুকু করিও। দয়াল, তোমার চরণে এই প্রার্থনা করি।

 আর, ঠাকুর,—আর একটা ভয় প্রাণে জাগিতেছে। যে তত্ত্বজ্ঞান। তুমি দেখাইয়াছ, তাহা গোপন রাখিব, না প্রকাশ করিব। ঠাকুর! আমি কিছুই বুঝিতেছি না। একি প্রচার করিব, না নিজে নিজে, গোপনে গোপনে সাধন করিতে ও সম্ভোগ করিতে চেষ্টা করিব? আমি ভাল মন্দ জানি না। প্রকৃতি আমার সর্ব্বদাই বহির্মুখ; সর্ব্বদাই আত্ম প্রকাশে আত্মপ্রসাদ প্রাপ্ত হয়। এ যে তত্ত্বের আভাস দিলে, তাহা অতি নিগূঢ়। এ বলা কঠিন, বোঝান কঠিন। অথচ, আমি এ মধুর বস্তু, নিজে ধরিয়াই বা রাখি কেমন করিয়া? তাই তোমার চরণে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করিতে চাই। আমায় একেবারে অধিকার কর। আমার ধর্ম্মাধর্ম্ম সকল গ্রহণ কর। যাতে সর্ব্ব ধর্ম্মান পরিত্যজ্য—তোমার চরণশরণাগত হইতে পারি, তাই কর। তা নইলে, আমার আর গতি নাই। গতি কর, দয়াল, গতি কর। তোমারই জয় গুরো! তোমারই জয়, তোমারই জয়। তুমি ধন্য, তোমার প্রেম, ধন্য, তোমার করুণা ধন্য, তোমার চরণাশ্রয় ধন্য!

সমাপ্ত