জেলের খাতা/জীবনের হিসাব নিকাশ
দ্বিতীয় অধ্যায়
জীবনের হিসাব নিকাশ
“পঞ্চাশোর্দ্ধে বনং ব্রজেৎ”—— বাণপ্রস্থ অবলম্বনের সময় প্রায় সমুপস্থিত। এ সময়ে জীবনের একটা হিসাব নিকাশ করিবার ইচ্ছা স্বাভাবিক তাই এই আত্ম-জীবন কাহিনী লিখিতে প্রবৃত্ত হইলাম।
মনে মনে, গোপনে, আত্মচিন্তাতে এ হিসাবনিকাশ করিলেই তো হয়, তাহা আবার কাগজে কলমে লিখার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন আছে। প্রথমতঃ আর যে পারে পারুক, আমি কোন গভীর চিন্তাই মনে মনে করিতে পারিনা। প্রকাশের প্রয়াসেই আমার চিন্তা পরিস্ফুট হয়, অভিব্যক্তির চেষ্টাতেই আমার অন্তরের ভাব বিকশিত হইয়া উঠে। আপনার মনোভাবকে যখন আপনি দেখিতে চাই, তখনই তাহাকে ভাষায় প্রকাশিত করিতে হয়। এই জন্যই লেখা ও বলা আমার প্রকৃতিগত হইয়া আছে। এই জন্য বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া অবধি যখনই যাহা লিখিয়াছি, বা যখনই যাহা বলিয়াছি, তার প্রথম পাঠক ও প্রথম শ্রোতা ত আমি নিজেই হইয়াছি। আমি সততই নিজের জ্ঞানলাভের জন্য, নিজের উদ্দীপনার জন্ম, নিজের শিক্ষার জন্য, নিজের উন্নতির ও নিজের তৃপ্তির জন্য, লিখিয়াছি ও বলিয়াছি। এই কারণে অনেক সময় আমার লেখা ও বলা অপরের নিকট দুর্ব্বোধ্যও হইয়া গিয়াছে। আমি নিজের বোধগম্য হইবার জন্য যে ভাষা আবাক হইয়াছে, তাহাই সতত ব্যবহার করিয়াছি, নিজে যাহা কিছু অধিগত করিয়াছি, তাহার বিবৃতি বা পুনরুক্তি করি নাই, প্রয়োজন হইলে, কেবল উল্লেখমাত্র করিয়াছি। এই জন্য যাঁহারা অন্য ভাবের ভাবুক, যাঁরা অন্য ধাপের বা ধাতের লোক, তাঁদের বোধগম্য করিবার কোন প্রয়াস কোনদিন পাই নাই, এবং তাঁহাদের নিকট আমার কথা ও লেখা অনেক সময় জটিল ও অবোধ্য রহিয়া গিয়াছে।
ফলতঃ আমার লেখাতে ও বলাতে সর্ব্বদাই আমি নিজেকে শিষ্যরূপে দেখিয়াছি। গুরু যে কে, তাহা ভাল করিয়া ধরিতে পারি নাই। তবে ইহা অসংখ্যবার উপলব্ধি করিয়াছি যে কে যেন অন্তরঙ্গ হইতে, আমার লেখনী বা রসনাকে অবলম্বন করিয়া আমাকে অনেক অদ্ভূত সত্য শিক্ষা দিতেছেন। এজন্য লোকে যাহাকে আমার রচনা বা আমার উক্তি বলিয়া ব্যক্ত করিয়াছে, তাহা দেখিয়া ও শুনিয়া আমি নিজেই চমকিত ও মুগ্ধ হইয়া গিয়াছি এবং নিজের লেখা পড়িতে পড়িতে নিজেই কত সময় বিস্ময়ে, আনন্দে ভগবৎ-কৃপা ও ভগবৎ-প্রেরণা প্রত্যক্ষ করিয়া অজস্র অশ্রুবিসর্জ্জন করিয়াছি।
মনোমধ্যে মনোভাব স্বপ্নের মত, বায়ুর মত, আকাশে তাড়িত বিচ্ছিন্ন মেঘখণ্ড সকলের মত অস্পষ্ট, অস্পৃশ্য ও অগ্রাহ্য ও চঞ্চল হইয়া বিচরণ করে। এই মনোভাবকে যখন ভাষার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করি, তখন তাহা স্থির হইয়া আত্মস্বরূপ প্রকাশিত করিতে থাকে। ভাষার আবরণে আবৃত হইতে যাইয়া যাহা অসম্বন্ধ ছিল, তাহা সুসম্বন্ধ ও ঘননিবিষ্ট হয়, যাহা একাকী ছিল, তাহা অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হইয়া, আপনার যথাযথ ওজন বুঝিয়া সংযত হয়; যাহা অসত্য তাহা পরিহৃত, যাহা সত্য তাহা যুক্তিপ্রতিষ্ঠ, ও যাহা সত্যাভাব মাত্র ছিল, তাহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। ভাষার মুকুরেই সত্যের আত্মস্বরূপ ও চিন্তার নিজমূর্তি পরিষ্কাররূপে প্রতিবিম্বিত হয়। মনোগত চিন্তা ও ভাব যখন ভাষাতে অভিব্যক্ত হয়, তখনই আমরা তাহার স্বরূপ সাক্ষাৎকার লাভ করি। এই জন্য নিজ জীবনের স্বরূপ যদি দেখিতে হয়, তাহাকে ভাষায় অভিব্যক্ত করা আবশ্যক হইয়া উঠে। আত্মজীবন কাহিনী রচনার এক প্রয়োজন ইহা। এ প্রয়োজন আমার নিজস্ব। দর্পণাস্তে জীব যেমন নিজ মূর্ত্তি দেখে, এই কহিনীতে তেমনি আমি আমার এই অর্দ্ধশত বর্ষব্যাপী জীবনের স্বরূপ-ছবি দেখিতে পাইব, এই বাসনা হইতেই এই চেষ্টার জন্ম।
কিন্তু নিজের কথা লিখিতে লোকে সহজেই শঙ্কিত হয়। এ সঙ্কোচ স্বাভাবিক। যদি নিজের কথা সত্য সত্য নিজেরই কথা বলিয়া ভাবিতাম, তবে আমিও কখনও এ কাহিনী লিখিতে বসিতাম না। কিন্তু নিজের কি আছে? নিজের কা’কে বলিব? এ জীবন কি আমার না তোমার? আমরা কি জীবনের কর্তা? যদি তা হয়, তবে হয়ত আত্মকথা বিবৃতিতে দোষ আছে। কিন্তু সত্য তো এ নয় ৷ এ জীবনের যদি কোন শিক্ষা প্রত্যক্ষভাবে, উজ্জ্বলরূপে লাভ করিয়া থাকি, তাহা এই যে ইহা আমার নিজের নহে ৷ এ জীবনের কর্ত্তা আর একজন, সে জন যেই হউক না কেন। তাঁরে চিনি এমন কথা বলি না। তাঁরে যে একবারেই চিনি নাই, এমনও বলিতে পারি না ৷ এ জীবন তাঁরই খেলা। ইহার প্রভু, নিয়ন্তা, কর্ত্তা সকলি সে জন। এ জীবনের কথা নিজের কথা নয়, তাঁরই কথা।
আর যদি নিজেরই ভাবিতাম, তাহা হইলেও এ কাহিনী লিখিতে সঙ্কুচিত হইতাম না। এতদিন ধরিয়া এই জীবন ভোগ করিলাম, এত দীর্ঘকাল এই আমির সঙ্গে বসবাস করিলাম, কিন্তু তাকে ভাল করিয়া তো কখনো একবার প্রত্যক্ষ করিলাম না। সমাধিতে যে আত্মসাক্ষাৎকার হয়, সাধুমুখে শুনিয়াছি, সে প্রত্যক্ষের কথা বলিতেছি না। কিন্তু সাধারণভাবে যাকে দেখা বলে, সে ভাবেও তো নিজেকে কখনো ভাল করিয়া দেখিলাম না। এ জীবনে কত লোকের সঙ্গ করিলাম, কত সম্বন্ধে আবদ্ধ হইলাম, পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, কত লোককে দেখিলাম, বুঝিলাম, কত লোকের জীবনগ্রন্থ অধ্যয়ন করিয়া কত সুখ, কত শিক্ষা লাভ করিলাম; আর কেবল নিজের জীবনই দেখিলাম না, পড়িলাম না, ইহার যে শিক্ষা তাহাই ভাল করিয়া ধরিলাম না। এও কি ক্ষোভের কথা নহে? আর এ জীবনকে যদি দেখিতে হয়, তবে ইহাকে বাহিরে, চক্ষের উপরে, অপরের জীবনের মত ধরিতে হইবে। ইহার জ্ঞানলাভ করিতে গেলে, ইহাকে ধ্যানের বিষয় করিতে হইবে। আর তাহা করিতে গেলেই, ইহার যথাযথ ছবি আঁকিয়া নিজের মনের সম্মুখে স্থাপন করা প্রয়োজন। আপনাকে আপনা হইতে পৃথক্ করিয়া না ধরিলে, কখনই আপনাকে আপনার জ্ঞানের বিষয়ীভূত করা যায় না। জ্ঞেয়কে জ্ঞাতা হইতে পৃথক্ করিয়াই জ্ঞানের সূত্রপাত হয়। এই জন্যও নিজেকে সত্যভাবে, সম্পূর্ণভাবে, জানিতে গেলে আপনার জীবনের যথাযথ চিত্র অঙ্কিত করিয়া আপনার সমক্ষে ধারণ করা আবশ্যক। সকল জ্ঞানের সেরা জ্ঞান আত্মজ্ঞান। এই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য, আত্মজীবন-কাহিনী রচনা করিয়া, ধ্যানসহকারে তাহা অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। ইহাতে লজ্জার বা সঙ্কোচের বিষয় কি আছে?
এইরূপভাবে আপনার জীবনী রচনার চেষ্টাতে আরো ফল আছে। তাহাতে জীবন ফুটিয়া উঠে। এইরূপ প্রয়াসে যাহা অস্পষ্ট ছিল, তাহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে; যাহা অব্যক্ত ছিল তাহা ব্যক্ত হয়; যাহার মর্ম্ম অজ্ঞাত ছিল, তাহার অর্থ প্রকাশিত হইয়া পড়ে। ইহা অভিব্যক্তির সাধারণ ধর্ম্ম। মনে মনে, গোপনে গোপনে, আত্মচিন্তাতে আপনাকে যতটা পরিষ্কাররূপে জানা যায়, ভাষায় সে চিন্তাকে যথাযথরূপে ব্যক্ত করিতে পারিলে, তদপেক্ষা অনেক পরিষ্কার করিয়া আপনাকে দেখা যায়, ও বোঝা যায়। লোকে বলে, ভাষায় চিন্তা ও ভাব হাল্কা হইয়া পড়ে। কখনো কখনো হয়ত এরূপ হইয়া থাকে। কিন্তু তাহার কারণ অভিব্যক্তির চেষ্টা নহে, কিন্তু অভিব্যক্তার অক্ষমতা। আবার কখন কখন এমন বস্তুও আমাদের চিন্তার ও ভাবনার বিষয়ীভূত হইয়া থাকে, যাহা কেবলমাত্র প্রতিবোধগম্য, গভীর আত্মপ্রত্যয় লব্ধ, যাহাকে প্রকাশ করিবার শক্তি ভাষা এখনো লাভ করিতে পারে নাই, প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনেই স্বল্পবিস্তর পরিমাণে এইরূপ কোন কোন গভীরতম অভিজ্ঞতা থাকে, যাহা কথায় ব্যক্ত হয় না। এসকল কথা জীবনের অতিশয় অন্তরঙ্গ কথা তার চিত্র কোন পটে উঠে না। সে তত্ত্ব প্রকাশ করে, এমন জ্যোতি জগতে নাই।
ন তত্র সূর্য্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্ব্বং
তস্য ভাসা সর্ব্বমিদং বিভাতি॥
সে গভীর আত্মতত্ত্ব, যেখানে জীব-ব্রহ্ম একীভূত হইয়া বাস করিতেছেন, যে আত্মতত্ত্ব ব্রহ্মতত্ত্বকে প্রকাশ করে,-তাহা বর্ণনা করে সাধ্য কার? প্রাকৃতজনের তাহা সাধ্যাতীত। কিন্তু জীবন যাহাকে বলি, তাহা এ গভীর আত্মতত্ত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত হইলেও, তাহার বাহিরে, তাহার বহিরঙ্গরূপেই, বিরাজ করে। কেবল ইহারই চিত্রাঙ্কণ, ইহারই বর্ণনা, ইহারই প্রতিকৃতির অভিব্যক্তি সম্ভবপর।
প্রত্যেক জীবনেই, সমান্তরাল ভাবে, নিয়ত দুই লীলাতরঙ্গ প্রবাহিত হইতেছে। এক অন্তরঙ্গ লীলা, আর এক বহিরঙ্গ লীলা। অন্তরঙ্গ লীলার উপরেই বহিরঙ্গ লীলা প্রতিষ্ঠিত সত্য, কিন্তু সে লীলা অনুভব করা, তাহা প্রত্যক্ষ করা সুকঠিন, বহু সাধন-সাপেক্ষ। এই অন্তরঙ্গ ক্ষেত্রে ভগবান আপনার জীব-প্রকৃতির সঙ্গে নিত্য-লীলাতে নিযুক্ত। এই জীব-প্রকৃতি তাঁর লীলার নিত্য সহচরী। আমরা সচরাচর যাহাকে আমি আমি বলি, তাহা এই জীব-প্রকৃতির অংশ, তারই প্রতিবিম্ব বটে; কিন্তু তদপেক্ষা অনেক নিম্ন ভূমিতে বাস করিতেছে।অজামেকং লোহিত শুক্ল কৃষ্ণাং
বহবীঃ প্রজাঃ সৃজমানং সরূপাম।
অজো হ্যেকো জুষমানৌহমুশেতে
জহাত্যেনাং ভুক্তভোগামজেহন্যঃ॥
উপনিষদ এখানে তিন নিত্যতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করিতেছেন। এক প্রকৃতি সত্ত্ব রজ তম গুণান্বিতা,-লোহিত শুক্ল কৃষ্ণাং—দ্বিতীয় জীবাত্মা যিনি এই প্রকৃতি দ্বারা সেবিত হইয়া তাহাকে ভোগ করেন; জুষমানৌহমুশেতে; আর তৃতীয় পরমাত্মা যিনি ভোক্তা ও ভোগ্য এই উভয় হইতে পৃথক্ হইয়া, জহাত্যেনাং ভুক্তভোগাম, ইহাদেরই সঙ্গে নিয়ত বাস করিতেছেন।
পরবর্ত্তী শ্রুতিতেই জীবাত্মা ও পরমাত্মার নিত্য-লীলা বর্ণিত হইয়াছে ।
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে
তপরয়ো নঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য
নশ্নম্নন্ন্যোহ ভিচাবশীতি ॥
এক শাখী পরে, দু বিহগবরে,
সুখে বসবাস করে,
(উভে) উভয়ের সখা, প্রেমে মাখামাখা,
দোঁহে দোহারে নিরখে;—
ইহা আমরা যাহাকে সংসারী, মোহান্ধ, জীব বলি, তাহার কথা নহে। ইহা নিত্যধামের নিত্যলীলার কথা। এ জীব-তত্ত্ব অহঙ্কার-তত্ত্বের উপরে।
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনোবুদ্ধিরেব চ
অহঙ্কার ইতীয়ং সে ভিন্না প্রকৃতিরষ্ঠধা॥
অপরেয়মিতস্ত্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মেহপরাম
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ॥
ভগবানের সর্ব্ববিধ নিকৃষ্ট প্রকৃতি মধ্যে আমাদের মন, বুদ্ধি, এবং অহঙ্কার এ সকল অন্যতম। এ সকল অপরা প্রকৃতি। অন্যা পরা প্রকৃতি তাঁর আছে—তাহাই জীবাত্মা
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ।
জীবভূতা সেই শ্রেষ্ঠ প্রকৃতি দ্বারা এই জগৎ ধৃত হইয়া রহিয়াছে।
এই জীব-প্রকৃতি, ভগবানের ন্যায়, স্বয়ং সিদ্ধা, নিত্য বুদ্ধ শুদ্ধ মুক্ত স্বভাব সম্পন্না। ইহার মোহ নাই, মায়া নাই। ইহা ভগবল্লীলার নিত্য সহচরী। অহঙ্কার-তত্ত্ব পর্য্যন্ত মায়াধীন, প্রকৃত জীব-তত্ত্ব মায়াতীত! এই জন্যই শ্রুতিতে জীবের মুক্তিকে নিত্যসিদ্ধাবস্থা বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। মুক্তি জন্য-বস্তু নহে। ক্রিয়া দ্বারা, সাধনা দ্বারা তাহা কেহ প্রাপ্ত হয় না। সাধনা দ্বারা কেবল যে মোহেতে জীবের এই নিত্যসিদ্ধ মুক্তভাবকে আচ্ছন্ন করিয়া থাকে, তাহা অপসৃত হয় মাত্র। ঠুলিতে চক্ষু ঢাকিয়া রাখিলে, জীব দৃশ্য বস্তু দেখে না সত্য, কিন্তু তাহাতে তাহার চক্ষুর স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ দৃষ্টিশক্তি কখন বিলুপ্ত হয় না। আর এই ঠুলি খুলিয়া দিলে চক্ষু আবরণমুক্ত হয় মাত্র, কিন্তু তাহাতে চক্ষুর অভিনব দৃষ্টিশক্তি হয় না। সেইরূপ মায়াবৃত-জ্ঞান জীব আপনার স্বরূপ দেখে না, তাই বন্ধ-দুঃখ ভোগ করে, কিন্তু এই আবরণে সে স্বরূপ কখন নষ্ট হয় না। মায়ার ঠুলি অপসৃত হইলেই, আবরণ-মুক্ত হইয়া সে তাহার নিত্যসিদ্ধাবস্থা উপলব্ধি ও প্রত্যক্ষ করে। ইহাই জীব-প্রক্বতি। এই জীব-তত্ত্ব অহঙ্কার-তত্ত্বের উপরে ও অতীতে। এই জীব-তত্ত্ব ভগবত্তত্ত্বের সঙ্গে নিত্যযুক্ত হইয়া আমাদের প্রত্যেকের জীবনে বাস করিতেছে।
আর আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এই জীব-ভগবানের নিত্যলীলা নিয়ত অভিনীত হইতেছে। এইখানেই এই বিচ্ছিন্ন জীবনের একত্ব ও প্রতিষ্ঠা। ঐ লীলাতেই জীবনের বিবিধ সম্বন্ধসকলের উৎপত্তি ও পরিণতি। ঐ নিত্য, ঐ তুরীয় ধামে যে প্রেমের, জ্ঞানের, পুণ্যের, আদান প্রদান নিয়ত চলিতেছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ও উপরিস্থ বুদ্বুদের ন্যায় আমাদের জীবনের জ্ঞান, প্রেম, পুণ্যাদি ফুটিয়া উঠিতেছে। সে লীলা নিগূঢ়। তাহা বুদ্ধির অগম্য। তাহার বর্ণনা তো দূরের কথা, ধ্যান ও ধারণাও বহুভাগ্যবলে ক্বচিৎ কখন সাধুজনের পক্ষে সম্ভব হইলেও, প্রাকৃত জনের অধিকারের সম্পূর্ণ বহির্ভূত। সে তত্ত্ব ব্যক্ত করিবে কে? সে চিত্র অঙ্কন করে সাধ্য কার? সেই নিগূঢ় তত্ত্বের আভাস পাইয়াই শ্রুতি বলিতেছেন,
ন তত্র সূর্য্যো ভাতি ন চন্দ্র তারকম্
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্ব্বং
তস্য ভাসা সর্ব্বমিদং বিভাতি।
এ অন্তরঙ্গ লীলাতত্ত্ব ভাষায় প্রকাশ হয় না; ব্যক্ত করিবার প্রয়াসেই বোধ হয়, তাহা লঘু হইয়া পড়ে। সে লীলা বর্ণনা করিবার অধিকার আমার নাই, তাহা অনুভব মাত্র যদি করিতে পারি, তাহা হইলেই কৃতকৃতার্থ হইয়া যাই। সে নিত্য বৈকুণ্ঠ-ধামে ভক্তি-বলেই ভক্তেরা প্রবেশ করিয়া থাকেন।
বহুনাং জন্মনামান্তে জ্ঞানবান মাং প্রপদ্যতে।
বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ॥
সে নিখিল-রসামৃত-পূরিত, চিরবসন্ত-সেবিত, ভক্তমধুপকুল প্রেমস্তুতিগীতগুঞ্জিত, লীলাতরঙ্গোচ্ছ্বসিত, নিত্যমলয়বীজিত, চিদালোকোদ্ভাসিত, অপ্রাকৃত, নিত্য, তুরীয় লীলার কথা ভাষায় প্রকাশিত হয় না। সে তত্ত্বের সামান্য আভাস পরম ভক্তজনের জীবনে প্রত্যক্ষ করা যায়; প্রাকৃতজনের সে তত্ত্ব বর্ণনায় অধিকার নাই, সে কথা বলিতেছি না। কিন্তু ঐ লীলা ছাড়িয়া এই সংসার আবর্ত্তেরই বা অর্থ পাই কোথায়? প্রদোষ সময়ের আলোক অন্ধকারের যে অপূর্ব্ব মিলন তার অর্থ ও মীমাংসা যেমন দিবসের নিরবছিন্ন আলোকরাশির মধ্যে, সেইরূপ মর জীবনের জ্ঞান ও অজ্ঞানের, চৈতন্য ও মোহের যে অত্যদ্ভুত সংমিশ্রণ, তারও অর্থ ও মীমাংসা, ঐ নিত্য, ঐ অমর, ঐ চিদালোক-সমুজ্জ্বল বৈকুণ্ঠধামে। এ সংসারের অনিত্যতা সেই নিত্য সত্যকেই আপনার কারণ ও আশ্রয়রূপে নিয়ত নির্দ্দেশ করিতেছে। জীবের চিরঅতৃপ্ত রসলিপ্সা নিয়ত সেই নিখিল রসত্বকেই আপনার উদ্ভব ও পরিতৃপ্তিরূপে নির্দ্দেশ করিতেছে। সংসারের যে সকল সম্বন্ধ আমাদিগকে আবদ্ধ করিতেছে, এই সকল বাৎসল্য, সখ্য, দাস্য, মাধুর্য্যের কি কোন অর্থ নাই? জন্ম মরণের অতি সংঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রের মধ্যেই কি এ সকল সম্বন্ধের খেলা ফুরাইয়া যায়? তবে এ শোক, এ ক্রন্দন, এ নিরাশাই তো জীবের চিরবিহিত নিয়তি। সংসারের তবে অর্থ কি রহিল? এই যে অতৃপ্ত বাসনা, ইহারই বা সার্থকতা হইল কোথায়? এই যে অনন্ত জ্ঞান-পিপাসা, এই যে চির-জ্বলন্ত প্রেমলিপ্সা, এই যে আত্যন্তিক সেবাপ্রবৃত্তি, এই যে অতুল-অতৃপ্ত করুণা,—যাহা সংসারে কেবল মাত্র উদ্রিক্ত হয়, কিন্তু কদাপি পরিতৃপ্ত হয় না, হইতে পারে না, ইহার কি কোনোই অর্থ নাই? যদি না থাকে, তবে সংসারের কোনোই সার্থকতা কল্পনা করাও সম্ভব হয় না, জ্ঞান ধারণা করাতো দূরের কথা। তাহা হইলে এ সংসার কোন একান্ত ক্রুরমতি ব্যক্তির খেলারূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার অন্তরালে, ইহার মূলে, অনন্ত মঙ্গল-শক্তি বা ইচ্ছা কল্পনা করাও অসম্ভব হইয়া উঠে। তবে আস্তিক্যের আশ্রয়, ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা, ভক্তির অবলম্বন, জীবনের সার্থকতা, মৃত্যুর শিক্ষা, সকলই সমূলে বিনষ্ট হইয়া যায়। আর এই সংসারচক্রের পশ্চাতে, ইহার উদ্ভব, ইহার আশ্রয়, ইহার প্রেরণা ও ইহার পরিণতিরূপে এক নিত্য, তুরীয়, অপ্রাকৃত লীলারঙ্গের প্রতিষ্ঠা কর, দেখিবে সকলই সত্য ও সার্থক হইয়া উঠে।
ঊর্দ্ধমূলোঽবাক্শাখ এষোঽশ্বত্থঃ সনাতনঃ
তদেব শুক্রং তদ্ ব্রহ্ম তদেবামৃতমুচ্যতে॥
তস্মিংল্লোকাঃ শ্রিতাঃ সর্ব্বে।
তদু নাত্যেতি কশ্চন। এতদ্বৈতৎ॥
এই যে নিয়তপরিণামী সংসাররূপ সনাতন অশ্বত্থবৃক্ষ, ইহার মূল ঊর্দ্ধে, ব্রহ্মলোকে, ইহার শাখাসকল নিম্নগামী, জীবজগতাভিমুখী। এই সংসারবৃক্ষের যে মূল, তাহাই শুক্র বা জ্যোতির্ম্ময়, তাহাই ব্রহ্ম, তাহাই অমৃত বলিয়া উক্ত হয়। তাহাতেই লোকসকল আশ্রিত হইয়া আছে, তাহার অতীতে কিছুই নাই।
পুনশ্চ ভগবদ্গীতায়—
ঊর্দ্ধমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্।
ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ॥
অধশ্চোর্দ্ধঞ্চ প্রসৃতাস্তস্য শাখা গুণপ্রবৃদ্ধা বিষয় প্রবালাঃ।
অধশ্চ মূলানুসন্ততানি কর্ম্মানুবন্ধীনি মনুষ্যলোকে॥
ন রূপমস্যেহ তাথোপলভ্যতে নান্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা।
অশ্বত্থমেনং সুবিরূঢ়মূলমসঙ্গশস্ত্রেণ দৃঢ়েন ছিত্বা॥
হে অর্জ্জুন! এই যে সংসার দেখিতেছ, ইহার রূপ, ইহার অন্ত, ইহার আদি, এবং ইহার আশ্রয় জীবের প্রত্যক্ষীভূত হয় না। কারণ ইহার মূল উর্দ্ধে সংসারাতীতে মায়াতীত পুরুষোত্তমে। অধোদেশে, মায়াময়ী সৃষ্টিতে ইহার শাখাসকল প্রসৃত হইয়াছে। ইহা প্রবাহরূপে অবিচ্ছিন্ন বলিয়া অব্যয় পদবাচ্য হইয়াছে। কর্ম্মফল বিধানের দ্বারা ধর্ম্মাধর্ম্ম প্রতিপাদন করিয়া জীবকুলকে আশ্রয় দান করিতেছে বলিয়া, বেদসকল এই সনাতন সংসার-বৃক্ষের পর্ণস্বরূপে কল্পিত হয়। দেবলোক ও মনুষ্যলোক এই বৃক্ষের ঊর্দ্ধ ও অধোগামী শাখা। সত্ব রজঃ তম এই ত্রিগুণের দ্বারা শোধিত হইয়া, এই সকল শাখা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতেছে। রূপরসগন্ধাদি ইহার প্রবালস্থানীয়া। অধোদেশে মনুষ্যলোকে এই সনাতন সংসার-বৃক্ষের শিকড়সকল ভোগবাসনা প্রভৃতিরূপে বিস্তৃত রহিয়াছে।
পরমপুরুষ পুরুষোত্তম ভগবান এই সংসারচক্রের নিয়ন্তা। কিন্তু পুরুষ তো কখন একাকী বাস করেন না। প্রকৃতির সঙ্গে তিনি নিত্যযুক্ত হইয়া রহিয়াছেন। প্রকৃতি সহবাসে, প্রকৃতি সান্নিধ্যেই তাঁহার পুরুষত্ব প্রতিষ্ঠিত ও প্রকাশিত। এই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁহার যে অচিন্ত্যভেদাভেদ সম্বন্ধ, তারই মধ্যে ভগবানের পরম পুরুষত্ব সিদ্ধ হইতেছে। এই প্রকৃতিকে অবলম্বন করিয়াই তিনি আপনার জ্ঞানের ও আনন্দের আয়োজন করিতেছেন। এই প্রকৃতিকে অবলম্বন করিয়া, তাহার সঙ্গে নিত্যলীলাতে নিযুক্ত থাকিয়াই তিনি আপনি আপনাকে আত্মারূপে জানিতেছেন ও সম্ভোগ করিতেছেন। এই নিত্য, তুরীয় লীলা ব্যতীত পুরুষস্বরূপের আশ্রয়, প্রতিষ্ঠা ও সার্থকতা সম্পাদিত হয় না। আর এই যে সংসারচক্র, ইহারও আশ্রয়, প্রতিষ্ঠা ও সার্থকতা ঐ তুরীয়, ঐ নিত্য লীলাতেই অন্বেষণ করিতে হয়। এই প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়াই তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করিতেছেন। এই সংসার পুরুষ-প্রকৃতির প্রকট লীলা। এখানে পরমপুরুষ কারণব্রহ্মরূপে ব্রহ্মাণ্ডে, অন্তর্যামী পরমাত্মারূপে জীবের অন্তরে, আর লীলাময় ভগবানরূপে মনুষ্যলোকে, পিতা মাতা, ভ্রাতা ভগিনী, সখাসখী, দাসদাসী, প্রভু ভর্ত্তা, পতি পত্নী, নায়ক বা নায়িকা গণের দেহ আশ্রয় করিয়া, সেই নিত্যধামের নিত্যলীলার রস মাধুর্য্যের বিকাশ করিয়া, কালের সীমাবেষ্টিত জগত রঙ্গমঞ্চে, আপনার অপ্রাকৃত বা তুরীয় লীলারই প্রাকৃত ও প্রকট অভিনয় প্রদর্শন করিতেছেন। ইহাই সংসারের অর্থ। ইহাতেই জীবের অশন-পিপাসার, সুখদুঃখের, আশা-নিরাশার, মিলন-বিচ্ছেদের, অনুরাগবিরাগের, জীবন-মৃত্যুর ও সকলের সার্থকতা।
আর এই জীবন যদি স্বয়ং ভগবান কর্তৃক ভাগবতী লীলার অভিনয়ক্ষেত্র রূপে রচিত হইয়া থাকে, তবে ইহার কর্ত্তা তো আর আমি রহিলাম না। এখানে যে তিনিই নটরূপে সমুদয় ঘটনা ও সম্বন্ধকে আত্ম-প্রয়োজনে, যথেপ্সীতভাবে, যথোপযুক্ত প্রকারে সংযোজিত ও বিয়োজিত করিয়াছেন ও করিতেছেন। জীবনের কাহিনী তবে আর জীবের আত্মকাহিনী রহিল কৈ? ইহা যে ভাগবতী লীলার অপূর্ব্ব কাহিনীতে পরিণত হইয়া গেল। এ কাহিনী বর্ণনায় আর অভিমানের বা সঙ্কোচের অবসর রহিল কোথায়?
সকল সময়ে আপনার জীবন রঙ্গমঞ্চে ভগবানকে নটেশরূপে দেখিতে পাই না, সত্য। আর তারই জন্য এ সংসারে এত ক্লেশ, এত শোক, এত তাপ সহ্য করিয়া থাকি। কিন্তু এ জীবনের বিচিত্রতা পর্য্যবেক্ষণ ব্যতীত, ভগবল্লীল। প্রত্যক্ষ করিবার অন্য উপায়ই বা আর কি আছে? মানসপটে জীবনের বিবিধ অঙ্কলকলকে প্রতিফলিত না করিলে, তাহার অভ্যন্তরস্থ ভাগবতী লীলার সাক্ষাৎকারই বা হয় কিরূপে? উপস্থিত ঘটনাবলী আমাদিগকে সুখদুঃখের তাড়নায় এতই বিভ্রান্ত করিয়া তোলে, যে তাহার মধ্যে ভাগবতী লীলা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু যখন এ সকল অতীতের স্মৃতিতে স্থৈর্য্য ও শান্তিলাভ করিতে থাকে, তখন ইহাদের নিগূঢ় মঙ্গল অভিপ্রায় ধীরে ধীরে, ঊষার উদ্ভিন্ন আলোকের মত ফুটিতে আরম্ভ করে। তখনই এ সকল বিচিত্রতার মধ্যে জীবনের একত্ব অনুভব করিয়া আমরা বিস্ময়ে, আনন্দে নির্ব্বাক্ হইয়া যাই। এই সকল পুণ্যস্মৃতিকে এক সূত্রে গ্রথিত করিলেই তাহার মধ্যে ভগবানের অপূর্ব্ব প্রেমলীলা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হয়।
জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনায় ভগবদ্করুণা আমরা অনেক সময় হয়ত দেখিতে পাই; না দেখিলেও, তাহা কল্পনা করিয়াই আশ্বস্ত বা শান্ত হইতে চেষ্টা করিয়া থাকি। গভীর আনন্দে, বা গভীর শোকের মধ্যে, নবজীবনের অপূর্ব্ব অঙ্কুরোদ্গমে কিম্বা মৃত্যুর ঘননিবিড় অন্ধকারের মধ্যে, প্রাকৃতজনের ভাগ্যেও ভগবদ্দর্শন লাভ না হউক, ভগবদ্শক্তির অনুভূতি স্বল্পবিস্তর হইয়া থাকে। আর সচরাচর লোকে জীবনের এই সকল বিশেষ বিশেষ ঘটনাকেই ভগবানের প্রেমের ও বিধাতৃত্বের প্রমাণরূপে গ্রহণ করিয়া, তাহার পুণ্যস্মৃতি প্রাণমধ্যে জাগরূক রাখিতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতি দিনের, প্রতি মুহূর্ত্তের সুখ ও দুঃখ, জ্ঞান ও অজ্ঞান, আশা ও নিরাশা, সফলতা ও নিষ্ফলতার মধ্যেও যে সেই একই শক্তি, একই প্রেম, একই মঙ্গল সঙ্কল্প আপনাকে আপনি ফুটাইয়া তুলিতেছে, ইহা আমরা দেখিতে পাই না, দেখিতে চাহি না, ক্বচিৎ যদি ভগবৎ-প্রসাদে তাহার আভাস প্রাপ্ত হই, তাহা হইলেও তাহাতে সরল শ্রদ্ধা স্থাপন করিতে পারি না। ভাগবতী লীলাকে এতটা সস্তা করিয়া তুলিতে আমাদের দুর্ব্বল বিশ্বাসের সাহসে কিছুতেই কুলায় না।
আর, প্রতি দিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার ও ব্যবস্থার মধ্যে ভগবানের লীলা যদি দেখিতে হয়, তবে এগুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখিলে চলিরে না। জীবনকে খণ্ড খণ্ড করিয়া দেখিলে, ইহার মধ্যে মৃত্যুরই পৈশাচনৃত্য দেখিতে পাই, তাহার কোলাহলের ভিতরে নরকপালগণের অট্টহাস্যই কেবল শুনিতে পাই,— অমৃতের সন্ধান বা ভগবৎ বেনুধ্বনি কিছুই তাহার মধ্যে দেখিতে বা শুনিতে পাওয়া যায় না।
মনসৈবেদমাপ্তব্যং নেহ নানাস্তি কিঞ্চন।
মৃত্যোঃ স মৃত্যুঙ্গচ্ছতি য ইহ নান্যেব পশ্যতি॥
এখানে বহুত্ব কিছুই নাই, ইহা একাগ্রমনে ধ্যান করিয়া বুঝিতে হইবে। এখানে যে বহুতর প্রত্যক্ষ করে, মৃত্যু হইতে সে মৃত্যুতেই কেবল গমন করিয়া থাকে। জীবনকে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া দেখিলে চলিবে না। জীবনকে এইরূপে বিচ্ছিন্নভাবে দেখিলে, তাহার গতি ও নিয়তি, একত্ব ও মহত্ব, নিগূঢ়ত্ব ও দেবত্ব, কিছুই দেখা যায় না। এই মুহূর্ত্তকে যখন পূর্ব্বাপর মুহূর্তসকলের সঙ্গে সংযুক্ত করি, অদ্যকার বিধানকে যখন গত কল্যকার বিধানের ভিতর দিয়া দেখি,—ইহাকে যখন আজন্মব্যাপী সমুদয় ঘটনাবলীর সঙ্গে এক সূত্রে গাঁথিয়া ফেলিতে পারি, তখনই জীবনের মর্ম্ম বুঝিতে সমর্থ হই। তখনই দেখি আজি যাহাকে সুখ বলিয়া আলিঙ্গন করিতেছি, তাহা গত কল্যকার দুঃখ যাতনারই ফল; আর আজি দুঃখবোধে যাহা হইতে সরিয়া যাইতে চেষ্টা করিতেছি, তাহা কেবল জীবনক্ষেত্রকে কঠোর হলচালনা দ্বারা বিদীর্ণ করিয়া কল্যকার মঙ্গল ও মুক্তির বীজ বপনের উপযোগী করিতেছে।
ফলতঃ জীবনের ক্ষুদ্র বৃহৎ সমুদায় ঘটনা ও অভিজ্ঞতাকে যতটা সম্ভব, একসূত্রে আবদ্ধ করিয়া, যথাযথভাবে সন্নিবিষ্ট করিয়া দেখিলেই কেবল তাহাতে সত্যভাবে ভগবল্লীলা প্রত্যক্ষ করা যায়। আর এইভাবে যখন জীবনের কাহিনী রচনায় প্রবৃত্ত হই, তখন ইহা ভগবদুপাসনার অঙ্গ হইয়া পড়ে।
ভক্তিশাস্ত্রে ভগবদ্ স্মরণের উপদেশ আছে। এ স্মরণ কাহাকে বলে? স্মরণ বলিতে পূর্ব্ব অভিজ্ঞতা বোঝায়। যাহাকে পূর্ব্বে দেখি নাই, তাঁহাকে স্মরণ করিব কেমন করিয়া? শ্রুত বিষয়ের স্মৃতি হয়। ভগবল্লীলা পুরাণ ইতিহাসে যাহা শোনা গিয়াছে, তাহারই পুনরাবৃত্তিকে লোকে সচরাচর স্মরণ বলিয়া মনে করে। ইহাও স্মরণ সত্য। কিন্তু আমার নিজ জীবনে যদি ভগবল্লীলা না দেখিলাম বা না বুঝিলাম, তবে এ স্মৃতিতে আমার লাভ কি? বন্ধ্যার পুত্রস্নেহের ন্যায় ইহা যে কেবল কল্পিত, কেবল শব্দমাত্রে প্রতিষ্ঠিত; সত্য বা বস্তুতন্ত্র নহে। রাম-বনবাসে জননী কৌশল্যার গভীর মর্মবেদনা বুঝেন কেবল পুত্রবতী রমণী, অপুত্রা যে সে ইহার কি জানে? পুরাণ ইতিহাসের স্মৃতি যদি আমার আত্মস্মৃতিকে জাগাইয়া দেয়, তবেই কেবল তাহাদের সাহায্যে আমার ভগবৎ-স্মরণ সম্ভব হয়, অন্যথা নহে। পুরাণেতিহাসে ভগবল্লীলা কাহিনী শ্রবণ করা গৌণ স্মরণ, মুখ্য স্মরণ নিজ জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলীতে ভগবানের প্রেম ও প্রকাশ প্রত্যক্ষ করা। আত্মজীবন-কাহিনী ভক্তিভরে অধ্যয়ন ধ্যান করাই প্রকৃত স্মরণ। ইহা ভক্তি-সাধনার মুখ্য অঙ্গ মধ্যে পরিগণিত।
আর এইভাবে যদি আত্ম-জীবনচরিত রচিত হয়, তাহা হইলে, ইহা ভগবদুপাসনার অঙ্গ হইয়া যায়। ভগবদ্গুণ বর্ণনায় যদি অপরাধ না হয়, এরূপ আত্মচরিত রচনায় তবে লোকে সঙ্কুচিত হইবে কেন?
এইরূপ আত্মচরিত কথনের প্রয়োজন দুই, এক অন্তরঙ্গ, অপর বহিরঙ্গ। অন্তরঙ্গ প্রয়োজন ভগবল্লীলারস আস্বাদন, বহিরঙ্গ প্রয়োজন লোকমণ্ডলী মধ্যে সে নিখিল লীলারহস্য প্রচার।
কিন্তু প্রাকৃত জনের জীবন-কাহিনী শুনিবে কে? লোকে মহৎ জীবনের আখ্যায়িকাই আগ্রহ সহকারে পাঠ করে, তাহাদের জীবনে ও চরিত্রেই কেবল শিক্ষনীয় বিষয় আছে মনে করে। সামান্য লোকের জীবনের অকিঞ্চিৎকর কথা শুনিয়া লাভ কি? আজি পর্য্যন্ত জীবন-চরিত যে আদর্শে রচিত ও যে ভাবে পঠিত হয়, তাহাতে এ আপত্তি উঠে বটে। কিন্তু এ আদর্শই কি ঠিক?
ফলতঃ মহৎজীবনের আখ্যায়িকায় ইতর পাঠকবর্গের উপকার অপেক্ষা অপকারই অধিক হইয়া থাকে বলিয়া মনে হয়। ইহাতে অনেক সময় ক্ষুদ্রচেতা পাঠকের চিন্তা ও কল্পনাকে আপনার জীবন ও অধিকারের সত্য হইতে বিচলিত করিয়া, এক অলীক ও অনধিকার পথে পরিচালিত করিয়া থাকে। এ সকল মহৎ জীবনের আলোচনায় দুর্ব্বল লোককে স্বধর্ম্মচ্যুত ও ভয়াবহ পরধর্ম্ম পথে পরিচালিত করিয়া উভয়ভ্রষ্ট করিয়া তোলে। ইহারা আপনার ক্ষুদ্রতাকে সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিয়া তাহারই মধ্যে আপনার নিজস্ব মহত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করিতেও পারে না, আর লোকোত্তর চরিতের যে বিশালত্ব ও ঔদার্য্য তাহাও লাভ করিতে সমর্থ হয় না। মহৎজীবনের মোহিনী কল্পনায় ইহাদের জীবন ও চরিত্র মহৎ না হইয়া অনেক সময় লঘু ও আকাশমার্গচারী হইয়া পড়ে। আমি চাই আমার মত যারা, ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্রত্বের মধ্যেই যাহারা আত্মহারা ও বিভ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে, তাদের অভিজ্ঞতা কি ইহাই জানিতে। তারা এই দুর্ব্বলতার মধ্য হইতে প্রতিদিন যদি বল সংগ্রহ করিতেছে শুনি, এই সামান্য ভাবনার ভারই সোজাভাবে বহন করিতেছে বুঝি, প্রতিদিন শতবার বিষয়জালে আবদ্ধ হইয়া, আবার সেই জাল কাটিয়া বাহির হইতেছে দেখি,— পাপের মধ্যেই পুণ্য, নিরাশার মধ্যেই আশা, দুঃখের মধ্যেই সুখ, ভীরুতার মধ্যেই সাহস লাভ করিতেছে, এ যদি ভাল করিয়া ধরিতে পারি, তবে আমারও বুকে বল থাকে, চিত্তে ধৈর্য্য আসে, মনে সাহস আসে, জীবনে আশা আসে। এই শিক্ষাই, এই প্রেরণাই, এই প্রবোধই আমি চাহি। বামন কি করিয়া আপনার আয়ত্ত ফল আহরণ করে, আমি তাহাই জানিতে চাহি, সে শিক্ষারই আমার আবশ্যক, প্রাংশুজনে কি করিয়া আপনার জীবনের ঈপ্সিত লাভ করেন ইহা জানিয়। আমার কি লাভ?