প্রথম অধ্যায়

প্রাণের কথা

 প্রাণং দেবা অনুপ্রাণস্তি। মানুষ্যঃ পশবশ্চ যে। প্রণো হি ভূতা নামাযুঃ। তস্মাৎ সর্ব্বায়ূষমুচ্যতে।

 সর্ব্বমেব ত আয়ুর্যন্তি। যে প্রাণংব্রহ্মোপাসতে।[]

 শুনিয়াছি, বয়স হইলে, লোকের প্রাণের মায়া কমিয়া আসে। যার কমে না, সে অধম, ঘোর সংসারী। বয়সের সঙ্গে আমার কিন্তু প্রাণের মমতা কমে নাই, বরং বাড়িয়াই বুঝি চলিয়াছে। এ জন্য আমাক অধম বলিতে হয়, বল। অধম যে নই, স্পদ্ধা করিয়া এমন কথাও বলিতে পারি না। তোমরা অধম আমায় বলিলে, গায়ে বড় লাগে সত্য, যেন তপ্ত তৈলের ছিটা পড়ে, মন প্রাণ তাতে চিড়বিড় করিয়া উঠে। তোমরা আমার আপনার জন নও, তাতেই বুঝি অমন হয়। আবার অধম বলিয়া তোমাদের আনন্দ হয়, তোমাদের অভিমান পুষ্ট হয়, তাই তাতে আমার অভিমানে এমন আঘাত লাগে। কিন্তু আমি নিজেকে অধম বলিয়া জানি বা না জানি, অনেক সময় ভাবিয়া থাকি। আামার নিজের মুখে যখন আমি নিজেকে অধম বলি, তখন প্রণে আরাম পাই। নিজেকে নিজে নীচু করার একটা মহত্ব আছে, তারই জন্য আপনাকে অধম বলিয়া মানাতে আামি কুণ্ঠিত নহি। অধম যে নই, -এমন কথা তাই বলিতে চাহি না। কিন্তু প্রাণকে ভালবাসি এই জন্য আমি অধম, এ কথা তোমরা বলিলেও আমি শুনিব না। বয়স ফুরাইয়া আসিল, কিন্তু প্রাণের মায়া কমিল না, এজন্য আমি একরত্তিও লজ্জিত নই; প্রাণের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হইবে—ভাবিতে অসহ্য যাতনা হয়, একথা স্বীকার করিতে আমি বিন্দুমাত্রও কুণ্ঠিত নহি। প্রাণ আমার অতি প্রিয়, এ প্রাণের চাইতে প্রিয়তর এ জগতে আর কিছুই নাই। এই প্রাণ আমার প্রীতির মাপকাঠি। যা’কে নিরতিশয় প্রীতি করি তা’কে প্রাণতুল্য বলিয়া সম্বোধন করি। যার চাইতে জগতে আর কিছু প্রিয়তর আছে বলিয়া মনে হয় না, তাকে প্রাণ বলিতে প্রাণ জুড়াইয়া যায়। এ জগতে যা কিছু প্রিয়, তা কেবল এই প্রাণের জন্য। এই প্রাণের সেবা করিয়া তারা সকলে প্রিয় হইয়াছে! স্ত্রী পুত্র পরিবার আত্মীয় বন্ধু বান্ধব, সমাজ, স্বদেশ, দেব, মানব সকলে প্রিয় এই প্রাণের জন্য। এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ড নিয়ত এই প্রাণের সেবা করিয়া এত প্রিয় হইয়াছে। এমন যে প্রিয় প্রাণ, ইহাকে ছাড়িব ভাবিলে কষ্ট হয়, এ আর বিচিত্র কি?

 এ প্রাণকে বড় ভালবাসি; কিন্তু তাকে ভালরূপ করিয়া এখনো চিনি না। ভাল করিয়া যদি জানিতেই পারিতাম, তবে বুঝিবা এ প্রেমও থাকিত না। জানি অথচ জানি না, যত জানি তত জানি না, যত নিকটে আনি ততই যেন আরো দূরে সরিয়া যায়; এই যে আলো-আঁধারের বিচিত্র লীলা, তাহাতেই প্রেম জন্মে, তাতেই প্রেম বাঁচে ও বাড়ে। যাকে ভালবাসি সে চিরকাল আমার চাইতে বড় থাকিবে। যাকে একেবারে জানিয়া ফেলিলাম, সে ত মুঠোর ভিতরে আসিয়া পড়িল। সে তো ছোট হইয়া গেল। তার প্রতি প্রেম আর তেমন ভাবে, তেমন জ্বলন্ত পিপাসা বুকে লইয়া ছুটিয়া যায় না। আর ঐ পিপাসাই প্রেমের প্রাণ।

জানি, জানি, মনে জানি; কিন্তু আমি জানিনে
চিনি, চিনি, মনে চিনি; কিন্তু আমি চিনিনে।

 ইহাই প্রেমের উপজীব্য। প্রাণকে আমি জানি না, তাই এত ভালবাসি। যদি এ জনমে প্রাণকে ভাল করিয়া একবার জানিয়া ফেলিতে পারিতাম, তবে তার মায়া আপনি হয়ত কাটিয়া যাইত। বয়সের সঙ্গে যাদের প্রাণের মায়া সত্য সত্যই কাটিয়া যায় বুঝিবা তারা প্রাণকে ভাল করিয়া জানিয়া ফেলে। আর জানুক বা না জানুক, যতটা সম্ভব-একেবারে তারা শেষটা দেখিয়ছে, অন্ততঃ এ অভিমান তাদের জন্মে। নইলে প্রাণের মায়া ছুটে কিসে? তারা এই দেহকেই প্রাণ বলিয়া ধরিয়া লয়, এ সকল ইন্দ্রিয়কেই প্রাণ বলিয়া গণনা করে, তাই দেহ যত দুর্ব্বল হয়, ইন্দ্রিয় যত বিকল হয়, তাই প্রাণও শেষ হইয়া আসিতেছে ভাবিয়া, তা'র প্রতি মমতাশূ্ন্য হইয়া পড়ে। তারা যন্ত্রকে যন্ত্রী বলিয়া ধরে, আঁধারকে আধেয় বলিয়া ভাবে। যন্ত্রকে জানিয়াই যন্ত্রীকেও জানিয়া ফেলিয়াছে, তাঁর দৌড় কত তাহা দেখিয়াছে, মনে করে। তাই তাদের প্রাণের মায়া কমিয়া যায়। কিন্তু আমি এখনো প্রাণকে চিনিলাম না। প্রাণের স্বরূপ এখনো বুঝিলাম না, এ প্রাণের ভিতরে কত কি যে আছে না আছে, তার কিছুরই সন্ধান এখনো পাইলাম না। এ জন্ম বুঝি এই ভাবেই হবে। কত জন্ম যে এইভাবে যাবে তাহারই বা ঠিকানা কোথায়? বয়স বাড়িল, আয়ু ফুরাইতে চলিল, কিন্ধ এ প্রাণকে জানা হইল না, তাই ইহকে এত ভালবাসি। এ প্রাণের উৎপত্তি কোথায়, ইহার স্থিতি কিসে, ইহার গতি ও পরিণাম কি,—এ সকল কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না। খুঁজিতে গেলে, আপনাকে অনন্ত অসীমে হারাইয়া ফেলি। এ জনমে এতটুকু মাত্র মনে হয়, যেন বুঝিয়ছি যে এই প্রাণ হেয় বস্তু নহে। ইহা ক্ষুদ্র নহে। ইহার মধ্যে যেন এই বিশাল বিশ্ব লুকাইয়া আছে। জানিয়াছি শুধু এই যে, এ প্রাণ নিত্য বস্তু, শাশ্বত সনাতন। উর্দ্ধমুলোহবাকশাখঃ এযোহশ্বত্থ সনাতন,—মনে হয় এই প্রাণই সেই শ্রুতিকথিত সনাতন অশ্বখ বৃক্ষ যাহার মূল উদ্ধে অনস্ত দেবপিতৃলোকে, আর যাহার শাখা প্রশাখা নিয়ে এই নরলোকে অনন্তভাবে পরিব্যাপ্ত হইয়া আছে। এই প্রাণের উৎপত্তি কোথায় জানি না, জানি কেবল, পিতৃকুল, মাতৃকুল, দুই পবিত্র কুলধারা এই প্রাণেতে গঙ্গা যমুনার মত সম্মিলিত হইয়া ইহাকে পরম পবিত্র প্রয়াগ তীর্থে পরিণত করিয়াছেন। প্রতি নিঃশ্বাসে, প্রতি প্রশ্বাসে আমি আজন্মকাল এই পবিত্র সঙ্গমক্ষেত্রে স্নান করিয়া পবিত্র হইয়াছি। পিতাতে মাতাতে, দুই দুই প্রাণধারা মিলিত হইয়া তাঁহাদের প্রাণের সৃষ্টি করিয়া ছিল। অথবা তাই কেন বলি, তাঁদের মিলনে দুই নহে, চারি, চারি নহে, আট; আট নহে, যোড়শ; যোড়শ নহে, বত্রিশ; বত্রিশ নহে, চৌষট্টি; চৌষট্টি নহে শতাধিক, সহস্র।ধিক,—কত কুলধারা, কত প্রাণধার যে এক একটি প্রাণেত আসিয়া মিলিত হয়,তার সংখ্যা করে কে? এই প্রাণ ধরিয়া যখন উচ্চে বহিয়া চলি,—অল্পক্ষণ মধ্যে এক অসংখ্যশাখ, অনাদ্যনস্ত প্রাণস্রোতে গিয়া আত্মহারা হইয়া যাই। তখন দেখি এই প্রাণই পবিত্র সুরধুনী, সকল প্রাণের প্রতিষ্ঠ। বিষ্ণুপাদপদ্মে—এই প্রাণধারার উৎপত্তি। এই প্রাণের দিকে যখনই তাকাই তখন উদার-চরিত না হইয়াও, সমগ্র বসুধাকে কটুম্ব বলিয়া আলিঙ্গন করিতে সাধ যায়। কত শত কত সহজ কত লক্ষ, কত কোটী কোটী প্রাণধারা মিলিয়া একটী ক্ষুদ্র প্রাণের সৃষ্টি করে, তার গণনা করিবে কে? শত শত মন্বন্তর ব্যাপী প্রাণন চেষ্টার শেষ ফল রূপে এই ক্ষুদ্র প্রাণ ফুটিয়া উঠিয়াছে, ইহার মর্য্যাদার সীমা কোথায়? কত যুগ যুগান্ত ব্যাপিয়া, কত দেব, কত মানব, কত দেবর্ষি, কত রাজর্ষি, কত মহর্ষি, কত জ্ঞানী, কত কর্মীকত যোগীকত ভক্ত, কত আশা ভরে, কত যত্নে, কত আদরে, কত ভাবে, এই প্রাণের পরিচর্যা করিয়া, কত শিক্ষা দীক্ষা দিয়াআপনাদের আজন্ম সাধিত, সাধনসম্পত্তি দ্বারা অভিষিক্ত করিয়া, ইদানীং এই সংসারে, এক ক্ষুদ্র পরিবারে, এক নরদম্পতির পরম পবিত্র প্রাণষাগের যজ্ঞফলরূপে, এই ক্ষুদ্র প্রাণকে ফুটাইয়াছেন,—ইহা যখন মনে হয়, তখন, সত্য বলি, এ প্রাণকে আর আমার বলিতে সাহস হয় না। এ যে বিশ্বপ্রাণ—এ যে হিরণ্যগর্ভ; এ যে প্রজাপতি; পবিত্র পুরুষযজ্ঞে ইহার উৎপত্তি। যে যজ্ঞের দেবতা কাম, ছন্দ বেদমাতা গায়ত্রী, ঋষি বিশ্বস্য মিত্রং বিশ্বামিত্র; পুরুষ প্রেমস্নাত হইয়া যে যজ্ঞের অগ্নিতে আপনাকে আপনি শ্রদ্ধা সহকারে, আহুতিরূপে অর্পণ করেন, সেই মহাযজ্ঞ হইতে এই প্রাণের উৎপত্তি। এ প্রাণের মহত্ত্বের শেষ কোথায়? এমন প্রাণকে ভলেবাসি, ইহার জন্য লজ্জিত হইব কেন?

 এই বিশাল বিশ্ব এই প্রণকে আশ্রয় করিয়া আছে। এই জ্যোতির্ম্ময় সূর্য্যদেবতা, অনাদি কাল হইতে প্রাণের দ্বারস্থ হইয়া, ইহার নিকটে, নিয়ত আপনার জীবনের সম্যক সফলতা ভিক্ষা করিতেছেন। যে রূপ: তন্মাত্রা জ্যোতির্ম্ময় সবিতার প্রাণস্বরূপ, তাহা আপনার সার্থকতার জন্য এই প্রাণমুখাপেক্ষী চক্ষু দুটীর মুখ চাহিয়া আছে। চক্ষুর জন্য রূপের সৃষ্টি, না রূপের জ্ন্য চক্ষুর সৃষ্টি—কে বলিবে? তেজ আগে না চোখ আগে কে জানে? কি প্রাণের আশ্রয় করিয়া প্রাণের মধ্যে যে ইহারা পরস্পরের সফলতা সম্পাদন করে, এ তো প্রত্যক্ষ কথা,—ইহা অস্বীকার করিব কেমনে। যে শব্দতন্মাত্রা প্রাচীন ঋষিকুলপুঞ্জে আকাশ-দেবতার প্রাণ, তাহা আপনার সফলতার জন্য অতিযুগলের মুখাপেক্ষী হইয়া আছে। যে স্পর্শতন্মাত্রা বায়ুদেবতার প্রাণ তাহা সেইরূপ আপনাকে চরিতার্থ করিবার প্রত্যাশায় ত্বকের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকে। যে রসতন্মাত্রা জল দেবতা বারুণীর প্রাণ, তাহা আপনার সফলতার জগ্য এই প্রাণমিশ্রিত রসনার প্রতি চাহিয়া থাকে। যে গন্ধতন্মাত্রা এই ধরিত্রী পৃথিবী দেবতার প্রাণ, তাহা এই ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের আশ্রয়ে আপনার সফলতা লাভ করিয়া থাকে। পঞ্চতন্মত্রাত্মক এই পঞ্চ মহাভূত, পঞ্চভূতাত্মক, এই বিশাল জগতপ্রপঞ্চ এই পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের, এবং এই পঞ্চেন্দ্রিয়, আপন সফলতা লাভের জন্য এই প্রাণের-শরণাগত হইয়াছে। এবং এই প্রাণই বিশ্বম্ভর,—বিশ্বকে ভরণপোষণ করিতেছে। সৃষ্টি-লীলায় এই প্রাণই মহাবিষ্ণু; ব্যষ্টিভাবে, এই প্রাণই ক্ষিরোদশায়ী, জীবান্তর্যামী; সমষ্টিভাবে, এই প্রাণই নারায়ণ বা বিশ্বমানব। এই প্রাণই ভগবানের পরা প্রকৃতি।

 ভূমিরাপোইনলো বায়ুঃ খংমনোবুদ্ধিরেব চ। অহঙ্কারং ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা॥। অপয়েয়মিত স্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মেইপরাম্‌। জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ॥

 ভূমি, জল, অনল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, —আমার এই বিভিন্ন অষ্ট প্রকারের প্রতি। এ সকল আমার নিকৃষ্ট প্রকৃতি, আমার অন্য এক শ্রেষ্ঠ প্রকৃতি আছে, —যে জীবপ্রকৃতি, যাহা দ্বারা, হে মহাবাহো! আমি এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করিয়া রহিয়াছি।

 এই প্রাণই, এই পরা জীবপ্রকৃতি। এ প্রাণের দ্বারাই ভগবান সমুদায় জগৎ ধারণ করিয়া রহিয়ছেন। সৃষ্টিলীলায় এই প্রাণই লীলাময়ের প্রধান সহায়। এমন যে বস্তু, এমন যে মহান্‌, এমন যে পবিত্র পরম তত্ত্ব, তাহাকে ভালবাসি, ইহাতে লজ্জার কথা কি আছে?

 তোমরা তা জান না। সংসারের লোকে সে খবর রাখে নি। কিন্তু যে দিন এই ক্ষুদ্র প্রাণ ভূমিষ্ট হয়, সে দিন এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে সাড়া পড়িয়ছিল। দেবলোক, পিতৃলোক সিদ্ধলোক, গন্ধর্ব্বলোক, নরলোক, সুরলোক, যক্ষরক্ষ-অসুর-লোক,—সকল লোকে সে দিন সাড়া পড়িয়ছিল। বালকেরা নদীতীরে দাড়াইয়া ক্রীড়াচ্ছলে নদীগর্ভে উপলখণ্ড নিক্ষেপ করিয়া, নদীজলের তরঙ্গভঙ্গ দেখিয়া আমোদ করে তারা জানে না যে এই এক একটী সামান্য তরঙ্গে বিশাল সাগরবক্ষ পর্য্যন্ত অদৃশ্যে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিতেছে। শিশুরা সাবান জলে ফুঁ দিয়া আকাশে বুদ্‌বুদ উড়াইয়া, তার গায়ে ইজধমুর রং ফুটাইয়া করতালি দিয়া নৃত্য করে; তারা জানে না যে এই এক একটী বুদ্‌বুদ যখন ফাটিয়া আকাশে মিলিয়া যায়, তখন নিখিল বায়ুমণ্ডল স্পন্দিত হইয়া উঠে। তেমনি আমরাও জানি না যে, এক একটী ক্ষুদ্র মানব শিশুর প্রথম নিঃশ্বাস যখন এই পৃথিবীতে পড়ে, তখন নিখিল বিশ্বে রোমাঞ্চ উঠিয়া থাকে, এই ক্ষুদ্র জীবের সামান্য নিঃশ্বাসের সঙ্গে কত স্নেহ, কত প্রেম, কত আনন, কত বিষাদ, কত আশা, কত আশঙ্কা-যে বিশাল বিশ্বপ্রাণে শিহরিয়া উঠে, তার খবর কে রাখে? তার ওজন জানে। কে? বুভুক্ষিত দেবতারা, তৃষিত পিতৃলোকেরা আসিয়া তখন ইহার সুতিকাগারকে জনাকীর্ণ করিয়া তোলেন। মা, তুমি জান না যে তোমার শয্যাতল তখন সকল তীর্থের সারতীর্থ হইয়া দাঁড়ায়।

 তোমরা এই ক্ষুদ্র নবজাত প্রাণকে একরত্তি মানুষ, এক মুঠো মাংস পিণ্ড দেখিয়া অবজ্ঞা করিতে পার। কিন্তু সর্ব্বজ্ঞ দেবতারা জানেন এই একরত্তি জীব, এই এক মুঠো রক্ত মাংস বস্তু কি? তাঁরা জানেন এই এক বিন্দু প্রাণ, আজ বিশান বিশ্বের অনাদি সঞ্চিত কর্ম্মফলের বোঝা মাথায় করিয়া এই পৃথিবীতে আসিয়াছে।

একঃ প্রজায়তে লোকঃ একোহনুভুঙক্তে সুকৃতমেক এবচ দুষ্কৃতং।

 জীব একাকী জন্মগ্রহণ করে, একাকীই সুকৃত দুষ্কৃত ভোগ করে— কথা মিথ্যা নহে। কিন্তু সে একাকী হইলেও, অগণ্য জীবের কর্ম্মফলের বোঝা মাথায় লইয়া জন্মিয়া থাকে। এই তো তার মহত্ব, একাকী জন্মিয়া সে বহুজীবের, বহুযুগের সঞ্চিত কর্ম্ম ক্ষয় করিতে প্রবৃত্ত হয়। খৃষ্টীয়ানেরা বলেন, বিশ্বপিতা পরমেশ্বর পাপী জগতের পরিত্রাণের জন্য, আপনার একমাত্র পুত্রকে বলিদান করিয়াছেন। অজ্ঞলোকে ভাবে, জগতের ইতিহাসে, দুই হাজার বৎসর পূর্ব্বে, জুদিয়াভূমে, ক্যালাভেরী ক্ষেত্রে, এক বার মাত্র এই পবিত্র প্রায়শ্চিত্তের এই মহান পুরুষ-ষজ্ঞের অনুষ্ঠান হইয়াছিল। কিন্তু ভক্ত জ্ঞানীরা জানেন যে এ প্রায়শ্চিত্ত, কেবল একবার মাত্র হয় নাই। জগতের আদি হইতে, পুরুষ পরম্পরায় এই পবিত্র প্রায়শ্চিত্ত, এই মহান পুরুষ-যজ্ঞ সকল দেশে সকল সমাজে নিয়ত অনুষ্ঠিত হইয়া আসিতেছে। প্রত্যেক জীবের জীবন আবরণ, এই মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে। প্রত্যেক প্রাণী সমুদায় বিশ্বের কর্ম্মফল ভোগ করিতে জন্মগ্রহণ করিয়া, এই প্রায়শ্চিত্তের সাধন করে। প্রাণী মাত্রেই, জগতের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিবার জন্য, এ সংসারে জন্ম লইয়া থাকে। কারো ভগ্যে এ কার্য্যসমাধা হয়, কারো ভাগ্যে বা হয় না, কিন্তু সকলেই এই মহাযজ্ঞের স্বধা রূপে বিশাল বিশ্বের নিথিল কর্ম্মকুণ্ডে, বিশ্বপিতা বিধাতাপুরুষ কর্তৃক, আহুতি প্রদত্ত হইতেছে। কবে কোন্‌ ঐতিহাসিক যুগে, কোন্ অজ্ঞাত কারণে, মাতা বসুন্ধরা একবার বিক্ষুব্ধ হইয়া, কোথায় কি বিষরাশি উদিগরণ করিয়া ছিলেন, তারই জন্য পৃথিবীর সে সকল ভূভাগ আজি পর্য্যন্ত বিষধর বীজানুপুঞ্জে পরিপূর্ণ হইয়া আছে। এই সকল ভূভাগে যেই জন্মা’ক না কেন, সেই যে বসুধার এই প্রাচীনকৃত কর্ম্মবোঝ মাথায় লইয়া আসে, এবং আমরণ এই প্রাণনাশী জীবানুঞ্জের সঙ্গে যুঝিয়া সেই প্রাচীন পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত করে,—ইহা কি সত্য নহে? কেন যে মাঝে মাঝে সূর্য্য দেহে স্ফোটক প্রকাশিত হয়, পণ্ডিতেরা এখনো ইহার তত্ত্ব আবিষ্কার করিতে সমর্থ হন নাই; কিন্তু এই সকল সৌর স্ফোটক বা sunspot এ পৃথিবীর আবহাওয়ার যে বৈলক্ষণ্য ঘটিয়া থাকে একথা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। এই সৌরস্ফোটক নিবন্ধন বায়ুমণ্ডলের স্বভাব বিপর্য্যয় যখন ঘটে, তখন যে প্রাণীই সে বায়ুমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করুক না কেন, সবিতার এই কর্ম্মফলের বোঝা সল্পবিস্তর পরিমাণে তাহাকে বহিতেই হয়। মাটির দোষগুণ যে কেবল উদ্ভিদেই ফুটিয়া উঠে, তাহা নহে;—প্রাণীকেও পূর্ণমাত্রায় তাহার ভাগী হইতে হয়। জলের দোষগুণ, বায়ুর দোষগুণ,রূপঞ্চমহাভূতের সমুদায় সুকৃত দুস্কৃতের ভার এ জগতে স্বল্পবিস্তর পরিমাণে, আপন আপন প্রকৃতি প্রত্যেক জীবকেই বহন করিতে হইতেছে। আর পুর্ব্বপুরুষের দোষগুণের ভার যে সকল মানুষকেই বহিতে হয়, এ তো প্রত্যক্ষ কথা। পিতার কর্ম্মবোঝা মাথায় লইয়া পুত্র জন্মগ্রহণ করে। একরতি শিশুও তার সামান্য ইচ্ছার ব্যাঘাত জন্মিলে, যে ক্রোধাবেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া, বিকারগ্রস্ত রোগীর ন্যায়, দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া আপনার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিক্ষেপে প্রাণহানির আশঙ্কা পর্যন্ত জাগাইয়া তোলে,—এ কি কেবল তার নিজের কর্ম্মের ফলে, না,—পিতার ক্রোধ, মাতার অপস্মার, পিতামহের পারষ্য, মাতামহের মাৎসর্য্য, এইরূপ পুরুষপরম্পরাগত সঞ্চিত কর্ম্মের পরিণাম? জীব একাকী জন্মগ্রহণ করে, একথা সত্য, কিন্তু সে কেবল আপনার কর্ম্মবোঝা মাথায় লইয়া কর্ম্মটুকু মাত্র ক্ষয় করিতে এ সংসারে আসে, ইহা সত্য নহে। এই বাংলা দেশে জন্মিয়া, এই মাটীর দোষগুণের বোঝা কি সকল বাঙ্গালীকে বহিতে হইতেছে না? মাটীর গুণে, জলের গুণে, হাওয়ার গুণে, বঙ্গবাসী বাঙ্গালী হইয়াছে, শিখ শিখ হইয়াছে, রাজপুত রাজপুত হইয়াছে, গুজ্‌রাটী গুজ্‌রাটী হইয়াছে, মারাঠা মারাঠা হইয়াছে,—তামিল, তৈলঙ্গী সকলেই আপনার দেহে আপন আপন মাটীর দোষগুণের বোঝা বহিতেছে; কেহ বা দীর্ঘাকৃতি কেহ বা খর্ব্বকায়, কেহ বা বলিষ্ঠ কেহ বা দুর্ব্বল, কেহ বা কর্ম্মঠ কেহ বা অকর্মণ্য হইয়াছে,—ইহা কি সত্য নহে? মানুষ কেবল নিজের সুকৃত দুষ্কৃত বোঝা লাইয়াই এ সংসারে জন্মগ্রহণ করে, এই যদি সত্য হয়, তবে সংসারের সকল সম্বন্ধই শিথিল ও গ্রন্থিহীন হইয়া পড়ে। একের সঙ্গে অপরের সুখদুঃখের ও পাপপুণ্যের এই যে বিপুল, এই যে জটিল বন্ধন, তাহা নিতান্তই কাল্পনিক, মায়িক, অলীক হইয়া দাঁড়ায়। তবে এ জগতে কে আর কার অপেক্ষা রাখে? কে কার জন্য দায়ী হয়? পিতা পুত্রের জন্য, পুত্র পিতার জন্য, পতি পত্নীর জন্য, পত্নী পতির জন্য, প্রভু ভৃত্যের জন্য, ভৃত্য প্রভুর জন্য, রাজার প্রজার জন্য, প্রজা রাজার জন্য, বন্ধু বন্ধুর জন্য, কারো জন্য কাহারো আর কোনো দায়িত্ব থাকে না।

{{block center|

তুমি কার, কে তোমার, কারে বলরে আপন,
মোহমায়া নিদ্রাবশে, দেখিছ স্বপন,—

 ইহাই সংসারের সকল তত্ত্বের সারতত্ত্ব হইয়া দাঁড়ায়। স্নেহের, প্রীতির, প্রেমের, ভক্তির, দয়ার, দাক্ষিণ্যের, এ সকলের কিছুরই আর কোনো সত্য ও সারবত্তা থাকে না। এই যে পরম্পরাপেক্ষীভাব, ইহা হইতে স্নেহ, প্রেম, ভক্তি, দয়া, দাক্ষিণ্য কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য, ধর্ম্মাধর্ম্ম, সকলের উৎপত্তি। জীব কেবল আপনারই কর্ম্মফল ভোগ করিতে সংসারে আসে, কেবল আপনিই আপনার করে ভালমন্দ দ্বারা আবদ্ধ হয়, এ যদি সত্যই সত্য হয়, —তবে এ সকলের আর কোনো আশ্রয় রহিল কি? দশের কল্যাণের সঙ্গে একের কল্যাণ জড়িত, দশের ভালমন্দের উপরে একের ভালমন্দ প্রতিষ্ঠিত, দশের সুখের ভিতর দিয়া একের সুখ, দশের তৃপ্তির ভিতর দিয়া একের তৃপ্তি, দশের উন্নতির মধ্য দিয়া একের উন্নতির পন্থা,—এই যে সমাজস্থিতি হেতু, এই যে লোকধর্ম্ম —এ সকলের আর কোন প্রতিষ্ঠা থাকে কই? ফলতঃ জীব একাকী জন্মগ্রহণ করে, এ কথা সত্য; কিন্তু বহু লোকের বহু যুগের সঞ্চিত কর্ম্মের বোঝা মাথায় লইয়া সে জন্মায়, আর জন্মিয়া এই নিখিল বিশ্বের বিশাল কর্ম্মজালেতে সে আবদ্ধ হয়, এও অতি সত্য। যে কর্ম্মবোঝা লইয়া সে সংসারে আসে,তাহা এখানে আপনার স্বজাতীয় সমুদায় কর্ম্মকে টানিয়া আনে। পাপ পাপকে টানিয়া লয়, পুণ্য পুণ্যকে টানিয়া আনে। এইরূপে পরস্পরের সুকৃত দুষ্কৃতের বোঝা নিয়ত বাড়িয়া যায়। লৌহচূর্ণ মিশ্রিত গন্ধক চূর্ণের মধ্যে একখণ্ড চুম্বক ফেলিয়া দিলে যেমন আশে পাশের সমুদায় বিচ্ছিন্ন লৌহকণা তার গায়ে আসিয়া। আপনি লাগিয়া যায়, সেইরূপ প্রত্যেক প্রাণীর নিজের সুকৃত দুষ্কৃত, চতুপার্শ্বস্থ জড় ও জীব সকলের পূর্ব্বসঞ্চিত ও অধুনাকৃত,সুকৃত দুষ্কৃতকে আপনার মধ্যে আনিয়া ফেলে। “তুমি কার কে তোমার” বলিয়া এ অপরিহার্য নিয়তি পরিহার করা যায় না। কেউ আমার, আমি কারো হই বা না হই,— আমার পাপ পুণ্যের ভাগী তারা, তাদের সুকৃত দুষ্কৃতের ফলভোগী আমি। এ সম্বন্ধ সত্য। এ সম্বন্ধ নিত্য। মায়িক বলিয়া, চক্ষু বুজিয়া, ইহাকে অগ্রাহ্য করিলে চলিবে কেন?

 ফলতঃ ইহা মায়িকও নহে। তোমাকে আমা হইতে, আমাকে তোমা হইতে, যে পৃথক, অসম্বদ্ধ বলিয়া ভাবি—এই যে আমি আমি তুমি তুমি করি, এই যে দুনিয়ার সুখ দুঃখের ভাগ বাটোয়ারা করিয়া আপনারটি আপনি গুছাইয়া লইতে চাই, ইহাই মায়ার খেলা। এই বিচ্ছিন্ন জ্ঞানই মায়িক। কিন্তু তুমি আমি যে মূলে, এক একই প্রাণসাগরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গভঙ্গ, একই জ্ঞানসূর্য্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিরণ খণ্ড-—একই অনাদ্যনন্ত নিত্যপ্রদীপ্ত পাবকরাশির সামান্য ফুলিঙ্গমাত্র— ইহাই সত্য।

তদেতত্‌ সত্যম্‌—

যথা সুদীপ্তাত্‌ পাবকাদ্বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবস্তে স্বরূপাঃ।
তথাঞ্চরাত্‌ বিবিধাঃ সৌম্য ভাবাঃ প্রজায়ন্তে তত্র চৈবাপিযস্তি॥

 ইহাই সত্য হে সৌম্য! যে যেমন প্রজ্জলিত অগ্নি হইতে অগ্নিরূপ সহজ সহজ স্ফুলিঙ্গ প্রসূত হয়, সেইরূপ অক্ষয়। পুরুষ হইতে বিবিধ প্রাণীসকল জন্মগ্রহণ করিয়া, পুনরায় তাঁহাতেই প্রত্যাবৃত্ত হয়। এই একেতে সকলে প্রতিষ্ঠিত বলিয়া, এই একে, সূত্রে মণিগণা ইব- সূত্রে যেমন হারের মণি সকল গাঁথা থাকে, তেমনি সকলে গাঁথা বলিয়া, জড়ে ও জীবে এই বিচিত্র সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়। যে প্রাণ আমাতে, সেই প্রাণ তোমাতেও, তাই তোমাকে আমি বুঝি। যে জ্ঞান আমার বুদ্ধিকে উন্মুক্ত করিতেছে, তাহাই তোমার বুদ্ধিকেও প্রকাশ করিতেছে বলিয়া তোমাকে আমি জানি, আমাকে তুমি জান। একই প্রেম, একই স্নেহ, একই দয়া, একই দাক্ষিণ্য,—সমুদায় বিশ্বকে আচ্ছন্ন করিয়া আছে বলিয়া, আমার ও তোমার ও এই বিশাল জনসমাজের স্নেহ-প্রেম দয়া-দাক্ষিণ্যের সম্বন্ধসকল প্রতিষ্ঠিত ও প্রকাশিত হইতেছে। সেই মহান্ একে, সেই পরমতত্ত্বে, সেই নিখিলরসামৃতমূর্ত্তি ভগবানে, সংসারের বিচিত্র সম্বন্ধসকল প্রতিষ্ঠিত। তাঁহা হইতে যখন এগুলিকে পৃথক্‌ করিয়া দেখি, তখনই এসকল মায়িক হইয়া দাঁড়ায়, এসকলের কোনো সত্য ও সারবত্তা আর থাকে না। তখন সত্যি সত্যি,—

তুমি কার, কে তোমার, কারে বলরে আপন,
মিছে মায়া নিদ্রাবশে, দেখিছ স্বপন—

 ইহাই সত্য হইয়া দাঁড়ায়। কিন্তু আমাকে ও আমার যাঁরা তাঁদের সকলকে যখন ভগবানের মধ্যে দেখি,—

এক ভানু অযুত কিরণে,
উজলে যেমতি সকল ভুবনে,
(তেমতি) তাঁর  প্রীতি হইয়ে শতধা—বিরচয়ে সতীর প্রেম,
জননী-হৃদয়ে করে বসতি—

 এই যখন প্রত্যয় করি,—তখন এই মায়াবরণ সরিয়া গিয়া, সংসারের সকল সম্বন্ধ, সকল সুখ, সকল দুঃখ, সকল ভেদাভেদ, সকল ধর্ম্মাধর্ম্ম, সকল কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্যকে সত্য করিয়া তোলে। তখন আর “তুমি কার কে তোমার, কারে বলরে আপন,”—এই বলিয়া এই স্নেহ-প্রেম দয়া-দাক্ষিণ্যের, এই ধর্ম্মকর্ম্মের গুরুতর দায়িত্ব ও কঠিন ঋণজাল এড়াইতে পারি না। তখন দেখি—

“আমি সবাকার, সবাই আমার,
বিশ্ব আমার আপন।

জগতের সুখ, জগতের আশা, যত ভালবাসা,—
সকলের ভাগী এ অধম জন।”

 তখনই মিছে মায়া নিদ্রাবেশ কাটিয়া গিয়া,—দিব্য দৃষ্টি লাভ করিয়া, ভারতযুদ্ধক্ষেত্রে অর্জ্জুনের মত, ভগবদ্দেহে নিখিল বিশ্বের অনন্ত সম্বন্ধসকলকে যুগপৎ একস্থ ও পৃথকীভূত প্রত্যক্ষ করিয়া কৃতার্থ হই।

দ্বিতীয় অধ্যায়

 এই ক্ষুদ্র প্রাণ ভগবদ্দেহে, ভাগবতী লীলার অঙ্গরূপে, এই বিশাল কর্ম্মজালে আবদ্ধ হইয়া, পৃথিবীতে আসিয়া উপস্থিত হয়। তাই বলি, এই এক রত্তি মানুষ, এই এক মুঠো রক্তমাংস, সামান্য বস্তু নহে। ব্রহ্মাণ্ডের অনাদিসঞ্চিত সমুদায় কর্ম্মের বোঝা মাথায় করিয়া, এই ক্ষুদ্র প্রাণ, এই সূতিকাগারে আসিয়া ভাসিয়া উঠিয়াছে। ক্ষিত্যপতেজমরুৎব্যোম—এই পঞ্চমহাভূতের যা কিছু দোষগুণ, তাহা সমুদায় ইহার এই সকল ক্ষুদ্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে অভিনব আশ্রয় পাইয়াছে। এই পঞ্চ মহাভূতের গত কর্ম্মের বোঝা বহিবার জন্য এই শিশু এই ভৌতিক জগতে আসিয়া জন্মিয়াছে। যুগযুগান্ত সঞ্চিত এই ভৌতিক ঋণ সে শোধ দিতে এই মহাসংকল্প লইয়া জন্মিয়াছে—শোধ দিবে, না হয় এই ভৌতিক ঋণের শরশয্যাতেই তনুত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবে, এই ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা লইয়া এই প্রাণ এই ভৌতিক দেহ ধারণ করিয়াছে। তাই আমরণ এই সকল মহাভূত অহর্নিশ, অবিশ্রান্তভাবে, তার এই ভৌতিক দেহের সেবাতে নিযুক্ত রহে। আপনাদের অনাদিকত কর্ম্মবন্ধন এই ক্ষুদ্র প্রাণী আত্মবলিদানে নষ্ট করিবে, আপনাদিগের অনাদিকৃত পুণ্যফল এ পুষ্ট করিবে,—এই আশায় উৎফুল্ল হইয়া, এই সকল মহাভূত নবজাত ক্ষুদ্র প্রাণীর মুখপানে সতৃষ্ণ হইয়া চাহিয়া থাকে। অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য—ভূদেবতা, অন্তরীক্ষ দেবতা, আকাশ দেবতাগণ,— সকলে আপন আপন কর্ম্মফল ক্ষয়ের প্রত্যাশায়, আপন আপন অমরজীবনের সার্থকতালাভের লোভে, এই মরপ্রাণীর দিকে অনিমেষ নয়নে চাহিয়া থাকেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে পালন করে যারা, এই ক্ষুদ্র প্রাণের সম্মুখে ভিখারীর মত দাঁড়াইয়া থাকে তারা। দেবপিতৃলোকেরা ব্রাহ্মণ্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া, এক হাত তুলিয়া এই ক্ষুদ্র প্রাণকে আশীর্ব্বাদ করেন, আর অপর হাত পাতিয়া ইহার নিকটে আপন ঈপ্সিত যাচ্‌ঞা করেন। দেবতারা যজ্ঞাহুতি লোভে, ঋষিরা জ্ঞানবিজ্ঞানের লোভে, পিতৃগণ কুলস্থিতিপ্রার্থী হইয়া, ভিখারীবেশে এই ক্ষুদ্র প্রাণের শয্যাপার্শ্বে আসিয়া উপস্থিত হন। ইঁহারা সকলে আপন আপন জীবনের সফলতা কামনা করিয়া, এই ক্ষুদ্র প্রাণের বন্দনা করেন:—

 এষোঽগ্নিস্তপত্যেষ, সূর্য্যএষ, পর্জন্যো মঘবনেষ, বায়ুরেষ, পৃথিবী রয়িদৈবঃ সদসচ্চামৃতঞ্চ যত্।

অরা ইব রথনাভৌ প্রাণে সর্ব্বং প্রতিষ্ঠিতম্।
ঋচো যজুংষি সামানি যজ্ঞঃ ক্ষত্রং ব্রহ্ম চ॥
প্রজাপতিশ্চরসি গর্ভে ত্বমেব প্রতিজায়সে।
তুভ্যং প্রাণ প্রজাস্ত্রিমা বলিং হরন্তি যঃ প্রাণৈ প্রতিতিষ্ঠসি
দেবানামপি বহ্নিতমঃ পিতৃণাং প্রথমা স্বধা।
ঋষীণাঞ্চরিতং সত্যমথর্ব্বাঙ্গিরসামসি॥
ইন্দ্রস্তুং, প্রাণ, তেজসা, রুদ্রোঽসি পরিরক্ষিতা।
ত্বমন্তরীক্ষে চরসি, সূর্য্যত্ত্বং জ্যোতিষাস্পতিঃ॥
ব্রাত্যস্ত্বং প্রাণৈকঋষিরত্তা বিশ্বস্য সৎপতিঃ।
বয়মাদ্যস্ব দাতারঃ পিতা ত্বং মাতরিশ্বনঃ॥
যা তে তনু বাচি প্রতিষ্ঠিতা, যা শ্রোত্রে, যা চক্ষুষি।

যা চ মনসি সন্ততা শিবাং তাং কুরু, মোত্‌ক্রমীঃ॥
প্রাণস্যেদং বশে সর্ব্বং ত্রিদিবে যত্ প্রতিষ্ঠিতম্।
মাতেব পুত্রোন রক্ষস্ব, শ্রীশ্চ প্রজ্ঞাঞ্চ বিদেহিন—ইতি।

 এই প্রাণই অগ্নির মত প্রদীপ্ত হন, ইনিই সূর্য্য, ইনিই পর্জ্জন্য, মঘবন, ইনিই বায়ু, ইনিই পৃথিবী, ইনিই এই বিশ্বের উপাদান—রয়ি, এই প্রাণদেবতাই স্থূল ও সূক্ষ্ম, নিত্য ও অনিত্য যাহা কিছু তৎসমুদায়।

 অরাসকল যেমন রথচক্রে সংযুক্ত থাকে, সেইরূপ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রাণেতে সংযুক্ত রহিয়াছে। ঋগ্বেদ, যজুর্ব্বেদ, সামবেদ, যজ্ঞ, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ—এ সকল এই প্রাণেতে প্রতিষ্ঠিত, এই প্রাণাপেক্ষী হইয়া আছেন।

 হে প্রাণ, তুমি প্রজাপতি; তুমিই গর্ভে বিচরণ কর, তুমিই গর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হও। হে প্রাণ, তুমি এই ইন্দ্রিয়গ্রামের আশ্রয় হইয়া আছ। তোমারই জন্য তোমার এই সকল প্রজা নিয়ত বলি আহরণ করে।

 হে প্রাণ, তুমিই দেবতাদিগের শ্রেষ্ঠ অগ্নি, পিতৃগণের প্রথম সর্ব্বোত্তম স্বধা, ঋষিদিগের আচরিত সত্য তুমি, অঙ্গিরসদিগের আদিগুরু অথর্ব্ব তুমি।

 হে প্রাণ, বীর্য্যে তুমি ইন্দ্র, রক্ষণে তুমি রুদ্র, তুমি অন্তরীক্ষে বিচরণ কর, তুমিই জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর পতি সূর্য্য।

 হে প্রাণ, তুমি স্বয়ং শুদ্ধ—তোমার শুদ্ধির আবশ্যক হয় না। তুমি একর্ষি অগ্নি। তুমি বিশ্বের ভোক্তা, সৎপতি। তুমি মাতরিশ্বের জনক, আমরা সকলে তোমার ভোজ্য বাহক।

 হে প্রাণ, তোমার যে স্বরূপ বাগিন্দ্রিয়ে প্রতিষ্ঠিত, যাহা শ্রোত্রে, যাহা চক্ষুতে প্রতিষ্ঠিত;— তোমার যে স্বরূপ মনোমধ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া আছে,—তাহাকে তুমি কল্যাণপ্রদ কর। হে প্রাণ, তুমি উৎক্রমণ করিও না।

 হে প্রাণ, এই ত্রিদিবে যাহা কিছু আছে, তৎসমুদায় তোমারই বশীভূত। মাতা যেমন পুত্রদিগকে রক্ষা করেন, সেইরূপ তুমি আমাদিগকে রক্ষা কর। আমাদিগকে শ্রী ও প্রজ্ঞা প্রদান কর।

 দেবপিতৃলোকে পূজ্য এই প্রাণ,—ইহাকে যদি ভালবাসি, তাহা তো গৌরবের কথা, তার জন্য লজ্জিত হইব কেন? দুঃখ এই—তাকে ভাল করিয়া ভালবাসিতে পারিলাম না। দুঃখ এই—অনন্তকাল এই প্রাণের সঙ্গে একাত্ম হইয়া এ সংসারে বসবাস করিলাম, কিন্তু মোহবশতঃ, প্রমাদালস্য নিদ্রাভিভূত হইয়া, ইহার প্রকৃত তত্ত্ব ও যথার্থ মর্য্যাদা বুঝিলাম না। এই প্রাণদেবতাকে ভাল করিয়া এখনো চিনিলাম না, ইহাকে ভাল করিয়া এখনো দেখিলাম না,—ইহাই তো এ জনমের সকল দুঃখের চাইতে বেশী দুঃখ। প্রাণের সঙ্গে, প্রাণের মধ্যে, প্রাণের কৃপাতে এ সংসারে এ দীর্ঘ জীবন কাটাইলাম, তবু ইহার পরিচয় পাইলাম না, ইহার গৌরব বুঝিলাম না, এই তো জন্মের সকল ক্ষোভের চাইতে বেশী ক্ষোভ। মাছ যেমন জলে জন্মে, জলে থাকে, জলেতেই জীবনের আনন্দ সফলতা লাভ করে, অথচ জল কি তাহা জানে না; পাখী যেমন আকাশে থাকে, আকাশে উড়ে, আকাশেই তার জীবন ও জীবনের অশেষ আনন্দ সম্ভোগ করে, অথচ এই কিরণ-বরণ-শব্দ-গন্ধ পূরিত বায়ুমণ্ডল কি বস্তু তাহা আদৌ জানে না, বুঝে না;—তেমনি আজন্মকাল এই প্রাণের মধ্যে, এই প্রাণের সঙ্গে, এই প্রাণকে লইয়া এ সংসারে বাস করিলাম, ইহারই দৌলতে, এই সকল সুখসাধক ইন্দ্রিয়ের সহায়ে, ক্ষুদ্র হইয়াও এই বিশাল কাম্য বস্তু-পূর্ণ বিষয়-রাজ্য, রাজার মত ভোগ করিলাম, অথচ এই প্রাণকে জানিলাম না, ইহার মর্য্যাদা বুঝিলাম না, ইহার আদর করিলাম না, একবার ইহার প্রতি ভাল করিয়া চাহিলাম না। এইতো দুঃখ। এখন দিন ফুরাইয়া আসিল, সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল, শরীর দুর্ব্বল, ইন্দ্রিয় বিকল হইয়া আসিল, এখন যদিই বা এই প্রাণের প্রতি একটু মমতা জন্মে, তাহাতে বিস্ময়ের, লজ্জার, দুঃখের, বা অপরাধের কথা কি?

 ফলতঃ এ প্রাণকে কখনো, সত্যভাবে ভালবাসি নাই। যে যাকে ভালবাসে সে তার শ্রীবৃদ্ধিকামনা করে। যে যাকে ভালবাসে সে তার সেবা করে। এ জনমে প্রাণের শ্রীবৃদ্ধি চাহিলাম কৈ? প্রাণের সেবা করিলাম কৈ? এই প্রাণাশ্রিত ইন্দ্রিয়কুলের সেবা করিয়াছি, এদের মুখ চাহিয়া আজন্ম চলিয়াছি, এদের সুখ দিতে দিতে নিঃস্ব হ‍ইয়া পড়িয়াছি, কিন্তু প্রাণের আরাধনা করিলাম কই? প্রাণের মর্য্যাদা যদি জানিতাম, প্রাণকে যদি সত্য সত্য ভালবাসিতাম, তবে এই সকল বিষয়, ও এই সকল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রাণেরই সেবা করিতাম, প্রাণের দ্বারা এদের সেবা করিতে যাইয়া আজ প্রাণান্ত হইয়া পড়িতাম না। খাদ্যাখাদ্য নির্ব্বাচনে রসনার তুষ্টি কিসে হয়, তাই দেখিতেছি, প্রাণের পুষ্টি কিসে হবে, তা ভাবি কৈ? এইরূপ চোখে কি দেখায় ভাল তাই দেখি, কানে কি শোনায় ভাল তাই শুনি, স্পর্শে কি লাগে মিষ্টি তাই ছুঁই, কোন্ দৃশ্যে, কোন্ শব্দে, কোন্ স্পর্শে, যে প্রাণ হৃষ্ট ও পুষ্ট হইবে, সে বিচার করি কৈ?

 আদিপুরুষ যেমন প্রজাকামনায় আপনি বহু হইয়াছেন, সেইরূপ প্রাণকে সত্য সত্য যে ভালবাসে, সে প্রাণকে বহু করিতে চাহে, এবং সে সংসার-ব্রত গ্রহণ করে। বহুস্যাং প্রজায়েঽতি; আমি এতদ্বারা প্রজোৎপাদন করিয়া বহু হইব, এই পবিত্র কামনা লইয়া প্রাণের জন্য প্রাণের প্রয়োজনে যাহারা গৃহী হয়, তারা প্রজা কামনায় সংসার করে, ইন্দ্রিয় ভোগের লালসায় নহে। ফলতঃ প্রাণের মর্যাদা যে জানে, সে এইরূপেই প্রাণের মর্যাদা রক্ষা করে। তোমরা ইহাতে সম্ভ্রম নষ্ট হইল বলিয়া ভ্রুকুঞ্চিত করিও না, আমি নিঃসঙ্কোচে বলিতেছি, প্রাণের মর্য্যাদা যে জানে, কামের মর্য্যাদা সে বোঝে। সে স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধের মাহাত্ম্য ও দেবত্ব প্রত্যক্ষ করিয়া সর্ব্বদা বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হয়। শ্রুতি কহেন—

 পুরুষে ঽ বা অয়মাদিতো গর্ভো ভবতি। যদেতদ্রেতস্তদেতৎ সর্ব্বেভ্যোঽঙ্গেভ্যস্তেজঃ সম্ভুতমাত্মন্যেবাত্মানং বিভর্ত্তি তদ যদা স্ত্রিয়াং সিঞ্চত্যখৈনজ্জনয়তি তদস্য প্রথমং জন্ম।

 তৎস্ত্রিয়া আত্মভূয়ং গচ্ছতি যথা স্বমঙ্গং তথা। তস্মাদেনাং ন হিনস্তি সাস্যৈমাত্মানমত্র গতং ভাবয়তি।

 সা ভাবয়িত্রী ভাবয়িতব্যা ভবতি তং স্ত্রী-গর্ভং বিভর্ত্তি সোঽস্রএব কুমারং জন্মনোঽস্রেঽধিভাবয়তি। স য‍ কুমারং জন্মনেঽস্রেঽ ধিভাবয়ত্যাত্মানমেব তদ্ভাবয়ত্যেষাং লোকানাং সন্তত্যা এবং সন্ততা হীমে লোকাস্তদস্য দ্বিতীয়ং জন্ম।

 সোঽস্যায়মাত্মা পুণ্যেভ্যঃ কর্ম্মেভ্যঃ প্রতিধীয়তে।—ঐতরেয়োপনিষৎ। এই আত্মা (বা পরমাত্মা) প্রথম হইতেই বীজরূপে পুরুষের মধ্যে বাস করেন। এই বীজই তাহার সকল অঙ্গের তেজ বা সারভাগ, এই বীজকে ধারণ করিয়া সে আপনার শরীরে সেই আত্মাকেই ধারণ করে। এই বীজ যখন স্ত্রীতে সঞ্চিত হয়, তখনই এই আত্মার প্রথম জন্ম হয়।

 এই আত্মা তখন স্ত্রীর নিজের অঙ্গের ন্যায় তাঁহার আত্মভূত হইয়া যায়। সেই স্ত্রী তখন সেই আত্মাই আমার মধ্যে বাস করিতেছেন, ভাবিয়া ইহাকে পোষণ করেন।

 তখন স্ত্রী পোষণযোগ্যা হন। স্ত্রী এই বীজকে গর্ভে ধারণ করেন। এই সন্তানের জন্মের পূর্ব্বে ও অব্যবহিত পরে পিতা ইহার সেবা করিয়া থাকেন। গর্ভস্থ শিশুর পরিচর্য্যা করিয়া পিতা আপনার আত্মারই পরিচর্য্যা করেন। এইরূপে সংসারে স্থিতি রক্ষা পায়, সংসারস্থিতি রক্ষার্থে পিতা গর্ভস্থ শিশুর সেবা করেন। ইহাই আত্মার দ্বিতীয় জন্ম।

 এই কুমার সর্ব্বপ্রকার পুণ্যকর্ম্ম সাধনে পিতার প্রতিনিধি হইয়া সংসার ধর্ম্ম রক্ষা করে।

 প্রাণকে সত্য সত্য যে ভালবাসে সে ঋষি না হইয়াও এই প্রাচীন মন্ত্রের সাক্ষাৎকার লাভ করে। তাহার নিকটে এই সকল তত্ত্ব আপনি ফুটিয়া উঠে। পত্নী পতির প্রাণকে বহু করেন, তারই জন্য তাঁহারা পরস্পরের এত প্রিয়। পঙ্কে যেমন দেবভোগ্য পবিত্র পঙ্কজের উৎপত্তি, সেইরূপ পতিপত্নীর ইন্দ্রিয়বিকার হইতেই বিশ্বপূজ্য এই প্রাণের প্রকাশ হয়। কাম বলিয়া এই ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ ও সম্ভোগকে ঘৃণা করিতে পারি না। ইহাকে যদি কাম বলিতে হয় বল, ক্ষতি নাই। পূর্ব্বতন ঋষিগণ নিঃসঙ্কোচে ইহাকে কাম বলিয়াই বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু একথা ভুলিও না যে এ সেই কাম, যে কাম হইতে বিশাল বিশ্বের সৃষ্টি হইয়াছে। যে কামনায় স্রষ্টা, সৃষ্টিতপস্যায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন—সোঽকাময়ত বহুস্যাং প্রজায়েঽতি,—স তপস্তপ্যত, স তপস্তপ্যত সর্ব্বমিদমসৃজত যদিদং কিঞ্চ,—এ সেই কাম। যে কামাগ্নি প্রথম পুরুষযজ্ঞে আহুত হইয়াছিল, যাহা হইতে ঋক্, যজু, সাম—সকল জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎপত্তি, যাহা হইতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্র, বিশ্—সকল সমাজশৃঙ্খলার সৃষ্টি, যাহা হইতে সকল যজ্ঞের, সকল ধর্ম্মের, সকল কর্ম্মের সূচনা এ সেই কামাগ্নি। ইহাই সৃষ্টির আদি, তাই ইহাকে আদিরস কহে। ইহা হইতেই সকল লাবণ্যের, সকল কারুণ্যের, সকল সৌন্দর্য্যের, সকল মাধুর্য্যের, সকল শৌর্য্যের ও সকল বীর্য্যের বিগ্রহরূপী কামদেবতা কন্দর্পের জন্ম। প্রজা সৃষ্টিব্যাপারে ইহাই ভগবানের চিদানন্দবিভূতি—প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ—হে অর্জ্জুন, প্রজাসৃষ্টি হেতু আমিই কন্দর্প। প্রজনঃ প্রজোৎপত্তিহেতুঃ কন্দর্পঃ কামোঽস্মি, ন কেবলং সম্ভোগমাত্রপ্রধানঃ কামো মদ্বিভূতিরশাস্ত্রীয়ত্বাৎ—সম্ভোগমাত্র প্রধান ষে কাম, তাহাই নিকৃষ্ট, তাহাই হীন ও হেয়, তাহা ভগদ্বিভূতি মধ্যে পরিগণিত হয় না। কিন্তু প্রজোৎপত্তি হেতু যে কাম তাহাই ভাগবতী লীলার অঙ্গ, তাহাই ভগবদ্বিভূতি।—এ সেই কাম। বেদ‍ ‌ নিঃসঙ্কোচে ইহারই কথা বলেন। বেদান্ত পবিত্র দৃষ্টিতে ইহাকেই ব্রহ্মানন্দের মাপকাঠি করিতেও শঙ্কা বোধ করেন না। পুরাণ এই কামকেই দেবতা বলিয়া পূজা করিয়া থাকেন। এই কামদেবতাই সৃষ্টির মেরুদণ্ড স্বরূপ, ইনিই জগতে প্রাণী-প্রবাহ রক্ষা করিয়া আসিতেছেন। ইঁহারই সাহচর্য্যে প্রাণ আপনার পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। যে প্রাণের মর্য্যাদা বোঝে, সে এই পবিত্র কামেরও মর্য্যাদা জানে।

 প্রাণের মর্য্যাদা জানি না বলিয়া, এই কামেরও মর্য্যাদা ও শুদ্ধতা বুঝি না। তাই কামের নামে, মিথ্যা লজ্জাভাবে, কাণে হাত দেই। তাই “প্রজায়ৈঃ গৃহমেদিনঃ”—প্রাচীনেরা প্রজার জন্য সংসারী হইতেন, এ কথা পড়িয়া ঘৃণায় ভ্রুকুঞ্চিত করি। তাই—“পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্য্যা”—পূর্ব্বপুরুষদিগের এই আদর্শকে হীন বলিয়া উপেক্ষা করি। মনে ভাবি, আমরাই বুঝি দাম্পত্যসম্বন্ধের উন্নত আদর্শ ও প্রেমের বিশুদ্ধ স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়াছি। যে প্রেম রমণীয়তাকেই রমণীর শ্রেষ্ঠ, ও সত্য স্বরূপ বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিতে যায়, তাহার কামোপভোগ প্রবৃত্তি কি সাংঘাতিক ইহা একবারও তাকাইয়া দেখি না। রমণীর জন্যই পুরুষকে ও পুরুষের জন্যই রমণীকে প্রতিষ্ঠিত করিতে যাইয়া,—পবিত্র দাম্পত্যসম্বন্ধকে অতি লঘু, অতি হীন করিয়া তুলিয়াছি, ইহা বুঝিবার শক্তি পর্য্যন্ত যাদের নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তারা প্রাণের মর্য্যাদা বোঝে না। ইহা আর বিচিত্র কি? কামকে লোকে পশুবৃত্তি বলে; কিন্তু এই সম্ভোগমাত্র-প্রধান প্রেম যে পশুবৃত্তি অপেক্ষাও অধম ইহা ভাবে না। পশুপক্ষীর মধ্যেও এ সম্বন্ধ এতটা কামোপভোগ-প্রধান নহে। এই বিশাল বিশ্বের অপর সর্ব্বত্র এই বিচিত্র কামলীলার মধ্যে নির্ব্বাহ স্বরূপে প্রজোৎপত্তির চেষ্টাই প্রত্যক্ষ করি, সভ্যতাভিমানী মানুষেই কেবল ইহার ব্যতিক্রম দেখিতে পাই। এখানেই কেবল দেখি, জীব কেবলমাত্র ভোগের জন্য রূপের অনুশীলন করে। কেবল আমোদের তৃপ্তি হেতুই, কেহ বা সমাজবিধির আবরণের মধ্যে থাকিয়া, কেহ বা এই সূক্ষ্ম আররণকেও তুচ্ছ করিয়া,—স্ত্রীপুরুষ সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়। বিশ্বের আর কোথাও কামদেবতার এমন দুর্গতি হয় নাই। নববসন্ত সমাগমে বনরাজি যে নব জীবনের উচ্ছ্বাসে অপূর্ব্ব বরণকিরণগন্ধে বিশ্বপ্রাণকে বিমোহিত করিয়া তোলে, সে কি কেবল আপনার রূপ-যৌবনের বাহার জাহির করিবার জন্য? অসংখ্য কীটপতঙ্গের মন ভুলাইবার জন্যই বনরাজি এ বিচিত্র রূপের হাট খুলিয়া বসে, সত্য। রং ফুটাইয়া এরা প্রজাপতিকুলকে আহ্বান করে, গন্ধ ছুটাইয়া মধুপশ্রেণীকে মাতাইয়া বুকে টানিয়া লহে, এ সকলই সত্য। কিন্তু প্রজাপতির মন ভুলান, মধুপেরে লোভ দেখানো,—ইহাদের রূপ ও রসের মুখ্য লক্ষ্য নহে। এ সকল কেবল ছলাকলা মাত্র। মূল লক্ষ্য এদের প্রাণেরই উপরে পড়িয়া থাকে। প্রজাপতির পাখায় চড়াইয়া, ভৃঙ্গের পাতায় জড়াইয়া, পুষ্পিত বনরাজি আপনার প্রাণকে বনস্থলীময় ছড়াইয়া দিতে চাহে। আপনার কেশররাজি বিলাইয়া নূতন উদ্ভিদপ্রাণ সৃষ্টি করিবার জন্যই তরুলতা এত যত্ন করিয়া বিচিত্র বরণকিরণগন্ধে আপনাদিগকে সাজাইয়া, অচল বলিয়া নিজেদের যাহা সাধ্যাতীত, চঞ্চল পতঙ্গকুলকে প্রলুব্ধ করিয়া, সেই কার্য্য সাধিয়া লহে। বাসন্তী বনস্থলীর এই অপূর্ব্ব কামলীলা যখন ধ্যান করি, তখন সত্য সত্য প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ—এই ভগদ্বাক্যের প্রামাণ্য প্রত্যক্ষ করিয়া কৃতার্থ হই। যেমন উদ্ভিদে সেইরূপ যাদের ইতর প্রাণী বলি, তাদের মধ্যেও এই প্রজোৎপত্তির জন্যই রূপ রসের অদ্ভূত লীলা দেখিতে পাই। বিধাতা কুক্কুটের চূড়া, ময়য়ের পাখা, প্যারাডাইজ পাখার অদ্ভূত পালক-সম্পদ, কোকিলের মধুর কণ্ঠ খঞ্জনের মনোহর নৃত্য—এ সকলের কিছুই কেবল পরস্পরের মনোরঞ্জন করিবার জন্য ইহাদিগকে দান করেন নাই। পাখীদের কামলীলাতে কি যে অদ্ভূতভাবে বন উদ্বেলিত হইয়া উঠে, কত ছলাকলা যে তারা জানে, প্রিয়জনের মন ভুলাইবার জন্য কত ফষ্টি নষ্টি যে তারা করে, বিহগকুলের গতিবিধি যাঁরা পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন, তাঁরা তা জানেন। বাওয়ার পাখী প্রিয়তমকে ভুলাইয়া আপনার কুঞ্জে আনিবার জন্য যেমন করিয়া তার কুঞ্জটা সাজায়, প্যারাডাইজ পাখী যেমন করিয়া আপনার রূপের বাহার খুলিয়া নাচে, কোকিল, দোয়েল, পাপিয়া, যেমন করিয়া গান করে,—মানব সমাজে কোনও নায়ক আজ পর্য্যন্ত সে শিক্ষা, সে চাতুর্য্য, সে মাধুর্য্য লাভ করিতে পারেন নাই। কিন্তু এ সাজসজ্জা, এ নাচগান, এ ছলাকলা, এ ফষ্টিনষ্টি, এ সকলের ভিতর দিয়া ঐ বিশ্বজনীন প্রাণন চেষ্টা,—প্রজাপতির সেই অনাদি আদি সঙ্কল্প ‘বহুস্যাং প্রজায়েঽতি’ তাহাই ফুটিয়া উঠিতেছে। মন ভুলান—উপায়; প্রজোৎপত্তি, প্রাণের সেবা, প্রাণের সৃষ্টি, প্রাণস্থিতি রক্ষা, প্রাণধারার পুষ্টি,—এই সকল কামলীলার ইহাই এক মাত্র নিগূঢ় লক্ষ্য। পশুদের মধ্যেও তাহাই দেখি,—তারাও প্রজননের জন্যই—আপনাদিগকে বহু করিবার উদ্দেশ্যেই, পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়। প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ—ভগবানের এই যে চিদানন্দবিভূতি ইহা ইতর জীবজগতে শুদ্ধভাবে বিরাজ করিতেছে। মনুষ্যের মধ্যেই এই পবিত্র কামপ্রবৃত্তি লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া, সম্ভোগমাত্র-প্রধানা হইয়াছে।

 মানুষ যখন সহজ মানুষ ছিল, তখন সে প্রাণের মর্যাদা বুঝিত, তখন তার রূপের আস্বাদন, যৌবনের সম্ভোগ, সকলই স্বাভাবিক অর্থাৎ প্রাণাপেক্ষী ছিল। স্বাস্থ্যই তখন রূপের প্রধান মাত্রা ছিল। পুরুষের শৌর্য্যে, রমণীর মাধুর্য্যে, তখন রূপের মাত্রা হইত। তেজই শৌর্য্যের ধর্ম্ম,—আর যদেতপ্রেত স্তদেতৎ সর্ব্বেভ্যোঽপেস্তেজ—পুরুষের সকল অঙ্গের তেজের সারভুত যে বীর্য্য—তাহাই শৌর্য্যের একমাত্র মাপকাটী। এই, তেজই পুরুষের পুরুষত্ব, এই পুরুষত্বের আভাই পুরুষের প্রকৃত রূপ। সুগঠিত দেহ এই পুরুষত্বকে প্রকাশ করে। আয়ত বক্ষ, আজানুলম্বিত বাহু, ব্যুঢ়োরষ্ক বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশু মহাভুজ, এ সকল শৌর্য্যবীর্য্যের পরিচায়ক, এসকল পুরুষত্বের কায়ব্যুহ স্বরূপ, তাই এ সকল রূপের তটস্থ লক্ষণ। প্রকৃতরূপে পুরুষের রূপের স্বরূপ লক্ষণ তার পুরুষত্ব; তার প্রজোৎপত্তির যথার্থ সামর্থ্য। পুরুষের রূপ যেমন শৌর্য্যে ও বীর্য্যে, রমণীর মাধুর্য্য তেমনি মাতৃত্বে। জঘন্য লোকের হাতে পড়িয়া রমণীর প্রকৃত রূপের দাবীটাও অতি হীন ও লঘু হইয়া পড়িয়াছে;—কিন্তু যাঁরা প্রথম রমণী সৌন্দর্য্য অঙ্কিত করিতে যাইয়া—গুরু নিতম্ব, পীন পয়োধরের বর্ণনা করিয়াছিলেন, তাঁরা যে মাতৃত্বকেই রমণীর মাধুর্য্যের প্রধান মাপকাঠি করিয়াছিলেন, এ কি অস্বীকার করিতে পারি? রমণীর রূপ কেবল তার চোখে বা নাকে, রংএ বা কেশে নহে; কিন্তু তার দেহে, তার অঙ্গ বিন্যাসে ও অঙ্গ বিকাশে; চোখ তার মোহিনী শক্তিমাত্র প্রকাশ করে। নাকে মুখে, বর্ণে, কেশে তার স্বাভাবিক সুস্থতা, দেহের নিরোগ নির্বিকার ভাব মাত্র জ্ঞাপন করে। কিন্তু প্রকৃত রূপ তার অঙ্গবিকাশে, তাহাতেই তার মাতৃত্ব ফুটিয়া উঠে। ডালিম যেমন আপনার রসে আপনি ফাটিয়া পড়ে, সেইরূপ আপনার অন্তর্নিহিত মাতৃত্বের উচ্ছ্বাসে যে রমণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সকল ভরা জোয়ারে ভরা গাঙ্গের মত অপূর্ব্ব স্থিরচঞ্চলভাব ধারণ করে,—সেই ভারে যিনি সন্নতাঙ্গী, সেই ভারে যিনি মন্থরগামিনী, সেই অজাত অজ্ঞাত রসের উচ্ছ্বাসে যিনি সমুদ্ভাসিতা,—সেই রমণীই তো প্রকৃত রূপবতী। রমণীরূপের উৎকর্ষ গণেশজননীতে;—রমণী সৌন্দর্য্যের পরিপক্কতা ও পরিণতি—ম্যাডোনায়। গণেশজননী যারা গড়িয়াছিল, মাড্যোনা যারা আঁকিয়াছিল, তারা প্রাণের মর্য্যাদা বুঝিয়াছিল, তাই শ্রেষ্ঠতম রমণীরূপকে তারা মাতৃমূর্ত্তিতে প্রকাশিত করিতে চাহিয়াছিল, তাদের রূপের জ্ঞান সহজ, স্বাভাবিক, সত্য ও পবিত্র ছিল। আর আমরা,—আমরা প্রাণের মর্য্যাদা ভুলিয়া গিয়াছি বলিয়া প্রকৃত কামের মর্য্যাদা হারাইয়াছি। আমরা তাই রূপের মরকত আসনে পার্ব্বতীকে ছাড়িয়া রতিকে, ম্যাডোনাকে উপেক্ষা করিয়া ভিনাসকে বসাইতেছি। তাই পুরুষ এখন রমণীর রূপ খুঁজেন তার চোখে ও মুখে, রমণীও পুরুষের রূপ দেখেন তার পোষাকে! “গুরু নিতম্ব, পীন পয়োধর”— শুনিলে এখন আমাদের সুরুচি শিহরিয়া উঠে; কিন্তু টুকটুকে ঠোঁট, টকটকে গাল, ঢল ঢল চোখ, ঢেউখেলান চুল,—এ সকল সহজই হউক বা সাধিতই হউক, এ সকলে স্বাস্থ্যের গুণই জ্ঞাপন করুক আর কস্‌মেটিকের কৌশলই গোপন করুক,—এ সকলে আমাদের বিশুদ্ধ রুচি পীড়িত হয় না। অথবা এ সকলে কেবলমাত্র কামোপভোগ করিবার জন্য সভ্যতার ছলাকলার মোহিনী মূর্ত্তিই প্রকাশ করে, মাতৃত্বের দেবী-প্রতিমার কোনই সন্ধান দেয় না।

 প্রাচীনেরা প্রাণের মর্য্যাদা জানিতেন, তাই প্রজোৎপত্তির জন্য সংসার করিতেন। প্রাচীনারা প্রাণের মহত্ব বুঝিতেন, তাই দেবতার নিকটে সন্তান কামনা করিতেন। কোন রমণী সন্তান সম্ভাবিতা হইয়াছেন, এ কথা প্রকাশ করা, ইহার আলোচনা করা সেকালে তাই শিষ্টাচার-বিরোধী ছিল না। সন্তান-সম্ভাবিতাকে লইয়া সমাজ আনন্দোৎসব করিতেও কুণ্ঠিত হইত না। আমরা প্রাণের মর্য্যাদা ভুলিয়া গিয়া এ সকলকে হীন, নিকৃষ্ট, অকথ্য বলিয়া মনে করিতেছি। তাঁরা প্রজোৎপত্তিকে জীবনের প্রথম কর্ত্তব্য বলিয়া মনে করিতেন, আমরা ম্লেচ্ছ সমাজ-বিজ্ঞানের উদ্‌ভ্রান্ত মত ও আসুরী আদর্শের দ্বারা অভিভূত হইয়া, “ফিলজফির ফল” আহরণ করিয়া, যাহাতে প্রজোৎপত্তি না হয় বা কম হয়, তারই চেষ্টা করিতেছি।

 কিন্তু প্রাচীনেরা—“প্রজায়ৈঃ গৃহমেদিনঃ”—প্রজোৎপত্তির জন্য গৃহী হইতেন বলিয়া, অসংযত কামোপভোগে প্রবৃত্ত হইয়া বিড়ালছানার মত রাশি রাশি মানবছানা উৎপাদন করিয়া পৃথিবীকে পীড়িত, সমাজকে দুঃস্থ ও স্বজাতির শৌর্য্যবীর্য্য সমূলে নষ্ট করিতেন না। কিশোর বয়সে কঠোর ব্রহ্মচর্য্যেয় দ্বারা আপনাদের পুরুষত্বকে সুরক্ষিত ও পরিপুষ্ট করিয়া, পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্তিতে, বলিষ্ঠ দেহে, নির্ম্মল মনে তাঁহারা ব্রহ্মবর্চ্চস-সম্পন্ন হইয়া, জীবনের দশসংস্কারের প্রধান সংস্কার জ্ঞানে, পরিণয়-বন্ধনে আবদ্ধ হইতেন; এবং গার্হস্থজীবনে দাম্পত্যসম্বন্ধকে বহুবিধ বিধিনিষেধের দ্বারা বেষ্টিত করিয়া, একই সঙ্গে কামের মর্য্যাদা রক্ষা ও প্রাণের পুষ্টিসাধন করিতেন। এই সকল উপায়ে, এই সকল সংযম ও নিয়মের শাসনের প্রভাবে প্রাচীন সমাজে অযথা প্রজোৎপত্তি নিবারিত হইত। আর সেকালে সমাজে সংযমের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল বলিয়া ম্যালথাসের নীতি অনুসরণ বা “ফিলজফির ফল” আহরণ করা একান্তই অনাবশ্যক ছিল।

 ফলতঃ কাম ও প্রাণ, ছায়াতপের ন্যায় পরস্পরের সঙ্গে নিয়ত বাস করে। যেখানে ছায়া একান্ত আতপ-বিরহিত হইয়া পড়ে, সেখানে যেমন কেবলমাত্র গাঢ়তম অন্ধকারের প্রতিষ্ঠা হয়, সেইরূপ কামও যেখানে প্রাণসম্পর্ক বিরহিত হয়, প্রাণের সঙ্গে যেখানে তাহার একান্ত বিচ্ছেদ ঘটে, সেখানেই তাহা নিতান্ত সম্ভোগমাত্র-প্রধান হইয়া উঠে। আর যেখানেই এইরূপ যথেচ্ছ ইন্দ্রিয়সেবার লালসা রোধ করা অনাবশ্যক বা অসাধ্য বোধ হয়, সেখানেই কেবল প্রজাবৃদ্ধি নিবারণের জন্য বিবিধ অস্বাভাবিক ও আসুরী উপায় অবলম্বন করা আবশ্যক হইয়া উঠে। যে পরিমাণে যেখানে প্রাণের মর্য্যাদা নষ্ট হইতে আরম্ভ করে, সেখানে কামও আপনার পবিত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া কেবলমাত্র সম্ভোগ-প্রধান হইয়া পড়ে; আর যেখানে আবার কামলিপ্সা নিতান্ত বলবতী ও স্বেচ্ছাচারিণী হয়, সেখানে প্রাণের মর্য্যাদা ক্রমে বিলুপ্ত হইতে আরম্ভ করে।

 প্রাচীনেরা প্রাণের মর্য্যাদা বুঝিতেন, তাই কামেরও মর্য্যাদা রক্ষা করিবার জন্য, প্রাচীন সমাজে অশেষবিধ বিধিনিষেধাদি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। আধুনিক সভ্যতা সে সকল তিথি নক্ষত্রাদির বিচারকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারে, কিন্তু prostitution in married life নামে যে অদ্ভূত অসুর তাহার দাম্পত্য-সম্বন্ধকে আসিয়া আক্রমণ করিয়াছে, তাহার দমনের উপায় এখনও খুঁজিয়া পায় নাই। কেহ বা ধর্ম্মোপদেশের দ্বারা, কেহ বা রাজবিধির সাহায্যে এই অনিষ্ট নিবারণের প্রস্তাব করিতেছেন। কিন্তু এ রোগের নিদান নির্ণয়ের শক্তি ও প্রবৃত্তি কাহারও আছে বলিয়া মনে হয় না। আধুনিক সভ্যতা নামে যে আদর্শ ও সাধনা জগৎকে আচ্ছন্ন করিতে চাহিতেছে, তাহার মূল পর্য্যন্ত সংশোধন না করিলে, এই রোগের উপশম কখনও হইতে পারে না। কিন্তু বোঝে কে? এ কথা মুখ ফুটিয়া বলে, এমন বুকের পাটাই বা ক’জনার আছে?

  1. তৈত্তিরীয়োপনিষত্‌ ব্রহ্মানন্দবল্লী