জেলের খাতা/স্বরূপোপাসনা, সম্পদুপাসনা ও প্রতীকোপাসনা

চতুর্থ অধ্যায়।

স্বরূপোপাসনা, সম্পদুপাসনা ও প্রতীকোপাসনা

 আর এই নিম্ন অধিকারেও শ্রেষ্ঠ নিকৃষ্ট ভেদ আছে। ফলতঃ বেদান্তে তিনপ্রকার উপাসনার বিধান আছে। স্বরূপোপাসনা, সম্পদুপাসনা ও প্রতীকোপাসনা। স্বরূপেপাসনা—ব্রহ্মাত্মৈকত্ববোধ; ইহাকে প্রকৃতপক্ষে উপাসনা। বলা যায় না; কারণ। স্বরূপোপলব্ধিতে উপাস্য-উপাসক ভেদ থাকে না। স্বরূপোপাসনায় যতক্ষণ অধিকার না জন্মে, ততক্ষণ সম্পদুপাসনা বা প্রতীকোপাসনা বিহিত হয়। ইহার মধ্যে সম্পদুপাসক মধ্যম অধিকারী, প্রতীকোপাসক নিকৃষ্ট অধিকারী।

সম্পদুপাসনা

 দুই বস্তুর মধ্যে কোন সামান্য ধর্ম্ম দেখিয়া, ক্ষুদ্রতরের সাহায্যে বৃহত্তরের যে জ্ঞান জন্মে, তাহার নাম সম্পদজ্ঞান। ভূগোল শিখিবার কালে ক্ষুদ্র কমলালেবুর সাহায্যে বৃহৎ ও অপরিমেয়প্রায় যে এই পৃথিবী তাহার আকারের জ্ঞান সাধিত হয়, এ জ্ঞান সম্পদজ্ঞান। দৃষ্ট ও পরিমিত কমলালেবুর সঙ্গে অদৃষ্ট ও প্রায় অপরিমিত পৃথিবীর আকার সাদৃশ্য আছে। সুতরাং ভূগোলে পৃথিবী কমলালেবুর মত গোলাকার। এই উপদেশ দিয়া পৃথিবীর আকারের জ্ঞান জন্মায়। পৃথিবী যদি উপাস্য হইতেন, তবে কমলালেবু অবলম্বনে তাহার যে উপাসনা হইত, তাহাকে সম্পদুপাসনা বলা যাইতে পারিত।

প্রাণোপাসনা

 প্রণোপাসনা ও সূর্য্যোপাসনা উভয়ই সম্পদুপাসনা। নিরাকারবাদীও প্রাণরূপে ব্রহ্মের উপাসনা করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহারা ইহাকে স্বরূপেপাসনা বলিয়াই গণনা করেন। ফলতঃ প্রাণতত্ত্বে ও পরাতত্ত্বে ও ব্রহ্মতত্ত্বে, প্রভেদ বিস্তর। উপনিষদে ব্রহ্মকে প্রাণরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে —‘যিনি সর্ব্বভূতে প্রকাশ পাইতেছেন, তিনি প্রাণ-স্বরূপ।’ কিন্তু এখানে প্রাণ বলিতে বিশ্বপ্রাণ বোঝায়। জীবে যাহা ধর্ম্মভাবে প্রাণরূপে প্রকাশিত হয়, তাহা নহে, কিন্তু যে নিত্যবস্তুকে আশ্রয় করিয়া এ সকল প্রাণ স্থিতি করিতেছে তাহাকেই এখানে প্রাণ বলা হইয়াছে। এ প্রাণ অদ্বৈত বস্তু। আমার, তোমার, তাহার-—এবষিধ উপাধি এ প্রাণে আরেপিত হয় না। যাঁহার ব্রহ্মরূপে আপনার বিশিষ্ট প্রাণের ধ্যান করেন, তাঁহাদের প্রানাত্মবুদ্ধি নষ্ট হয় নাই। আর এই প্রাণাত্মবুদ্ধি, দেহাত্মবুদ্ধি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইলেও অবিদ্যান্তর্গত। প্রাণময় কোষ, কোষপঞ্চকের দ্বিতীয় কোষ। বেদান্ত বলেন য়ে, পঞ্চকোষ ভেদ না হওয়া পর্য্যন্ত অদ্বৈত ব্রক্ষাতত্ত্বে জীব কখনো পৌঁছিতে পারে না। সুতরাং প্রাণোপাসনা স্বরূপ উপাসনার অন্তর্গত বলিয়া গৃহীত হয় না। প্রাণেপাসনা সম্পদুপাসনা। প্রাণের সঙ্গে ব্রহ্মের সামান্য ধর্ম্ম আছে। ব্রহ্ম চৈতন্যস্বরূপ, প্রাণ চৈতন্যরূপী। প্রাণের মধ্যে প্রাণরূপে, প্রাণাবলম্বনে ব্রহ্মোপাসনা করিতে হইলে, প্রাণের এই চৈত্যাধর্ম্মকেই কেবল ধ্যান করিতে হইবে। প্রাণ যেমন চৈতন্যরূপীতেমনি জড়দেহেও আবদ্ধ, জড়ের দোষগুণের দ্বারা সর্ব্বদাই স্বল্পবিস্তর অভিভূত হয়। আবার প্রাণ গমনাগমনশীল, প্রকাশপ্রকাশাধীন। প্রাণের সংসার আছে, সংস্থিতি আছে। এ সকল ব্রক্ষে নাই। সুতরাং সমগ্র প্রাণকে, তার জড়সংশ্লিষ্টতা, গতাগতি, জন্মমৃতুজরাভিভূত প্রভৃতি বজ্জন না। করিয়া,—উপাসনা, এবং তাহার ধ্যান ধারণার চেষ্টা করিলে, তাহা সম্পদুপাসনা বলিয়া পরিগণিত হইবে না। মূল উপাস্যের সঙ্গে সম্পদের যে সামান্য ধর্ম্ম, তাহাই সম্পদুপাসনার প্রাণ; যখনই ধ্যান এই সামান্য ধর্ম্মের অতিক্রম করে তখনই ইহা নষ্ট হইয়া যায়।

সুর্য্যোপাসনা

 প্রাণোপাসনার ন্যায় সূর্য্যোপাসনাও বেদান্তে সম্পদুপাসনা বলিয়া পরিগণিত হয়। এখানেও ব্রহ্মের সঙ্গে সূর্যের যে সামান্যধর্ম্ম রহিয়াছে, তাহার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই কেবল সুর্য্যের উপাসনা করিলে, তাহা সম্পদ্‌ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে, অন্যথা নহে। ব্রহ্ম স্বপ্রকাশ ও জগৎ প্রকাশক; ব্রহ্ম আপনাকে প্রকাশিত করিতে যাইয়া এই ব্রহ্মাণ্ডকে প্রকাশিত করিয়াছেন ও প্রতিনিয়তই প্রকাশিত করিতেছেন। ইহাই ব্রহ্মাচৈতন্যের মুল লক্ষণ। এই অর্থেই ব্রহ্ম জ্ঞান-সূর্য্য। আর এই খানেই ব্রহ্মের সঙ্গে সূর্য্যের সামান্যধর্ম্ম লক্ষিত হয়। কারণ সূর্য্য স্বয়ং-প্রকাশ, অপর কিছু সূর্যকে প্রকাশিত করে না করিতে পারে না; অথচ সূর্য্য, অপর যাহা কিছু দৃষ্ট বস্তু, তৎসমুদায়কে প্রকাশিত করিতে যাইয়াই তাহার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীরূপে আপনাকে প্রকাশিত করিতেছেন। সূর্যের এই স্বয়ং-প্রকাশত্ব ও জগৎ প্রকাশকত্ব ধর্ম্মকে ধ্যানের বিষয়ীভূত করিয়া যে সূর্য্যোপাসনা হয়, তাহাই সম্পদুপাসনা। তদ্বারা ব্রঙ্গধ্যানের সহায়তা হয়। তাহাই ব্রদোপাসনার সোপামরূপে পরিগণিত হইতে পারে।

সম্পদুপাসনা ও নিরাকারবাদ

 নির্ব্বিশেষ, নিরাকার ব্রহ্মাবস্তুকে যখন মূল উপাস্যরূপে গ্রহণ করিয়া সেই উপাসনার নিম্নতর সোপানরূপে সম্পরূপাসনা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তখন ইহার দ্বারা যে নিরাকারবাদের বা অপরোক্ষ ব্রহ্মোপাসনার মর্যাদহানি হয়, এমন বলা যায় না। ফলতঃ প্রকৃত ব্রহ্মতত্বের দিক হইতে দেখিলে খৃষ্টীয়ান, মোহাম্মদীয়ন প্রভৃতি নিরাকারোপাসকাভিমানী ধর্ম্মসম্প্রদায়সকলে যেরূপ উপাসনা প্রচলিত আছে, তাহাও স্বরূপ-উপাসনা বলিয়া গৃহীত হইবে না। খৃষ্টীয়ানেরা ঈশ্বরকে পিতা ও প্রভুরূপে ভজনা করেন। মুসলমান সাধকেরাও তাঁহাকে রাজা ও প্রভু এবং কখনো কখনো সখারূপেও ভজনা করিয়া থাকেন। আর সূক্ষ্মভাবে বিচার করিলে ঈশ্বরে পিতৃত্ব, প্রভুত্ব, বা স্বামিত্ব আরোপ করাও সম্পদজ্ঞানেরই লক্ষণ। আধুনিক নিরাকারবাদের আলোচনায় সবিস্তারে এ বিষয়ের বিচার করিব।

প্রতীকোপাসনা ও সাকারবাদ

 প্রতীকোপাসনাই অতি স্থূলভাবে সাকারোপাসনা বলিয়া বিবেচিত হয়। কাষ্ঠলোষ্ট্রের উপাসনা প্রতীকোপাসনার অন্তর্গত। দেশ-প্রচলিত প্রতিমা-পূজাকে ঠিক প্রতীকোপাসনা বলা যায় কি না, সন্দেহের কথা। কারণ, মুর্ত্তিমাত্রেই যদিও প্রতীক তথাপি ভগবদস্বরূপের কোনো না কোনো ধর্ম্মের সঙ্গে প্রতিমাদির স্বল্পবিস্তর সামান্যধর্ম্ম প্রকাশেরও চেষ্টা হইয়া থাকে। প্রতিমাপূজাতে এইজন্য সম্পদ ও প্রতীকের মাঝামাঝি একটা ভাব আছে। ইহাকে প্রতীকাশ্রিত সম্পদুপাসনা বলা যাইতে পারে। যাহা হোক, প্রতীকোপাসনকে বেদান্তে আধ্যাসজনিত উপাসনা বলে। অধ্যাস অর্থ-পরত্রদৃষ্ট অন্যত্রাবভাসঃ—অন্যত্রদৃষ্ট কোন বস্তুকে যেস্থানে তাহা প্রকৃতপক্ষে নাই, সেখানে আরোপ করার নাম অধ্যাস। কোনোকালে বনে যে সর্প দৃষ্ট হইয়াছিল, গৃহস্থিত রজ্জুতে সেই সর্পের অস্তিত্ব আরোপ করাকে অধ্যাস বলে। ইহা অধ্যাসের ধর্ম্ম। প্রতীকোপাসনা অধ্যাসজনিত উপাসনা; ইহার অর্থ এই যে, শাস্ত্রে শ্রুত উপদেশ প্রাপ্ত, অথবা আপনার বুদ্ধিতে প্রকাশিত, বা আত্মাতে আভাস রূপে অনুভূত যে ঈশ্বরতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব, তাহাকে, যে বস্তুতে তাহার স্বতঃ প্রকাশ নাই, তাহাতে আরোপ করিয়া, ঈশ্বর বা ব্রঙ্গরূপে সে। বস্তুর পূজা করাই প্রতীকোপাসনা। এখানেও সুতরাং সাধক একে বারে নিরাকাণ্ড ঈশ্বরতত্ত্বের জ্ঞানবর্জ্জিত নহেন। উপাসনার অবলম্বন সাকার অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হইলেও, উপাস্য যিনি, তিনি নিরাকার অতীন্দ্রিয়; প্রতীকোপাসনায়ও জ্ঞানের অভাব বা বিলোপ হয় না। সুতরাং প্রতীকোপাসনাকেও প্রকৃতপক্ষে সাকারবাদ বলা যায় না; তবে ইহা নিরুষ্ট আধিকাব, বেদান্ত স্বয়ংই এ কথা স্বীকার করেন।

আধুনিক নিরাকারবাদ

 আমাদের আধুনিক নিরাকারবাদও মোটামুটি সম্পদ্‌সোপান পর্য্যন্তই উঠিয়াছে। ভগবানের ইচ্ছা হইলে প্রবন্ধাস্তরে ইহার বিস্তৃত আলোচনার চেষ্টা করিব।