জেলের খাতা/অবতারবাদ ও সাকারবাদ

তৃতীয় অধ্যায়

অবতারবাদ ও সাকারবাদ

 ফলত অবতারবাদ মাত্রেই সাকারবাদ। অবতীর্ণ হইতে গেলেই ঈশ্বরকে কোন না কোন আকার ধারণ করিতে হয়। আমাদের দেশে অবতার স্বীকার করিয়াও হয়ত কেহ বা নিরাকারবাদী থাকিতে পারেন। আমাদের শাস্ত্রে অবতার অসংখ্য; যুগাবতার, লীলাবতার, গুণাবতার, আবেশাবতার ইত্যাদি বহুবিধ অবতারের উল্লেখ আছে, আবার পূর্ণ অবতারেরও উল্লেখ আছে। আর মায়াবাদের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি অবতার দেহকে মায়িক বলিয়া, অবতারীর নিরাশয়ত্ব সম্পূর্ণরূপেই রক্ষা করিতে পারেন। আর এরূপ সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করিবার চেষ্টা যে আমাদের মধ্যে একেবারে হয় নাই, তাহাও নহে। কিন্তু খৃষ্টীয় অবতারবাদে-ইনকারণেষন-বক্তমাংসময় দেহ ধারণ বোঝায়। এখানে গুণাবতার, আবেশাবতার প্রভৃতির স্থান নাই। এখানে Word made flesh— ঈশ্বরের যে বাক্য অনাদি আদি হইতে। ঈশ্বরের সঙ্গে ছিলেন যিনি স্বয়ং ঈশ্বর-“God or very God—তাহাই রক্তমাংসে পরিণত বা প্রকাশিত হন। সুতরাং এখানে অবতারকে সাকার বলিতেই হয়। তবে যে আকারে যিশু ইহলোকে বিহার করিয়াছিলেন, তাহা সত্যই তাঁর দেহ ছিল,না কে বল মাত্র ছায়াবাজির ছায়ার মত ছিল, -এ প্রশ্ন প্রাচী খৃষ্টমগুলীর মধ্যেও উঠিয়াছিল। একদল লোকে যিশুর নরা্কৃতি যে রক্তমাংস গঠিত ছিল, ইহা বিশ্বাস করিতেন না, তাঁরা বলিতেন যে যিশুকে কে বল মানুষের মত দেখাইত মাত্র, বস্তুত তিনি মানব-দেহধারী ছিলেন না। আমাদের পরিভাষায় বলিতে গেলে, এই বলিতে হয় যে, ইহারা যিশুর মানবদেহকে “মায়িক” বলিয়া স্বীকার করিতেন, “কায়িক” বলিয়া মানিতেন না। কিন্তু খৃষ্টীয় মণ্ডলী ইহাদিগকে “হেরিটিক্‌” বা অবিশ্বাসী বলিয়া বর্জ্জন করেন। তদবধি যিশু যে নরদেহে সত্য সত্যই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, ইহা সকল খ্রীষ্টীয়ান্‌ মণ্ডলীই একবাক্যে স্বীকার করিয়া আসিতেছেন।! আর যিশু ও ঈশ্বরেতে যখন বস্তুত ও তত্ত্বত, Ousia বা Essenceএ, কোনই পার্থক্য নাই, তখন ঈশ্বরতত্ত্ব নিরাকার হইয়াও মানবাকার ধারণে যে তাহার মর্য্যাদাহানি হয় না, ইহা খৃষ্টীয়ান্‌ মাত্রেই স্বীকার করিবেন। সুতরাং খৃষ্ট-শিশুদিগকে কোনো ক্রমেই যথার্থ নিরাকারবাদী বলিয়া গ্রহণ করা যায় না।

ইস্‌লামের নিরাকারবাদ

 বর্ত্তমান সময়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম্ম সকলের মধ্যে এক ইস্‌লামকেই অনেক পরিমাণে নিরাকারবাদী বলা যায়। “অনেক পরিমাণে” বলিতেছি এই হেতু যে, ইস্‌লামও দ্বৈততত্ত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত; সুতরাং দ্বৈতবাদে ঈশ্বরতত্বে যে পরিচ্ছিন্নতা অপরিহার্য্যরূপে আরোপিত করে, তাহার দ্বারা ইস্‌লামের ঈশ্বরতত্ত্বেও একরূপ চিদাকার আরোপিত হইয়া থাকে; তথাপি ইস্‌লাম ইশ্বরের অবতার বা বিগ্রহ এ সকল কিছুই স্বীকার করেন না। সুতরাং হিন্দুধর্ম্মে কিম্বা খৃষ্টীয়ধর্ম্মে যে আকারের সাকারবাদ দেখিতে পাওয়া যায়, ইস্‌লামে সেরূপ কিছুই পাওয়া যায় না। তবে ইস্‌লামে স্বর্গের যেরূপ কল্পনা করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার নিরাকারবাদ সম্বন্ধেও অনেকটা সন্দেহ উপস্থিত হয়। মুসলমান সাধকদিগের জীবনচরিত পাঠে এ সনেহ আরও দৃঢ় হইয়া উঠে। কারণ, ইস্‌লামের ঈশ্বরতত্ত্ব একান্ত নিরাকার যদিই বা হয়, মুসলমান সাধনতে সে নিরাকারত্ব সম্পূর্ণরূপে রক্ষিত হয় নাই।

ইস্‌লামের গুরুবাদ

 কারণ, ইস্‌লামে অবতারবাদ না থাকিলেও অতি পরিস্ফুট আকারে গুরুবাদ আছে। ইস্‌লাম অবতার অস্বীকার করিয়াও নবী বা প্রবক্তা স্বীকার করেন। ইহারা ঈশ্বরের প্রেরিত, ঈশ্বরের প্রিয়, ঈশ্বরের আদেশ প্রচার করিয়া লোক মণ্ডলীকে ধর্ম্ম পথে লইয়া যান। রসুলকে ছাড়িয়া কোনো মুসলমান খোদার দরজায় পৌঁছিতে পারেন না। সুতরাং হজরত্‌ মোহাম্মদ মুসলমান সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। গভীর যোগে ও সমাধিতে মুসলমান সাধকদিগের সমক্ষে হজরত্‌ মোহাম্মদ বা আলী প্রভৃতি তাঁহার আসন্ন পরিচারক ও শিষ্যগণের মধ্যে কেহ কেহ সর্ব্বদাই প্রকাশিত হইয়া থাকেন। যে সাধক এইরূপে ধ্যানযোগে আল্লার, রসুলের বা তাঁহার অনুচরগণের সাক্ষাৎকার লাভ করেন ইস্‌লাম তাঁহাকে অতি উচ্চ অধিকারী বলিয়া গণ্য করেন। সুতরাং তত্ত্বাঙ্গে একরূপ নিরাকার হইয়াও, সাধনা বলে, এট গুরুবাদ নিবন্ধন, ইস্‌লাম যে সাকার-আশ্রয় লইয়া থাকেন, ইহা অস্বীকার করা অসম্ভব।

সাকারোপাসনা— পরদেবোপাসনা

 অতএব, জগতে প্রাচীনকাল হইতে যে সকল ধর্ম্ম লোকসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছে, তাহার আলোচনাতে দেখি যে, এক ভারতবর্ষে, নির্গুণ ব্রহ্মোণাসকদিগের দ্বারাই কেবল যথার্থ নিরাকারতত্ত্ব আয়ত্ত করিবার চেষ্টা হইয়াছিল। আর সকল ধর্ম্মেই কোথাও বা তত্ত্বাঙ্গে ও সাধনাঙ্গে উভয়ত, কোথাও বা অন্তত সাধনাঙ্গে, কোনো না কোনো আকারে সাকারবাদ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহুদী, খৃষ্টীয়ান বা ইস্‌লাম ধর্ম্মে যে আপাতত সাকারোপাসনার তীব্র প্রতিবাদ দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার অর্থ একান্তভাবে সাকারোপাসনা বর্জ্জন করা নহে, কিন্তু পর দেবোপাসনা মাত্রকে বিগর্থিত বলিয়া প্রতিষ্ঠিত করা। ইহুদায় মুর্ত্তিপূজা পাপ বলিয়া পরিত্যক্ত হয়। ইহুদীর এই আদেশের বশেই খৃষ্টীয়ান মণ্ডলী মধ্যেও সাকারোপাসনা বর্জ্জিত হইয়াছে। ইস্‌লামও এই দশাণ্ডকে ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া মানেন, এবং ইস্‌লামে সাবারোপাসনার বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিবাদ দেখা যায়, তাহাও মূলে ইহুদা ধর্ম্ম হইতেই গৃহীত হইয়াছে। মোহাম্মদের সময়ে আরবে নানা প্রকারের দেব-দেবীর ভজনা বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল। এই সকল দেবোপাসনার সঙ্গে প্রথম। হইতেই ইসলামের ঘোরতর প্রতিদ্বন্দিতা দাঁড়াইয়া যায়। ক্রমে এই দেবোপাসকদিগের সঙ্গে মোহাম্মদ ও তাঁহার শিষ্যগণের মারাত্মক বিরোধ উপস্থিত হয়, এবং ইহাদের হাতে প্রথমে হজরত্‌ ও তাঁহার ভক্তগণ নিরতিশয় লাঞ্জনা প্রাপ্ত হন। এই কারণে, বোধ্‌-পরস্তদের প্রতি স্বভাবতঃই ইস্‌লামের একটা গভীর বিধে জন্মিয়া যায়। আপনার মণ্ডলীর পবিত্রতা, অর্থাৎ পার্থক্য, রাখিবার জন্য মোহাম্মদকে অতি তীব্রভাবে এই সাকারাবাদের নিন্দা করিতে হয়। সুতরাং মূলত ইহুদীয়, খৃষ্টীয় বা মোহাম্মদীয় ধর্ম্মে যে সাকারাবাদ বর্জ্জিত হইয়াছে, তাহার মর্ম্ম নিরাকারবাদ প্রতিষ্ঠা করা নহে, কিন্তু ঐকান্তিকভাবে পরদেবোপাসনার মাত্র প্রতিরোধ করা। যে প্রয়োজনে প্রাচীন ভারতে, আর্য্যসমাজে অনার্য্য মিশ্রণ। হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য জাতিভেদ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ঠিক তদনুরূপ প্রয়োজনে, ইহুদীয় ও পরে খৃষ্টীয় ও মোহাম্মদীয় ধর্ম্মে সাকারোপাসনার বিরুদ্ধে এরূপ কঠোর নিষেধ প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রচ্ছন্ন সাকারবাদ

 ফলত প্রকৃত মিরাকারবাদী সরকারোপাসনাকে মিথ্যা ও কল্পিত বলিয়া বর্জ্জন করিলেও, পাপ বলিয়া কখনো ঘৃণা করিতে পারেন না। সাকারোপাসনায় ঈশ্বরের অবমাননা হয়, এ কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা বাস্তবিক একান্ত নিরাকারবাদী নহেন। অজ্ঞাতসারে তাঁহারা ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট আকার আছে, ইহা ধরিয়া লন। যার কোনো নিজস্ব আকার আছে, অন্য আকারে উস্থিত করিলেই তাহার গৌরবহানির সম্ভবনা আছে, ইহ। বুদ্ধিতে পারা যায়। কিন্তু ধার নিজস্ব কোনা আাকার নাই, যে বস্তু একান্ত নিরাকার, তাহাতে কোন ভক্তিযোগ্য আকার আরোপ করিলে তাঁহার অবমাননা হইবে কেন? সুতরাং সাকারোপাসনাকে যাঁরা পাপ বলিয়া বর্জ্জন করিতে বলেন, তাঁহাদিগকে প্রচ্ছন্ন সাকারবাদী ভিন্ন আর কিই বা বলা যাইতে পারে! ভারতের নির্গুণ ব্রহ্মোপাসক বা গুদ্ধাদ্বৈতবাদী প্রকৃত নিরাকারবাদী; সুতরাং তাঁহারা সাকারোপাসনাকে অসৎ বলিরা উপেক্ষা করিলেও কখনো অপরাধ বলিয়া নিষেধ করেন না। হিন্দু বৈদান্তকেরা নিরাকারের উপাসক হইয়াও খৃষ্টীয়ান বা মুসলমান ধর্ম্মোপদেষ্টাগণের যায় কেন যে এ দেশে প্রচলিত প্রতিমা-পূজার কোন বিশেষ প্রতিবাদ করেন না, তাঁহাদের বিশুদ্ধ নিরাকারবাদই ইহার প্রধান কারণ।

অবিদ্যাবদ্বিষয়ানি

 ইহাদের চক্ষে, সাক্ষ।ৎ ব্রহ্মানুভূতি না হওয়া পর্যন্ত জীব যা কিছু সাধন ভজন করুক না কেন, সকলই পারমার্থিক দৃষ্টিতে মিথ্যা, সকলই অবিদ্যাবদ্বিষয়ানি। বিষয়, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, -এ সকলই মায়াধীন, মায়াভিভূত। জীব যতক্ষণ না এ সকলকে একন্তভাবে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে, ততক্ষণ তাহার আত্মসাক্ষাৎকার লাভ হয় না। ততক্ষণ সে যে কোনো প্রকারের উপাসনায় নিযুক্ত হউক না কেন, তৎসমুদায়ই মায়িক, মিথ্যা, কল্পিত! সমাধিতে আত্মসাক্ষাৎকার হয়। সমাধিতে সকল ইন্দ্রিয় রুদ্ধ হইয়া যায়। সে অবস্থায় দ্রষ্টা স্বরূপে অবস্থান করেন; আর তখন কঃ কেন পশ্যেৎ-কে কাহার দ্বারা কা’কে দেখে, কে কিসের দ্বারা কা’কে শোনে—সকলই ব্রহ্মাত্মৈকত্বে একীভূত হইয়া কেবল অ।নন্দঘন মাত্র অনুভূত হয়। তখন উপাস্য উপাসকের সম্বন্ধও লুপ্ত হয়। এই জন্য অদ্বৈত সিদ্ধান্তে উপাসনামাত্রেই ভেদাত্মক বলিয়া, মিথ্যা। কিন্তু মিথ্যা হইলেও, নিস্ফল নহে। কারণ ইহার দ্বারাই ক্রমে শুদ্ধচিত্ত হইয়া সাধক অদ্বৈততত্ত্বে প্রবেশ করেন। নিম্ন অধিকারীর জন্য উপাসনাদি নিত্য কর্ম্মরূপে বিহিত হয়।