জেলের খাতা/খৃষ্টীয় ঈশ্বর-তত্ত্ব

দ্বিতীয় অধ্যায়

খৃষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্ব

 খৃষ্টীয়ধর্ম্ম ইহুদীর ধর্ম্মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। ইহদীর জিহোবাকেই খৃষ্টীয়ানেরাও ঈশ্বর বলিয়া মানেন; এবং এই দশাজ্ঞা ও পুরাতন বাইবেলের সকল কথাই তাঁরা প্রামাণ্য বলিয়স্বীকার করেন। নূতন পুস্তকের বা নিউ টেষ্টেমেণ্টের বিশেষত্ব যিশুর অবতারতত্ত্ব। ইহুদীর ধর্ম্মে অবতারবাদের নামগন্ধ নাই। ফলতঃ ঈশ্বর যতদিন কোনো না কোনোভাবে চাক্ষুষ থাকেন, সাক্ষাৎভাবে যখন তাঁহার দর্শন লাভ ও উপদেশ শ্রবণ সম্ভব হয়, ততদিন অবতারের প্রয়োজনই হয় না। দেবতা যখন একান্ত অতীন্দ্রিয় হইয়া পড়েন, তখনই তাঁহার সঙ্গে মানুষের যোগ স্থাপন ও রক্ষা করিবার জন্য নবী বা প্রফেট্‌, পয়গম্বর ও অবতারাদির প্রয়োজন হয়। ইহুদীর ঈশ্বর প্রথমে ইহুদী-সমাজের নেতৃবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ ভাবেই কথাবার্ত্তা কহিতেন। এমন কি কখনো বা তাঁহাদের সঙ্গে হাতাহাতি কুস্তি কসরৎ করিতে আসিতেন। সে অবস্থায়, কাজেই পয়গম্বর বা অবতারের আবশ্যক হয় নাই। ইহুদার ঈশ্বর যখন লোকচক্ষুর একান্ত অতীত হইয়া গেলেন, তখন হইতে ইহুদাসমাজে। নবী বা প্রফেটদিগের আবির্ভাব আরম্ভ হইল। ঈশ্বরের “বাণী” আসিয়া ইহাদিগকে অবলম্বন করিয়া। ইহুদা-সমাজে তাঁহার আদেশ প্রচার করিতে লাগিল। তখন হইতে এই সকল নবী বা প্রফেট বা প্রবক্তাই ইহুদাধর্ম্মের লৌকিক অবলম্বন হইলেন। কিন্তু এই নবীদিগের সময় হইতেই, কালক্রমে ইহুদার উদ্ধার-সাধনের জন্য জিহোবার নিকট হইতে একজন মিসায়া বা মসী বা বিশেষ দূত, আবির্ভুত হইবেন, এ ভাব ইহুদা-সমাজে অল্পে অল্পে জাগিতে আরম্ভ করে। তাঁহার আদি ইহুদী শিষ্যগণ যিশুকে এই মসী বা মিসায়াবপেই গ্রহণ করেন। তাঁহাদের নিকটে যিশু “ঈশ্বরের সন্তান” রূপেই প্রকাশিত হন। বাইবেলের পুরাতন পুস্তকে দেবদূতদিগকে বারম্বারই ঈশ্বরপুত্র আখ্যা দিয়াছে। ইহুদী ভাষায় ইহাদিগকে—“বেনে ইলোহিম্‌”-বলিত। যিশু স্বয়ং এই উপাধি গ্রহণ করেন—আপনাকে ঈশ্বরপুত্র বা সন্‌ অব্‌ গড্‌, Son of God বলিয়া প্রচার করেন। তাঁহার ইহুদী শিয্যেরা ঈশ্বরপুত্র বলিতে প্রবক্তাগণকে কথিত মসী বা মিসায়া বলিয়াই বুঝিায়াছিলেন। খৃষ্টধর্ম্ম এই ঈশ্বরপুত্রের যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা যিশুর ইহুরা শিষ্যগণের ব্যাখ্যা বলিয়া মনে হয় ন।;—প্রকাশ্যভাবে যিশুর ঈশ্বরত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই দৃষ্ট হয়।

 In the beginning was the Word and the Word was ith God, and the Word was God.  আদিতে “বাক্য” ছিল, এই বাক্য ঈশ্বরের সঙ্গে ছিল, এবং এই “বাক্য”ই ঈশ্বর ছিল। এবং এই “বাক্য”ই যিশুরূপে অবতীর্ণ হয়। গ্রীসীয় ভাষায় লগস্‌ Logos শব্দের ইংরাজী অনুবাদ word; পাদ্রিরা বাংলাতে ইহাকেই “বাক্য” বলিয়াছেন। এই লগস কথা গ্রীসীয় দর্শনের কথা। লগসবাদ গ্রীক্‌ তত্ত্ববিচারের একটী প্রধান অঙ্গ। ইহার আলোচনা এ স্থলে সম্ভব নহে। এই মাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, পণ্ডিতেরা এখন প্রায় একবাক্যে এ কথা স্বীকার করেন যে, খৃষ্টীয় লগসবাব, যাহার উপরে যিশুর দেবত্ব ও অবতারত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, জোহন কিম্বা যিনিই খৃষ্টীয় ধর্ম্মগ্রন্থের এই চতুর্থ পুস্তক রচনা করুন না কেন, ইহা গ্রীক্‌ সাধনা হইতে গ্রহণ করিয়াছেন। ইহুদার প্রাচীন তত্ত্ব বিচারে ইহার কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। গ্রীকেরা নিতান্তই সাকারোপাসক ছিলন। গ্রীসের তত্ত্বজ্ঞানীরা বিবিধভাবে এই সাকারোপাসনার দেবদেবীর ব্যাখ্যা করিয়া, গ্রীসের উচ্চতর তত্ত্বের সঙ্গে তাহার সামঞ্জস্য করিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ইহুদা ধর্ম্মে ও ইসলামে যেভাবে সাকারবাদ একান্তরূপে বর্জ্জনের চেষ্টা দেখা যায়, গ্রীসে তাহা কখনো দেখা যায় নাই। এই বিষয়ে গ্রীসের ও ভারতবর্ষের আর্য্যগণের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য দৃষ্ট হয়। গ্রীসের তত্ত্বজ্ঞানের আশ্রয়ে খৃষ্ঠীয় ঈশ্বরতত্ত্ব ফুটিয়া উঠে, সুতরাং ইহা যে নিতান্ত নিরাকার নহে, এ আর বিচিত্র কি!

খৃষ্টীয় ঈশ্বরতত্ব, সাকার-নিরাকার

 ফলতঃ তত্ত্ববস্তু, যাহা দ্বারা তাত্ত্বিকেরা এই জটিল বিখ-সমস্যার মীমাংসা করিতে চেষ্টা করেন, তাহা শুদ্ধ নিরাকারও নহে, শুদ্ধ সাকারও নহে; তাহা সাকারে নিরাকার ও নিরাকারে সাকার। আমাদের দেশের দার্শনিক পরিভাষাতে এই তত্ত্বকে ব্যক্ত করিতে গেলে এই বলিতে হয় যে, স্বরূপত তত্ত্ববস্তু নিরাকার, তটস্থ লক্ষণায় সাকার। অর্থাৎ বিশ্ব হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া যদি এই তত্ত্বকে ধরিতে যাই, তাহা হইলে, তাহাকে নিরাকাররূপেই ধরিতে হয়; কিন্তু এ নিরাকার অর্থে তখন বস্তুত নির্গুণ হইয়া দাড়ায়। কিন্তু বিশ্বের পরিণাম ও বিবর্ত্তনের সঙ্গে সংযূক্ত করিয়া, বিশ্বের কারণ, বিশ্বের নিয়ন্তা বিশ্বের উৎপত্তি, স্থিতি ও গতিরূপে যখনই এই পরমতত্ত্বকে ধরিতে যাই, তখনই তাহাকে সগুণ অর্থাৎ সাকারভবে ধরিতে হয়। এখানেও এক অর্থে এই তত্ত্ব নিরাকার ঘটে; সে অর্থ এই যে, ইহা কোনো আকার-বিশেষে আবদ্ধ নহে, অথচ সকল আকারেই বর্ত্তমান। স্বর্ণের যেমন নিজস্ব কোনো আকার নাই;— স্বর্ণ গোল, কি চতুষ্কোণ, কি ত্রিকোণ, এ কথা বলা যায়। ন।; অথচ কঙ্কণ, বলয়, হার, কুণ্ডলাদি সকল সাকার;—আমাদের দেশের দার্শনিকের তত্ত্ববস্তুকেও সেইরূপ সাকার-নিরাকাররূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। পৃষ্ঠায় ঈশ্বরতত্ব যে এভাবে সাকার ও নিরাকার, এমন বলা যায় না। কিন্তু অন্যভাবে ইহ। যে নিতান্ত নিরাকার নহে, ইহাও অস্বীকার করা অসম্ভব।

খৃষ্টয়ান ত্রিত্ববাদ বা ট্রিনিটি

 খৃষ্টীয়ান ঈশ্বরতত্ত্ব, খৃষ্ঠীয় ত্রিত্ব-বাদে বা ট্রিনিটিতেই বিশদৱাপে ধরিতে পারা যায়। পিতা, পুত্র, পবিত্রাত্মা,—এই তিনে মিলিয়া খৃষ্ঠীয় ঈশ্বরতত্ত্ব পূর্ণ হয়। কিন্তু ত্রিত্ববাদ বা ট্রিনিটি, ত্রীশ্বরবাদে বা ট্রাইথিজ্‌ম নহে; পিতাপুত্র, পবিত্রাত্মা, এ ভিন একান্ত পৃথক্‌ ও স্বতন্ত্র তত্ত্ব নহে, একই তত্ত্বের বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র। স্বরূপত এ তিনই এক, প্রকাশে পৃথক। One in Osia, different in hypostatis; Otsia ও lyp০statis, উষিয়া ও হাইপোক্টেটিস,এই দু ইটী গ্রীক্‌ শব্দের দ্বারা খৃষ্টীয়ান তত্ত্বজ্ঞানিগণ খৃষ্টীয় ত্রিত্ববাদের মর্ম্ম ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করিয়া থাকেন। Ousia উষিয়া শব্দের ইংরাজী অনুবাদ Essence, আমরা যাহাকে স্বরূপ বলিতে পারি; Hypostatis—হাইপোষ্টেটিস্ শব্দের ইংরাজী Appearance, আমরা যাহাকে প্রকাশ বলিতে পারি। অতএব পিতা, পুত্র ও পবিত্রাত্মা -ইহারা স্বরূপত এক, কিন্তু প্রকাশে ভিন্ন। পুত্রকে পিতারূপে গ্রহণ করা, খৃষ্টীয় সাধনায় অতি গুরুতর অপরাধ, অথচ পুত্রের ঈশ্বরত্ব অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করিয়া কেহ খৃষ্টীয়ান থাকিতে পারে না। ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, প্রকাশের দিক দিয়া পিতাপুত্রের মধ্যে যে বিভিন্নতা, ইহাও নিত্য। নিগুণ ব্রহ্মবাদে প্রকাশ মাত্রকেই মায়িক বলিয়া, তাহার পারমার্থিক সত্য অস্বীকার করে। খৃষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্বে পিতা ও পুত্রের মধ্যে যে বিভিন্নতা তাহাকে এইরূপ মায়িক বলে না, তাহা পারমার্থিক। মায়িক সৃষ্টিতেই বস্তু ও তাহার প্রকাশের মধ্যে যে সম্বন্ধ তাহা অস্থায়ী ও আকস্মিক; এখানেই স্বরূপে ও রূপে প্রভেদ অছে। মায়াতীত যে পরমতত্ত্ব, তাহাতে এই সম্বন্ধ নিত্য ও সত্য, সেখানে যাহা রূপ তাহাই স্বরূপ। ইহাই আমাদের বৈঞ্চব সিদ্ধান্ত। খৃষ্টীয় সিদ্ধান্তও কতকটা এই রূপই। Hypostatis ও Ousia দুই নিত্য ও স্থায়ী। অনাদিকাল হইতে, ঈশ্বর পিতারূপে, যিশু পুত্ররূপে ও পরিত্রাত্মা তাঁহাদের উভয়ের অঙ্গরূপে, এক ও পৃথক হইয়া বাস করিতেছেন। জোহনের লিখিত সুসমাচারের প্রথমেই এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। -In the beginning was the Word, the Word was with God, the Word was God.

 এই ত্রিত্ববাদের আলোচনাতে আমরা দেখিতে পাই যে, খৃষ্টীয় ঈশ্বর তত্ত্বও ঐকান্তিকভাবে নিরাকার নহে। কারণ এখানে “স্বরূপত” এক হইয়াও, যখন ঈশ্বর ও যিশু ও পবিত্রাত্মা, “রূপত” বা Hypostatis এ নিত্যকালেই পরস্পর হইতে পৃথক হইয়া আছেন, তখন “রূপত” অন্তত এই তিন তত্ত্ব যে পরস্পর হইতে পরিচ্ছিন্ন, ইহা অস্বীকার করা অসম্ভব। এবং আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, পরিচ্ছিন্ন তত্ত্ব মাত্রেই প্রকৃতপক্ষে সাকার। তবে জড় আকারসম্পন্ন এই অর্থে এস্থলে, সাকার শব্দ ব্যবহৃত হয় না। সাকার বলিতে চিদাকারও বোঝায়। আর আমাদের দেশের শাস্ত্রেতেও সাকার বলিতে প্রকৃত পক্ষে চিদাকারই ব্যক্ত হয়, জড়াকার নহে। এবং এই চিদাকার অর্থে, খৃষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্বও সাকার, অথবা নিরাকারে-সাকার বা সাকারে-নিরাকার।

খৃষ্টীয় সাধনায় সাকারবাদ।

 আর তত্ত্বেতে যদিও যিশু চিদাকার সম্পন্ন বলিয়াই প্রতিষ্ঠিত হন, খৃষ্টীয় সাধনাতে ফলত তাঁহাকে মানবাকারেই প্রতিষ্ঠিত করে। আমরা এদেশে, সাধন-ভজন বলিতে যাহা বুঝি, খৃষ্টীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্যাথলিক মণ্ডলীতেই কেবল তাহা ভাল করিয়া দেখিতে পাই। প্রোটেস্টেণ্ট্‌ মণ্ডলী মধ্যে বাইবেল পাঠ এবং প্রার্থনাই প্রধান, এমন কি একমাত্র সাধন-ভজন বলিয়া পরিগণিত হয়। ইংলওে, আংলিকান্ দলের মধ্যে এর চাইতে একটু বেশী ভজননিষ্ঠা দেখা যায় বটে। আমাদের এদেশে যে সকল প্রোটেস্টেণ্ট্‌ খৃষ্টীয় ধর্ম্মপ্রচারক আছেন, তন্মধ্যে অক্সফোর্ড মিশনের প্রচারকেরা এই অংলিকান্‌ দলভূক্ত। ইহাদের মধ্যে অনেকটা আচার নিয়মাদি দেখিতে পাওয়া যায়। আর ইহার অনেকটা রোমান্‌ ক্যাথলিক্‌দিগেরই মত। রোমান্ ক্যাথলিক্‌ খৃষ্টীয় মণ্ডলীতে যিশুখৃষ্ট্রের বিশেষ ভজনা হয়। এবং ইহারা খৃষ্টমূর্ত্তি ধ্যান করেন ও আপনাদের উপসনালয়ে যিশুখৃষ্টের, এমন কি যিণ্ড-মাতা মরিয়মের মূর্ত্তিও প্রতিষ্ঠিত করিতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করেন না। সুতরাং ইহাদের খৃষ্টোপাসনা যে সাকার, ইহা অস্বীকার করা যায় না।

 আর প্রোটেস্টেণ্টগণ যদিও খৃষ্টমূর্তির প্রতিষ্ঠা করিয়া তাহার ভজনা করেন না, কিন্তু ত্রুশকাষ্ঠে আত্মবলিদান করিয়া পুণ্যচরিত্র যিশু জগতের পাপের যে প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছেন, তাহার ধ্যান করিয়া থাকেন। Passion and Christ—যিশুর এই আত্মবলিদান সতত চিন্তা করিয়া যিশুর শোণিতে আপনাকে শুদ্ধ করিবে, -প্রোটেস্টেণ্ট খৃষ্টমণ্ডলী সকলেরই গভীরতম ধর্ম্মোপদেশ ইহাই! আর এই ভাবটী আয়ত্ত করিতে গেলেই যিশুর মূর্ত্তি ধ্যান করা আবশ্যক হইয়া উঠে। অতএব কোনো না কোন আকারে খৃষ্টীয় সাধনাও যে সাকারভাবাপন্ন ইহা মানিতেই হয়। তবে যে সকল খৃষ্টীয়ান সাধনজ্ঞানের ধার ধারেন না, কে বল চরিত্র শোধনে যাদের সমুদায় ধর্ম্মচেষ্টা পর্য্যবসিত হয়, যারা ধর্ম্মকে ভাবোদ্ভোসিত মরালিটিতে—মাথু আর্‌লণ্ড যাকে ধর্ম্ম বলিয়ছেন—সেই morality lit up by emotion- অধ্যাত্ম সম্পদ জ্ঞানে তাহারই অনুশীলন করেন, তাঁদের কথা স্বতন্ত্র। তাঁহাদিগকে খৃষ্টীয়ান সাধক বলিয়া না; ধরিলেও চলে।