জেলের খাতা/সাকার ও নিরাকার

প্রথম চিন্তা

গোটা দুই তিন কঠিন কথা

প্রথম অধ্যায়

সাকার ও নিরাকার

“ব্রহ্ম” শব্দ মুখ্য অর্থে কহে ভগবান্‌
চিদৈশ্বয্য-পরিপূর্ণ অনুর্দ্ধ সমান।
তাঁহার বিভূতি দেহ সব চিদাকার
চিদ্বিভূতি আচ্ছাদিয়া, কহে নিরাকার[১]

 ঈশ্বর সাকার না নিরাকার, বহুদিন হইতে এ দেশে এ বিচার চলিয়া আসিতেছে। বর্ত্তমানেই যে কেবল এক দল নিরাকারবাদী, প্রচলিত সাকারোপাসনার প্রতিবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহা নহে। প্রাচীনকাল হইতেই এ দেশে একদল নিরাকারোপাসক দেখিতে পাওয়া যায়।

 দ্বিবিধো হি বেদোক্ত ধর্ম্ম, প্রবৃত্তিলক্ষণো নিবৃত্তিলক্ষণশ্চ— (শঙ্কর গীতাভাষ্য)-বেদোক্ত ধর্ম্ম দ্বিবিধ, এক প্রবৃত্তিলক্ষণ, অপর নিবৃত্তিলক্ষণ। এই নিবৃত্তিমার্গে নিরাকারের ধ্যান-ধারণার চেষ্টা দেখিতে পাওয়া যায়। আধুনিক সাকারোপাসনাতে ও প্রাচীন বৈদিক কর্ম্মকাণ্ডে, এ দুয়ের মধ্যে প্রভেদ অনেক; তাহার আলোচনা এস্থলে ’অনাবশ্যক। আধুনিক নিরাকারবাদে ও বেদান্তপ্রতিষ্ঠিত জ্ঞানকাণ্ডেও পার্থক্য অনেক। শ্রুতি ব্রহ্মকে সবিশেষ ও নির্ব্বিশেষ, উভয়রূপেই প্রতিষ্ঠিত করিলেও, বেদান্তের ঝোঁক নির্ব্বিশেষেরই উপরে। কিন্তু বর্ত্তমানে নিরাকারবাদ যে আকার। ধারণ করিয়াছে, বেদান্তের নিরাকারবাদ তাহা হইতে অনেক ভিন্ন। তত্ত্বমসি-—এই মহাবাক্যই বেদান্তের শেষ কথা। ব্রহ্ম আত্মস্বরূপ—আত্মসাক্ষাৎকারে, অপরোক্ষানুভূতিতে,ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার লাভ হয়; আর সে অবস্থায় জ্ঞাত ও জ্ঞেয়ের ভেদজ্ঞান লুপ্ত হইয়া যায়। ব্রহ্মবস্তুকে জ্ঞেয়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে গেলেই জ্ঞাতার অধীন করা হয়, তাহার স্বাতন্ত্র্য আর থাকে ন॥ সুতরাং বিষয়জ্ঞানে জ্ঞাতাজ্ঞেয়ের ষে সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়, ব্রহ্মজ্ঞানে তাহা হইতে পারে না, জ্ঞেয়রূপে নহে, জ্ঞাতারূপেই ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার লাভ হইয়া থাকে। ইহাই প্রাচীন বৈদান্তিক নিরাকারবাদ। এই নিরাকাববাদ অদ্বৈত-তত্ত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত। নিরাকাববাদ না বলিয়া ইহাকে নির্গুন বা নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মবাদও বলা যাইতে পারে।

প্রাচীন নির্গুণ ব্রহ্মবাদ ও আধুনিক নিরাকার ব্রহ্মাবাদ

 এই প্রাচীন নির্গুণ ব্রহ্মবাদ ও আধুনিক নিরাকার ব্রহ্মবাদের মধ্যে প্রভেদ বিস্তর। আমদের নিরাকাববাদ ঠিক নির্গুণবাদ নহে। আমাদের নিরাকারবাদ অদ্বৈতবাদের নামান্তর নহে—ফলতঃ আধুনিক নিরাকারবাদী আচার্য্যগণ প্রায় সকলেই অদ্বৈত ব্রহ্মবাদকে বর্জ্জন করিতে উপদেশ দিয়াছেন। ঈশ্বর নিরাকার, কিন্তু নির্গুণ নহেন। তিনি স্রষ্টা, পাতা, পরিত্রাতা। তিনি পিতা, তিনি মাতা, তিনি সখা, তিনি পরমাত্মীয়। তিনি পুণ্যের পুরস্কর্ত্তা ও পাপের দণ্ডদাতা। এই সকলই ভেদাত্মক, দ্বৈততত্বেই এ সকলের প্রতিষ্ঠা। প্রাচীন নিরাকারবাদ অদ্বৈততত্ত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল; আধুনিক নিরাকারবাদ দ্বৈততত্ত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত। এ দুয়ের মধ্যে মূলতঃ প্রভেদ এই। দ্বৈতাদ্বৈতের বিচার এস্থলে অনাবশ্যক ও অপ্রাসঙ্গিক। দ্বৈতবাদই সত্য, না, অদ্বৈতবাদ সত্য,—এ প্রশ্ন এ স্থলে তোলা নিম্প্রয়োজন। বর্ত্তমান প্রসঙ্গে বিচার্য্য কেবল এইটুকু—দ্বৈততত্ত্বে প্রকৃত নিরাকারবাদের প্রতিষ্ঠা হয় কি না।

আকারের অর্থ কি

 যার আকার নাই, আকার সম্ভব নহে, তাহাই নিরাকার। কিন্তু এই আকার বলিতে কি বুঝি? আকারের লক্ষণ কি? সীমাবদ্ধ করাই কি আকারের মূল ধর্ম্ম নহে? আকাশের আকার নাই—কিন্তু যখনই ঘটের বা, পটের দ্বারা এই আকাশকে পরিচ্ছিন্ন ও সীমাবদ্ধ করি, তখনই ঘটাকাশ-পটাকাশের উৎপত্তি হয়। অন্য ভাষায় যাহাকে dimension কহে, তাহাই আকারের মৌলিক লক্ষণ। পরিচ্ছিন্নতাই এই dimensionএর প্রাণ। য।হা পরিচ্ছিন্ন নহে, তাহার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ভেদ নাই— থাকা অসম্ভব। সুতরাং যার আকার আছে, তাহাই পরিচ্ছিন্ন, তাহাই সীমা বদ্ধ। যাহা নিরাকায় তাহা অপরিচ্ছিন্ন ও অসীম। এখন প্রশ্ন এই দ্বৈতবস্তু মাত্রেই পরিচ্ছিন্ন কিনা? আর তাই যদি হয়, তবে দ্বৈতবাদে পরিচ্ছিন্ন ব্রহ্ম বা ঈশ্বরতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করে কি না? এবং তাহা হইলে, দ্বৈতবাদীমাত্রেই, প্রকৃতপক্ষে, সাকারবাদী কি না?

দ্বৈতবাদ ও সাকারবাদ

 দ্বৈতবাদ তিনটী পরস্পর পরিচ্ছিন্ন তত্ত্ব সর্ব্বথাই প্রতিষ্ঠিত করিয়া থাকে। প্রথম ঈশ্বরতত্ত্ব, দ্বিতীয় জীবতত্ত্ব, তৃতীয় জড়তত্ত্ব। ঈশ্বর, জীব ও জড় হইতে পৃথক্‌; জীব, ঈশ্বর ও জড় হইতে ভিন্ন;—ইহাই দ্বৈতবাদের সিদ্ধান্ত। ঈশ্বরের সঙ্গে জীব ও জড়ের সম্বন্ধ যেরূপই নির্দিষ্ট হউক না। কেন,~যতক্ষণ জীব ও জড় হইতে তিনি পৃথক ও পরিচ্ছিন্ন,—ততক্ষণ জীব ও জড়ের দ্বারা তিনি সীমাবদ্ধ। আপাতত ইহাই দ্বৈত সিদ্ধান্তের অপরিহার্য্য পরিণাম বলিয়া সকলেরই মনে হইবে। কিন্তু ঈশ্বরতত্ত্বকে কোনরূপে সীমাবদ্ধ করিলে, তাহার সত্য নষ্ট ও মর্য্যাদা হানি হয়। সুতরাং দ্বৈতবাদী, ঈশ্বরতত্ত্বের অসীমত্ব ও সর্ব্বথা ব্যাপকত্ব রক্ষা করিবার জন্য বিশিষ্টাদ্বৈত এবং দ্বৈতাদ্বৈত প্রভৃতি সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। কিন্তু এ সকল সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করিতে যাইয়া, জীব ও ভগবানের পার্থক্য রক্ষা করিবার জন্য, তাঁহারা কোনো না কোনো আকারে সাকারবাদও প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। ঐতিহাসিক আলোচনায় দেখি যে, যেখানেই বিশুদ্ধ অদ্বৈত সিদ্ধান্ত পরিতাক্ত হইয়াছে, সেইখানেই কোনো না কোনো আকারের সাকারবাদ অবলম্বিত হইয়াছে।

খৃষ্টীয়ান্‌ ও বৈষ্ণব তত্ত্ব

 পাদ্রিরা যাই বলুন না কেন,—এ তত্ত্বের অনুশীলন যারা করেন, তাঁরা কৃষ্ণতত্ত্বের সঙ্গে খৃষ্টতত্ত্বের আশ্চর্য্য সাদৃশ্য দেখিতে পান। বাহিরের সাদৃত্যের-কৃষ্ণের জন্মলীলা ও খ্রষ্টের জন্ম-বিবরণের মধ্যে যে অদ্ভূত ঐক্য দেখা যায়,—কংশ ও হীরডের কাহিনী,”এ সকলের মূল কি, পণ্ডিতেরা তাহার কিছু কিছু আলোচনা করিয়াছেন। কিন্তু সে বিচার এ স্থলে অপ্রাসঙ্গিক। তত্ত্বের দিক্‌ দিয়াই বৈষ্ণব ধর্ম্মের সঙ্গে খৃষ্টীয়ান ধর্ম্মের বিশেষ সাদৃশ্য দেখা যায়। উভয়ই ভক্তি-পন্থা সুতরাং উভয়ই সমজাতীয় ধর্ম্ম, এ সাদৃশ্যের ইহা এক কারণ। আর ভক্তি-পন্থা বলিয়া, উভয়ই শুদ্ধ অদ্বৈততত্ত্বের বিরোধী এবং দ্বৈতসিদ্ধান্তের পক্ষপাতী। এই জন্য খৃষ্টীয়ান ও বৈষ্ণব উভয়েই এক অর্থে সাকারবাদী।

খৃষ্টীয় সাকারবাদ

 বৈষ্ণবেরা ইহাতে লজ্জিত নহেন, জানি। কিন্তু খৃষ্টীয়ানেরা এ কথাতে নিরতিশয় ব্যথিত হইবেন। তাঁহাদিগকে ব্যথিত করা আমার ইচ্ছা নহে। সাকারবাদ ঘলিতে, এখানে আমি কাষ্ঠ-লোষ্ট্রের উপাসনা বা প্রচলিত প্রতিমাপূজা নির্দ্দেশ করিতেছি না। খৃষ্টীয়ানেরা যে ঈশ্বরকে জড়-আকার সম্পন্ন মনে করেন, এমন কথা আমি বলি না। আর খৃষ্টীয়ান বধূগণ যদি বৈঞ্চবতত্ত্বের আলোচনা ভাল করিয়া, সংস্কার-বর্জ্জিত হইয়া, করেন তবে এও দেখিবেন যে বৈষ্ণবেরাও ঈশ্বরে কোন প্রকারের জড় স্বভাব আরোপিত বা কল্পিত করেন না। বৈষ্ণব ঈশ্বরতত্ত্ব সাকার বটে, কিন্তু চিদাকার। খৃষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্বও কি তাহাই নহে?

বাইবেল কি বলে।

 বাইবেলের ঈশ্বরতত্ত্ব মোটামুটি দুইভাগে বিভক্ত হয়। এক পুরাতন ইহুদাধর্মের ঈশ্বরতত্ব, আর এক যিশুখৃষ্ট ও তাঁহার প্রথম শিষ্যদিগের বা নিউ টেষ্টেমেণ্টের ঈশ্বরতত্ত্ব। ইহুদার ঈশ্বরতত্ত্ব যে একান্ত নিরাকার নহে, পণ্ডিতেরা এখন প্রায়। একবাক্যে এ কথা স্বীকার করেন। পুরাতন পুস্তকে বা ওল্ড্‌ টেষ্টেমেণ্টে ঈশ্বরের কোনো আকার নির্দ্দেশ করে না, সত্য; কিন্তু নানাভাবে নানাদিক্‌ দিয়া, তাঁহাতে মানবধর্ম্ম আরোপিত করে, এ কথা অস্বীকার করা অসম্ভব। সুতরাং ইহুদার ঈশ্বরতত্ত্ব নিতান্ত নিরাকার এমন সিদ্ধান্ত হয় না। খৃষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্ব তদপেক্ষা সূক্ষ্মতর সন্দেহ নাই,~কিন্তু ইহাও একান্ত নিরাকার নহে।

খৃষ্টীয় ঐশ্বর্য্যবৃদ্ধি

 খৃষ্ট-পন্থা ভক্তি-পন্থা; সুতরাং এখানে ভগবদৈশ্বর্য্যের অনুশীলন স্বাভাবিক; ইহুদার ধর্ম্মশাস্ত্রে ভগবদৈশ্বর্য্যের বিস্তর বর্ণনা আছে,— দাউদের গীতে তাহার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়। কিছু সে সকল বর্ননা সহজ ও স্বাভাবিক। আমাদের শ্রুতিতেও এই শ্রেণীর ঐশ্বর্য্যজ্ঞান অতি পরিস্ফুট দেখিতে পাই। কিন্তু খৃষ্টীয় ভগবদৈশ্বর্য্যের অনুশীলন, বৈদিক নহে, পৌরাণিক।

ঈশ্বরের সিংহাসন

 দৃষ্টান্তস্বরূপ, জোহন লিখিত Book of Revelation—বর্ত্তমান খৃষ্টীয় ধর্ম্মগ্রন্থের শেষ পুস্তকের উল্লেখ করা যাইতে পারে। জোহন অধ্যাত্ম-দৃষ্টিতে ঈশ্বরের দরবারের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়া, এই পুস্তকের চতুর্থ অধ্যায়ে তাহার বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি অধ্যাত্মশক্তি ন।ভ করিয়া দেখিলেন- A throne was set in heaven and One sat on the throne- স্বর্গে (আকাশে?) একটা সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, এবং “একজন” ঐ সিংহাসনে উপবেশন করিয়া আছেন। এই “একজনের” কোনো বিশেষ আকারের বর্ণনা নাই, কিন্তু তাঁহার আভার বর্ণনা আছে।

 And He, that sat, was to look upon like a jasper and a sardine stone, and there was a rainbow round about the throne, in sight like unto an emerald.

 “আর যিনি বসিয়ছিলেন তাঁহাকে “জ্যম্পার” বা “সার্ডিন্‌” মণির মত দেখাইতেছিল; ঐ সিংহাসনের চারিদিকে মরকতের ন্যায় আভাযুক্ত ইন্দ্রধনু শোভা পাইতেছিল।”

 And out of the throne proceeded lightnings and thunderings and voices, and there were seven lamps of fire burning before the throne, which are the seven Spirits of God.  আর এই সিংহাসন হইতে বিদ্যুৎ বজ্রনিনাদ ও বিবিধ বাণী প্রসৃত হইতেছিল, এবং এই সিংহাসনের সম্মুখে সাতটি দীপ জ্বলিতেছিল। এই সপ্ত দীপ ঈশ্বরের সপ্তপ্রাণ বা আত্মা।

জোহনের ঈশ্বর সাকার না নিরাকার

 জোহন যদিও ঈশ্বরের আকার অনির্দ্দিষ্ট রখিয়াছেন, তথাপি এই ঈশ্বর যে একান্ত নিরাকার নহেন, এই বর্ণনায় ইহা অতি পরিস্কার ভাবেই প্রমাণিত হয়।

 প্রথমত সিংহাসনে বসিতে যাইয়াই তিনি দেশে আবদ্ধ হইয়াছেন। দ্বিতীয়ত তাঁহার সপ্ত ‘স্পিরিটের’ উল্লেখ হইয়াছে। যিশুখৃষ্ট ঈশ্বরকে এই ‘স্পিরিট’ রূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। God is Spirit and ye shall worship God in Spirit and in Truth.—ঈশ্বর স্পিরিট, তোমরা স্পিরিটে ও সত্যভাবে তাঁহার ভজনা করিবে। এই স্পিরিট বস্তু যে কি, নির্দ্ধারণ করা কঠিন। স্পিরিট বলিতে প্রাণ বুঝায়, আত্মা বুঝায়, শৌর্য্য বুঝায়, শক্তি বুঝায়, অন্তরের ভাবও বুঝায়। আমাদের আত্মা শব্দ যেমন বহু অর্থ-ব্যঞ্জক, ইংরাজী স্পিরিটও সেইরূপ। মোটের উপর God is Spirit, ঈশ্বর প্রাণস্বরূপ, এই বলিলেই, বোধ হয়, ইহার মর্ম্ম প্রকাশিত হয়। তোমরা প্রাণের সঙ্গে, সত্যভাবে,তাঁহার ভজনা করিবে। অন্তত: যিশু এই স্পিরিট শব্দ দ্বারা ঈশ্বর নিরাকার এমন অর্থ ব্যক্ত করিতে চাহিয়াছিলেন, মনে হয় না। কারণ, এরূপ বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি ইহুদীদিগকে উপদেশ দিতেছিলেন। আর যিশুর সময়ে ইহুদায় কোনোপ্রকারের সাকারোপাসনা প্রচলিত ছিল না। ইহুদাধর্ম্ম সে সময়ে বাহ্য ক্রিয়াকলাপে আবদ্ধ হইয়া প্রাণশূন্য হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার অন্তমুর্খিনতা লোপ পাইয়াছিল। যিশু সর্ব্বোতোভাবে ইহুদার এই বহিমুর্খিনতারই বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেন। সুতরাং-God is Spirit. —ইত্যাদি উপদেশ সাকারোপাসনার প্রতিবাদ রূপে গ্রহণ করা সঙ্গত নহে। সে যাই হোক, এখানে জোহন ঈশ্বরের সপ্ত স্পিরিট বা সপ্তপ্রাণের উল্লেখ করিয়াছেন। এই সপ্তপ্রাণ, Seven Spirits of God সপ্ত প্রদীপ হইয়া এই সিংহাসনের সম্মুখে জ্বলিতে ছিল। ঈশ্বরের অঙ্গকান্তিরও বর্ণনা আছে-“Was to look upon like a jasper or saidine stone—কেবল অঙ্গের বর্ণনাই নাই। কিন্তু তাহা না থাকিলেও ঈশ্বর-স্বরূপের যে আভাস এখানে দেওয়া হইয়াছে, তাহা চাক্ষুষভাবে নিতান্ত স্থূল অর্থে সাকার না হইলেও, একান্ত নিরাকার, এমনই কি বলা যায়? ফলত, জোহন যখন বলিতেছেন যে —

 I saw in the right hand of Him that sat on the throne a book.

 যিনি সিংহাসনে বসিয়াছিলেন, তাঁহার দক্ষিণ দিকে আমি একখানা পুস্তক দেখিয়াছিলাম—তখন তাঁহার আকার প্রতিষ্ঠারই বা বড় বেশী বাকী রাখিয়াছেন কৈ? অন্তত বাম দক্ষিণ নির্দ্দেশ করিয়া তাঁহাকে পরিচ্ছন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, ইহা মানিতেই হইবে। অবশ্য “আধ্যাত্মিক” ব্যাখ্যা সকল পৌরাণিক কাহিনীতেই প্রযুক্ত হইতে পারে।

খৃষ্টের মুর্ত্তি

 জোহন ঈশ্বরের কোনো আকারের উল্লেখ না করিলেও খৃষ্টকে নিতান্ত সাকাররূপেই প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। খৃষ্টের ইহলোকে মানুষী দেহ ছিল। দেহ স্বর্গে দেখা গেল না। জোহনের উক্তি পাঠে মনে হয় যে, খৃষ্টের মানুষী দেহ, তাঁহার স্বরূপ-দেহ নহে, যদিও ঐ রূপেতেই তিনি স্বর্গারোহণের পরেও শিষ্য-মণ্ডলী সমক্ষে উপস্থিত হইয়াছিলেন, সে কেবল তাঁহাদের প্রতীতির জন্য। স্বর্গে, ঈশ্বরের সিংহাসনে,—তিনি স্বরূপত বিরাজ করিতেছিলেন। এই স্বরপ তাঁর মেষরূপ, সপ্তশৃংগযুক্ত ও সপ্তচক্ষুষ্মান।

 And I beheld, and lo! in the midst of the throne. ..... stood a Lamb as it had been slain, having seven eyes, which are the seven Spinits of God sent forth into all the earth.

চিৎ-আকার

 কিন্তু স্থূল- দৃষ্টিতে ঘদিও এ সকল আপাতত স্থূল বলিয়াই বোধ হয়, ফলত জোহনের এই বর্ণনাতে কোনো তত্ত্বজ্ঞ খৃষ্টীয়ানই চাক্ষুষরূপ কল্পনা করেন না। ঈশ্বর নিরাকার—"স্পিরিট”—; যিশুও ঈশ্বরেরই অঙ্গ, ঈশ্বরের সঙ্গে নিত্যযুক্ত, ঈশ্বর হইতে আকারে (Hypostatisএ) ভিন্ন, কিন্তু স্বরূপত একাত্ম ও একই রূপ; সুতরাং যিশুও নিরাকার—“স্পিরিট”; কিন্তু এ নিরাকার চিদাকার অস্বীকৃত হয় না। খৃষ্টীয় ঈশ্বরতত্ব, খাঁটি নিরাকার নছে, কিন্তু চিদাকার সম্পন্ন। বৈষ্ণবতত্ত্বও তাহাই।

নিরাকার—অতীন্দ্রিয়

 মোট কথা, দেখিতে পাই এই যে, দ্বৈতবাদে যে ঈশ্বরতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তাহা প্রকৃত অর্থে একান্ত নিরাকার না হইলেও, অর্থাৎ জীবের ও জড়ের পক্ষে তাহার ঐকান্তিক বিভিন্নতা নিবন্ধন, এই তত্ত্ব স্বল্পবিস্তর সীমাবদ্ধ হইলেও, নিরাকার বলিতে খৃষ্টীয়ান প্রভৃতি দ্বৈতবাদিগণ কেবলই অতীন্দ্রিয় বুঝিয়া থাকেন। আর তাই যদি হয়, তবে যাঁহাদিগকে সাকারবাদী বলা হয়, তাঁদের, সকালের সঙ্গে না হউক, অন্তত অনেকেরই সঙ্গে এই সকল নিরাকারবাদীদের বিবাদের মূল নষ্ট হইয়া যায়। কারণ, বৈষ্ণব প্রভৃতি সাকারবাদিগণ কেহই ঈশ্বরে প্রাকৃত আকার আরোপ করেন না।

দ্বৈতবাদে ঈশ্বরতত্ত্ব

 বিশেষত সকল দ্বৈতবাদীই প্রতিমার উপাসনা করেন না। কিন্তু দ্বৈতবাদেই, অলক্ষিতেই হউক অথবা জ্ঞাতসারেই হউক, ঈশ্বরে নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট কোনো না কোনো আকার আরোপিত হইয়া থাকে। আর ইহা দেখা যায় যে, যে ঈশ্বরবাদ সাকারবাদের যত তীব্র প্রতিবাদ করে, তাহাই স্বয়ং সে পরিমাণে সাকার।

 ফলত, যে সকল ধর্ম্মে প্রতিমা-পূজাকে পাপ বলিয়া বর্জ্জন করিতে বলে, তৎসমুদয়েরই ঈশ্বরতত্ত্ব কোনো না কোনো আকারে সাকার। বাইবেলের পুরাতন পুস্তকে, ঈশ্বরের কোনো প্রতিমূর্ত্তি রচনা করা নিষিদ্ধ হইয়াছে। এই নিষেধ ইহুদী ধর্ম্মের। মোহম্মদীয় ঈশ্বরতত্ত্ব বহুল পয়িমাণে ইহুদীয় ঈশ্বরতত্ত্বের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং ইস্‌লামেও প্রতিমূর্ত্তি রচনা নিষিদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু এই নিষেধের মূল কি?

ইহুদীর দশাজ্ঞা

 ইহুদীর গ্রন্থ হইতে খ্রীষ্টিয়ান ধর্ম্মগ্রন্থের “দশাজ্ঞা” সংগৃহীত। বাইবেলে বলে,

 And God spake all these words saying,

 I am the Lord thy God, which have brought thee out of the land of Egypt, out of the house of bondage.

 Thou shalt have no other gods before me.

 Thou shalt not make unto thee any graven image or any likeness of anything that is in heaven above or that is in the earth beneath, or that is in the water under the earth.

 Thou shalt not bow down thyself to them, nor serve them; for I, the Lord thy God, am a jealous God.

 খৃষ্টীয়ানেরা এই “আজ্ঞার” বলেই সাকারোপসনাকে পাপ বলিয়া গণনা করেন। কিন্তু ইহুদী ধর্ম্মকে প্রকৃতপক্ষে একেশ্বরবাদ বলা যায়। কি না, পণ্ডিতেরা এখন এই প্রশ্নই তুলিয়াছেন। ফলতঃ পুরাতন বাইবেল পাঠে, ইহুদার ঐকান্তিক একেশ্বরবাদের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইহুদা ধর্ম্ম জাতিগত ধর্ম্ম,—ইংরেজীতে ইহাকে এথ্‌নিক রিলিজিন—Ethnic religion কছে। এই সকল এথ্‌নিক বা জাতীয় বা গ্যাশন্যাল ধর্মের লক্ষণই এই যে, এ সকলে অপরাপর জাতির বা দেবতাদির সত্য বা অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। ইহুদার ঈশ্বর ইহুদার, মিশরের ঈশ্বর মিশরের। ইহুদার পক্ষে মিশরের ঈশ্বরের ভজনা পাপ, বিজাতীয় দেবতার উপাসনা একান্ত নিষিদ্ধ। ইহাই প্রাচীন ইহুদার। “একেশ্বরবাদের” অর্থ। বর্ত্তমান সময়ে পণ্ডিতেরা, এই জন্য ইহুদারধর্ম্মকে একেশ্বরবাদী ধর্ম্ম, বা মনোথিইজম্ (Monotheism) বলিতে, কুণ্ঠিত হন। তাঁহারা ইহাকে এখন একদেবোপাসনা বা মনোল্যাট্রি Monolatry বলিয়া থাকেন।

একদেবোপাসনা

 এই একদেবোপাসনায় অন্য দেবতার অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয় না, অপর দেবতার আরাধনা মাত্র নিষিদ্ধ হয়। প্রাচীন ইহুদা ধর্ম্মে অপর দেবতার অস্তিত্ব পরিস্কাররূপে মানিয়ছে। প্রথম প্রথম ইহুদার দেবতা যে, এই সকল অপর দেবতা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, এমন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার পর্যন্ত কোনো চেষ্টা দেখা যায় না। ক্রমে ইহুদার দেবতাকে অপর সকল দেবতার উপরে স্থাপন করিবার চেষ্টা ফুটিয়া উঠে। দাউদের গীতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়।

 In the council of the gods sits God: He judgeth among the gods.

 দেবতাদের সভায় ঈশ্বর উপস্থিত হইয়া তাঁহাদের বিচার করিতেছেন, আর বলিতেছেন

 How long will ye judge unjustly

 আর কত কাল তোমরা অন্যায়রূপে লোকের বিচার করিবে?

 এবং শেষে দেবতাদিগকে শাসাইয়া ভয় দেখাইতেছেন, তাঁরা যদি অন্যায় পথ বর্জ্জন না করেন তবে,

 I have said ye are gods, and all of you are children of the Most High; but ye shall die like men, and fall like one of the princes,

 যদিও আমি বলিয়াছি যে, তোমরা অমর, এবং সত্যই তোমরা সকলে সর্ব্বোত্তম পুরুষের সন্তান, কিন্তু তথাপি তোমরা মনুষ্যের ন্যায় মরিবে এবং এই সংসারের রাজাদের ন্যায় তোমাদের অধঃপতন হইবে।

 এস্থলে একরূপ বহুদেববাদেরই আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা বহুদেববাদ নহে। দেবতার অস্তিত্ব মানিলেই বহুদেববাদী বা polytheist হয় না। একেশ্বরবাদের সঙ্গে যেমন মানবের অস্তিত্বের কোনো বিরোধ নাই, মানবের চাইতে শ্রেষ্ঠতর ও উন্নততর যদি কোনো লোক থাকে, তারই বা বিরোধ হইবে কেন? হিন্দুদের যাঁরা বহুদেববাদী কহেন, তাঁরা দাউদের এই গীতকে প্রমাণ্য খৃষ্টীয় শাস্ত্র বলিয়া যদি স্বীকার করেন, তবে খৃষ্টীয়ানদিগকেও বহুদেববাদী বলিতে বাধ্য হইবেন। ফলত খৃষ্টীয়ান ও হিন্দু, দুয়ের কেহই বহুদেববাদী বা পলিখিইষ্ট নহেন।  কিন্তু এখানে (৮২ দাউদের গীত) যদিও ইহুদার ঈশ্বরের একছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত দেখিতে পাই, বাইবেলের পুরাতন পুস্তকের আদিভাগে তাহাও দেখা যায় না। সেখানে ইহুদার ঈশ্বর ইহুদারই ঈশ্বর, ইহুদারই পূজ্য, ইহুদীদিগের সঙ্গেই তাঁর বিশেষ সম্পর্ক, এই মাত্রই দেখি। অপর জাতির অন্য দেবতা আছেন, থাকুন; যতদিন সে সকল জাতি ইহুদার সঙ্গে বিরোধ করিতে না আসে ও ইহুদার উন্নতির পথে না দাঁড়ায়, ততদিন ইহুদার ঈশ্বরও সে সকল জাতির দেবতার সঙ্গে কোনো প্রকারের প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ত হন না।

এথ্‌নিক বা সামাজিক ধর্ম্ম।

 বস্তুত এথ্‌নিক ধর্ম্মমাত্রেই সামাজিক বন্ধন রক্ষা করিবার প্রাণপণ চেষ্টা দৃষ্ট হয়। সমাজ-বন্ধনের উপরেই এথ্‌নিক ধর্ম্মসকল প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং সমাজের ঘননিবিষ্টতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য এথ্‌নিক ধর্ম্ম সর্ব্বদাই সচেতন থাকে। অন্য সমাজের সঙ্গে আপন সমাজের লোক যাহাতে না মিলিয়া মিশিয়া যাইতে পারে, এই জন্য এথ্‌নিক ধর্ম্মে নানাবিধ বিধি নিষেধ প্রতিষ্ঠিত থাকে। ইহুদার দশ আজ্ঞায় সাকারোপাসনার বিরুদ্ধে যে আদেশ দেখিতে পাই, তাহার প্রকৃত মর্ম্ম অপর দেবোপাসনা নিবারণ করা, সাকারবাদ পরিহার করা নহে। কারণ, যে জিহোবা এই আজ্ঞা প্রচার করেন, তিনি স্বয়ংই জড় আকারবিশিষ্ট হউন বা না হউন, অন্ততঃ পরিচ্ছিন্ন স্বভাবসম্পন্ন এবং সেই অর্থে যে অবশ্যম্ভাবিরূপেই সাকার, ইহা অস্বীকার করা অসম্ভব। কেবল তাহাই নহে, মুসাই এই দশাজ্ঞা প্রাপ্ত হন। জিহোবা যে মুসার অন্তরে এই সকল বিধি প্রকাশ করেন, তাহা নহে। মুসা আমাদের ঋষিদের ন্যায় মন্ত্র “দর্শন” করেন নাই। জিহোবা দুই খণ্ড প্রস্তর ফলকে এই দশটী আজ্ঞা আপনার অঙুলি দ্বারা খোদিত করিয়া মুসার হস্তে প্রদান করেন।  And He gave unto Moses, when he had made an end of commuuning with him upon Mount Sinai, two tables of stone, oritted with the fingers of God.

 ইহুদার ঈশ্বর যে নিতান্তই “সাকার” ছিলেন, এর চাইতে তবে। দৃঢ়তর প্রমাণ আর কি দেওয়া যাইতে পারে? হিন্দু সাকারবাদও এর চাইতে বেশী “সাকার,” এ কথা বলা যায় কি না সনেহ। জিহোবার সাকারত্বের আরো অনেক প্রমাণ আছে, ইহুদার ঈশ্বরতত্ত্বের অনুশীলনের অবসর পাইলে সে সকল বিষয় আলোচনা করা যাইতে পারে।

  1. চৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি~প্রকাশানন্দের সহিত বিচার। চৈঃ চঃ অঃ সপ্তম পরিচ্ছেদ।