জোড়া পাপী/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
কোন কার্য্য দেখিয়া তাহার ফল অনুমান করা যায় না। এই যে কিছুক্ষণ পূর্বে ভয়ানক ঝড় ও বৃষ্টিতে না জানি কতই কষ্ট ভোগ করিলাম এবং মনে মনে ঈশ্বরকে শত শত গালি দিলাম, তাহার ভিতর মঙ্গলময় যে আমার উদ্ধারের উপায় করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহা কি তখন জানিতে পারিয়াছিলাম? তখন কি জানিতাম যে, সেই ঝড়ে নারিকেলবৃক্ষটা পড়িয়া যাইবে এবং সেই পতনে ঐ অন্ধকূপের সুড়ঙ্গদ্বার ভাঙ্গিয়া যাইবে? কখনও না। তাই বলিতেছি, মঙ্গলময়ের কার্য্য সমস্তই মানবের মঙ্গলের জন্য। আমরা সামান্য প্রাণী, তাঁহার কার্যের কি বুঝিব?
দেখিতে দেখিতে রাত্রি প্রভাত হইল। উষার আলোক প্রকটিত হইব। মাত্র আমি মুখাদি প্রক্ষালন করিলাম। যে যে স্থানে ক্ষতবিক্ষত হইয়া গিয়াছিল, গঙ্গার জলে সেই সকল স্থান উত্তমরূপে ধৌত করিলাম এবং কাপড় ভাল করিয়া পরিধান করিয়া বসিয়া রহিলাম।
কিছুক্ষণ পরেই এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ একখানি নামাবলী গায়ে দিয়া হরিনাম করিতে করিতে ঘাটে আগমন করিলেন। বৃদ্ধ হইলেও ব্রাহ্মণের বেশ ক্ষমতা ছিল। তাহার শরীর বেশ দৃঢ় ও সবল বলিয়া বোধ হইল। ঘাটে আসিয়া ব্রাহ্মণ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং আমাকে অপরিচিত দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়ের বাড়ী কোথায়? এত প্রত্যুষে স্নান করিতে আসিয়াছেন?”
ব্রাহ্মণের মিষ্ট কথায় আমি তাহার নিকটে যাইলাম। পরে অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, “আমি স্নান করিতে আসি নাই, আর আমার বাড়ীও চন্দননগরে নহে। নরেন্দ্রনাথ মুখো নামে একজন লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে আমি কলিকাতা হইতে এতদূরে আসিয়া পড়িয়াছি। কিন্তু যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করিয়া তাঁহার কোন সন্ধান পাইতেছি না।”
আমার কথায় ব্রাহ্মণ আরও বিস্মিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা কহিলেন, “কে নরেন—হাটখোলার নরেনবাবু?”
শশব্যস্ত হইয়া আমি বৃদ্ধের কথায় সায় দিলাম। বলিলাম, “আপনি যথার্থ ই হনুমান করিয়াছেন। যদি তিনি আপনার পরিচিত হন, তাহা হইলে দয়া করিয়া আমাকে তার বাড়ী দেখাইয়া দিলে উপকৃত হইব।”
ব্রাহ্মণ হাসিয়া বলিলেন, “সে কি কথা! আমার স্নান শেষ হইলে যখন বাড়ী যাইব, তখন আপনিও আমার সঙ্গে যাইবেন। নরেনবাবুর বাড়ী আমাদেরই বাড়ীর নিকট। আশ্চর্য্য এই যে, আপনি এত চেষ্টা করিয়া তাহার ন্যায় সজ্জনের সন্ধান পাইলেন না।”
এই বলিয়া ব্রাহ্মণ স্নানার্থে গমন করিলেন, আমি ও তাঁর অপেক্ষায় সেই স্থানে বসিয়া রহিলাম।
প্রায় অর্দ্ধঘণ্টাকাল গঙ্গাগর্ভে থাকিয়া ব্রাহ্মণ ঘাটে উঠিলেন। পরে সেখানে অ'হ্নক জপ প্রভৃতি সমাধা করিয়া আমার নিকটে আসিয়া বলিলেন, “এইবার চলুন।”
প্রায় অর্দ্ধক্রোশ পথ গমন করিবার পর এক প্রকাণ্ড দ্বিতল অট্টালিকার সম্মুখে তিনি দণ্ডায়মান হইলেন এবং আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “ইহাই নরেনবাবুর বাড়ী।”
ব্রহ্মণের কথা শেষ হতে না হইতে একজন গৌরকান্তি হৃষ্টপুষ্ট প্রৌঢ় সেই অট্টলিকার দ্বার উদঘাটন করিলেন, এবং সম্মুখেই আমার সমভিব্যাহারী ব্রহ্মণকে দেখিয়া অতি বিনীতভাবে বললেন, “আজ আমার সুপ্রভাত, নতুবা এই প্রাতে আপনার ন্যায় সাধুব্যক্তির চরণ দেখিতে পাইব কেন?”
বাধা দিয়া ব্রাহ্মও হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “উভয়ত, প্রত্যুষে অপর ন্যায় সজ্জনের সহিত সাক্ষাৎ হওয়া সামান্য ভাগ্যের কথা নহে। এখন ও সকল কথা ছাড়িয়া দিন, এই বাবু আনার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন।”
এই বলিয়া ব্রাহ্মণ প্রস্থান করিলেন। নরেন্দ্রনাথ আমার নিকট আসিয়া অতি নম্র ভাবে বলিলেন, “মহাশয়ের নাম?”
আমি প্রকৃত নাম না বলিয়া আর একটা নাম বললাম কিন্তু পদবীর পরিবর্তন করিলাম না।
“কোথা হইতে আসা হইতেছে?” কলিকাতা।”
“কি জন্য?”
“সে সকল কথা সকলের সমক্ষে বলা উচিত নহে।”
“তবে আসুন, বাড়ীর ভিতরে আসুন।”
এই বলিয়া আমাকে লইয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন এবং নীচের একখানি ঘরে বসিতে অনুরোধ করিলেন।
নরেন্দ্রবাবুকে দেখিয়া এবং তাঁহার সহিত কথাবার্তা কহিয়া তাহাকে অতি সজ্জন বলিয়াই বোধ হইল। তিনি যে সেই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডে যোগদান করিবেন, তাহা আমার বিশ্বাস হইল না। কিন্তু একবার প্রবঞ্চিত হইয়া তাহার ন্যায় দেব চরিত্রের উপরেও সন্দেহ জন্মিল। ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, আপনার একখানি পাখা অমর হস্তগত হইয়াছে। তাহাতে আপনার নাম ধাম লেখা আছে। সেই লেখা দেখিয়া আমি এতদুরে আসিয়া আপনার সন্ধান পাইয়াছি।”
নরেন্দ্রনাথ অধিকতর অশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার পাখা? আমার এক প্রজা আমায় দুইখানি করিয়া তালপাখা দিয়া থাকে। আমি প্রতিবারই উহাদের উপর নিজের নাম ধাম লিখিয়া থাকি। কিন্তু আমার পাখা আমাদের বাড়ীতেই ত আছে।”
আমি বলিলাম, “আপনি অনুগ্রহ করিয়া একবার দেখিয়? আসুন, আপনার পাখা ঘরে আছে কি না?”
নরেন্দ্রনাথ তখনই বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন এবং অনতিবিলম্বে প্রত্যাগমন করিয়া বলিলেন, “না মহাশয়! দুইখানি পাাখার মধ্যে একখানি রহিয়াছে—অপরানি আমার স্ত্রী এক দূর-সম্পর্কীয়া ভগিণীকে দিয়াছেন। সম্ভবতঃ সেই পাখাখানিই আপনি দেখিয়া থাকিবেন।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাহার বাড়ী কোথায়?
ন। চন্দননগরে।
আ। এখান হইতে কতদূর?
ন। অধিক দূর নহে—প্রায় এক ক্রোশ হইবে।
আ। তাঁহার স্বামীর নাম? কেশবচন্দ্র শর্ম্মা।
আ। তাঁহার সহিত এখন সাক্ষাৎ হইতে পারে?
ন। সে কথা ঠিক বলিতে পারিলাম না। একবার আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসি।
এই বলিয়া তিনি ভিতরে গেলেন। ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “না মহাশয়, তাহার সহিত আর এখানে দেখা হওয়া অসম্ভব, তিনি পর রাত্রের ট্রেনে কলকাতায় গিয়াছেন।”
আ। সস্ত্রীক?
ন। আজ্ঞে।
আ। তবেই হইয়াছে, তাঁহার স্ত্রী আর এ জগতে নাই।”
আমার কথায় বাধা দিয়া নরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি! কি ভয়ানক সংবাদ দিতেছেন? বাড়ীতে জানিতে পারিলে এখনই যে একটা তুমুল কাণ্ড হইবে!”
নরেন্দ্রবাবুকে আর কোন কথা গোপন করা যুক্তিসিদ্ধ মনে করিলাম না। কেবল গত রাত্রের কথা ছাড়া আর সকল কথাই একে একে ব্যক্ত করিলাম।
নরেন্দ্রনাথ অতি মনোযোগের সহিত আমার সকল কথা শুনিলেন। পরে অতি বিষন্ন ভাবে উত্তর করিলেন, “এ সেই কেশবেরই কার্য্য! বিবাহ করিয়া অবধি সে একদিনের জন্য স্ত্রীকে সুখী করে নাই। যতদিন বিবাহ হয় নাই, তত কাল সে এক প্রকার ছিল কিন্তু বিবাহের পর তাহার স্বভাব পরিবর্তিত হইল। এদিকে পাড়ার লোকে ও তাহাকে একঘরে করিল। একদিন শুনিলাম, সৌদামিনীকে লোকে উড়ের মেয়ে বলিয়া যৎপরোনাস্তি নিন্দা করিতেছে। এবং সেইদিন হইতে সৌদামিনী কিম্বা কেশব আর কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যায় না।”
আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সত্যই তিনি উৎকলসাসীর কন্যা?”
নরেন্দ্রনাথ ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে না—তাঁহার পিতা বহু দিন উড়িষ্যায় বাস করিয়াছিলেন, এই অপরাধে তাহাকে জাতিচ্যুত হইতে হইয়াছিল।
আ। কেশববাবু কি তাহার কোন প্রতিবাদ করেন নাই?
ন। কিছুমাত্র না—তিনি স্বয়ংই ঐ কথা লোকের নিকট বলিয়া বেড়াইতেন।
আ। আমাকে কেশবচন্দ্রের বাড়ীটা দেখাইয়া দিন।
নরেন্দ্রনাথ সম্মত হইলেন। অনেকদূর যাইবার পর নরেন্দ্রনাথ অনতিদূরে একখানি ক্ষুদ্র অট্টালিকা প্রদর্শন করিয়া বলিলেন, “ঐ যে কেশবচন্দ্র দরজায় দাঁড়াইয়া?”
আমি সেইদিকে গমন করিলাম এবং কেশবচন্দ্রকে সবলে ধারণ করিয়া বলিল, “কি মহাশয়! আমাকে চিনিতে পারেন?”
আমার কণ্ঠস্বরে কেশব চমকিত হইলেন, তিনি আমার আপাদমস্তক লক্ষ্য করিলেন। পরে অতি বিমর্ষভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কি সর্ব্বনাশ, আপনি এখনও জীবিত আছেন?”
আমি সে কথা গ্রাহ্য করিলাম না। সম্মুখেই একগাছি বড় দড়ি দেখিতে পাইয়া তাহার সাহায্যে কেশবকে উত্তমরূপে বন্ধন করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন আপনার বন্ধু কোথায় বলুন। কেন না তিনিও আমার জীবন সংহার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। বিশেষতঃ তাহার উদ্যানে যে মানুষ মারা কল আছে, তাহা ভাঙ্গিয়া না ফেলিলে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না।
দেখিতে দেখিতে সেইস্থানে লোকে লোকারণ্য হইল। সমাগত সকলেই কেশবের বিপক্ষ বলিয়া বোধ হইল। তাহারা সকলে ই কেশবকে নানাপ্রকার গালি দিতে লাগিল।
কেশব কোনমতেই তাঁহার বন্ধুর কথা বলিলেন না। কিন্তু তাহা জানিতে আমার বিশেষ কষ্ট হইল না। উপস্থিত লোক দিগের মধ্যে একজন আমায় সাহায্য করিতে স্বীকৃত হইলেন। তিনি তখনই থানা হইতে কয়েকজন কনষ্টেবল লইয়া একেবারে সারদাচরণের উদ্যান-বাটিকায় গমন করিলেন এবং সহসা তাহাকে ধৃত করিয়া বন্দী করতঃ আমার নিকটে আনয়ন করিলেন।
তখন দুই বন্দী লইয়া আমি থানার দারোগার সহিত সাক্ষাৎ করলাম এবং বন্দীদ্বয়কে তাহার জিম্মায় রাখিয়া ও তাঁহাকে সমস্ত ঘটনা বলিয়া তাহার নিকট বিদায় লইলাম।
দারোগা সাহেব অতি ভদ্রলোক। তিনি সত্বর বন্দীদ্বয়কে কলিকাতায় প্রেরণ করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন।
সময়মত দারোগাবাবু উভয়কেই কলিকাতায় আনয়ন করিলেন ও এখানকার প্রধান কর্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া সারদাচরণের নামে হত্যা করিবার উৎযোগ এই অভিযোগ উপস্থিত কলেন। পরে অনুসন্ধানে দারোগাবাবু সারদাচরণের সমস্ত লীলা প্রকাশ করিয়া দিলেন। তাঁহার স্ত্রী পুত্র কেহই ছিল না, একজন বেশ্যা লইয়া তিনি ঐ বাগানে বাস করিতেন। সারদাচরণের দলের সমস্ত লোকই ধৃত হইয়া উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হইল।
কেশবচন্দ্র পরিশেষে সমস্ত কথা স্বীকার করেন ও কহেন, লোক গঞ্জনায় ও জাতিচ্যুত হওয়ার নিমিত্তই তিনি গাড়ীর ভিতরেই তাঁহার স্ত্রীকে হত্যা করেন ও পরিশেষে চলিত ট্রামের সম্মুখে তাহাকে ফেলিয়া দিয়া, গাড়ী হইতে অবতরণ পূর্বক ভিড়ের ভিতর লুকাইয়া পড়েন। কিন্তু সেইস্থান হইতে পলায়ন করেন না। আমি যখন পাখা পরীক্ষা করি, তিনি দেখিতে পান এবং আমি কোন পথ অবলম্বন করি, তাহাই লক্ষ্য করিতে থাকেন। পরিশেষে আমি যে ট্রেনে চন্দননগরে গমন করি, তিনিও সেই ট্রেনে গমন করিয়া আমার অগ্রেই ষ্টেশন হইতে বাহির হইয়া পড়েন। পরিশেষে কৌশল করিয়া আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া, আমাকে যে উপায়ে হত্যা করিতে প্রবৃত্ত হন, তাহা পাঠকগণ পূর্ব্বেই অবগত হইয়াছেন।
যথাসময়ে কেশবচন্দ্রের বিচার হয়, বিচারে তিনি চরম দণ্ডে দণ্ডিত হন।
সমাপ্ত।
পর সংখ্যা অর্থাৎ ২০৫ সংখ্যা বর্দ্ধিত আকারে আশ্বিন মাস হইতে বাহির হইবে।