জোড়া পাপী/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
কতক্ষণ যে সেই অবস্থায় পড়িয়াছিলাম, বলিতে পারি না, কিন্তু যখন আমার জ্ঞান সঞ্চার হইল, তখন বুঝিতে পারলাম, আমার সর্বাঙ্গে ভয়ানক বেদনা হইয়াছে, মুখ ও ললাটে হাত দিয়া দেখিলাম, তখনও সেই সকল স্থান হইতে রক্ত ঝরতেছে।
কিছুক্ষণ সেই ভাবে পড়িয়া থাকিয়া ভাবিলাম, কেন এমন হইল? পীতাম্বর কে? কেনই বা সে ষ্টেশন হইতে আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিতেছে। পূর্বে তাহার কথাবর্তা শুনিয়া অত্যন্ত পরোপকারী বলিয়া মনে করিয়াছিলাম; কিন্তু এখন তাহাকে একজন ভয়ানক বিশ্বাসঘাতক দস্যু বলিয়া বোধ হইল। সারদাচরণই বা কে? উভয়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন প্রকার ষড়যন্ত্র ছিল। নতুবা দুইটীর শয্যার মধ্যে পীতাম্বর যে শয্যায় শয়ন করিল, সেটীর ত কোনরূপ গোলযোগ ছিল না, সে ত অনায়াসে আমার সাক্ষাতে শয্যায় গিয়া শয়ন করিল। আর আমিই বা পড়িলাম কেন? শয্যাটী এরূপ ভাবে রচিত হইয়াছিল যে, শয়ন করিব। মাত্র একেবারে অন্ধকূপে পতিত হইব। কি ভয়ানক কৌশল! কি অদ্ভুত রহস্য!! কি ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা!!!
একটী একটী করিয়া অনেকগুলি দিয়াশলাই পোড়াইলাম, কিন্তু সে স্থান হইতে বহির্গত হইবার কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না। ভাবিলাম, এইরূপেই কি আমার জীবন শেষ হইবে? যেমন করিয়া পারি, সেখান হইতে উদ্ধার হইব, মনে মনে এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলাম।
কথায় বলে, ইচ্ছা থাকিলে পথ পাওয়া যায়। কথাটা মিথ্যা নহে। অনেক চেষ্টার পর, আমি দেখিলাম, সম্মুখে এক অতি সঙ্কীর্ণ পথ। দাড়াইতে চেষ্টা করিলাম, পারিলাম না। আরও কিছুক্ষণ সেই স্থানে পড়িয়া রহিলাম, পরে অনেক কষ্টে বসিয়া বসিয়া সেই পথে গমন করিলাম। প্রত্যেক পদবিক্ষেপে আমার পদদ্বয় কর্দমাক্ত হইতে লাগিল, পচা দুর্গন্ধ যেন চতুর্গুণ বৃদ্ধি হইল, আমার বমি হইবার উপক্রম হইল; কিন্তু আমি কিছুতেই পশ্চাদপদ হইলাম না।
অল্প অল্প করিয়া কিছুদুর অগ্রসর হইলে পর, সহসা শীতল বায়ু আমার দেহ স্পর্শ করিল। এতক্ষণ সেই দুগন্ধ ও এক প্রকার উত্তপ্ত বায়ুর মধ্যেই ছিলাম, শীতল বায়ু সেবনে মনে স্ফূর্ত্তি হইল। আমি উৎসাহান্বিত হই। আরও অগ্রসর হইতে লাগিলাম।
এইরূপে আরও খানিক দূর গমন করিয়া একটা ভাঙ্গা দরজা আমার নয়নপথে পতিত হইল। প্রথলিত দিয়াশলাই এর কাটার সাহায্যে আমি সেই দ্বারের নিকট উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, একটা প্রকাণ্ড নারিকেল বৃক্ষ ভাঙ্গিয়া সেই দ্বারে পতিত, সম্ভবত সেই পতনশীল নারিকেলবৃক্ষের ভরেই দরজাটা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।
দ্বার উন্মুক্ত দেখিয়া আমি নিমেষ মধ্যে তথা হইতে বহির্গত হইলাম। দেখিলাম, আমি একটা উদ্যানের ভিতর আসিয়া পড়িয়াছি। বাগানটী কাহার? যে বাগানে আমার এই দুর্দশা হইয়ছিল, সেখান হইতে কতদূরে আসিয়া পড়িয়াছি? তখন রাত্রিই বা কত? কোথায় যাইলে অবশিষ্ট রাত্রিটুকু নির্ব্বিবাদে অতিবাহিত করিতে পারিব? এই সকল প্রশ্ন তখন আমার মনোমধ্যে উদিত হইতে লাগিল। আমি আর অলোক জালিতে সাহস করিলাম না। কোনরূপে সেই বাগান হইতে বহির্গত হইয়া এক সরকারী পথে উপস্থিত হইলাম, এবং সেই পথ দিয়া ক্রমাগত পূর্বমুখে যাইতে লাগিলাম।
প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা কাল এই প্রকারে গমন করিবার পর, আমি গঙ্গাতীরে উপস্থিত হইলাম। নিকটেই মনের জন্য একটী ঘাট, আমি সেই ঘাটের এক নিভৃত স্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম এবং কত কি চিন্তা করিতে লাগিলাম।