জোড়া পাপী/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।


 সুখের পর দুঃখ আর দুঃখের পর সুখ এ জগতের ইহাই এক চিরন্তন প্রথা। নিরবচ্ছিন্ন সুখ যেমন কাহারও অদৃষ্টে ঘটে না, নিরবচ্ছিন্ন দুঃখও তেমনই কাহ'কেও ভোগ করতে হয় না! পর্যায়ক্রমে সুখ দুঃখ না আসিলে লোকে সুখের প্রয়াসী হয় না এবং দুঃখ তত কষ্টকর বলিয়া বোধ হয় না। দুঃখ আছে বলিয়াই সুখের এত আদর-সুখের জন্য লোকে এত লালায়িত।

 কিছুক্ষণ ভয়ানক অশান্তির পর প্রকৃতি ক্রমেই শান্তমূর্তি ধারণ করিল। যে আকাশ এতক্ষণ দুর্ভেদ্য নিবিড় জলদজালে আবৃত ছিল, দেখিতে দেখিতে তাহা পরিষ্কার হইল। সেই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘমালা কোথায় অদৃশ্য হইল। আকাশে অগণন তারকারাজি শোভা পাইতে লাগিল। যে পবন এতক্ষণ সংহার-মূর্ত্তি ধারণ করিয়া দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়। সন্ সন্ শব্দে প্রকাণ্ড মহীরুহ ধ্বংস করিতেছিল, প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেও শান্ত হইল—প্রবল প্রভঞ্জন মুক্তি কাগ করিয়া মলয়মারুত মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিল। কোচমান পুনরায় শফট চালনা করিল।

 জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, সেখান হইতে হাটখোলা বাইতে হইলে আরও এক কোয়ার্টার সময় লাগিবে। পল্লীগ্রামের পথ, সেই মাত্র মুষলধারে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, পথে আলোকের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে আরও অধিক সময় লাগিবার সম্ভাবনা দেখিয়া, আমার সঙ্গী সেই যুবক অতি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, আজ রাত্রিও অনেক হইল, তাহার উপর এই দুর্যোগ, কেন এত কষ্ট স্বীকার করিবেন? যখন আজ আপনাকে এখানেই থাকিতে হইল, তখন কাল প্রতেই সেখানে গিয়া সেই বাবুর সহিত দেখা করবেন।”

 যুবকের কথাই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হইল। এতক্ষণ সেই ঝড় বৃষ্টি সহ করিয়া মনে মনে বড়ই বিরক্ত হইয়াছিলাম। ভাবিতে ছিলাম, কি কুক্ষণেই সেদিন কলিকাতা ত্যাগ করিয়াছি। কিন্তু স্বয়ং সে কথা ব্যক্ত করিতে লজ্জা বোধ কষিতেছিলাম। এখন যুবকের কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এখান হইতে আপনার বাড়ী কতদুর?”

 যু। প্রায় অর্ধ ক্রোশ; কিন্তু যখন এতদূর আসিয়াছি তখন আর আপনাকে আমাদের বাড়ীতে যাইতে হইবে না। নিকটেই আমার এক বন্ধুর বাড়ী আছে। তিনি বেশ সঙ্গিতসম্পন্ন অপচ দেববিজে তাঁহার বেশ ভক্তিও আছে। যদি আপনার অমত না হয়, তাহা হইলে আজ রাত্রে সেইখানেই বাস করা যাউক।

 আ। এখান হইতে কতদূর?

 যু। এই বাগানের পরবর্তী বাগানে তাঁহার প্রকাণ্ড অট্টালিকা, তিনি সেখানে একাই বাস করেন।

 আ। সস্ত্রীক?

 যু। আজ্ঞে হাঁ।

 আ। আপনিও কি আজ রাত্রে সেখানে থাকিবেন?

 যু। সে আপনার ইচ্ছা, যদি আপনি এখানে একা থাকিতে ইচ্ছা না করেন, তাহা হইলে অদ্য আমাকেও থাকিতে হইবে।

 আ। কিন্তু আপনার বাড়ীতে কি মনে করিবেন, তাহার আপনার জন্য না জানি কতই উদ্বিগ্ন হইবেন।

 যুবক হাসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে না, আমি একজন ভৃত্যকে বাড়ী পাঠাইয়া দিব। তার মুখে তাঁহারা সকল কথাই জানতে পারিবেন।”

 আমি সম্মত হইলাম। তখন সেই যুবকের পরামর্শ মত কোচমানের ভাড়া মিটাইয়া দিয়া তাহাকে বিদায় দিলাম। পরে আমরা দুইজনে মন্থরগমনে সেই অন্ধকারময় পথ দিয়া পরবর্তী উদ্যানের দিকে গমন করিলাম এবং অনতিবিলমে এক প্রকাও উদ্যানের ফটকে প্রবেশ করিলাম।

 ফটকের দুই পার্শ্বে দুইটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহ ছিল। সম্ভবতঃ ঘর দুইখানি দ্বারবানদ্বয়ের বাসস্থান। আমরা উভয়ে উদ্যানে প্রবেশ করিবা মাত্র একজন জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যান বাবু! কাহাকে খুঁজিতেছেন?”

 আমার সঙ্গী সেই যুবক যেন বিরক্তির সহিত বলিয়া উঠিলেন, “সারদাবাবু বাড়ীতে আছেন? আমাকে কি চিনিতে পার নাই রামসদয়?

 যে লোক প্রশ্ন করিয়াছিল, যুবক যাহাকে রামসদয় বলিয়া সম্বোধন করিলেন, যুবকের কথায় অত্যন্ত লজ্জিত হইল। অতি বিনীতভাবে বলিল, “কেও, পীতারবাবু! এই দুর্যোগে আপনি এখানে? আপনাকে চিনিতে পারি নাই—ক্ষমা করিবেন।”

 যুবক সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বাবু কোথায়?”

 রা। তিনি উপরেই আছেন। এতক্ষণ নীচে ছিলেন, ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি, উপরে গিয়াছেন।

 যু। একবার ডাকিয়া দাও আর নীচেকার বৈটকখানার দরজা খুলিয়া দাও।

 রা। আপনিত উপরে যান, আজ কেন ও কথা বলিতেছেন?

 যু। আমি একা হইলে তোমায় কষ্ট দিতাম না। আমার সঙ্গে একজন বাবু আছেন দেখিতেছ না।

 রামসদয় তখনই যুবকের আদেশ পালন করিল।

 কিছুক্ষণ পরেই একজন সন্ত্রস্ত যুবক স্বহস্তে একটা প্রজ্জ্বলিত হ্যারিকেনল্যাম্প লইয়া আমাদের নিকট আগমন করিলেন, এবং আমার সঙ্গীকে দেখিয়া শশব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হে পীতাম্বর। এই দুর্য্যোগে এখানে কেন?”

 যুবক সকল কথাই ব্যক্ত করিলেন। পরে বলিলেন, “বাবুকে আজ রাত্রের মত তোমার বাড়ীতে আশ্রয় দিতে হইবে। আমাদের বাড়ীতেই ইহাকে লইয়া যাইতেছিলাম কিন্তু সেও ত এখান হইতে অনেক দূর। এই দুর্যোগে রাত্রিকালে পল্লীগ্রামের পথ দিয়া এতটা পথ যাওয়া বড় সই কথা নহে। সেই জন্যই অগত্যা তোমার আশ্রয়ে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।”

 তিনি বলিলেন, “তুমিও কেন আজ এখানে থাক না—আমি একজন ভৃত্য তোমার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিতেছি।”

 যুবক সম্মত হইলেন। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “বাবুরও ইচ্ছা সেইরূপ।

 তিনি সাগ্রহে বলিলেন, “আমার পরম সৌভাগ্য যে, আজ রাত্রে তোমাদের মত দুইজন ব্রাহ্মণ আমার গৃহে অতিথি।

 এই বলিয়া তিনি তখনই নীচেকার বৈটকখানার দ্বার খুলিয়া আমাদিগকে বসিতে অনুরোধ করিলেন। আমরাও তাঁহার কথামত কার্য্য করিলাম। তখন তিনি আমাদের আহারাদির বন্দোবস্ত করিবার জন্য উপরে গমন করিলেন।

 কিছুক্ষণ উপবেশন করিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “বাবুর কি সন্তান সন্ততি নাই?”

 যুবক বলিলেন, “আজ্ঞে হাঁ, আছে বই কি? দুইটী কন্যা, একটী পুত্র। কন্যা দুইজনেই বিবাহিতা; উভয়েই এখন শ্বশুরালয়ে। পুত্রটার বয়স পাঁচ বৎসরের অধিক নহে, সে হয়ত এখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।”

 আ। এই বাবুরই নাম কি সারদাচরণ?

 যু। আজ্ঞে হাঁ।

 আ। ব্রাহ্মন সন্তান?

 যু। আজ্ঞে হাঁ—কিন্তু তত্রাপি দেবদ্বিজে অশেষ ভক্তি। বিশেষ বয়োজ্যেষ্ঠ ও গুণী লোকের সম্মান রক্ষা করিতে তিনি মুক্তহস্ত।

 আ। বাড়ীতে বাবুর স্ত্রী ব্যতীত আর কোন রমণী আছেন?

 যু। এক দূর-সম্পর্কীয় বিধবা ভগ্নী-বলিতে গেলে তিনিই সংসারের গৃহিণীস্বরূপ। তাহার বিনানুমতিতে কেহ কোন কার্য্য করিতে সাহস করেন না।

 এই প্রকার কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে সারদাচরণ তথায় আগমন করিলেন এবং কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনার ন্যায় লোকের উপযুক্ত আহারাদি সংগ্রহ করা আমার ক্ষমতার বহির্ভূত। আজ আপনার বিশেষ কষ্ট হইতেছে দেখিতেছি।”

 আমি হাসিয়া বললাম, “অমন কথা বলিবেন না, আমার এই সঙ্গীর মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে আপনাকে পরম সৌভাগ্যবান বলিয়াই বোধ হয়। আপনি যদি আমার ন্যায় দরিদ্রের আহার দিতে না পারিবেন, তবে পারিবে কে? সামান্য শাকান্ন হইলেই আমি পরম পরিতুষ্ট হইয়া থাকি।”

 সারদাচরণও হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আহারের জন্য ভাবি না, কিন্তু সত্যই আজ আপনার শয়নের বড় কষ্ট হইবে।”

 আমি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন—এই বৈঠকখানায় স্বচ্ছন্দে শয়ন করিয়া রাত্রিযাপন করিব। আপনার কোন চিন্তা নাই। যেমন করিয়াই হউক, যখন আপনার আশ্রয়ে আসিয়া পড়িয়াছি, তখন আমার কোন কষ্ট হবে না।”

 সারদাবাবু বলিলেন, “আপনি অতি সজ্জন, তাই ওকথা বলিতেছেন। কিন্তু আপনাকে কেমন করিয়া এই বৈঠকখানায় শয়ন করিতে বলিব। উপরে দুই তিনটা ঘর আছে—তাহারই একটাতে আপনি শয়ন করিবেন। তবে ঘর গুলি প্রত্যহ ব্যবহার হয় না। বলিয়া কিছু অপরিষ্কার।”

 বাধা দিয়া আমি বলিলাম, “সেজন্য আপনার কোন চিন্তা নাই—আমার জন্য আপনি ব্যস্ত হইবেন না। আমাকে বন্ধু মনে করিবেন। বাস্তবিকই আজ এই ভয়ানক বিপদে আপনার সাহায্য পাইয়া আপনাকে পরম বন্ধু বলিয়া মনে করিতেছি।”

 সারদাবাবু হাসিলেন-কোন উত্তর করিলেন না। তখন অন্যান্য কথা আরম্ভ হইল। কথায় কথায় জনিতে পারিলাম, সারদাচরণের পুল্রটী পীড়িত।

 কিছুক্ষণ পরে সারদাচরণ বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন এবং অনতিবিলম্বে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত হইয়াছে।

 আমরা উভয়েই গাত্রোত্থান করিলাম এবং তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে উপরে উঠিলাম। সিঁড়ি হইতে উঠিয়া সম্মুখেই একটী অনতিক্ষুদ্র দালান দেখিতে পাইলাম। তাহারই মধ্যস্থলে আর একটা হ্যারিকেন ল্যাম্প জ্বলিতেছিল। তাহার সম্মুখে তিনখানি থালে নানা প্রকার খাদ্যদ্রব্য সজ্জিত রহিয়াছে। সারদাবাবু অর্থে আমাকে, পরে পীতাম্বরকে এক একখানি আসনে বসিতে অনুরোধ করিলেন এবং স্বয়ং অবশিষ্ট আসনে উপবেশন করিলেন।

 কলিকাতার বনিয়াদী বড়লোকেরা সচরাচর রাত্রে যেরূপ আহার করিয়া থাকেন, সারদাবাবু আমাদের জন্য সেই সকল আহায্যের আয়োজন করিয়াছিলেন। আমি বাস্তবিকই ক্ষুধার্ত হইয়াছিলাম, পরম পরিতোষ সহকারে সে গুলির সদ্ব্যবহার করিলাম।

 আহারাদি সমাপ্ত হইলে আমরা পুনরায় নীচে আসিলাম। সারদাচরণ ও আমাদের সহিত আসিলেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজবের পর অধিক রাত্রি হওয়ায় সকলেই গাত্রোত্থান করিলাম। সাদাচরণ আমাকে শয়নগৃহে লইয়া গেলেন, পীতাম্বরও সেই গৃহে শয়ন করিবেন বলিয়া আমাদের অর্থে অগ্রে যাইতে লাগিলেন।

 সারদাচরণ যে গৃহে আমাদিগকে লইয়া গেলেন, সেই ঘরখানি বেশ বড়। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে পনের কিম্বা ষোল হাতের কম নহে। ঘরের মধ্যে দুইখানি খাটের উপর দুইটী শয্যা ছিল। একটা টেবিলের উপরে এক আলোকাধার হইতে মিট মিট করিয়া অলোক অতেছিল। সেই সামান্য আলোকে ঘরখানি প্রায় অন্ধকারময় বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সারদাচরণ আমাদিগকে সেই শয্যা দেখাইয়া দিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, যেন শয়নের পূর্ব্বে আলোক নির্ব্বাপিত করা হয়।


 পীতাম্বরের অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়াছেন। আমিই তাহাকে অগ্রে শয়ন করিতে অনুরোধ করিলাম। তিনিও তখনই খাটের উপর গিয়া শয়ন করিলেন।

 কিছুক্ষণ পরে আমিও আলোক নির্বাপিত করিয়া অপর খাটখানির নিকট গমন করিলাম। আমরা যাইবার পূর্ব্বেই খাট দুই পানির উপর শয্যা রচিত হইয়াছিল। প্রত্যেক বিছানার উপর একটী করিয়া মসারি ও ফেলা ছিল।

 মসারির দরজা খুলিয়া আমি যখন শয্যায় শয়ন করিলাম, তখনই আমার মস্তক বিঘূর্ণিত হইল; আমি সহসা যেন এক অন্ধকূপের মধ্যে পড়িয়া গেলাম এবং নিমেষ মধ্যে হতচেতন হইয়া গড়িলাম।