জোড়া পাপী/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 আমার হঠাৎ মনে পড়ল,কলিকাতায় যেমন হাটখোলা আছে, ফরাসডাঙ্গা চন্দননগরে সেই প্রকার একটী স্থানকে হাটখোলা বলে। বাবুটার নাম নরেন্দ্রনাথ মুখো, ব্রাহ্মণ সন্তান। যদি কলিকাতার হাটখোলায় তাহার বাড়ী হইত, তাহা হইলে তিনি হাওড়া ষ্টেশন হইতে আসিবেন কেন? যখন তিনি হাওড়া স্টেশন হইতে গাড়ী ভাড়া করিয়াছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই কোন দূরদেশ হইতে আসিয়াছেন। আর যদি কলিকাতায় হাটখোলাতেই তাহার বাড়ী হয় এবং তিনি নিজ বাড়ীতেই প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, তাহা হইলে কোচমানকে বাগবাজারে লইয়া যাইতে বলিবেন কেন? সুতরাং কলিকাতা হাটখোলায় যে তাহার বাড়ী নহে তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম।

 চন্দননগরে যে হাটখোলা আছে তাহাও গঙ্গার তীরে। নাথ কি তবে সেই স্থান হইতেই আসিতেছিলেন? যে রমণী তাঁহার সঙ্গে ছিল, যিনি খুন হইয়াছেন, তাঁহারই বা পিত্রালয় কোথায়? বাগবাজারের কোন স্থানে গাড়ী লইয়া যাইবার কথা ছিল, কোচমান নিশ্চয়ই সে কথা জানিত না। নতুবা সে নিশ্চয়ই উহা ব্যক্ত করিত।

 এই প্রকার নানা চিন্তায় প্রায় এক ঘণ্টাকাল অতীত হইল। বেলা প্রায় চারিটা বাজিল। আমি অগত্যা চন্দননগরে গিয়া নরেন্দ্রবাবুর সন্ধান লইতে মনস্থ করিলাম। নিকটেই টাইমটেবল ছিল-দেখিলাম, সাড়ে চারটার সময় একখানি টেন ছাড়ে। সত্বর প্রস্তুত হইয়া একজন কনষ্টেবলকে একখানি সেকেণ্ডক্লাশ গাড়ীভাড়া করিয়া আনিতে বলিলাম।

 একবার ভাবলাম, পুলিশের বেশেই চন্দননগয়ে যাত্রা করিব, কিন্তু পরক্ষণে আমার মতের পরিবর্তন হইল।—ছদ্মবেশেই যাইতে স্থির করিলাম। তদনুসারে একজন ভদ্রলোকের বেশ ধরিয়া গাড়ীতে আরোহণ করিলাম, এবং গাড়ী ছাড়িবার দশ মিনিট পূর্বে হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত হইলাম। তখনই একখানা সেকেণ্ডক্লাসের টিকিট কিনিয়া যথাস্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম। যথা সময়ে গাড়ী হাওড়া স্টেশন ত্যাগ করিয়া অতি দ্রুতবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল এবং একে একে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাত আটটা ষ্টেশন ছাড়িয়া একেবারে শ্রীরামপুরে গিয়া থামিল।

 সন্ধ্যার সময় গাড়ীখানি চন্দননগর ষ্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইল। ষ্টেশনে নামিয়া একজন রেলওয়ে কুলিকে হাটখোলার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। পরে তাহারই নির্দিষ্ট পথে যাইবার জন্য মনস্থ করিলাম। ষ্টেশন হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময় একজন যুবক আমার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মহাশয় কি হাটখোলায় যাইবেন?”

 সহসা এক অপরিচিত যুবকের মুখে ঐ প্রশ্ন শুনিয়া আমি বিস্মিত হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কেমন করিয়া সে কথা জানিতে পারিলেন?”

 ঈষৎ হাসিয়া যুবক বলিল, “আপনি যখন সেই কুলিকে জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, আমি তখন তথায় দাঁড়াইয়া ছিলাম। আপনি তাহাকে হাটখোলার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন সেই জন্যই আমার অনুমান, আপনি ঐ স্থানেই যাইতে ইচ্ছা করেন।”

 যুবকের কথায় আমি আন্তরিক লজ্জিত হইলাম, আমি যখন হাটখোলার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তখন আমার কথাগুলি কিছু উচ্চৈস্বরে উচ্চারিত হইয়াছিল, সুতরাং সে কথা যে, নিকটস্থ লোকেরা শুনিতে পাইবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?

 এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি যুবককে বলিলাম, “হাঁ মহাশয়, আমি হাটখোলায়ই যাইব। আপনার বাড়ী কোথায়?”

 যু। আমার বাড়ী অত দূরে নয়—পালপাড়া।

 আ। সেখান হইতে হাটখোলা কতদূর?

 যু। প্রায় অর্ধ ক্রোশ।

 আ। আর এখান হইতে?

 যু। প্রায় দেড় ক্রোশ।

 আমি চমকিত হইলাম। ভাবিয়াছিলাম, হাটখোলা নিকটেই হইবে; কিন্তু দেড়ক্রোশ পথ দূর শুনিয়া বড়ই চিন্তিত হইলাম। ভাবিলাম, এতটা পথ পদব্রজে যাওয়া বড় সহজ নহে। যুবককে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ষ্টেশনে গাড়ী নাই কেন? এখানে কি ভাড়া টায়া গাড়ী পাওয়া যায় না?”

 যুবক বলিল, “কেন পাওয়া যাইবে না? আজ বোধ হয় কোন কারণ বশতঃ এখানকার গাড়ী গুলি খাড়া হইয়া গিয়াছে। তাই ষ্টেশনে গাড়ী দেখা যাইতেছে না। কিন্তু আপনার যদি বিশেষ প্রয়োজন হয় নিকটেই আস্তাবল আছে। সেখানে অন্ততঃ দুই তিনখানি গাড়ী পাইবেন। তবে ভাড়া বোধ হয় কিছু বেশী লাগিবে।”

 আ। কি করিব? রাত্রে শেষে কোথায় যাইতে কোথায় যাইব? আপনি যদি একখানি গাড়ীভাড়া করিয়া দেন, তাহা হইলে বড় উপকৃর্ত হই। আর আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে আপনিও অনায়াসে তাহাতে যাইতে পারিবেন।

 যু। আপত্তি কিছুই নাই। আপনি এই দোকানে বসুন, আমি শীঘ্রই একখানি গাড়ীভাড়া করিয়া আনিতেছি।

 এই বলিয়া যুবক পার্শ্বই একখানি দোকান প্রদর্শন করিল, এবং তখনই তথা হইতে প্রস্থান করিল। আমিও নির্দিষ্ট দোকানে গিয়া উপবেশন করিলাম।

 সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সাজের আধার সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করিয়াছিল। একে কৃষ্ণপক্ষ, তাহার উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় অন্ধকারের মাত্রা দ্বিগুণ হইয়াছিল। সহরে যেমন গ্যাসের আলোক থাকে, চাননগরে সে রূপ নাই। মধ্যে মধ্যে এক একটা কেরোসিনের অলোক মিট মিট করিয়া জ্বলতেছিল। তাহাদের ক্ষীণ আলোকে পল্লী গ্রামের পথ দিয়া কলিকাতাবাসীর যাতায়াত করা যে কি কষ্টকর, তাহ। ভুক্তভোগী মাত্রেই অনুভব করিতে পারেন। অনেক দিন পূর্বে আমি আর একবার চন্দননগরে গিয়াছিলাম। কিন্তু সে রাত্রে নহে। রাত্রিকালে সেই অপরি— চিত স্থানে কোথায় বাস করি, তাহা ও সহসা স্থির করিতে পারিলাম না।

{gap}}যে যুবক আমার জন্য গাড়ী আনিতে গিয়াছিলেন, তিনি আমার সহিত যে প্রকার ব্যবহার করিতেছেন, তাহাতে তাহাকে সজ্জন বলিয়াই বোধ হইল। নতুবা পরের জন্য তিনি সেই রাত্রে অত কষ্ট করিতে স্বীকার করিবেন কেন?

 সে যাহা হউক, সেই দোকানে বসিয়া আমি নানা প্রকার চিন্তা করিতেছি, এমুন পময় একখানা গাড়ী লইয়া সেই যুবক প্রত্যাগমন করিলেন। আমি তখনই দোকানদারের নিকট বিদায় লইয়া গাড়ীর উপর আরোহণ করিলাম। যুবক গাড়ীতেই ছিলেন, আমাকে উঠিতে দেখিয়া অবতরণ করিতেছিলেন। আমি বাধা দিয়া তাঁহাকে সেই গাড়ীতে যাইতে অনুরোধ করিলাম। তিনি অনেক বার আমার কথা কাটাইলেন কিন্তু আমার নির্ব্বব্ধাতিশয় দর্শনে অবশেষে সম্মত হইয়া আমার পার্শ্বে উপবেশন করিলেন। কোচমান হাটখোলার দিকে শকট চালনা করিল।

 কিছুদূর গমন করিলে পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার নাম কি? যিনি এই বিপদে আমার এত সাহায্য করিলেন, তাহার নাম না জানিতে পারিলে মনে বড় দুঃখ হইবে।”

 ঈষৎ হাসিয়া যুবক বলিলেন, “আমার নাম পীতাম্বর চক্রবর্তী।”

 আ। পালপাড়াতেই আপনার বাড়ী?

 পী। আজ্ঞে হা—পুরুষানুক্রমে ঐখানেই বাস করিয়া আসিতেছি।

 আ। আপনার পিতামাতা বর্ত্তমান?

 পী। আজ্ঞে না, তাহারা বহুদিন হইল স্বর্গে গমন করিয়াছেন।

 আ। তবে আপনিই এখন অভিভাবক?

 পী। আজ্ঞে না, আমার জোষ্ঠ ভ্রাতা আছেন।

 আ। উভয়ের একই সংসার?

 ঈষৎ হাসিয়া যুবক উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে হাঁ, এখনও ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই হয় নাই। সহরে যেমন ইচ্ছা করিলেই লোকে স্বতন্ত্র হইতে পারে, পল্লীগ্রামে সেরূপ হয় না। এখানকার লোকদিগের কিছু চক্ষু লজ্জা আছে বলিয়া বোধ হয়।”

 আ। আপনারা তবে দুই ভাই?

 পী। আজ্ঞে হাঁ।

 আ। আপনার সন্তান-সন্ততি কি?

 পী। একটী পুত্র ও একটী কন্যা।

 আ। আর আপনার জ্যেষ্ঠের?

 পী। তিনি নিঃসন্তান।

 আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “সেই জন্যই আপনারা এখনও এক সংসারে আছেন। যদি কখনও আপনার জ্যেষ্ঠের পুত্র সন্তান জন্মে, তখন আমার কথার যথার্থ বুঝিতে পারিবেন।”

 যুবকও হাসিয়া বলিলেন, “তাহার আর সে আশা নাই—তিনি গৃহশূন্য!”

 আ। যদি আবার দারপরিগ্রহ করেন?

 যু। সে বয়সও নাই।

 আ। তাহার বয়স কত?

 যু। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর।

 আমি হাসিয়া বললাম, “এত বেশী বয়স হয় নাই। ব্রাহ্মণসন্তান মুমুর্ষু অবস্থাতেও বিবাহ করেন শুনিতে পাওয়া যায়। আপনার যদি এখন ঐরূপ বলিতেছেন বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে তাহার মতিগতি কি হইবে কে জানে?

 যু। তিনি আমারই পুত্রকে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করিয়াছেন।

 আ। সে কি! পোষ্যপুত্রের প্রয়োজন কি? আপনার পুত্রইত আপনাদের উভয় ভ্রাতার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইবে।

 যু। কারণ আছে। দাদার স্ত্রী তাঁহার পৈতৃক বিষয়ে উত্তরাধিকারিণী হইয়াছিলেন। সম্পত্তি তা সামান্য নহে, প্রায় বিশ হাজার টাকা হইবে। তিনি যখন ঐ সম্পত্তি গ্রহণ করেন, তখনই আমার পুকে পোষ পুত্ররূপে লইয়াছিলেন এবং তাহারই নামে সেই সমস্ত বিষয় উইল করিয়া দেন।

 এইরূপ কথাবার্ত্তায় গাড়ীখানি পালপাড়ায় আসি। উপস্থিত হইল। কোচমান উপুর হইতে বলিল, “বাবু, পালপাড়ায় কাহার বাড়ীতে যাইব?”

 আমি যুবকের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি আর আমার জন্য কষ্ট করেন কেন? তবে, কোচমানকে ভাল করিয়া বলিয়া দিন, যেন সে ভবিষ্যতে কোনরূপ গোলযোগ না করে।”

 আমার কথা শুনিয়া যুবক কি চিন্তা করলেন। পরে বলিলেন, “কেমন করিয়াই বা আপনাকে একা ছাড়িয়া দিই। আপনার সহিত আলাপ করিয়া পরম আপায়িত হইয়াছি। যেখানে আপনি যাইতেছেন তাহা কি আপনার পরিচিত? আপনি কি পূর্ব্বে আর কখনও সেখানে গিয়াছিলেন?”

 যুবকের প্রশ্নে সহসা আমার মুখ দিয়া সত্য কথাই নির্গত হইল। আমি বলিলাম, “আজ্ঞে না।”

 যু। যদি বিশেষ প্রয়োজন না থাকে, তাহা হইলে আজ রাত্রে কেন আমাদের বাড়ীতেই আসুন না। ব্রাহ্মণের বাড়ীতে একরাত্রি যাস করলে কোন ক্ষতি হইবে না বোধ হয়। কথায় কথায় আপনার নাম পর্য্যন্ত জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম।

 আমি নাম বলিলাম; কিন্তু প্রকৃত নাম গোপন করিলাম। পদবীর পরিবর্তন করিলাম না।

 আমার কণা নিয়া যুবক সাগ্রহে বলিলেন, “তবে আর কি ‘ব্রাহ্মণস্য ব্রাহ্মণো গতি: ’ আপনি যখন ব্রাহ্মণ, তখন আর আমাদের বাড়ীতে যাইতে আপত্তি কি?”  আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “আপত্তি কিছুই নাই, তবে কাজটা কিছু জরুরি—আজ আমায় সেখানে যাইতেই হইবে।”

 কিছুক্ষণ চিন্তার পর যুবক বলিলেন, “বেশ কথা—কিন্তু আজত আর আপনি স্বস্থানে ফিরিতে পারিবেন না। আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন?”

 আ। কলিকাতা।

 যু। তবে ত এরাত্রে কলিকাতা প্রত্যাগমন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। এখন রাত্রি প্রায় আটটা, হাটখোলা দিয়া কার্য শেষ করিয়া ষ্টেশনে ফিরিতে অন্তত দশট। বাঙ্গিয়া যাইবে। তখন ত আর গাড়ী পাইবেন না। এখান হইতে রাত্রি সাড়ে নয়টার সময় কলিকাতায় শেষ ট্রেন যায়।

 আমিও চিন্তিত হইলাম। সেই রাত্রে কেমন করিয়া একা অপরিচিত স্থানে বাস করিব, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। যুবকের বাড়ীতেই সেরাত্রি বাস করিতে স্থির করিলাম। তাঁহাকে বললাম, “যদি আর ট্রেন না থাকে, তাহা হইলে অগত্যা আমাকে এখানে থাকিতে হইবে। এই অপরিচিত স্থানে আপনি আমার যেরূপ উপকার করিতেছেন, তাহাতে আপনার অনুরোধ রক্ষা না করা নিতান্ত মূর্খের কার্য্য। কিন্তু যে কার্য্যের জন্য এতদূর আসিয়াছি অগ্রে তাহা শেষ না করিয়া আপনার বাড়ীতে যাইতে পারিব না।

 আমার কথায় যুবক অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। তিনি আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাটখোলায় কাহার বাড়ীতে যাইবেন?”

 যুবকের কথায় ও কার্যে আমি এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলাম যে, তাঁহার নিকট সে কথা গোপন করিতে ইচ্ছা হইল না। আমি বলিলাম, “হাটখোলায় নরেন্দ্রনাথ বাবুর বাড়ীতে যাইব। আপনার সহিত তাহার আলাপ আছে কি?”

 কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া যুবক উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে না, চিনিতে পারিতেছি না। আমাদের বাড়ী হইতে হাটখোলা অনেকটা দূর। হাটখোলার সকল লোকের সহিত আম দের আলাপ থাক। এক প্রকার অসম্ভব। তবে আমিও আপনার সঙ্গে যাইতেছি, উভয়ে মিলিয়া শীঘ্রই উহার সন্ধান করিতে পারিব।”

 আমি আন্তরিক প্রীত হইলাম এবং ক্রমাগত হাটখোলার দিকে যাইতে লাগিলাম। কোচমান উপর হইতে বলিল, “বাবু, বড় দুর্য্যোগ-আপনাদের ছাতাটা এক বার দিন। ঝড় উঠিয়াছে, এখনই বৃষ্টি আসিবে।”

 উভয়েরই নিকট ছাতা ছিল—আমি আমার ছাতাটা কোচমানকে দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে একবার আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, একখানি ভয়ানক কৃষ্ণবর্ণ মেঘ সমস্ত আকাশ ছাইয়া ফেলিয়াছে। একটাও তারকা নয়নগোচর হইল না। এতক্ষণ প্রকৃতি নিস্তব্ধ ছিল-গাছের পাতাটা পর্যন্ত নড়ে নাই। সহসা দুর হইতে এক প্রকার সে সে। শব্দ উথিত হইল। দেখিতে দেখিতে পথের ধূলিকণা মেঘকারে উড়িতে লাগিল, মধ্যে মধ্যে দামিনী চমকিতে লাগিল, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক গর্জনও হইতে লাগিল। মড় মড় শব্দে বৃক্ষের বড় বড় শাখাগুলি ভাঙ্গিতে লাগিল। একাণ্ড মহীরুহ সকল দুলিতে দুলিতে ভূমিসাৎ হইতে লাগিল। ক্রমে দুই এক ফেঁটা বৃষ্টি ও পড়িতে লাগিল।

 কাচমন ঝড়ের সময় অতি কষ্টে শকট চালনা করিয়াছিল। কিন্তু যখন বৃষ্টির প্রকোপ বর্ধিত হইল, তখন সে অশ্বরজু সংযত করিয়া এক প্রকাণ্ড আম্রবৃক্ষের তলায় আশ্রয় গ্রহণ করিল। সৗভাগ্যক্রমে গাড়ীতে যে দুইটা লণ্ঠন ছিল, তাহারা তখনও নীর্ব্বাপিত হয় নাই। একটা গভীর বাহিরেই রহিল, অপরটী গাড়ীর ভিতরে লইলাম। চারিদিকে ভয়ানক অন্ধকার, আর সেই মুষলধারে বর্ষণের মধ্যে আমরা তিনটা মানব এক নিবিড় অস্ত্রবৃক্ষের তলায় আশ্রয় লইয়া কত কি ভাবিতে লাগিলাম।