জ্ঞাতি-শত্রু/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পদব্রজে গমন করিবার পর আমি চিৎপুর রোডে আসিয়া ট্রামের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। এমন সময়ে হরিসাধন বাবুর কয়েকজন আত্মীয় ঘাট হইতে বাড়ীতে ফিরিতে ছিলেন দেখিতে পাইলাম। যদিও তাঁহারা আমারই পার্শ্ব দিয়া গমন করিলেন, তত্রাপি তাঁহারা আমাকে দেখিতে পাইলেন না।
আমি দেখিলাম, তাঁহারা সকলেই বিষণ্ণ, কেবল একজন শক্তি- সাধনের নাম করিয়া কি বলিতে বলিতে যাইতেছিলেন। শক্তিসাধনের নাম শুনিয়া আমার সন্দেহ হইল। আমি দূরে থাকিয়া তাঁহাদের পশ্চাদনুসরণ করিতে লাগিলাম।
কিছুদূর যাইতে না যাইতে তিনি বলিলেন, “এ শক্তিরই কাজ। যে লোক ব্রাহ্মণের সন্তান হইয়া সামান্য বাগ্দিনীর হাতে ভাত খাইতে পারে, তাহার অসাধ্য কি?”
তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে অপর ব্যক্তি বলিলেন, “না—না, অমন কথা মুখে আনিও না। যে ব্যক্তি দাদার অনুগত, দাদার অন্নে প্রতিপালিত, এত অত্যাচার উৎপীড়ন করিলেও যে দাদা আপন সন্তানের ন্যায় ভালবাসিতেন, সে লোক কেন সহসা সেই দাদাকে হত্যা করিবেন। নিজের পায়ে নিজে কেন কুঠার মারিবেন?”
প্রথম ব্যক্তি উত্তর করিলেন, “আমি সেকথা বলি নাই। আমি বলিতেছি যে, শক্তিসাধন রসময় বাবুর উপর অত্যন্ত বিরক্ত। তিনি অন্যায় করিয়া রসময়ের উপর সন্দেহ করিয়া এ কার্য্য করিয়াছেন।”
দ্বিতীয় ব্যক্তি শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সত্য না কি?”
প্র। আমি যখন ডাক্তারের সার্টিফিকেট আনিতে বাড়ীতে ফিরিয়া গিয়াছিলাম, তখন সেই পুলিসকর্ম্মচারীর মুখে শুনিলাম যে, শক্তি রসময় বাবুর নামে বৃথা সন্দেহ করিয়া এই অভিযোগ করিয়াছেন।
দ্বি। যদি ইহা সত্য হয়, তাহা হইলে উভয়ের পক্ষেই বড় ভাল হইবে না। পুলিস সহজে ছড়িবে না।
প্র। যদি হরি বাবুর মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া সেরূপ সন্দেহ না হয়, তাহা হইলে বোধ হয় আর কোন গোলযোগ হইবে না। পরীক্ষা শেষ না হইলে ত আর সৎকার করা হইবে না।
আমি আর তাঁহাদের অনুসরণ করা যুক্তিসিদ্ধ মনে না করিয়া তাঁহাদের নিকটে গমন করিলাম এবং অতি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনারাই কি হরিসাধন বাবুর মৃতদেহের সৎকার করিতে গিয়াছিলেন?”
একজন অতি কর্কশভাবে উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে হাঁ কিন্তু আপনাদের জন্যই সেই কার্যে ব্যাঘাত পড়িল। একে বিপদ, তাহার উপরে এই প্রকার অশান্তি, এমন করিলে লোকে কেমন করিয়া সুস্থমনে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিবে?”
আমি অতি মৃদুবচনে উত্তর করিলাম, “এ বিষয়ে আমার দোষ কি? যাঁহার সন্দেহ হইয়াছে, তাঁহাকে বলুন। আমি যতক্ষণ সংবাদ না পাইয়াছি, ততক্ষণ কিছু আর পরীক্ষা করিতে আসি নাই। বিশেষতঃ যদি বাস্তবিকই তাঁহার সন্দেহ সত্য হয়, তাহা হইলে আর আপনাদের অসন্তোষের কারণ কি? বোধ হয় আপনারা কেহই ইচ্ছা করেন না যে, হত্যা করিয়া লোকে নিষ্কৃতি লাভ করে।
যে ব্যক্তি আমার সহিত কথা কহিতেছিলেন, তিনি বলিয়া উঠিলেন, “আজ্ঞে না—আমাদের কাহারও সেরূপ ইচ্ছা নয়। কিন্তু যাঁহার কথায় বিশ্বাস করিয়া আপনি এই কার্য্যে ব্যাঘাত ঘটাইলেন, তিনিও নিতান্ত সহজ লোক নহেন।”
আ। কেন?
লো। রসময় বাবুর উপর তিনি হাড়ে চটা।
আ। স্বাভাবিক। রসময় বাবু তাঁহাদের পৈত্রিক সম্পত্তি কাড়িয়া লইয়াছেন।
লোকটী আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। তিনি আমার মুখের দিকে চাহিয়া ব্যঙ্গস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁহাদের সম্পত্তি কিরূপ? সম্পত্তি ত হরিসাধন বাবুরই ছিল।”
আ। তাহাতে কি শক্তিসাধন বাবুর অংশ ছিল না?
লো। আজ্ঞে না—তিনি ভ্রাতার নিকট আপনার অংশের মূল্য লইয়া তাঁহাকেই সেই অংশ বিক্রয় করিয়াছিলেন।
আ। তবে তিনি হরিসাধন বাবুর বাড়ীতে যাতায়াত করিতেন এবং তাঁহারই অন্ন ধ্বংস করিতেন কেন?
লো। হরিসাধন বাবু দয়া করিয়া তাঁহার ভরণপোষণের সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করিতেন। এমন কি, কিছু করিয়া মাসহারাও দিতেন। হরিবাবুর মৃত্যুতে শক্তিবাবুর বিশেষ অপকার হইয়াছে সন্দেহ নাই।
আ। তাঁহার ভ্রাতাই ত হরিসাধনের বিষয়ের উত্তরাধিকারী?
লোকটী ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে সে সকল কথা আমরা ভাল জানি না। হরিবাবুর কোন সন্তান জীবিত নাই।”
আ। রসময়বাবু কে?
লো। হরিবাবুর জ্ঞাতি ভাই।
আ। তাঁহাদের নিবাস কোথায়?
লো। হাটখোলায়।
আমি আর কোন প্রশ্ন না করিয়া পুনরায় চিৎপুর রোডের মোড়ে আসিয়া ট্রামের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম এবং কিছুক্ষণ পরেই হাঁসপাতালে গিয়া উপস্থিত হইলাম।