জ্ঞাতি-শত্রু/প্রথম পরিচ্ছেদ
জ্ঞাতি-শত্রু।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
বেলা একটা বাজিয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ পূর্ব্বে গলদ্ঘর্ম্ম হইয়া আমি আদালত হইতে ফিরিয়া আসিয়াছি এবং অফিস-ঘরে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছি। নির্ম্মল মেঘমুক্ত আকাশে দিনমণি প্রখর কিরণ বিকীরণ করিতেছে। সেই প্রচণ্ড মার্ত্তণ্ডতাপে সহরের রাজপথগুলি জ্বলন্ত অগ্নিমূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে। অবসর বুঝিয়া, প্রভঞ্জন ভীমনাদে চারদিকে প্রবাহিত হইতেছে। পবনের ভীম পরাক্রম সহ্য করতে না পারিয়াই যেন রাজপথের ধূলিকণা সকল ক্রোধে অগ্নিকণা মূর্ত্তি ধারণ করিয়া চারিদিকে পলায়ন করিতেছে। পথে লোকসমাগম অতি বিরল। কেবল মধ্যে মধ্যে দুই একখানা তৃতীয়শ্রেণীর ভাড়াটিয়া গাড়ী দুই একটী আরোহী লইয়া মন্থর গতিতে নির্দ্দিষ্টপথে গমন করিতেছে।
এমন সময়ে একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী থানার সম্মুখে আসিয়া স্থির হইল। আমার কৌতূহল জন্মিল। ভাবিলাম, বিশেষ বিপদ না হইলে কেহ আর সেই ভয়ানক রৌদ্রে থানায় আইসে না। বুঝিলাম, ব্যাপার গুরুতর। অফিস-ঘরের সম্মুখেই থানার ফটক। জানালা দিয়া দেখিলাম, এক যুবক সেই গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন এবং দ্বারস্থ কনষ্টেবলকে কি জিজ্ঞাসা করিয়া, তাহার সহিত অফিস-ঘরের দরজার দিকে আসিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ পরেই কনষ্টেবল তাঁহাকে আমার সম্মুখে আনায়ন করিলেন। তিনি নমস্কার করিলে আমি তাঁহাকে বসিতে বলিলাম। তিনি তখনই আমার অনুরোধ রক্ষা করিয়া কাঁদকাঁদস্বরে বলিলেন, “মহাশয়! আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে। আমার পিতৃস্থানীয় জ্যেষ্ঠকে কে হত্যা করিয়াছে।”
অতি কষ্টে এই কথাগুলি বলিয়া যুবক মস্তক অবনত করিলেন। তাঁহার চক্ষু দিয়া দরদরিতধারে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। আমি তাঁহার সে অবস্থায় কোন কথা জিজ্ঞাসা করা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম না।
যুবকের বয়স অনুমান ত্রিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ ও সুপুরুষ। কিন্তু তাঁহার দেহের লাবণ্য ছিল না। চক্ষুদ্বয় প্রশস্ত হইলেও যেন কোটরগ্রস্ত, তাহার নিম্নে কালিমা-রেখা। ভ্রাতৃবিয়োগে তাঁহার এই প্রকার পরিবর্ত্তন হইয়াছে কি না তাহা বুঝিতে পারিলাম না। যুবকের পরিধানে একখানি পাত্লা কালাপড়ে ধুতি, একটা আদ্ধির পাঞ্জাবি জামা, একখানি চাদর। পায়ে এক জোড়া বার্ণিস করা জুতা।
কিছুক্ষণ পরে যুবক কথঞ্চিৎ শান্ত হইলে আমি অতি মৃদুভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে আপনার জ্যেষ্ঠকে হত্যা করিয়াছে? কি হইয়াছে, সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলুন, আমি এখনই আপনার সহিত যাইতেছি।”
আমার কথায় যুবক আমার মুখের দিকে চাহিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল, তিনি যেন অনেকটা আশ্বস্ত হইয়াছেন। পরে অতি বিনীতভাবে বলিলেন, “আমার জ্যেষ্ঠ আজ বেলা দশটার পর মারা পড়িয়াছেন। লোকে বলিতেছে, তিনি ওলউঠা রোগেই মারা পড়িয়াছেন। আমার কিন্তু সেরূপ মনে হয় না। আমার কেন, আমার ভ্রাতৃবধূর পর্য্যন্ত ভয়ানক সন্দেহ হইয়াছে।”
যে ভাবে যুবক ঐ কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে আমারও কেমন সন্দেহ হইল। ঘটনা কি? কিরূপ অবস্থায় যুবকের ভ্রাতার মৃত্যু হইয়াছে? কিছুই জানিলাম না, অথচ তাঁহার কথা শুনিয়াই কেমন সন্দেহ জন্মিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার জ্যেষ্ঠের নাম কি?”
যুবক উত্তর করিলেন, “হরিসাধন বন্দ্যোপাধ্যায়।”
আ। আপনার নাম?
যু। শক্তিসাধন বন্দ্যোপাধ্যায়।
আ। আপনাদের নিবাস কোথায়?
যু। বাগবাজারে।
আ। এ বৎসর চারিদিকেই কলেরার উপদ্রব। প্রতিদিন কতশত লোক ওলাউঠায় প্রাণ দিতেছে। সহর বলিয়া বিশেষ কিছু জানিতে পারা যায় না। আপনার জ্যেষ্ঠও সেই পথে গিয়াছেন; ইহাতে আপনার সন্দেহ হইল কেন?
যুবক আবার আমার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। পরে অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “সকল কথা না বলিলে, আপনি আমার সন্দেহের কারণ বুঝিতে পারিবেন না। কিন্তু এখন তাহা বলিবার উপায় নাই।”
আমি তাঁহার কথায় বিস্মিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন? উপায় নাই কেন?
যুবক অতি বিনীতভাবে বলিলেন, “হয়ত এতক্ষণ দাদার দেহ তীরস্থ করা হইয়াছে। হয়ত দাহকার্য্যও সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। যদি তাহাই হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে প্রমাণের প্রধান উপায় থাকিবে না।”
যুবকের কথা আমি ভাল বুঝিতে পারিলাম না। মনে মনে বিরক্ত হইলাম; কিছু রূঢ়ভাবে বলিলাম, “আপনার মনের কথা কি পরিষ্কার করিয়া বলুন? আমাকে আপনি কি করিতে বলেন? কেমন করিয়া আপনার সাহায্য করিব?”
আমি যে আন্তরিক বিরক্ত হইয়াছি, তাহা যুবক আমার কথাতেই বুঝিতে পারিলেন। তিনি অতি বিনীতভাবে বলিলেন, “দাদার মৃত্যুতে আমার যথেষ্ট অপকার হইয়াছে। তিনি আমার পিতৃস্থানীয় ছিলেন। আমি তাঁহার অন্নে প্রতিপালিত। সেই কারণে তাঁহার সহসা মৃত্যুতে আমি এক প্রকার উন্মাদের মত হইয়া গিয়াছি। কি করিতেছি, কি বলিতেছি, কিছুরই স্থিরতা নাই। আমাকে ক্ষমা করুন—আমার সন্দেহ এই যে, দাদাকে কেহ বিষ খাওয়াইয়া হত্যা করিয়াছে। কিন্তু লােকে তাহা না বুঝিয়া তিনি কলেরায় মারা পড়িয়াছেন, এই প্রকার রাষ্ট্র করিছে, আপনি এখন যাহা কর্ত্তব্য তাহাই করুন। আমার মস্তিষ্কের স্থিরতা নাই।”
যুবকের শেষ কথায় তাঁহার পূর্ব্বের কথার অর্থ বুঝিতে পারিলাম। শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলাম, “যদি আপনার এই সন্দেহ হইয়াছিল, তবে এতক্ষণ আমায় সংবাদ দেন নাই কেন? দশটার পর আপনার জ্যেষ্ঠের মৃত্যু হইয়াছে, আর বেলা এখন প্রায় দুইটা। লাস কি দাহ হইয়া গিয়াছে বোধ হয়?”
আমার প্রশ্নে যুবক যেন চমকিত হইলেন। আমি তাঁহার মনোগত উদ্দেশ্য ভাল বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু তিনি তখনই আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে না, দাহকার্য্য বোধ হয় এখনও হয় নাই। তবে মৃতদেহ ঘাটে লইয়া গিয়াছে।”
আ। কোন্ ঘাটে?
যু। কাশী মিত্রের ঘাটে।
আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়া তখনই কাশীমিত্রের ঘাটের রেজিস্ট্রারকে টেলিফোন করিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “হরিসাধন বন্দ্যোপাধ্যায় নামে কোন ভদ্রলোকের মৃতদেহ তীরস্থ করা হইয়াছে কি না? যদি হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার দাহকার্য্য আরম্ভ হইয়াছে কি না?”
উত্তরে রেজিষ্ট্রার বলিলেন, “লাস তীরস্থ হইয়াছে। দাহকার্য্য আরম্ভ হয় নাই, উদ্যোগ হইতেছে।”
আমি পুনরায় টেলিফোনের সাহায্যে তাঁহাকে মৃতদেহ দাহ করিতে অনুমতি দিতে নিষেধ করিলাম কিন্তু যুবককে কোন কথা বলিলাম না।