জ্ঞাতি-শত্রু/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 পরদিন প্রাতঃকালে আমি পুনরায় শক্তিসাধন বাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম। শুনিলাম, শক্তিসাধন অতি প্রত্যূষে তাঁহার জ্যেষ্ঠের মৃতদেহ সৎকারের জন্য শ্মশানে গমন করিয়াছেন। সুতরাং আমি তথায় আর কালবিলম্ব না করিয়া ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে গমন করিলাম।

 আমাকে দেখিয়া শক্তিসাধন প্রফুল্ল হইলেন এবং তখনই আমার নিকটে আসিয়া বলিলেন, “কেমন মহাশয়, আমার সন্দেহ সত্য হইল কি না?”

 আমি সহসা, কোন উত্তর করিলাম না। যে ভাবে শক্তিসাধন ঐ কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে তিনি যে বিশেষ আনন্দিত হইয়াছেন, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু সে বিষয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। কিছুক্ষণ পরে সকলের অগোচরে তাঁহাকে কোন নিভৃত স্থানে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে ব্যক্তি আপনার দাদার আহায়ের সময় তাঁহার পাতে হাত দিয়াছিলেন, তাঁহার নাম কি বলিতে পারেন?”

 “তাঁহার নাম রসময় বন্দ্যোপাধ্যায়।”

 অনন্তর রসময় বাবুর বাড়ীর ঠিকানা জানিয়া লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

 বিনা কষ্টে আমি রসময় বাবুর বাড়ী গিয়া পঁহুছিলাম। তখন বেলা প্রায় আটটা।

 রসময় বাবুর বাড়ীখানি সুন্দর, প্রকাণ্ড ও ত্রিতল। বাড়ীতে লোকজন অনেক। সদর দ্বারে উপস্থিত হইবা মাত্র একজন ভৃত্য আসিয়া আমার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিল। আমার কথা শুনিয়া সে প্রস্থান করিল এবং তখনই রসময় বাবুকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় দ্বারদেশে প্রত্যাগমন করিল।

 আমাকে দেখিয়া রসময় বাবু অতি সমাদরে ত্রিতলের একটা বৈঠকখানায় লইয়া গেলেন।

 বৈঠকখানাটী বেশ সাজানো। আমি ভিতরে গিয়া একখানি চেয়ারে উপবেশন করিলাম। রসময় বাবু অপর একখানি চেয়ারে আমার সম্মুখে বসিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইল যে, তিনি হরিসাধন বাবুর মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকান্বিত হইয়াছেন। তাহার বিষণ্ণ বদন দেখিয়া আমার আর এক সন্দেহ জন্মিল। আমি ভাবিলাম, রসময় হরিসাধনের জ্ঞাতি ভাই। ইনি তাঁহার মৃত্যুতে যেরূপ শোকাতুর হইয়াছেন, শক্তিসাধন আপন সহোদর হইয়া সেরূপ দুঃখিত নহেন কেন?”

 সে যাহা হউক, কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি রসময়বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন ত আপনাদের বিশ্বাস হইয়াছে যে, হরিসাধনবাবুকে কেহ বিষ প্রয়োগে হত্যা করিয়াছে?”

 একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া অত্যন্ত দুঃখিতভাবে রসময়বাবু বলিলেন, “যখন সরকারী ডাক্তার হরিসাধনের মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া ঐ কথা বলিয়াছেন, তখন আর আমাদের অবিশ্বাসের কারণ কি? কিন্তু আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইতেছি যে, শক্তিসাধন পূর্ব্বে একথা কেমন করিয়া জানিতে পারিল এবং কেই বা হরিসাধনের উপর এতদূর শত্রুতা করিল?”

 আ। কেন, আপনি কি তাহা জানেন না?

 আমার কথা শেষ হইতে না হইতে রসময়বাবু আন্তরিক রাগান্বিত হইলেন। তিনি অতি কর্কশভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কথার তাৎপর্য্য কি? আপনার কথার ভাবে বোধ হইতেছে যে, আপনি কাহাকেও সন্দেহ করিয়াছেন।”

 রসময়ের কথায় আমি আন্তরিক লজ্জিত হইলাম। ভাবিলাম, কথাটা বলা ভাল হয় নাই। কিন্তু যাহা হইয়া গিয়াছে তজ্জন্য বৃথা অনুশোচনা করিলে কোন ফল হইবে না জানিয়া, অতি নম্র কথায় রসময়কে শান্ত করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “গতকল্য আপনি হরিসাধনের বাড়ীতে গিয়াছিলেন কি?”

 অতিপয় বিরক্তির সহিত রসময় উত্তর করিলেন, “হাঁ, নিমন্ত্রিত হইয়া তাঁহার বাড়ীতে গিয়াছিলাম এবং একসঙ্গে বসিয়া আহার করিয়াছিলাম।”

 যেরূপ সরলভাবে রসময় ঐ কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে তাঁহার উপর কোন প্রকার সন্দেহ হইল না। যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্যের সহিত বিষ মিশ্রিত করিয়া অপরের প্রাণসংহার করিয়াছে, সে কখনও সরলভাবে সে কথার উল্লেখ করিতে পারে না; তাঁহার মনে কোন না কোন প্রকার ভয়ের উদ্রেক হইবেই। কিন্তু যখন শক্তিসাধনবাবু তাঁহারই উপর সন্দেহ করিয়াছেন, তখন একবার ভাল করিয়া না দেখিয়া কোন কার্য্য করা উচিত নহে। এই ভাবিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “হরিসাধনবাবুর সহিত আপনার কেমন সদ্ভাব? শুনিলাম, আপনি তাঁহার অনেক ক্ষতি করিয়াছেন?”

 “কে আপনাকে এমন কথা বলিল? বুঝিয়াছি, ইহাও সেই

শক্তিরই কার্য্য। লোকটা নীচ সংসর্গে থাকিয়া নীচ প্রকৃতি প্রাপ্ত হইয়াছে। যে ব্যক্তি অন্নদাতা জ্যেষ্ঠের নিন্দা করে, তাঁহাকে শক্ত বলিয়া পরিচয় দেয়, সে লোক সকল কথাই বলিতে পারে। কিন্তু হরিসাধন তেমন ছিলেন, না। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, আমি তাঁহাকে তাঁহার পৈত্রিক সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করি নাই বরং তিনিই এতদিন আমাদিগকে ঐ স্বত্ত্ব হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। যখন বুঝিতে পাৱিলেন, তখন আর আমাদের মনোমালিন্য রহিল না। কাল তাঁহাদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ ছিল, আমাদের উভয়ের মধ্যে এত সদ্ভাব যে, আমরা একপাতে দুইজনে আহার করিয়াছিলাম। শক্তিসাধন স্বচক্ষে এ ব্যাপার দেখিয়াছে।

 আমি সে কথার কোন উত্তর না দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি শুনিয়াছেন, হরিসাধনবাবুর পাকস্থলীতে আর্সেনিক পাওয়া গিয়াছে। তিনি বাস্তবিকই কলেয়ায় মারা পড়েন নাই।”

 রসময়বাবু আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন; কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া তাঁহাকে ভীত বলিয়া বোধ হইল না। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! হরিসাধনের মৃতদেহের সৎকার হইয়া গিয়াছে কি?”

 আমি উত্তর করিলাম, “এতক্ষণ বোধ হয় হইয়া গিয়াছে। অপরের দোষে তাঁহার মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করা হইয়াছিল। তাঁহার কি কোন সন্তান আছে?”

 র। আজ্ঞে না। শক্তিসাধনই তাঁহার মুখাগ্নি করিবার উপযুক্ত ভাই, কিন্তু লোকটা জাতিচ্যুত হইয়াছে। সুতরাং তাঁহার স্ত্রীকেই ঐ কার্য্য করিতে হইবে।

 আ। আর বিষয় সম্পত্তি?

 র। শক্তিসাধন কিছুই পাইবে না।

 আ। কেন

 র। যাহাকে সমাজ হইতে বহিস্কৃত করিয়া দেওয়া হইয়াছে, যে এখন একজন নীচ-জাতীয়া বেশ্যার সহিত বসবাস করিতেছে, সে কেমন করিয়া তাহার জ্যেষ্ঠের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইবে?

 আ। শুনিয়াছি, হরিসাধনের স্ত্রী না কি শক্তিসাধনকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন?

 র। আজ্ঞে হাঁ—সেই জন্যই বোধ হয় সে বাড়ী হইতে তাহার অন্ন উঠিবে না।

 এই কথা বলিয়া রসময়বাবু কি চিন্তা করিলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “শক্তিসাধন কেমন করিয়া জানিতে পারিল যে, হরিসাধন বিষপানে মারা পড়িয়াছেন। তাহার হঠাৎ এই সন্দেহেয় কারণ কি?”

 আমি আর সকল কথা গোপন রাখা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম না। তাঁহাকে বলিলাম, “শক্তিসাধন আপনার উপরে সন্দেহ করিয়া আমাদিগকে সংবাদ দিয়াছিলেন। তিনি বলেন, আপনি কৌশলে কোন খাদ্যদ্রব্যের সহিত আর্সেনিক মিশ্রিত করিয়া ছিলেন।”

 আমার কথায় বাধা দিয়া রসময়বাবু বলিয়া উঠিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! সেই জন্যই বুঝি আপনিও প্রথমে আমার উপর সন্দেহ করিয়া সেই সকল অপ্রীতিকর কথা বলিয়াছিলেন?”

 আ। আমার অপরাধ কি? আমি যেমন শুনিয়াছিলাম, সেই মতই কার্য্য করিতেছি।

 র। তিনি কি আমাকে কোন খাদ্যব্যের সহিত বিষ মিশ্রিত করিতে দেখিয়াছিলেন?

 আ। আজ্ঞে না, স্বচক্ষে দেখেন নাই। তবে আপনাকে বারম্বার হরিসাধনবাবুর পাতে হাত দিতে দেখিয়াই ঐ প্রকার সন্দেহ করিয়াছিলেন।

 আর সেই সন্দেহ করিয়া তিনি মৃতদেহ সৎকারে বাধা দিয়াছিলেন?

 রসময় বাবুর কথা শুনিয়া আমার চমক ভাঙ্গিল। আমি তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলাম না। কিন্তু তিনি পুনর্ব্বার আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “যখন শক্তিসাধন থানায় সংবাদ দিতে সাহস করিয়াছিল, তখন কি কেবল সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া সেই গুরুতর কার্য্য করিয়াছিল? শক্তিসাধন সামান্য বালক নহে, তাহার বয়স প্রায় চৌত্রিশ বৎসর। সে কি জানিত না যে, তাহার কথা প্রমাণ করিতে না পারিলে তাহারই সর্ব্বনাশ হইবে। নিশ্চয়ই জানিত। সুতরাং সামান্য সন্দেহ করিয়া সে এই মহৎ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে নাই।”

 রসময়বাবুর কথাগুলি আমার মনে লাগিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কি বলেন তিনি স্বচক্ষে কোন ব্যাপার দেখিয়াই থানায় সংবাদ দিতে সাহস করিয়াছিলেন?”

 সে কথা আপনিই বুঝিয়া দেখুন। যদি সরকারী ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া বলিতেন, হরিসাধন কলেরায় মারা গিয়াছেন, তাহা হইলে কি আপনারা শক্তিকে সহজে ছাড়িয়া দিতেন? তাহার মিথ্যা কথার জন্য কি কোন প্রকার শাস্তি দিতেন না?

 আ। নিশ্চয়ই তিনি শাস্তি পাইতেন। কিন্তু এখন ত তাঁহার সন্দেহ সত্যে পরিণত হইয়াছে, এখন ত আর তাঁহাকে শাস্তি দেওয়া যাইতে পারে না।

 রসময়বাবু সে কথার কোন উত্তর করিলেন না। পরে ব্যঙ্গস্বরে বলিলেন, “তিনি ত আমার নামেই দোষারোপ করিয়াছেন, যদি আপনার বিশ্বাস হয়, আপনি আমায় গ্রেপ্তার করুন। বিচারে যাহা হয় হইবে। কিন্তু বলিয়া রাখি, শক্তিসাধনকে সামান্য লোক মনে করিবেন না।”

 আমি শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তিনি কেমন লোক?”

 র। যিনি অন্নদাতা জ্যেষ্ঠকে সকলের নিকট শত্রু বলিয়া প্রকাশ করিতে লজ্জিত হন না, তিনি কেমন লোক বুঝিয়া লউন। পূর্ব্বে তিনি এমন ছিলেন না, সম্প্রতি কেদার ডাক্তারের সঙ্গে মিশিতে আরম্ভ করিয়া তাঁহার এত পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে।

 আ। কেদার ডাক্তার! তাঁহার নিবাস কোথায়?

 র। শক্তিসাধনের বাড়ীর নিকটেই। আজকাল শক্তির সহিত তাঁহার বিশেষ প্রণয়। এখন বাজে কথা ছাড়িয়া দিন, যে কার্য্যে আসিয়াছেন, তাহা সিদ্ধ করুন।

 কিছুক্ষণ ভাবিয়া আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “রসময়বাবু। আমরা পুলিসের লোক বটে, কিন্তু আমাদেরও একটা কর্ত্তব্য আছে।”

 আমার কথায় বাধা দিয়া রসময়বাবু লজ্জিতভাবে বলিলেন, নিশ্চয়ই আছে। আমি সে ভাবিয়া আপনাকে কোন কথা বলি নাই। যখন শক্তিসাধন আমারই নামে অভিযোগ করিয়াছে, তখন আপনি কি করিবেন? মিথ্যা হইলেও আপনাকে এখন তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া কার্য্য করিতে হইবে।

 আ। শক্তিসাধন আপনার নামে অভিযোগ করেন নাই, তাঁহার সে সাহস নাই। কেবল সন্দেহ করিয়াছেন।

 র। আপনি তবে এখন কি করিতে চান?

 আ। আপনার সাহায্য চাই!

 র। কোন্ কার্য্যে?

 আ। অকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করিতে। আপনারই মুখে শুনিলাম, হরিসাধনবাবুর সহিত আপনার বড়ই সদ্ভাব ছিল। যদি তাই হয়, তাহা হইলে আপনারও নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে।

 রসময় মুখে কোন উত্তর করিলেন না। কিন্তু তাঁহার চক্ষুদ্বয় দিয়া দরদরিত ধারে অশ্রুজল বিগলিত হইতে লাগিল। তিনি যে সম্পূর্ণ নির্দ্দোষী, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ রহিল না।

 কিছুক্ষণ পরে শান্ত হইয়া রসময় অতি বিনীত ভাবে বলিলেন, “আমি প্রাণপণে আপনার সাহায্য করিতে সম্মত আছি। যতক্ষণ না হরিসাধনের হত্যাকারীকে রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইতে দেখিতেছি, ততক্ষণ আমিও নিশ্চিন্ত হইতে পারি না। আপনি শক্তিসাধনের উপয় একটু নজর রাখিবেন, তাহা হইলে শীঘ্রই সফল হইতে পারিবেন। তদ্ভিন্ন আপনার যখন যেরূপ সাহায্যের আবশ্যক হইবে, দয়া করিয়া আমায় সংবাদ দিলে আমি আপনার নিকট গমন করিব।”

 কথায় কথায় বেলা দশটা বাজিয়া গেল। আমি রসময়বাবুকে ধন্যবাদ দিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইলাম এবং থানায় প্রত্যাগমন করিলাম।