লীলা।

বিশ্বসীমা প্রান্তভাগে বিচিত্র কানন,
দুলিয়া দুলিয়া যায় মৃদুল পবন।
দূরে রাখি হিংসা দ্বেষ, মঙ্গল আলয়,
সতত বিরাজে যেন শাস্তি সুধাময়ু।
অস্ত গেল দিনমণি শিখর উপরে,
বিচিত্র সুন্দর ঘটা, ক্ষুদ্র ঘন সাজে।
সমাধি পরেতে হেথা ফুল সাজাইয়ে,
নির্নিমেষ ভরে বালা চাহিল আকাশে,—
পুন সমাধি পরেতে করুণ-নয়নে;–
সে লোচনে কত যে হইল ভাব
কে বলিতে পারে?
অলক্ষ্য প্রভাবে এক জ্যোতির কণিকা
কোথা ভেসে গেল?—পাগলের পারা;
যেন ধীরে ধীরে জানু পাতি কহিল দেবেরে—
“কহ মোরে, পরমাণু কত দিন জীবে আর?”
অবশেষে বক্ষপরে গোলাপ ধরিয়া এক,—
মান মুখ,—বহিতেছে করুণার ধার,
ক্ষণে ক্ষণে পড়িছে বা শ্বাস হৃদি বিদরিয়ে,—
“অপ্রাপ্ত যৌবন তোর রে গোলাপ,—

আর কভু আসিবে কি সে আমার?—
দিয়েছিল এই ভাবে,—
বুকে করি রেখেছিনু আমি!

  •   *  *

ভালবাসি প্রাণ ভোরে,
তাই এবে বনবধু তুমি!

“হৃদয়ে হৃদয়ে,  পরাণে পরাণে,
হাসির সহিত,  হাসিটি মিলায়ে,
গাহিতে কহিত যবে সে আমায়;
হৃদয় হারাত,  পরাণ গলাত,
স্বপনের কথা,  সতত কহিত,—
মরিলে কি পুন পাব আর তায়?
‘লীলা’ ব’লে যবে  ডাকিত আমায়,
পুষ্পবৃষ্টি কেন,  হ’ত যে তথায়;–
অধীর-নয়ন প্রেমে বিগলিত –
আদরে যতনে কোলে টানি নিত।”

এ হেন সময়ে লহর আসিয়ে,
ধীরি ধীরি ধীরি,  পাদুটি টিপিয়ে,
চুপি চুপি চুপি পানিতল দিয়ে
চাপিয়া ধরিল নয়ন দুটী!—

আবার তখনি সহসা অমনি,
কি জানি কেন সে, পাগলের মত,
বিস্মিত হৃদয়ে ছাড়িয়া দিল!
সেই দিন হ’তে লহর কুমার,
জীবনেতে কেন কাঁদিতে শিখিল?

অঞ্চলেতে ধীরে অশ্রুজল মুছি,
কবির হৃদয় হৃদয়েতে ঢাকি—
কহিল বালিকা, ফুল-হাসি হাসি—
“পাপিয়সী আমি, দেখিছ কি আর?”
তখন লহর, আকাশের পানে—
হৃদয় তাহার ফাটিয়া গেল!
তারকার সহিত গোপনে ঢালিয়ে
কাতর নয়নে কহিতে লাগিল—
“কহ মোরে সই, তোমারে শুধাই,
ভাঙ্গা ঘরে কেন চাঁদিনী খেলিল?”

দুই দিন পরে বালা শুইল শয্যাতে,
পাংশুবর্ণ রেখা তার পড়িল মুখেতে,
অধীর নয়ন ক্রমে মুদিয়া আসিল,
ঘোর বাত্যা হ’তে যেন তিমিরে ডুবিল!
লহর কুমার হেথা শয্যার পার্শ্বেতে

থির নেত্রে মুখপানে চাহিয়ে চাহিয়ে—
সদাই প্রহর গুনিতে লাগিল!
হাত ধরি বালা কহিল তখন—
“চলিলাম ভাই”-হায়! হায়! হায়!
লহরও ঢালিল, মুখে মুখ দিল—
প্রাণশূন্য কায়া;—কেহ না উঠিল!