ঝাঁশির রাণী/ঝাঁশি-রাজ্য
ঝাঁশির রাণী।
ঝাঁশি-রাজ্য।[১]
রাণীর জীবনের ঘটনাগুলি ভাল করিয়া বুঝিতে হইলে, ঝাঁশির পূর্ব্ব-বৃত্তান্ত কতকটা জানা আবশ্যক। ঝাঁশি-রাজ্য বুণ্ডেলখণ্ডের অন্তর্ভূত। প্রথমে ইহা বোরচ্ছার রাজা বীরসিংহদেবের শাসনাধীনে ছিল। দিল্লিপতি আকবর বাদশাহের প্রসিদ্ধ মন্ত্রী আবুল ফজলকে বীরসিংহদেব নিহত করায়, আকবর তাঁহার শাসনের জন্য স্বীয় পুত্র সেলিমকে বুণ্ডেলখণ্ডে প্রেরণ করেন। বীরসিংহদেব ভয়ে পলায়ন করায়, বুণ্ডেলখণ্ড মোগলরাজের হস্তগত হয়। পরে, সেলিম (জাহাঙ্গীর) সিংহাসনারূঢ় হইলে, বীরসিংহের অপরাধ মার্জ্জনা করিয়া, তাঁহাকে বুণ্ডেলখণ্ড প্রত্যর্পণ করেন। জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হইলে, শাজাহান-বাদশাহের শাসনকালে, এই দুর্ব্বৃত্ত বীরসিংহদেব, মোগলরাজ্যের অন্তর্গত প্রদেশে লুটপাট আরম্ভ করায়, তাঁহার জায়গীর পুনরায় বাজেয়াপ্ত হয়। সেই সময় হইতে ১৭০৭ পর্য্যন্ত ঝাঁশি-প্রদেশ দিল্লি বাদশাহের শাসনাধীনে ছিল। তদনন্তর, বাহাদুর-শা দিল্লির সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলে, তিনি এই ঝাঁশি-প্রদেশ হিন্দু রাজা ছত্রশালকে জাইগীর-স্বরূপ দান করেন। ছত্রশালের অভ্যুদয়ে ঈর্ষান্বিত হইয়া মালোয়ার মুসলমান সুবেদার ও আলাহাবাদের নবাব তাঁহার রাজ্য বারম্বার আক্রমণ করিতে লাগিল।
রাজা ছত্রশাল এই সময়ে বার্দ্ধক্যদশায় উপনীত হওয়ায় প্রবল যবন সরদারদিগের সহিত প্রতিযোগিতা করিতে অসমর্থ হইয়া অবশেষে স্বকীয় উদ্ধার সাধনের জন্য, মহারাষ্ট্রাধিপতি বাজীরাও পেশোয়ার শরণাপন্ন হইলেন। পেশোয়া করুণা-পরবশ হইয়া ছত্রশালের সাহায্যে যাত্রা করিলেন, এবং মুসলমান সরদারদিগকে পরাভূত করিয়া ছত্রশালকে স্বরাজ্যে প্রতিস্থাপিত করিলেন। ছত্রশাল কৃতজ্ঞ হইয়া, বুণ্ডেলখণ্ডের কতকগুলি প্রদেশ, পেশোয়াকে নজর-স্বরূপ দান করিলেন। শুদ্ধ তাহাই নহে, মৃত্যুকালে বাজীরাওকে স্বীয় পুত্র-স্বরূপ গণ্য করিয়া, তিন কোটী টাকা আয়ের একটা ভূসম্পত্তি দান করিয়া গেলেন। ইহার অন্তর্ভূত ২০ লক্ষ টাকা আয়ের সম্পত্তি ঝাঁশি-রাজ্য। পরে, ১৭৫৯ খৃষ্টাব্দে ঝাঁশির পূর্বাধিকারী “গোসাবী” রাজার বিদ্রোহী হইয়া পেশোয়ার সুবেদারকে পরাভূত করিল। পেশোয়া এই সংবাদ শুনিবামাত্র রঘুনাথ-হরি-নেবালকর নামক একজন পরাক্রান্ত মারাঠী সরদারকে বুণ্ডেলখণ্ডে পাঠাইলেন। ইনি “গোসাবী” রাজাদিগকে পরাভূত করিয়া তথায় পুনর্ব্বার পেশোয়ার আধিপত্য স্থাপন করিলেন। পেশোয়া ইহাতে পরিতুষ্ট হইয়া ঝাঁশির সুবেদারী পদ রঘুনাথ-হরি-নেবালকরকে বংশপরম্পরাক্রমে প্রদান করিলেন। এই রঘুনাথরাও-হরি-নেবালকর―ইনি মহারাণী লক্ষ্মীবাইর ভর্ত্তৃবংশের আদিপুরুষ।
রঘুনাথ রাওর বার্ধক্যদশা উপস্থিত হইলে, তিনি স্বীয় কনিষ্ঠ সহোদর শিবরাও-ভাউকে ঝাঁশির সুবেদারী পদে স্থাপন করিলেন। শিবরাও-ভাউ ইনিও একজন বীরপুরুষ। এই সময়ে দ্বিতীয় বাজীরাওর শাসনকালে―মহারাষ্ট্রীয় রাজ্যসূত্র শিথিল হইয়া পড়ায়, পেশোয়ার অধীনস্থ সুবেদারেরা নিজ নিজ অধিকারের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করে। বুণ্ডেলখণ্ডে, শিবরাও-ভাউও সেই পথ অনুসরণ করেন। এই সময়ে, “বসঁই” (Bassein) সন্ধির সুযোগে, মারাঠী-সাম্রাজ্য মধ্যে ইংরাজদিগের চঞ্চু-প্রবেশ হইয়াছিল মাত্র, তখনও তাঁহারা প্রবল হইতে পারেন নাই। তখন শিন্দে, হোলকার, নাগপুরকর ভোঁসলে প্রভৃতি রণশূর মারাঠী সরদারদিগের জোট ভাঙ্গিবার জন্য, ওএলেসলি, লেক্ প্রভৃতি ইংরাজ সেনাপতিগণ, প্রকাশ্যরূপে পেশোয়ার পক্ষ অবলম্বন করিয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এই সময়ে বুণ্ডেলখণ্ডের সুবেদার শিবরাও ভাউ ইঁহাদিগকে নানাপ্রকারে সাহায্য করেন। সেই অবধি, ইংরাজ-সরকার ঝাঁশি-রাজ্যের সহিত মিত্রতা-সূত্রে আবদ্ধ হইলেন। অনন্তর শিবরাও-ভাউ স্বীয় পৌত্র রামচন্দ্র রাওর হস্তে ঝাঁশি-রাজ্য ন্যস্ত করিয়া, শ্রীক্ষেত্র ব্রহ্মাবর্ত্তে প্রস্থান করেন। এই সময়ে পুণা নগরস্থ পেশোয়া বিলাসের গভীরতম রসাতলে নিমগ্ন থাকায়, মহারাষ্ট্র-রাজ্যের সমস্ত আধিপত্য অল্পে অল্পে ইংরাজের হস্তগত হইতেছিল। রামচন্দ্র-রাও যখন ঝাঁশির গদিতে উপবিষ্ট হইলেন, তখন তাঁহার বয়স অতি অল্প ছিল, সুতরাং তাঁহার হইয়া তাহার মাতৃদেবী সখুবাই ও রাজ্যের পুরাতন দেওয়ান রাও-গোপাল-রাউ, ইঁহারাই রাজকার্য নির্ব্বাহ করিতেন। ১৮১৭ অব্দে সুবেদার রামচন্দ্রের তরফে গোপাল-রাও-ভাউ এবং ব্রিটিশ সরকারের তরফে পোলিটিকেল সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট জন-ওয়াকোপ—ইঁহাদের মধ্যে একটা সন্ধিপত্র লেখাপড়া হইল। রাও রামচন্দ্র বংশপরম্পরাক্রমে ঝাঁশি-রাজ্যের অধিকারী, এই কথা ব্রিটিশ সরকার এই সন্ধিপত্রে স্বীকার করিলেন এবং উভয় সরকার পরস্পরের সহিত মিত্রতা-সূত্রে আবদ্ধ হইয়া বিপদাপদে পরস্পরের সাহায্য করিবেন, এইরূপ স্থির হইল। এই সন্ধিপত্রের পণানুসারে রামচন্দ্র রাও বাস্তবিকই ইংরাজদিগকে নানাপ্রকারে সাহায্য করিয়াছিলেন। এই সকল উপকার স্মরণ করিয়া কৃতজ্ঞ ইংরাজ-সরকার ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে একটা দরবারের অনুষ্ঠান করিয়া, ঝাঁশির সুবেদারকে “মহারাজাধিরাজ” ও “ফিদবী বাদশাহা জানুজা ইংগ্লস্তান” (মহিমান্বিত ইংলণ্ডেশ্বরের একনিষ্ঠ সেবক) এই উপাধি অর্পণ করিলেন। শুদ্ধ তাহাই নহে, ইঁহাকে ছত্রচামরাদি রাজ-চিহ্ন ধারণের অধিকার প্রদান করিলেন এবং রামচন্দ্রের অনুরোধ-অনুসারে ঝাঁশির কেল্লার উপর ব্রিটিশ-পতাকা “য়ুনিয়ন জ্যাক্” স্থাপন করিবার অনুমতি দিলেন। রামচন্দ্র-রাশুর মৃত্যু হইলে, তাহার পত্নী স্বীয় ভাগিনেয়। কৃষ্ণরাও নামক একটা বালককে দত্তক গ্রহণ করেন, কিন্তু ব্রিটিশ-সরকার অশাস্ত্রীয়তা-মূলে ইহার দত্তক-বিধান অগ্রাহ্য করিয়া রামচন্দ্রের পিতৃব্যের এক ঔরসপুত্র তৃতীয় রঘুনাথ-রাওকে ঝাশির গদিতে স্থাপন করিলেন।
তৃতীয় রঘুনাথরাও অত্যন্ত দুর্বাসনী ছিলেন। তিনি ভোগবিলাসে বিপুল অর্থ অপব্যয় করিয়া ঋণগ্রস্ত হইয়া, ঝাঁশির অধিকাংশ ভূসম্পত্তি গোয়ালিয়র ও বোছার মহাজনদিগের নিকট বন্ধক রাখিতে বাধ্য হইয়া- ছিলেন। ইহা দেখিয়া ব্রিটিশ-সরকার, ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে, ঝাশি-রাজ্যের কার্যভার নিজ হস্তে গ্রহণ করেন। তৃতীয় রঘুনাথ রাওর মৃত্যু হইলে, বঁশির গদি অধিকার করিবার জন্য তিন চারিজন দাবীদার খাড়া হইল। তন্মধ্যে, ব্রিটিশ-সরকার শিবরাও-ভাউর পুত্র গঙ্গাধর-রাওর দাবী মঞ্জুর করিয়া তাহা- কেই গদিতে স্থাপন করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। কিন্তু যে পর্যন্ত ঝুঁশি- রাজ্যের ঋণ পরিশোধ না হয় সে পর্যন্ত ইংরাজ-সরকারের নিযুক্ত সুপারি-প্টেণ্টে রাজকার্য নির্বাহ করিবেন, এইরূপ স্থির হইল। তদনুসারে ১৮৪২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সমস্ত ঋণ কর্জের হিসাব নিষ্পত্তি হইল; এবং ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৪২ খৃষ্টাব্দের মধ্যে বুলেখণ্ডের পোলিটিক্যাল এজেণ্ট—উইলিয়ামহের সীম্যান সাহেব, গঙ্গাধর-বাওর সহিত একটা লেখাপড়া করিয়া, বুন্দেলখণ্ডস্থ ইংরাজ-সৈন্যের ব্যয় নির্বাহার্থ ২,২৭,৪৫৮ টাকা আয়ের একটা প্রদেশ লইয়া, গঙ্গাধর-রাওকে ঝাশির আধিপত্য প্রদান করিলেন। এই মহারাজা গঙ্গাধর-রাও, মহারাণী লক্ষ্মীবাই-সাহেবের ভাবী পতি।
- ↑ ইংরাজী শব্দ state অর্থে “সংস্থান” শব্দ মারাঠী ভাষায় ব্যবহৃত হইয়া থাকে।