টম্‌ খুড়ো/বিবি বর্ডের সহিত ইলাইজার কথোপকথন

বিবি বর্ডের সহিত ইলাইজার কথোপকথন।

 ইলাইজা তাহাদিগকে দর্শন করিয়া নয়ননীরে ভালিতে লাগিলেন, তদ্দর্শনে বিবির অশ্রুপাত হইল এবং তিনি ক্রন্দন করিতে করিতে বলিলেন, হে দরিদ্রা নারী! তোমার কোন ভয় নাই, আমাদিগকে তোমার বন্ধু স্বরূপ জানিও। অতএব বল তুনি কোথা হইতে আসিয়াছ তোমার অভাবই বা কি এবং কি জন্যই বা পলাইয়া আইলে? তাহাতে তিনি উত্তর করিলেন, আমি কেনটকি হইতে আসিতেছি, কিন্তু তৎকালে তিনি বিবির মুখ পানে চাহিয়া দেখিলেন যে তিনি ক্রন্দন করিতেছেন। তাহাতে হঠাৎ বলিলেন, হে মান্যা বিবি! আপনকার কি কখন সন্তান বিয়োগ হইয়াছে? তচ্ছ্রবণে সাহেব বিবি দুই জনেই অতিশয় দুঃখিত হইলেন। যে হেতুক এক মাস হইল তাঁহাদিগের একটী শৈশব সন্তান অকালে কাল গ্রাসে পতিত হইয়াছে। বর্ড সাহেব আপন তনয়ের মৃত্যু স্মরণ হওয়াতে শোকাতুর হইয়া বাতায়নের নিকটে বেড়াইতে লাগিলেন। বিবিও অত্যন্ত বিষাদসাগরে মগ্ন হইলেন। পরে কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া ইলাইজাকে বলিলেন, তুমি আমাকে কেন এরূপ নিদারুণ বাক্য প্রশ্ন করিলে, এক মাস গত হইল আমার একটী পুত্র মরিয়াছে। আহা! তাহার মুখ স্মরণ হইলে বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হয়। তাহাতে ইলাইজা বলিলেন, তবে তুমি আমার দুঃখ বিলক্ষণ বোধ করিতে পারিবে, কারণ আমারও একে একে দুইটী সন্তান মরিয়াছে, অবশেষে এইটী সবে ধন, ইহার মুখ চাহিয়া ধরাতলে প্রাণ ধারণ করিয়া আছি। ইহাকে ছাড়িয়া রাত্রি কালে নিদ্রা যাইতে পারিনা। পরন্তু আমার নিষ্ঠুর প্রভূ ইহাকেও বিক্রয় করিয়াছে, আমার নিকট হইতে লইয়া যাইবে। সন্তানকে বিক্রয় করা মা হইয়া কেমনে সহ্য করিব, তজ্জন্য সেই রাত্রেই বাছাকে লইয়া পলাইয়া আসিয়াছি, কিন্তু নৃশংস দাসক্রেতা দুই তিন জন লোক লইয়া আমার পশ্চাতে পশ্চাতে আসিতেছে। তদ্দর্শনে সাতিশয় ভীতা হইয়া যাইতে যাইতে সম্মুখে একটী নদী দেখিলাম, যাহার জল বরফরাশীতে আচ্ছাদিত। কি করি, তাহার উপর বার বার লম্ফ প্রদান করিয়া পার হইয়াছি। কেবল এক ব্যক্তি নদীর তটে আমাকে আশ্রয় প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি কে তাহা আমি জানি না। তাহাতে সকলেই একবারে বলিল, কি তুমি বরফের উপর দিয়া পার হইয়াছিলে? হাঁ মহাশয়! তাহারা পশ্চাতে আসিতেছে, আর কোন পথ নাই, সুতরাং এরূপে পার না হইয়া আর কি করি। জগদীশ্বরের অনুগ্রহে আসিয়াছি, আমার কি সাধ্য।

 ইলাইজার অসংসাহসী কর্ম্ম শ্রবণ করিয়া আবাসবাসী জনগণের মনে সাতিশয় দুঃখোদ্ভাবিত হইল। বর্ড সাহেব স্বীয় দুঃখ গোপন করিবার মানসে ছলে চস্মা পরিষ্কার করিতে করিতে নাসিকা ঝাড়িতে লাগিলেন। ক্ষণেক কাল পরে বিবি বর্ড শোক সম্বরণ করিয়া ইলাইজাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কোথায় যাইতে মানস করিয়াছ? তাহাতে তিনি কহিলেন আমি কেনেডা নগরে গমন করিব। যে হেতুক কেনেডা ব্যতীত আর কোন স্থান আমি অবগত নহি। ভাল, বিবি সাহেব কেনেডা এখান হইতে কত দুর হইবে? তাহাতে তিনি উত্তর করিলেন, কেনেডা অনেক দূর, কিন্তু তুমি এস্থানে অবস্থিতি কর যাহাতে তোমার ভাল হয়, তাহা করিতে যত্নবান্ হইব। পরে ডানিয়া নামক ভূত্যকে আহ্বান করত আদেশ করিলেন যে রন্ধনশালার নিকটবর্ত্তী আপন গৃহমধ্যে ইহাদিগের শয্যা পাতিয়া দেও। তখন ইলাইজার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, হে দরিদ্রা নারী ভীতা হইও না, জগদীশ্বরের প্রতি বিশ্বাস কর, তিনি তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন। এই বলিয়া সাহেব বিবি উভয়ে বৈঠকখানায় গনন করিলেন এবং তথায় যাইয়া বিবি বর্ড অগ্নির নিকটে উপবেশন করিয়া এই সকল বিষয় মনে মনে আন্দোলন করিতেছিলেন, সাহেবটী চিন্তান্বিত হওত গৃহের অভ্যন্তরে বেড়াইতে লাগিলেন। পরে ক্ষণেককাল বিলম্বে তিনি আপন ভার্য্যার নিকটে যাইয়া কহিলেন। দেখ; ইহাদিগকে রজনীতে এখানেরাখা কোনমতে বিধেয় নহে কি জানি নৃশংস বণিক কল্য প্রাতে এস্থানে আসিলেও আসিতে পারে তাহা হইলে অতিশয বিপদ ঘটীবার সম্ভাবনা, তচ্ছ্রবণে বিবি কহিলেন রাত্রিকালে কিরূপে স্থানান্তর করিবে, আর কোথাইবা লইয়া যাইবে, তাহাতে বর্ড সাহেব পাদুকা পরিধান করিতে করিতে বলিলেন যেস্থানে গমন করিলে নিরাপদ হইবে সেইস্থান আমি ভাল জানি, কিন্তু একটী বিষয় অতিশয় কঠিন হইতেছে, রাত্রিকালে আমি ভিন্ন অন্য কেহ সেখানে গাড়ি চালাইতে পারে না, এবং পথে দুইবার খাল পার হইতে হইবে, প্রথম বার যাহাহউক দ্বিতীয় বারই অত্যন্ত আপদ। অতএব বিশেষ অবগত না থাকিলে কেহই যাইতে পারিবে না তন্নিমিত্তে আমি তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব, যে হেতুক দরিদ্রা স্ত্রীলোক যে ধৃত হইবে তাহা আমি চক্ষে দেখিতে পারিব না, এই কথা শুনিয়া বিবি সাহেবের গাত্রে হস্তার্পণ করত বিস্তর ধন্যবাদ প্রদান করিয়া কহিলেন। তোমার এতাদৃশ গুণ না থাকিলেই বা তোমাকে এত ভাল বাসিব কেন? পরে বর্ড সাহেব শকট অন্বেষণে যাত্রা করিয়া ক্ষণেককাল দ্বার দেশে দণ্ডায়মান থাকিয়া পুনরায় প্রত্যাগমন পুরঃসর আপন ভার্য্যাকে কহিলেন প্রিয়া মেরি! যদ্যপি কিছু না মনে কর তাহা হইলে আমি একটী কথা বলি, অর্থাৎ আমাদিগের মৃত সন্তান হেনেরির দ্রব্যাদিতে দেরাজ পরিপূর্ণ রহিয়াছে এই বলিয়া গমন করত দ্বার রুদ্ধ করিলেন, তখন বিবি বর্ড আপন গৃহের পাশ্ববর্ত্তী শয়নাগারের দ্বার উদ্ঘাটন পূর্ব্বক আলো জ্বালিয়া চাবি কাটী লইয়া দেরাজ খুলিতে খুলিতে বিমর্ষভাবে ক্ষণেককাল চুপ করিয়া রহিলেন। তৎকালে দুইটী বালক তাঁহার অনুগামী হইয়া কিঞ্চিৎকাল তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করত কহিল হে মাত! যদ্যপি ভবদীয় আবাসে এবম্বিধ দেরাজ না থাকিত তাহা হইলে আপনি অত্যন্ত সুখী হইতেন, যে হেতুক মৃতসন্তানের দ্রব্যাদি সন্দর্শন করিলে কোন্ মাতার অন্তঃকরণে না শোক উপস্থিত হইয়া থাকে? পরে বিবি বর্ড ধীরে ধীরে দেরাজ উদ্ঘাটন পূর্ব্বক অনেক প্রকার বস্ত্র মোজা ও পাদুকা ও ক্রীড়া উপযোগী দ্রব্যাদি বাহির করত দেরাজের সন্নিকটে উপবেশিতা হইয়া বিস্তর ক্রন্দন করিতে লাগিলেন, ক্ষণেককাল পরে শোক সম্বরণ পুরঃসর গাত্রোত্থান করিয়া উত্তম উত্তম দ্রব্য গুলিন একত্র করিতেছেন, এমত সময়ে একটী বালক কহিল, হে মাত! আপনি এ সকল দ্রব্য লইয়া কোথায় নিক্ষেপ করিবেন? তাহাতে তিনি উত্তর করিলেন, প্রিয় বালকেরা! আমি যাহা করিতেছি তাহা যদ্যপি মৃত হেনেরি স্বর্গ হইতে দৃষ্টিপাত করিত, তাহা হইলে অতিশয় আহ্লাদিত হইত, আমাপেক্ষা অধিকতর কাতরাপন্ন ব্যক্তিকে এই সকল দ্রব্য প্রদান করিব। তাহাতে জগদীশ্বর যৎপরোনাস্তি মঙ্গল করিবেন, পরিশেষে বর্ড সাহেব রাত্রি দুই প্রহরের সময় শকট লইয়া বাটীতে প্রত্যাগমন করিয়া আপন ভার্য্যাকে আহ্বান করত কহিলেন। ইলাইজাকে সন্তান সহ জাগরিত কর, আমি শকট আনিয়াছি, তাহাদিকে লইয়া যাইব, তাহাতে তাহাদিগকে জাগরিত করিতে গাত্রোত্থান করিলেন, এবং তাহার হিতকারিণী বিবি কর্ত্তৃক দত্তা বস্ত্র ও টুপি পরিধান করত সন্তানটীকে ক্রোড়ে লইয়া দ্বার দেশে উপনীত হইল, পরে যখন শকট আরোহণ করিতে যান, এমত সময়ে বিবি বর্ডের মুখের দিগে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকাতে বোধ হইল যেন কোন কথা বলিবেন, কেবল ওষ্ঠ কম্পবান হইতে লাগিল, কিন্তু কোন কথা বলিতে পারিলেন না, তদীয় পরমহিতকারিণী বিবিকে যে কখন বিস্মরণ হইবেন না- তাহা তাঁহার ভাব ভঙ্গিতে বিশেষ প্রতীয়মান হইল।