টম্ খুড়ো/বর্ড সাহেবের বাটীতে ইলাইজার গমন
পরে ঐ সাধু ব্যক্তি ইলাইজাকে কিয়দ্দূরে একটী সুরম্য বাটী দর্শাইয়া বলিলেন যে, তুমি ঐ বাটীতে ত্বরায় গমন কর, তাহা হইলে তোমার এ বিপদোদ্ধারের উপায় অবশ্যই হইবে। যে হেতুক ঐ বাটীতে এক জন ভদ্রলোক স্বীয় সহ ধর্ম্মিনীর সহিত নিবসতি করেন, তিনি তোমার এরূপ দুরবস্থা সন্দর্শন করিলে উপায়ান্বেষণে অবশ্যই যত্নবান হইবেন। ইলাইজা তদনুসারে আর্দ্রবসনাবৃত তনয়টিকে ক্রোড়ে করিয়া অতিকষ্টে গমন করিতে লাগিল, যেহেতুক তাহার পাদদ্বয়ে পাদুকা না থাকাতে বরফের উপর দিয়া চলাতে পদক্ষত বিক্ষত হইয়া ছিল, কি করেন প্রাণের দায় সকলি সহ্য করিতে হয়। একবার যতদূর গমন করেন, আরবার ভূমিতে আসীন হন, আর চলিতে পারেন না, এরূপাবস্থায় বাটীর নিকটে উপনীত হইলেন, এবং তথায় যাইয়া দেখিলেন যে আবাস অভ্যন্তরে রন্ধন শা লায় অগ্নি প্রজ্বলিত হইতেছে, চা পাত্র মেজের উপরে স্থাপিত রহিয়াছে, অধুনা বাটীর ভিতরে গমন করিয়া আশ্রয় যাচ্ঞা করা দূরে থাকুক, প্রবেশ মাত্রই মূর্চ্ছাপন্ন হইয়া ভূমিতলে পতিত হইলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য্য এরূপাবস্থায় সন্তানটিকে ক্রোড় হইতে ছাড়েন নাই। সহসা এই ঘটনা উপস্থিত হওয়াতে তাহার মরণাববোধে আবাসবাসী লোক সকল একেবারে কোলাহল করিয়া উঠিল, এবং সকলেই সেই স্থানে আসিয়া ইলাইজাকে সুস্থ করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল, তৎকালে আমেরিকা রাজ্যের পার্লিয়ামেণ্টের একজন সভ্য প্রধান মান্যবর বর্ড সাহেব তদীয় সহধর্ম্মনীর সহিত কি হইল কি হইল শব্দ করিয়া পাকশালায় ধাবমান হইলেন, উক্ত সাহেবটি স্বয়ং ক্রীত দাস দাসী রাখিতেন, তন্নিমিত্তে দাস রাখাতে কোন হানি নাই বলিয়া তাহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, যে হেতুক ইলাইজার আগমনের কিঞ্চিৎকাল পূর্ব্বে তিনি যখন আপন ভার্য্যার সহিত এই সকল বিষয়ে কথোপকথন করেন, তখন পলাতকা দাসগণকে আশ্রয় প্রদান নিবারণের জন্য যে নূতন বিধি সম্প্রতি সংস্থাপন হইয়া ছিল, তাহার বিস্তর পোষকতা করিয়া ছিলেন, কিন্তু সে সকল কথায় বিবিবর্ড শ্রুতিপাত না করিয়া বলিলেন, দেখুন যে বিধিবিষয়ে আপনি এত পোষকতা করিতেছেন, বিবেচনা করিয়া দেখিলে, এবিধি অত্যন্ত লজ্জাকর ও ঘৃণাকর অতএব আমি সুযোগ পাইলে প্রথমেই এবিধি উল্লঙ্ঘনে যত্নবান হইব, এবং আমার অ ত্যন্ত মানস যে একজন দাস বা দাসীর সহিত সাক্ষাৎ হয়, আমি রাজনীতি কিছুই অবগত নহি বটে, কিন্তু ধর্ম্ম পুস্তকে পাঠ করিয়াছি, যে ক্ষুধিত ব্যক্তিকে আহার, ও বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া অতিমাত্র কর্ত্তব্য, অতএব আমি ধর্ম্মপুস্তকের মতানুসারে কার্য্য করিব, আপনি সমস্ত রাত্রি এই সকল বিষয়ে কথোপকথন করুন, পরন্ত কথায় যেরূপ বলিবেন কার্য্যে সেরূপ করিতে পারিবেন না, যদ্যপি কোন পলাতকা দাস বা দাসী তোমার ভবনে আশ্রয় প্রত্যাশায় আগমন করে, তাহা হইলে কি তাহাকে দুরীকরণ করিতে ইচ্ছা কর, বোধ হয় তাহা কখনই পার না, বাস্তবিক বর্ড সাহেব অতি দয়াবান ও ধর্ম্ম পরায়ণ ছিলেন, তদীয় ভার্য্যার কথার কোন উত্তর প্রদান না করিয়া চুপ করিয়া থাকিলেন।
সেই সময়ে ইলাইজার এই ঘটনা উপস্থিত, তাঁহারা উভয়ে তদ্দর্শনে রন্ধন শালায় ধাবমান হইয়া দেখিলেন যে ইলাইজা কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়াছে, অপিচ সন্তানটিকে না দেখিতে পাইয়া ইলাইজা অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, রে বাছা হারি! তুমি কোথায় গেলে? সেই দুষ্ট বণিক কি তোমাকে ধরিল, এই কথা শ্রবণ করিয়া হারি তৎক্ষণাৎ তথায় আসিয়া আপন মাতার ক্রোড়ে উপবেশন করিলেন, পরে ইলাইজা ক্ষণেককাল বিবি বর্ডের মুখের দিগে চাহিয়া থাকিয়া পদতলে পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন হে কৃপাময়ী বিবি আমাদিগকে রক্ষা করুন, যেন সেই নৃশংস আমার বাছাকে ধরিয়া লইয়া না যায় তাহাতে বিবি বলিলেন, তোমার কোন ভয় নাই, নিরাপদ হইয়াছ, এখানে কেহই তোমাদিগকে ধরিতে পারিবে না। এবম্বিধ আশ্বাসবাক্য শ্রবণ করত ইলাইজা অঞ্চলে মুখাচ্ছাদন করিয়া কাঁদিতে ২ পুনরায় বলিলেন, অনাথিনী দীন দুঃখিনীর প্রতি তোমার এমন দয়া, আহা! পরমেশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তৎকালে হারি আপন মাতাকে ক্রন্দন করিতে দেখিয়া সান্ত্বনার্থে ধাবমান হইয়া মায়ের কোলে যাইয়া বসিলেন। বিবি বর্ডের নানা প্রবোধ বাক্যে তিনি কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলেন, পরে ক্ষণেক কাল বিশ্রাম করণ জন্য অগ্নির নিকট একটী শয্যা প্রদান করিলেন এবং সমস্ত দিন ভ্রমণ করাতে অত্যন্ত শ্রান্ত হইয়াছিল, তজ্জন্য শয়ন করিবামাত্র উভয়েই অকাতরে নিদ্রা যাইলেন। তখন বর্ড সাহেব তদীয় ভার্য্যাকে কহিলেন, এ স্ত্রীলোকটী যে কোথা হইতে আসিয়াছে কিছুই জানি না। যাহা হউক, কিঞ্চিৎ বিশ্রামের পর যখন পুনরায় গাত্রোত্থান করিবে, তখন আসিয়া সমস্ত বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিব। এক্ষণে চল আমরা বৈঠকখানায় গমন করি, এই বলিয়া উভয়ে বৈঠকখানাভিমুখে চলিয়া গেলেন এবং তথায় যাইয়া বিবি বর্ড মোজা বুনিতে তৎপর হইলেন। এবং সাহেবটি একখানি সংবাদ পত্র লইয়া পাঠ করিতে লাগিলেন। ক্ষণেক কালের পর আপন ভার্য্যার নিকট যাইয়া বলিলেন, ভাল! আমি যে গৌনটি পরিধান করিয়া বৈকালে নিদ্রা যাইয়া থাকি, সে গৌনটি কোথায়? ঐ দরিদ্র কামিনীকে প্রদান করিলে ভাল হয় না? যে হেতুক দেখিতেছি তাহার বস্ত্রের অত্যন্ত প্রয়োজন হইয়াছে। তাহাতে বিবি বর্ড ইলাইজার আসিবার পূর্ব্বে রাত্রিযোগে যে অভিপ্রায় সাহেব ব্যক্ত করিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করত ঈষদ্ধাস্য করিয়া কহিলেন, সে গৌনটি আমি অবশ্য অনুসন্ধান করিব। ঘণ্টাদুই পর ইলাইজা জাগরিত হইলে সাহেব বিবি দুই জনেই রন্ধনশালায় গমন করিলেন।