টম্ খুড়ো/ইলাইজার নদী পার হওন
এই ক্ষণে ইলাইজা হারিকে লইয়া অনেক দূর গমন করিয়াছে, কিন্তু দিনযামিনী পদব্রজে চলিয়া যাওয়াতে দুই জনেই অতিশয় শ্রান্ত হইয়াছিল, তজজন্য হারি নিদ্রায় অচেতন হইয়া তুষারোপরি শয়ন করিতে আগ্রহ হ ইল। পরে দিনকর অস্তাচল গমন কালে তাহারাও হিওনাম্নী নদী তীরে উপস্থিত হইল। কিন্তু ঐ নদীতে পারাপার জন্য কোন সেতু না থাকাতে নিদাঘ সময়ে সকলেই নৌকাযোগে পারাপার হইত। শীতকালে বরফরাশিতে পরিপূর্ণ থাকাতে সকলে তাহার উপর দিয়া গমনাগমন করিত। অধুনা ফাল্গুন মাস বরফরাশী একেবারে দ্রবীভৃত প্রায় হইয়াছিল, জল প্রবাহ এতাদৃশ বেগবতী যে, কোন নাবিক সহসা নৌকা লইয়া পার করিতে সাহস করিত না। তন্নিমিত্ত ইলাইজা সম্ভানকে লইয়া ক্ষণেক কাল বিশ্রাম করেন, এই প্রত্যাশায় নদীর নিকটবর্ত্তী একটী বিপণিতে গমন করিলেন। তথায় কিঞ্চিৎ কাল অবস্থিতি করণান্তর দেখিলেন ঐ ভৃত্যদ্বয় অশ্বারোহণ করত নিষ্ঠুর বণিকের সহিত অতি বেগে আসিতেছে। তাহাতে সাতিশয় শঙ্কাকুল হইয়া তথা হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক তনয়টীকে কোলে করিয়া পুনরায় সেই স্রোতবাহিনীর তীরে উপনীত হইলেন। নদী ভীষণ শব্দে প্রবাহিত হইতেছে, কি করিয়া পার হন, এই চিন্তায় অতিশয় চিন্তিত হইতেছিলেন এবং পাছে তাহারা আসিয়া ধৃত করে, এই ভয়ে এক একবার পশ্চাদ্ভাগে নেত্রপাত করিতে লাগিলেন। ক্ষণেককাল পরে দেখিলেন যে, তাহারা প্রায় নিকটবর্ত্তী হইল আর উপায় নাই, কিন্তু তাহাতে ভগ্নোৎসাহ না হইয়া সাতিশয় সাহস পূর্ব্বক সন্তানকে বলিলেন বাছ! দৃঢ় করিয়া আমার গলদেশ ধারণ কর, এক্ষণে অনাথের নাথ দয়াময় ঈশ্বর ব্যতীত আর আমাদিগের কোন ভরসা নাই। এই বলিয়া তটিনী তট হইতে সলিলে ভাসমান বরফের উপরে লম্ফ প্রদান করিলেন, তাহাতে বরফ রাশী পদভরে জলমগ্ন না হইয়া ঘোরতর শব্দ করত পূর্ব্বমত ভাসমান রহিল। এইরূপ বারবার লস্ফ প্রদান করিয়া ভাসমান বরফের উপর দিয়া যত যাইতে লাগিলেন, ততই প্রাণপণে করুণাময় জগদীশ্বরকে ডাকিতেছিলেন, কিন্তু তাঁহার দয়ার লক্ষণ বিলক্ষণ প্রতীয়মান হইল। যে হেতুক ইলাইজা যে কয়েক খানি বরফের উপরে পদবিক্ষেপ করিয়াছিল, তাহার একখানিও জলসাৎ হয় নাই।
বণিক এতদ্রূপ অদ্ভূত ব্যাপার দর্শনে হতবুদ্ধি হইয়া ভৃত্যদ্বয়সহ নদীকুলে দণ্ডায়মান থাকিল। কিন্তু ইলাইজা ঈশ্বরানুগ্রহে নির্ব্বিঘ্নে প্রবাহের অন্য কূলে গমন করিল। এই সমস্ত বিষয় সন্দর্শন করাতে জনৈক সাধু ব্যক্তির অন্তঃকরণে করুণার সঞ্চার হওয়াতে তাহাদিগকে আশ্রয় প্রদানে বিস্তর আশ্বাস করিলে ইলাইজা সন্তানটিকে কোলে করিয়া নিরাপদে তাঁহার নিকট দাড়াইলেন। আহা! পরহিতৈষী দয়াবান্ ব্যক্তিদিগের এইরূপই কার্য্য, তাঁহারা যথাসর্ব্বস্ব পরহিতেই সমর্পণ করিয়া থাকেন। জগদীশ্বর তাহাদিগের মঙ্গল ককুন। অপিচ তাঁহারা উভয়েই দয়াশূন্য বণিকের হস্ত হইতে এরূপ ত্রাণ পাওয়াতে সাম ও আনডির মনে আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না, কতই হাস্য করিতে লাগিল। তদ্দর্শনে বণিক রোষপরতন্ত্র হইয়া যৎপরোনাস্তি গালি দিয়া তাহাদিগকে কশাঘাত করিল। পরে রজনী কালে পার হওয়া সুকঠিন বোধে পর দিন প্রত্যুষে নৌকা আনাইয়া পার হইবেন এবং হারিকে ধৃত করিবেন এই মনেস্থির করিয়া একটী সামান্য বিপণিতে রাত্রি অতিবাহিত করিলেন।