টুনটুনির বই/উকুনে-বুড়ির কথা
এক যে ছিল উকুনে-বুড়ী, তার মাথায় বড্ড ভয়ানক উকুন ছিল। সে যখন তার বুড়োকে ভাত খেতে দিতে যেত তখন ঝরঝর করে সেই উকুন বুড়োর পাতে পড়ত। তাইতে সে একদিন রেগে গিয়ে, ঠাঁই করে বুড়ীকে ঠেঙার বাড়ি মারলে। তখন বুড়ী ভাতের হাঁড়ি আছড়ে গুঁড়ো করে রাগের ভরে সেই যে নদীর ধার দিয়ে চলে গেল, আর তাকে বুড়ো ডেকে ফিরাতে পারলে না।
নদীর ধারে এক বক বসে ছিল, সে উকুনে-বুড়ীকে দেখে বললে, উকুনে-বুড়ী কোথা যাস?’
‘তোর স্বামী মারলে কেন? কি হয়েছে?’
উকুনে-বুড়ী বললে—
স্বামী মারলে, রাগে তাই
ঘর-গেরস্তী, ফেলে যাই।
বক বললে, ‘তোর স্বামী মারলে কেন? কি হয়েছে?’
উকুনে-বুড়ী বললে, ‘আমার মাথা থেকে তার পাতে উকুন পড়েছিল।’
বক, বললে, ‘কেন, উকুন তো বেশ লাগে! তার জন্যে মারলে কেন? তুই আমার বাড়ি চল। শুনেছি তুই খুব ভাল রাঁধিস।’ তাইতে উকুনে-বুড়ী বকের বাড়িতে রাঁধুনি হল। তার রান্না বকের বেশ ভালো লাগত, আর পাতে উকুন পড়লে তো সে খুব খুশীই হত।
তখন, একদিন হয়েছে কি—বক এনেছে একটা মস্ত শোল মাছ। এনে সে উকুনে-বুড়ীকে বলল, ‘উকুনে-বুড়ী, মাছটা বেশ করে রাঁধ।’
বলে সে আবার নদীর ধারে চলে গেল। উকুনে-বুড়ী মাছ রাঁধতে লাগল। রাঁধতে-রাঁধতে বেচারা মাথা ঘুরে কখন কড়ার মধ্যে পড়ে গিয়েছে কেউ জানতে পারেনি।
বক এসে দেখলে, উকুনে-বুড়ী পুড়ে মরে আছে। দেখে তার এমনি দুঃখ হল যে, সে নদীর ধারে গিয়ে মুখ ভার করে বসে রইল, সাতদিন কিছু খেল না।
নদী বললে, ‘ভালোরে ভালো, সাতদিন ধরে এমন করে বসে আছে, খায়-দায়নি। এর হল কি? হ্যাঁ ভাই বক, তোর হয়েছে কি ভাই?’
বক বললে, ‘আরে ভাই, সে কথা বলে কি হবে? আমার যা হবার তা হয়েছে।’
নদী বললে, ‘ভাই, আমাকে বলতে হবে।’
বক বললে, ‘যদি বলি, তবে কিন্তু তোর সব জল ফেনা হয়ে যাবে।’
নদী বললে, ‘হয় হবে, তুই বল।’
তখন বক বললে,
উকুনে-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল।
অমনি ফ্যান-ফ্যান করে দেখতে-দেখতে নদীর জল ফেনিয়ে সাদা হয়ে গেল।
সেই নদীতে এক হাতি রোজ জল খেতে আসে। সেদিন সে জল খেতে এসে দেখে, একি কাণ্ড হয়ে আছে।
হাতি বললে, ‘নদী, তোর একি হল? তোর জল কি করে ফেনা হয়ে গেল?’
নদী বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর লেজটি খসে পড়ে যাবে।’
হাতি বললে, ‘যায় যাবে তুই বল।’ তখন নদী বললে—
উকুনে-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল।
অমনি ধপাস করে হাতির লেজটা খসে পড়ে গেল।
তারপর হাতি গাছতলা দিয়ে যাচ্ছে, গাছ তাকে দেখে বললে, ‘বাঃ রে তোর একি হল? লেজ কোথায় গেল?’
হাতি বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর পাতাগুলি এক্ষুনি ঝরে পড়বে।’
গাছ বললে, ‘পড়ে পড়ুক, তুই বল।’ তখন হাতি বললে—
উকুন-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পড়ল।
অমনি ঝর-ঝর করে গাছের সব পাতাগুলি ঝরে পড়ে গেল। সেই গাছে এক ঘুঘুর বাসা ছিল। সে তখন খাবার খুঁজতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে, ওমা একি হয়েছে! ঘুঘু বললে, ‘গাছ, তোর একি হল? তোর পাতা সব কোথায় গেল?’
গাছ বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর চোখ কানা হয়ে যাবে।’
ঘুঘু বললে, ‘যায় যাবে, তুই বল।’ তখন গাছ বললে—
উকুনে-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পড়ল,
গাছের পাতা ঝরে পড়ল।
অমনি টস্ করে ঘুঘুর একটা চোখ কানা হয়ে গেল।
কানা চোখ নিয়ে ঘুঘু মাঠে চরতে গিয়েছে, তখন রাজার বাড়ির রাখাল তাকে দেখে বললে, ‘সে কি রে ঘুঘু, তোর চোখ কি হল?’
ঘুঘু বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোমার হাতে তোমার লাঠিটা আটকে যাবে।’
রাখাল বললে, ‘যায় যাবে, তুই বল।’ তখন ঘুঘু বললে—
উকুনে-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পড়ল,
গাছের পাতা ঝরে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ কানা হল।
অমনি চটাস করে রাখালের লাঠি তার হাতে আটকে গেল। সে কত হাত ঝাড়লে, কিছুতেই তাকে ফেলতে পারলে না। যখন গরু নিয়ে সে রাজার বাড়িতে ফিরে এসেছে, তখনো সে হাত ঝাড়ছে।
রাজার বাড়ির দাসী ভাঙা কুলোয় করে ছাই ফেলতে যাচ্ছিল। সে রাখালকে দেখে বললে, ‘দূর হতভাগা! অমনি করে হাত ঝাড়ছিস কেন? কি হয়েছে তোর হাতে?’
রাখাল বললে, ‘সে কথা যদি বলি, তবে কিন্তু আর ঐ কুলোখানা তোমার হাত থেকে নামাতে পারবে না, সেখানা তোমার হাতেই আটকে থাকবে।’
দাসী বললে, ‘ঈস! আচ্ছা থাকে থাকবে, তুই বল।’ তখন রাখাল বললে—
উকুনে-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেলিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পড়ল,
গাছের পাতা ঝরে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ কানা হল,
রাখালের হাতে লাঠি আটকাল।
অমনি দাসী ‘ওমা! এ কি গো! কি হবে গো!’ বলে কাঁদতে লাগল। সে অনেক করে ও কুলো হাত থেকে নামাতে পারলে না।
শেষে রাখাল-ছোকরাকে গাল দিতে দিতে ঘরে গেল।
ঘরে গিয়ে দাসী হাত থেকে আর কুলো নামাচ্ছে না। রানী তখন থালা হাতে করে রাজার জন্যে ভাত বাড়ছিলেন। দাসীকে দেখে তিনি হেসে বললেন, ‘দাসী তোর হয়েছে কি? কুলোটা হাত থেকে নামাচ্ছিসনে কেন?’
দাসী বললে, ‘তা যদি বলি রানীমা, তবে কিন্তু ঐ থালাখানা আর আপনার হাত থেকে নামাতে পারবেন না, ওখানা আপনার হাতে আটকে যাবে।’
রানী বললেন, ‘বটে! আচ্ছা বল দেখি কেমন আটকায়।’
তখন দাসী বললে—
উকুনে-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পডল,
গাছের পাতা ঝরে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ কানা হল,
রাখালের হাতে লাঠি আটকাল,
দাসীর হাতে কুলো আটকাল।
অমনি রানীর হাতে থালাখানি আটকে খেল, কিছুতেই তিনি আর তা নামাতে পারলেন না। তখন আর কি করেন? আর একখানা থালায় করে রাজামশায়ের জন্যে ভাত বেড়ে নিয়ে চললেন।
রাজামশাই পিঁড়িতে আটকে গেলেন [পৃঃ ৪৬
রাজামশাই তাকে দেখেই বললেন, ‘রানী, ঐ থালাখানা হাতে করে রেখেছ যে?’
রানী বললেন, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু আর তুমি এখান থেকে উঠে যেতে পারবে না, তুমি ঐ পিঁড়িতে আটকে থাকবে।’
শুনে রাজা হো-হো করে হাসলেন, তারপর বললেন, ‘আচ্ছা তাই হোক, তুমি বল।’ তখন রানী বললেন—
উকুনে-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পড়ল,
তখন সেই পিড়িসুদ্ধ তাঁকে ... [পৃঃ ৪৬
গাছের পাতা ঝরে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ কান হল,
রাখালের হাতে লাঠি আটকাল,
দাসীর হাতে কুলো আটকাল,
রানীর হাতে থালা আটকাল।
বলতে-বলতেই তো রাজামশাই পিঁড়িতে খুব ভালোমতোই আটকে গেলেন। কত টানাটানি করলেন, কিছুতেই উঠতে পারলেন না। চাকরদের ডাকলেন, তারাও কিছু করতে পারল না। তখন সেই পিঁড়িসুদ্ধ তাকে চারজনে ধরাধরি করে এনে সভায় বসিয়ে দিলে।
তা দেখে সভার লোকদের তো ভারী মুশকিলই হল। তাদের ভয়ানক হাসি পাচ্ছে। তার হাসি থামাতে পারছে না, হাসতেও পারছে না, পাছে রাজামশাই রাগ করেন। কেউ ভয়ে জিগগেস করতেও পারছে না রাজামশাইয়ের কি হয়েছে।
তখন রাজামশাই নিজেই বললেন, ‘তোমরা বুঝি জানতে চাচ্ছ, আমি পিঁড়িতে কি করে আটকে গেলাম।’
তারা হাত জোড় করে বললে, ‘হ্যাঁ মহারাজ।’
রাজা বললেন, ‘তা যদি বলি, তবে তোমরাও যে যার বসবার জায়গায় আটকে যাবে।’
তারা বললে, ‘মহারাজ যদি আটকালেন, তবে আমরা আর বাকি থাকি কেন?’
তখন রাজা বললেন—
উকুনে-বুড়ী পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পড়ল,
গাছের পাতা ঝরে পড়ল,
ঘুঘুর চোখ কানা হল,
রাখালের হাতে লাঠি আটকাল,
দাসীর হাতে কুলো আটকাল,
রানীর হাতে থালা আটকাল,
পিঁড়িতে রাজা আটকাল।
বলতেই আর তারা যাবে কোথায়! এমনি করে তারা তক্তপোশে আটকে গেল যে, আর তাদের উঠবার সাধ্য নেই।
ভাগিাস সেই দেশে এক খুব বুদ্ধিমাম নাপিত ছিল, নইলে মুশকিল হয়েছিল আর কি! নাপিত এসে বললে, ‘শীগগির ছুতোর ডাক।’
তখন ছুতোর এসে পিঁড়ি কেটে রাজামশাইকে ছাড়ালে, আর তক্তপোশ কেটে সভার লোকদের ছাড়ালে। একটু একটু কাঠ তবু সকলের গায়ে লেগে ছিল, সেটুকু চেঁচে তুলে দিল।
রানীর হাতের থালা, দাসীর হাতের কুলো আর রাখালের হাতের লাঠিও কেটে ফেলে দেওয়া হল।