টুনটুনির বই/বাঘখেকো শিয়ালের ছানা
এক শিয়াল আর এক শিয়ালনী ছিল। তাদের তিনটি ছানা ছিল, কিন্তু থাকবার জায়গা ছিল না।
তারা ভাবলে ‘ছানাগুলোকে এখন কোথায় রাখি? একটা গর্ত না হলেও তো এরা বৃষ্টিতে ভিজে মারা যাবে।’ তখন তারা অনেক খুঁজে একটা গর্ত বার করলে, কিন্তু গর্তের চরিধারে দেখলে, খালি বাঘের পায়ের দাগ! তা দেখে শিয়ালনী বললে, ‘ওগো, এটা যে বাঘের গর্ত। এর ভিতরে কি করে থাকবে?’
শিয়াল বললে, ‘এত খুঁজেও তো আর গর্ত পাওয়া গেল না। এখানেই থাকতে হবে।’
শিয়ালনী বললে, ‘বাঘ যদি আসে তখন কি হবে?’
শিয়াল বললে, তখন তুমি খুব করে ছানাগুলির গায় চিমটি কাটবে। তাতে তারা চেঁচাবে, আর আমি জিগগেস করব—ওরা কাঁদছে কেন? তখন তুমি বলবে—ওরা বাঘ খেতে চায়।’
তা শুনে শিয়ালনী বললে, ‘বুঝেছি। আচ্ছা, বেশ!’ বলেই সে খুব খুশী হয়ে গর্তের ভিতরে ঢুকল। তখন থেকে তারা সেই গর্তের ভিতরেই থাকে।
এমনি করে দিন কতক যায়, শেষে একদিন তারা দেখলে যে ওই বাঘ আসছে। অমনি শিয়ালনী তার ছানাগুলোকে ধরে খুব চিমটি কাটতে লাগল। তখন ছানাগুলি যে চেঁচাল, তা কি বলব!
শিয়াল তখন খুব মোটা আর বিশ্রী গলার সুর করে জিগগেস করলে, ‘খোকারা কাঁদছে কেন?’
শিয়ালনী তেমনি বিশ্রী সুরে বললে, ‘ওরা বাঘ খেতে চায়, তাই কাঁদছে।’
বাঘ তাঁর গর্তের দিকে আসছিল। এর মধ্যে ‘ওরা বাঘ খেতে চায়’
ওই বাঘ আসছে। [পৃঃ ১০৭ শুনে সে থমকে দাঁড়াল। সে ভাললে, ‘বাবা! আমার গর্তের ভিতর না জানি ওগুলো কি ঢুকে রয়েছে। নিশ্চয় ভয়ানক রাক্ষস হবে, নইলে কি ওদের খোকারা বাঘ খেতে চায়!’
তখুনি শিয়াল বললে, ‘আর বাঘ কোথায় পাব? যা ছিল সবই তো ধরে এনে ওদের খাইয়েছি!’
তাতে শিয়ালনী বললে, ‘তা বললে কি হবে? যেমন করে পার একটা ধরে আনো, নইলে খোকারা থামছে না।’ বলে সে ছানাগুলোকে আরো বেশী করে চিমটি কাটতে লাগল।
তখন শিয়াল বললে, ‘আচ্ছা, রোস রোস। ঐ যে একটা বাঘ আসছে। আমার ঝপাংটা দাও, এখুনি ওকে ভতাং করছি।’
ঝপাং বলেও কিছু নেই, ভতাং বলেও কিছু নেই—সব শিয়ালের ফাঁকি। বাঘের কিন্তু সেই ঝপাং আর ভতাং শুনেই প্রাণ উড়ে গেল, সে ভাবলে, ‘মাগো, এই রেল পালাই, নইলে না জানি কি দিয়ে কি করবে এসে।’ বলে সে আর সেখানে একটুও দাঁড়াল না। শিয়াল চেয়ে দেখলে যে, সে লাফে লাফে ঝোপ জঙ্গল ডিঙিয়ে ছুটে পালাচ্ছে! তখন শিয়াল আর শিয়ালনী লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললে, ‘যাক, আপদ কেটে গেছে!’
বাঘ তখনো এমনি ছুটেছে যে তেমন আর সে কখনো ছোটেনি।
একটা বানর গাছের উপর থেকে তাকে ছুটতে দেখে ভারী আশ্চর্য হয়ে ভাবলে, ‘তাই তো, বাঘ এমনি করে ছুটছে, এ তে সহজ কথা নয়! নিশ্চয় একটা ভয়ানক কিছু হয়েছে?’ এই ভেবে সে বাঘকে ডেকে জিগগেস করলে, ‘বাঘ ভাই, বাঘ ভাই, কি হয়েছে? তুমি যে অমন করে ছুটে পালাচ্ছ?’
বাঘ হাঁপাতে-হাঁপাতে বললে, ‘সাধে কি পালাচ্ছি? নইলে এক্ষুণি আমাকে ধরে খেত!’
বানর বললে, ‘তোমাকে ধরে খায় এমন কোনো জানোয়ারের কথা তো আমি জানিনে। ও কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’
বাঘ বললে, ‘সেখানে থাকতে বাপু, তবে দেখতুম! দূর থেকে অমনি করে সকলেই বলতে পারে?’
বানর বললে, ‘আমি যদি সেখানে থাকতুম, তবে তোমাকে বুঝিয়ে দিতুম যে সেখানে কিছু নেই। তুমি বোকা, তাই মিছামিছি অত ভয় পেয়েছ।’ এ কথায় বাঘের ভারী রাগ হল!
সে বললে, ‘বটে! আমি বোকা? আর তোমার বুঝি ঢের বুদ্ধি! চল তো একবার সেখানে যাই।’
বানর বললে, ‘যাব বৈকি, যদি আমাকে পিঠে করে নিয়ে যাও।’
বাঘ বললে, ‘তাই সই! আমার পিঠে বসেই চল!’ এই বলে সে বানরকে পিঠে করে আবার গর্তের দিকে ফিরে চলল।
শিয়াল আর শিয়ালনী সবে ছানাদের শান্ত করে একটু বসেছে আর অমনি বানরকে পিঠে করে বাঘ আবার আসছে। তখন শিয়ালনী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আবার ছানাগুলোকে চিমটি কাটতে লাগল, ছানাগুলিও ভূতের মতো চ্যাঁচাতে শুরু করল।
তখন শিয়াল আবার সেই রকম সুর করে বললে, ‘আরে থামো, থামো! অত চেঁচিও না—অসুখ করবে।’
শিয়ালনী বললে, ‘আমি বলছি, যতক্ষণ না একটা বাঘ এনে এদের খেতে দেবে, ততক্ষণ এরা কিছুতেই থামবে না।’
শিয়াল বললে, ‘আমি যে ওদের মামাকে বাঘ আনতে পাঠিয়েছি। এখুনি সে বাঘ নিয়ে আসবে, তোমরা থামো!’
বানরকে পিঠে করে বাঘ আবার গর্তের দিকে গেল। [ পৃঃ ১০৭
তারপর একটু চুপ করেই সে আবার বললে, ‘ঐ ঐ! ঐ যে তোদের বাঁদর মামা একটা বাঘ ধরে এনেছে! আর কাঁদিসনে; শীগগির ঝপাংটা দে ভতাং করি!’
বানরের এতক্ষণ খুব সাহস ছিল। কিন্তু ঝপাং আর ভতাঙের কথা শুনে আর সে বসে থাকতে পারল না। সে এক লাফে একটা গাছে উঠে, দেখতে দেখতে কোথায় পালিয়ে গেল।
আর বাঘের কথা কি আর বলব! সে যে সেইখান থেকে ছুট দিল দুদিনের মধ্যে আর দাঁড়ালই না।
তারপর থেকে আর শিয়ালদের কোনো কষ্ট হয়নি। তারা মনের সুখে সেই গর্তে থেকে দিন কাটাতে লাগল।