টুনটুনির বই/বাঘের উপর টাগ
এক জোলা ছিল। তার একটি বড় আদুরে ছেলে ছিল। সে যখন যা চাইত, সেটি না নিয়ে কিছুতেই ছাড়ত না।
একদিন এক বড়মানুষের ছেলে জোলার বাড়ির সামনে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে জোলার ছেলে তার বাপকে ডেকে বললে, ‘বাবা, আমার কেন ঘোড়া নেই? আমাকে ঘোড়া এনে দাও।’
জোলা বললে, ‘আমি গরিব মানুষ, ঘোড়া কি করে আনব? ঘোড়া কিনতে ঢের টাকা লাগে।’
ছেলে বললে, ‘তা হবে না। আমাকে ঘোড়া এনে দিতেই হবে।’
বলে, সেই ছেলে আগে নেচে-নেচে কাঁদল, তারপর গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল, তারপর উঠে তার বাপের হুঁকো কলকে ভেঙে ফেলল। তাতেও ঘোড়া কিনে দিচ্ছে না দেখে, শেষে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিল।
তখন জোলা তো ভারী মুশকিলে পড়ল। ছেলে কিছুতেই খাচ্ছে না দেখে, সে ভাবল, ‘এখন তো আর ঘোড়া কিনে না দিলেই হচ্ছে না। দেখি ঘরে কিছু টাকা আছে কি না।’
অনেক খুঁজে সে কয়েকটি টাকা বার করল। তারপর সেই টাকা কাপড়ে বেঁধে সে ঘোড়া কিনতে হাটে চলল।
হাটে গিয়ে জোলা ঘোড়াওয়ালাকে জিগগেস করল, ‘হাঁ গা, তোমার ঘোড়ার দাম ক-টাকা?’
ঘোড়াওয়ালা বললে, ‘পঞ্চাশ টাকা।’
জোলা কাপড়ে বেঁধে মোটে পাঁচটি টাকা এনেছে, পঞ্চাশ টাকা সে কোথা থেকে দেবে? কাজেই সে ঘোড়া কিনতে না পেরে মনের দুঃখে বাড়ি ফিরে চলল।
এমন সময় হয়েছে কি—দুজন লোক সেইখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। তাদের একজন বললে, ‘তোমার কিন্তু বড় মুশকিল হবে।’
তা শুনে আরেকজন বললে, ‘ঘোড়ার ডিম হবে!’
ঘোড়ার কিনা ডিম হয় না, তাই ঘোডার ডিম হবে’ বললে বুঝতে হয় যে ‘কিচ্ছু হবে না’, কিন্তু জোলা সে কথা জানত না। সে ঘোড়ার ডিমের নাম শুনেই ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘ভাই, ঘোড়ার ডিম কোথায় পাওয়া যায় বলতে পার?’
সেখানে একটা ভারী দুষ্ট লোক ছিল। সে জোলাকে বললে, ‘আমার সঙ্গে এস, আমার ঘরে ঘোড়ার ডিম আছে।’
সে দুষ্ট লোকটার ঘরে ছিল একটা ফুটি। সে জোলাকে তার সঙ্গে বাড়ি নিয়ে, সেই ফুটিটা তার হাতে দিয়ে বললে, ‘এই নাও ঘোড়ার ডিম। দেখ, কেমন ফেটে রয়েছে। এখুনি এর ভিতর থেকে ছানা বেরুবে। দেখো ছুটে পালায় না যেন!’
তখন জোলার আনন্দ দেখে কে!
সে জিগগেস করলে, ‘এর দাম কত?’
দুষ্ট লোকটা বললে, ‘পাঁচ টাকা।’ জোলা তখুনি সেই পাঁচটা টাকা খুলে দিয়ে ফুটি নিয়ে ঘরে চলল। ফুটি ফেটে রযেছে, ভিতরে লাল দেখা যাচ্ছে।
জোলা ভাবলে, ‘ঐ রে, ছানা যদি বেরিয়ে পালাতে চায়, তখুনি খপ করে ধরে ফেলব। তারপর গলায় চাদর বেঁধে তাকে বাড়ি নিয়ে যাব! যদি লাফায় তবু ছাড়ব না।’
এমনি নানা কথা ভাবতে-ভাবতে জোলা একটা নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল, আর ঠিক তখুনি তার ভয়ানক জল তেষ্টা পেল। জোলা ডাঙার উপর ফুটিটা রেখে জল খেতে গিয়েছে, এর মধ্যে যে কোথা থেকে এক শিয়াল সেখানে এসেছে, তা সে দেখতে পায়নি। তার জল খাওয়া হতে-হতে, শিয়ালও ফুটি প্রায় শেষ করে এনেছে। এমন সময় জোলা তাকে দেখতে পেয়ে, ‘হায় সর্বনাশ! আমার ঘোড়ার ছানা পালাল।’ বলে তাড়া করলে!
শিয়ালকে ছুটে ধরা কি জোলার কাজ। সে শিয়াল তাকে মাঠের উপর দিয়ে, বনের ভিতর দিয়ে, কোথায় নিয়ে গেল তার ঠিকানা নেই। শেষে জোলা আর চলতে পারে না। তখন ঘরে ফিরতে গিয়ে দেখে, পথ হারিয়ে গেছে।
তখন রাত হয়েছে, কাজেই আর ঘরে ফিরবার জো ছিল না। জোলা অনেক খুঁজে এক বুড়ীর বাড়িতে গিয়ে একটু শোবার জায়গা চেয়ে নিলে। বুড়ীর দুটি বই ঘর ছিল না। তার একটিতে বুড়ী আর তার নাতনী থাকত। আর একটিতে জিনিসপত্র ছিল, সেইটিতে সে জোলাকে জায়গা দিলে।
একটা বাঘ রোজ রাত্রে বুড়ীর ঘরের পিছনে এসে বসে থাকত। বুড়ী তা টের পেয়ে, রাত্রে কখনো ঘরের বাইরে আসত না, তার নাতনীকেও আসতে দিত না। কিন্তু নাতনীটি জোলার কাছে তার ঘোড়ার ডিমের কথা একটু শুনতে পেয়েছিল, তার কথা ভালো করে শুনবার জন্যে সে আবার তার কাছে যেতে চাইল। তখন বুড়ী তাকে বললে, ‘না-না, যাস্নে! বাঘে-টাগে ধরে নেবে।’
‘বাঘে-টাগে’ এমনি করে লোকে বলে থাকে। টাগ বলে কোনো জন্তু নেই। কিন্তু বাঘ তো আর সে কথা জানে না, সে ঘরের পিছনে বসে টাগের কথা শুনে ভারী ভাবনায় পড়ে গেছে। সে ঠিক বুঝে নিয়েছে যে, টাগ তার নিজের চেয়েও ঢের ভয়ানক একটা জানোয়ার বা রাক্ষস বা ভূত হবে। আর তখন থেকে তার বেজায় ভয় হয়েছে, আর সে ভাবছে, টাগ যদি আসে কোনখান দিয়ে সে পালাবে!
এমন সময় সেই জোলা ভোর হয়েছে কিনা দেখবার জন্যে বাইরে এসেছে। এসেই সে বাঘকে দেখতে পেয়ে মনে করলে ‘ঐ রে! আমার ঘোড়ার ছানা বসে আছে!’
অমনি সে ছুটে গিয়ে, বাঘের নাকে মুখে গলায় কাপড় জড়িয়ে তড়াক করে তার পিঠে উঠে বসল!
বাঘ যে তখন কি ভয়ানক চমকে গেল কি বলব। সে ভাবল ‘হায়-হায়! সর্বনাশ হয়েছে! নিশ্চয় আমাকে টাগে ধরেছে!’ এই মনে করে বাঘ প্রাণের ভয়ে ছুটতে লাগল। কিন্তু চোখে কাপড় বাঁধা ছিল বলে ভালো করে ছুটতে পারল না।
জোলা তো গোড়া থেকেই তার পিঠে চড়ে বসে আছে, আর ভাবছে এটা তার ঘোড়ার ছানা! সে ঠিক করে রেখেছে যে একটু ফরসা হলেই পথ চিনতে পারবে, আর ঘোড়ার ছানাটাকে নিয়ে বাড়ি যাবে। ফরসা যখন হল, তখন জোলা দেখলে যে, কাজ তো হয়েছে! সে ঘোড়া মনে করে বাঘের উপর চড়ে বসেছে। তখন আর সে কি করে? সে ভাবলে যে এবারে আর রক্ষা নেই!
বাঘ ছুটছে আর বলছে ‘দোহাই টাগদাদা’! আমার ঘাড় থেকে নামো, আমি তোমায় পুজো করব।’ জোলা জানে না যে বাঘ তাকেই টাগ বলছে! জোলা খালি ভাবছে, সে কি করে পালাবে।
এমন সময় বাঘ একটা বটগাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিল। সেই গাছের ডালগুলি খুব নীচু, হাত বাড়ালেই ধরা যায়! জোল খপ করে তার একটা ডাল ধরে ঝুলে গাছে উঠে পড়ল।
তখন জোলাও বললে, ‘বড্ড বেঁচে গিয়েছি!’
বাঘও বললে, ‘বড্ড বেঁচে গিয়েছি!’
কিন্তু খালি গাছে উঠলে কি হবে? তা থেকে নামতে পারলে তো হয়। সে হতভাগা বাঘটা সেখান থেকে ছুটে না পালিয়ে গাছতলায় বসে হাঁপাতে লাগল, আর চেঁচিয়ে অন্য বাঘদের ডাকতে লাগল। ডাক শুনে চার-পাঁচটা বাঘ সেখানে এসে বললে, ‘কি হয়েছে তোমার? তোমার চোখ বাঁধলে কে?’
বাঘ হাঁপাতে-হাঁপাতে বললে, ‘আরে ভাই, আজ আর একটু হলেই গিয়েছিলুম আর কি! আমাকে টাগে ধরে ছিল। অনেক হাত জোড় করে পুজো দেব বলতে তবে ছেড়ে দিয়েছে। সেই বেটা আমার চোখ বেঁধে রেখেছে, পুজো না দিলে আবার এসে ধরবে।’
এই কথা শুনে সব বাঘ মিলে, সেই গাছতলায় টাগের পুজো আরম্ভ করল। বড়-বড় মোষ আর হরিণ নিয়ে দলে-দলে বাঘ আসতে লাগল। জোলা আর অত বাঘ কখনো দেখেনি। সে তো গাছে বসে কেঁপেই অস্থির!
জোলা কাঁপছে আর গাছের পাতা নড়ছে। বাঘেরা তাতে ব্যস্ত হয়ে চেয়ে দেখল, কিন্তু পাতার আড়ালে ছিল বলে জোলাকে চিনতে পারল না।
একজন বললে, ‘ভাই, গাছের উপর ওটা কি?’
আর একজন বললে, ‘দেখ ভাই, ওটার কি মস্ত লেজ!’
লেজ তো নয়, জোলার কাপড় ঝুলছিল। পাতার জন্যে ভালো করে দেখতে না পেয়ে বাঘেরা তাকেই লেজ মনে করেছে। সেই লেজ দেখে একটা বুড়ো বাঘ বললে, ‘ওটা একটা খুব ভয়ানক জানোয়ার হবে, হয়তো বা টাগই হবে।’ এই কথা শুনেই তো সব বাঘ মিলে ‘ধরলে ধরলে! পালা, পালা!’ বলে সেখান থেকে ছুটে পালাল। তখন জোলাও গাছ থেকে নেমে বাড়ি গেল।
জোলাকে দেখে তার ছেলে বললে, ‘কই বাবা, ঘোড়া কই?’
জোলা তার গালে ঠাস করে এক চড় মেরে বললে, ‘এই নে তোর ঘোড়া!’
তারপর থেকে সে-ছেলে আর ঘোড়ার কথা বলত না।