টুনটুনির বই/বুদ্ধুর বাপ
এক যে ছিল বুড়ো চাষী, তার নাম ছিল বুদ্ধুর বাপ।
বুদ্ধুর বাপের ক্ষেতে ধান পেকেছে, আর দলে-দলে বাবুই এসে সেই ধান খেয়ে ফেলছে। বুদ্ধর বাপ ঠকঠকি বানিয়ে তাই দিয়ে বাবুই তাড়াতে যায়। কিন্তু ঠকঠকির শব্দ শুনেও বাবুই পালায় না। তখন সে রেগেমেগে বললে, ‘বেটারা! এবার যদি ধরতে পারি, তাহলে ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন দেখিয়ে দেব!’
ইঁড়-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন বলে কোনো একটা জিনিস নেই। বুদ্ধুর বাপ আর কোনো ভয়ানক গাল খুঁজে না পেয়ে ঐ কথা বলে। রোজই বাবুই আসে, রোজই বুদ্ধুর বাপ তাদের তাড়াতে না পেরে বলে,‘ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন দেখিয়ে দেব!’
এর মধ্যে একদিন হয়েছে কি—একটা মস্ত বাঘ রাত্রে এসে বুদ্ধুর বাপের ক্ষেতের ভিতর ঘুমিয়ে ছিল, ঘুমের ভিতর কখন সকাল হয়ে গেছে, আর সে-বাঘ সেখান থেকে যেতে পারেনি।
সেদিনও বুদ্ধুর বাপ বাবুই তাড়াতে এসে, ঠকঠকি নাড়ছে আর বলছে, ‘বেটারা, যদি ধরতে পারি তবে ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন দেখিয়ে দেব!’
ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন বাধন শুনেই তো বাঘের বেজায় ভাবনা হয়েছে। সে ভাবলে, ‘তাই তো! এটা আবার কি নতুন রকমের জিনিস হল? এমন বাঁধনের কথা তো কখনো শুনিনি!’ যতই ভাবছে, ততই ভার মনে হচ্ছে যে, এটা না দেখলেই নয়। তাই সে আস্তে-আস্তে ধানের ক্ষেতের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে, বুদ্ধুর বাপকে ডেকে বললে, ‘ভাই, একটা কথা আছে।’
বাঘ দেখে বুদ্ধর বাপ যে কি ভয় পেল, তা কি বলব! কিন্তু সে ভারী বুদ্ধিমান লোক ছিল। সে তখুনি সামলে গেল, বাঘ কিছু টের পেল না। বুদ্ধুর বাপ বাঘকে বললে, ‘কি কথা ভাই?’
বাঘ বললে, ‘ঐ যে তুমি কি বলছ, কিঁড়ি-মিড়ি-বাঁধন না কি! সেইটে আমাকে একটিবার দেখাতে হচ্ছে।’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘সে তো ভাই অমনি দেখানো যায় না। তাতে ঢের জিনিসপত্র লাগে।’
বাঘ বললে, ‘আমি সব জিনিস এনে দিচ্ছি। আমাকে সেটা না দেখালে হবে না।’
বুদ্ধুর বাপ বললে,‘আচ্ছা, তুমি আগে জিনিস আনো, তারপর আমি দেখাব।’
বাঘ বললে, ‘কি জিনিস চাই?’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘একটা খুব বড় আর মজবুত থলে চাই, এক গাছি খুব মোটা আর লম্বা দড়ি চাই, আর একটা মস্ত মুগুর চাই।’
বাঘ বললে, ‘শুধু এই চাই? এসব আনতে আর কতক্ষণ?’
সেটা হাটের দিন ছিল। বাঘ গিয়ে হাটের পথের পাশে ঝোপের ভিতর লুকিয়ে রইল। খনিক বাদেই সেই পথ দিয়ে তিনজন খইওয়ালা যাচ্ছে। খইওয়ালাদের থলেগুলি খুব বড় হয, আর তার এক-একটা ভারী মজবুত থাকে।
বাঘ ঝোপের ভিতর বসে আছে, আর খইওয়ালারা একটু একটু করে তার সামনে এসেছে। অমনি সে ‘হালুম’ বলে লাফিয়ে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াল। খইওয়ালারা তো খই-টই ফেলে, চেঁচিয়ে কোথায় পালাবে তার ঠিক নেই।
তখন বাঘ তাদের খইসুদ্ধ থলেগুলি এনে বুদ্ধুর বাপকে দিল। তারপর সে গেল দড়ি আনতে।
দড়ির জন্যে তার আর বেশী দূরে যেতে হল না। মাঠে ঢের গরু খোঁটায় বাধা ছিল, বাঘ তাদের কাছে যেতেই তারা দড়ি ছিঁড়ে পালাল। সেই সব দড়ি এনে সে বুদ্ধুর বাপকে দিল। তারপর সে গেল মুগুর আনতে।
পালোয়ানেরা তাদের আড্ডায় মুগুর ভাঁজছে, এমন সময় বাঘ গিয়ে সেখানে উপস্থিত হল। তাতেই তো ‘বাপ রে, মা রে!’ বলে তারা ছুট দিল। তখন বাঘ তাদের বড় মুগুরটা মুখে করে এনে বুদ্ধুর বাপকে বললে, তোমার জিনিস তো এনেছি, এখন সেটাকে দেখাও।’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘আচ্ছা, তবে তুমি একটিবার এই থলের ভিতরে এস দেখি।’
বলতেই তো বাঘমশাই গিয়ে সেই থলের ভিতরে ঢুকেছেন। তখন বুদ্ধুর বাপ তাড়াতাড়ি থলের মুখ বন্ধ করে, তাকে আচ্ছা করে দড়ি দিয়ে জড়াল। একটু নড়বার জো অবধি রাখল না।
তারপর দু-হাতে সেই মুগুর তুলে ধাঁই করে যেই থলের উপর এক ঘা লাগিয়েছে, অমনি বাঘ ভারী আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘ও কি করছ?’
বুদ্ধুর বাপ বললে, ‘কেন? ইঁড়ি-মিড়ি-কিঁড়ি-বাঁধন দেখাচ্ছি। তোমার ভয় হয়েছে নকি?’
ভয় হয়েছে বললে তো বড় লজ্জার কথা হয়, তাই বাঘ বললে, ‘না।’
তখন বুদ্ধুর বাপ সেই মুগুর দিয়ে ধাঁই-ধাঁই করে থলের উপর মারতে গেল। চ্যাঁচালে পাছে নিন্দে হয়, তাই মার খেয়েও বাঘ অনেকক্ষণ চুপ করে
বাঘ থলে নিয়ে আসছে! [পৃষ্ঠা ৭৮ ছিল। কিন্তু চুপ করে আর কতক্ষণ থাকবে। দশ-বারো ঘা খেয়েই সে ঘেঁয়াও-ঘেঁয়াও করে ভয়ানক চ্যাঁচাতে লাগল। খানিক বাদে আর চ্যাঁচাতে না পেরে, গোঙাতে আরম্ভ করল। বুদ্ধুর বাপ তবুও ছাড়ছে না, ধাঁই-ধাঁই করে সে খালি মারছেই। শেষে আর বাঘের সাড়া শব্দ নেই। দেখে সে ভাবলে, মরে গেছে। তখন থলে খুলে, বাঘটাকে ক্ষেতের ধারে ফেলে রেখে বুদ্ধুর বাপ ঘরে এসে বসে রইল।
বুদ্ধুর বাপ মুগুর দিয়ে ধাঁই-ধাঁই করে থলের উপর
মারতে লাগল [পৃষ্ঠা ৭৯
বাঘ কিন্তু মরেনি। চার-পাঁচ ঘণ্টা মড়ার মতো পড়ে থেকে, তারপর সে উঠে বসেছে। তখনো তার গায়ে বড্ড বেদনা, আর জ্বর খুব। কিন্তু রাগের চোটে সেসবে সে মন দিলে না। সে খালি চোখ ঘোরায় আর দাঁত খিঁচায়, আর বলে, ‘বেটা বুদ্ধুর বাপ! পাজী হতভাগা, লক্ষ্মীছাড়া; দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি!’
সেই কথা শুনেই তো ভয়ে বুদ্ধুর বাপের মুখ শুকিয়ে গেল। সে তখুনি ঘরে দোর দিয়ে হুড়কো এঁটে বসে রইল। তিনদিন আর ঘর থেকে বেরুল না।
বাঘ সেই তিনদিন বুদ্ধুর বাপের ঘরের চারধারে ঘুরে বেড়াল, আর তাকে গালি দিল। তারপর করেছে কি—দরজার কাছে এসে খুব ভালোমানুষের মতন করে বলছে, ‘আমাকে একটু আগুন দেবে দাদা? তামাক খাব!’
বুদ্ধুর বাপ দেখলে, কথাগুলি মানুষের মতো, কিন্তু গলার আওয়াজটা বাঘের মতো। তখন সে ভাবলে, আগুন দেবার আগে একলার ভালো করে দেখে নিতে হবে। এই ভেবে সে যেই দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরেছে,
বাঘ তার লেজটা দরজার নীচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। অমনি দেখে সর্বনাশ—বাঘ! তখন আর কি সে দরজা খোলে! সে কোঁকাতে কোঁকাতে বললে, “ভাই বড্ড জ্বর হয়েছে, দোর খুলতে পারব না। তুমি দরজার নীচ দিয়ে তোমার লাঠিগাছটা ঢুকিয়ে দাও, আমি তাতে আগুন বেঁধে দিচ্ছি।”
বাঘ লাঠি কোথায় পাবে? সে তার লেজটা দরজার নীচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। অমনি বুদ্ধুর বাপ বঁটি দিয়ে খ্যাঁচ করে সেই লেজ কেটে ফেললে।
বাঘ তখন ‘ঘেঁয়াও’ বলে বুদ্ধুর বাপের চালের সমান উঁচু লাফ দিল। তারপর একটুখানি লেজ যা ছিল, তাই গুটিয়ে চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে ছুটে পালাল।
তাতে কিন্তু বুদ্ধুর বাপের ভয় গেল না। সে বেশ বুঝতে পারল যে, এর পর সব বাঘ মিলে তাকে মারতে আসবে। সত্যি-সত্যি সে তার পরদিন দেখলে, কুড়ি-পঁচিশটা বাঘ তার ঘরের দিকে আসছে। তখন সে আর কি করবে! ঘরের পিছনে খুব উঁচু একটা তেঁতুল গাছ ছিল, তার আগায় গিয়ে বসে রইল।
সেইখানে একটা হাঁড়ি বাঁধা ছিল। বুদ্ধুর বাপ তার পিছনে লুকিয়ে দেখতে লাগল বাঘেরা কি করে।
বাঘেরা এসেই সেই হাঁড়ির আড়ালে বুদ্ধুর বাপকে দেখতে পেয়েছে। তখন তারা তাকে গাল দেয়, ভেঙচায় আর কত রকম ভয় দেখায়! বুদ্ধুর বাপ চুপটি করে হাঁড়ি ধরে বসে আছে, কিচ্ছু বলে না।
তারপর বাঘেরা মিলে বুদ্ধুর বাপকে ধরবার এক ফন্দি ঠিক করলে। তাদের মধ্যে যার খুব বুদ্ধি ছিল সে বললে, ‘আমাদের মধ্যে যে সকলের বড়, সে মাটিতে গুঁড়ি মেরে বসবে। তার চেয়ে যে ছোট, সে তার ঘাড়ে উঠবে। তার চেয়ে যে ছোট, সে আবার তার ঘাড়ে উঠবে। এমনি করে উঁচু হয়ে, আমরা ঐ হতভাগাকে ধরে খাব।’
তাদের মধ্যে সকলের বড় ছিল সেই ঠেঙাখেকো লেজকাটা বাঘটা। তার লেজের ঘা তখনো শুকোয়নি বলে সে বসতে পারত না, বসতে গেলেই তার বড্ড লাগত। কিন্তু না বসলেও তো চলবে না, যেমন করেই হোক বসতে হবে। এমন সময় একটি গর্ত দেখতে পেয়ে, সে সেই গর্তের ভিতরে লেজটুকু ঢুকিয়ে, কোনো মতে বসল। তারপর অন্য বাঘেরা এক-একজন করে তার পিঠে উঠতে লাগল।
এমনি করে, বাঘের পিঠে বাঘ উঠে, দেখতে-দেখতে তারা প্রায় বুদ্ধুর বাপের সমান উঁচু হয়ে গেল। আর একটু উঁচু হলেই তাকে ধরে ফেলবে।
বুদ্ধুর বাপ বলছে, ‘যা হয় হবে, একবার শেষ এক ঘা মেরেই নি।’ এই বলে সে হাঁড়িটি খুলে হাতে নিয়ে বসেছে—সেই হাঁড়ি সকলের উপরকার বাঘটার মাথায় ভাঙবে।
এমন সময় ভারী একটা মজা হয়েছে। যে গর্তে সেই লেজকাটা বাঘ তার লেজ ঢুকিয়েছিল, সেই গর্তটা ছিল কাঁকড়ার। কাঁকড়া কাটা লেজের গন্ধ পেয়ে আস্তে আস্তে এসে তার দুই দাঁড়া দিয়ে তাতে চিমটি লাগিয়েছে। চিমটি খেয়ে বেঁড়ে বাঘ বললে, ‘উঃ, হুঃ! ঘেয়াও! হাল্লুম! আরে উপরেও বুদ্ধুর বাপ, নীচেও বুদ্ধুর বাপ!’ বলতে বলতেই তো সে লাফিয়ে উঠল আর তার পিঠের বাঘগুলি জড়াজড়ি করে ধুপধাপ শব্দে মাটিতে পড়ে গেল। ঠিক সেই সময়ে বুদ্ধুর বাপও লেজকাটা বাঘের পিঠে হাঁড়ি আছড়ে ফেলে বললে, ‘ধর। ধর বেঁড়ে বেটার ঘাড়ে ধর!’
এর পর কি আর বাঘের দল সেখানে দাঁড়ায়? তারা লেজ গুটিয়ে, কান খাড়া করে, যে যেখান দিয়ে পারল ছুটে পালাল। আর কোনোদিন তারা বুদ্ধুর বাপের বাড়ির কাছেও এল না।