ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

 মফঃস্বলের পাঠকগণের মধ্যে, বোধ হয়, অনেকেই অবগত নহেন যে, কলিকাতায় যে সকল স্থানে শবদাহ হইয়া থাকে, সেই সকল স্থানে মিউনিসিপালিটী হইতে এক একজন কর্ম্মচারী নিযুক্ত থাকেন। কোন মৃতদেহ সৎকারার্থ সেই স্থানে নীত হইলে, তিনি উত্তমরূপে সেই দেহ প্রথম পরীক্ষা করিয়া থাকেন। এইরূপ পরীক্ষা করিয়া মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে যদি তাঁহার মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় না হয়, তাহা হইলে সেই শব দাহ করিতে তিনি আদেশ প্রদান করেন, ও পরিশেষে উহার সৎকার কার্য্য সমাপন হয়। যে সকল শব দেখিয়া মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে কর্ম্মচারীর মনে সন্দেহ হয়, সেই সকল মৃতদেহের সৎকার করিতে না দিয়া, তিনি তৎক্ষণাৎ নিকটস্থ পুলিসে সংবাদ প্রদান করিয়া থাকেন। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র পুলিস সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং লাস দেখিয়া বা প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান করিয়া যদি তাহাদিগের সন্দেহ দূর না হয়, তাহা হইলে তাহারা সেই মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত মেডিকেল কলেজে পাঠাইয়া দেয়। সেইস্থানে গবর্ণমেণ্ট-নিয়োজিত ডাক্তার কর্ত্তৃক সেই শব ছেদিত হইয়া উত্তমরূপে পরীক্ষিত হইলে পর সেই মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা হয়।

 কাশীমিত্রের ঘাটে সেই সময় যে কর্ম্মচারী নিযুক্ত ছিলেন, তিনি বহুদিবস হইতে সেই কার্য্য করিয়া আসিতেছিলেন। এই মৃতদেহ দেখিবামাত্র তাঁহার মনে সন্দেহের উদয় হইল, তিনি উহার সৎকার কার্য্য সমাধা করিতে না দিয়া, উহা সেইস্থানে রাখিয়া দিলেন এবং নিকটবর্ত্তী পুলিসে ইহার সংবাদ প্রদান করিলেন। সংবাদ পাইবামাত্র একজন উচ্চপদস্থ পুলিস-কর্ম্মচারী সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘাটের কর্ম্মচারী পুলিসকে উক্ত মৃতদেহ দেখাইয়া দিয়া আমার সম্মুখেই কহিলেন, “মৃতদেহের লক্ষণ দেখিয়া, আমার বোধ হইতেছে, ইহার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে নাই; বিষপানে ইহার মৃত্যু হইয়াছে।”

 কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া আমি অতিশয় চিন্তিত হইলাম; ভাবিলাম,—এই মৃতদেহ যদি কাটিয়া পরীক্ষা করা হয়, তাহা হইলে আমার সমস্ত গুপ্তঅভিসন্ধি প্রকাশ হইয়া পড়িবে। তখন আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়া ত পরের কথা, নরহত্যা অপরাধে পরিশেষে আমাকেই দণ্ডিত হইতে হইবে। এইরূপ অবস্থায় ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার হৃদয় আলোড়িত হইল সত্য; কিন্তু দেখিতে দেখিতে আমার মনের গতি পরিবর্ত্তিত করিয়া হৃদয়কে দৃঢ় করিলাম, এবং গভীরভাবে সেই পুলিস-কর্ম্মচারীকে কহিলাম,—“এই মৃতদেহ সম্বন্ধে আপনাকে চিন্তিত হইতে হইবে না। এই ঘাটের কর্ম্মচারী নিজের মূর্খতা নিবন্ধন আপনাকে সংবাদ প্রদান করিয়াছে সত্য, কিন্তু ইহার মৃত্যুসম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহ করিবার কোন প্রকার কারণই নাই। এই মৃত ব্যক্তি অন্য কেহ নহে, ইনি আমার সহোদর ভ্রাতা। আমি নিশ্চয় জানি, এ কোন প্রকারে বিষপান করে নাই। বিসূচিকারোগে ইহার মৃত্যু হইয়াছে। বিসূচিকারোগে মৃত ব্যক্তির কতকটা লক্ষণ বিষপানের লক্ষণের মত হয় বটে, কিন্তু সে প্রভেদ—আমরা ডাক্তার—আমরাই বুঝিতে পারি, ইহারা বুঝিবেন কোথা হইতে? যাহা হউক, আমি আপনাদিগের সে সন্দেহ এখনই মিটাইয়া দিতেছি। ভ্রাতা আমার যখন বিসূচিকারোগে আক্রান্ত হন, সেই সময়ে এই সহরের সর্ব্বপ্রধান ইংরাজ ডাক্তার ইহার চিকিৎসা করেন। আপনি এই মৃতদেহ স্থানান্তরিত না করিয়া একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই সেই ডাক্তার সাহেবের নিকট হইতে নিদর্শন পত্র (Certificate) লইয়া আসিতেছি, উহা দেখিলেই আপনাদিগের সকল সন্দেহ মিটিয়া যাইবে।

 দেখিলাম, পুলিস-কর্ম্মচারী আমার কথায় ভুলিলেন এবং আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া সেইস্থানেই অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। আমি একখানি গাড়ি আনাইয়া ডাক্তার সাহেবের বাটী-অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া জানিতে পারিলাম, ডাক্তার সাহেব বাড়ীতেই আছেন। ডাক্তার সাহেব আমাকে উত্তমরূপে জানিতেন। তাঁহার চাপরাশী গিয়া সংবাদ প্রদান করিবামাত্র, দেখিলাম, তিনি আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। ডাক্তার সাহেবকে দেখিবামাত্র কোন কথা না বলিয়া, তাঁহার নিয়মিত দর্শনীর দ্বিগুণ টাকা প্রথমেই তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম, ও পরিশেষে কহিলাম, “মহাশয়! রাত্রি প্রায় দুইটার সময় আমার ভ্রাতা, যাহার বিসূচিকারোগের চিকিৎসা আপনি করিয়াছিলেন, আমাদিগকে ফঁকি দিয়া ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপন করিবার নিমিত্ত তাহার মৃতদেহ আমরা কাশীমিত্রের ঘাটে লইয়া গিয়াছিলাম, কিন্তু ঘাটের যে কর্ম্মচারী মৃতদেহ পরীক্ষা করে, সে পুলিসের সাহায্যে আমার এই বিপদের সময় আমার নিকট ৫০০৲ পাঁচ শত টাকা চাহিয়া বসিয়াছে, ও বলিতেছে যে, যদি তাহাদিগের প্রার্থনা মত টাকা প্রদান না করি, তাহা হইলে উহারা উক্ত মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত মেডিকেল কলেজে পাঠাইয়া দিবে। মৃতদেহের এরূপ অবমাননা এতদ্দেশীয় হিন্দুজাতির পক্ষে অতিশয় নিন্দনীয়। এই নিমিত্তই আমি মহাশয়ের নিকট আগমন করিয়াছি, আমার ভ্রাতার কোন্ রোগ হইয়াছিল, এবং তাহার মৃত্যুর কারণই বা কি, এই সকল বিষয় বিবৃত করিয়া, অনুগ্রহ পুর্ব্বক একখানি নিদর্শন পত্র যদি আমাকে প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি কোন প্রকারে এই বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইতে সমর্থ হই। নতুবা যে কোন প্রকারেই হউক, এই বিপদের সময় ৫০০৲ পাঁচ শত টাকা সংগ্রহ করিয়া উহাদিগকে প্রদান করিতে হইবে; অন্যথা, হিন্দু হইয়া জীবন থাকিতে সহোদরের মৃতদেহের অবমাননা কোনক্রমেই দেখিতে পারিব না।” এই বলিয়া ডাক্তার সাহেবের সম্মুখেই দুই চারি ফোঁটা কৃত্রিম অশ্রু বিসর্জ্জন করিলাম।

 ডাক্তার সাহেব আমার এই সকল কথা শুনিয়া প্রথমে পুলিসের উপর অতিশয় বিরক্তিভাব প্রকাশ করিলেন, ও আমাকে সমভিব্যাহারে লইয়া তাঁহার আফিস ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। কাগজ কলম প্রভৃতি সমস্তই সেইস্থানে প্রস্তুত ছিল, আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একখানি নিদর্শন পত্র লিখিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। উহার মর্ম্ম এইরূপ—“ডাক্তার বাবুর ভ্রাতার চিকিৎসা আমি নিজে করিয়াছি। উহার বিসূচিকারোগ হইয়াছিল, ও সেই রোগেই উহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি জোর করিয়া বলিতে পারি, উহার মৃত্যু সম্বন্ধে পুলিসের সন্দেহ করিবার কোন কারণই নাই।”

 এই নিদর্শন পত্র সমভিব্যাহারে দ্রুতগতি আমি কাশীমিত্রের ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, পুলিসকর্ম্মচারী সেই মৃতদেহের নিকট বসিয়া রহিয়াছেন। সেই পত্র তাঁহার হস্তে অর্পণ করিলাম। একবার দুইবার করিয়া কয়েকবার মনে মনে তিনি এই পত্রপাঠ করিলেন, ও নিতান্ত ভগ্নহৃদয়ে পরিশেষে কহিলেন, “কলিকাতার সর্ব্বপ্রধান ইংরাজ ডাক্তার যখন বলিতেছেন—এই মৃত্যুতে কোনরূপ সন্দেহ নাই, তখন কি প্রকারে আমি এই শব পরীক্ষার নিমিত্ত ডেড্‌হাউসে পাঠাইয়া দিই, আমি এই পত্র আপনার নিকট রাখিলাম। আপনারা মৃতদেহের সৎকার কার্য্য সমাপন করিতে পারেন।” এই বলিয়া পুলিস-কর্ম্মচারী উক্ত পত্র হস্তে লইয়া, আস্তে আস্তে সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন। সৎকারের সমস্ত দ্রব্যই প্রস্তুত ছিল; দেখিতে দেখিতে চিতা প্রজ্জ্বলিত হইল, আমার ভ্রাতার মৃতদেহ ভস্মে পরিণত হইয়া গেল। আমার মনে যে ভয়ের কারণ উদিত হইয়াছিল, এতক্ষণে তাহা দূর হইল, আমিও নিশ্চিন্ত হইলাম।

 পিতামাতা প্রভৃতি সকলেই রোদন করিতে লাগিলেন। চিতার প্রজ্জ্বলিত-অগ্নি নির্ব্বাণের সঙ্গে সঙ্গে তাহার স্ত্রীর আর্ত্তনাদ নির্ব্বাপিত না হইয়া ক্রমে আরও প্রবলরূপ ধারণ করিতে লাগিল। আমি স্বচক্ষে উহাদিগের অবস্থা দেখিতে লাগিলাম। উহাদিগের মর্ম্মভেদী আর্ত্তনাদ আমার কর্ণকুহরে সবলে প্রতিঘাত করিতে লাগিল, কিন্তু ইহাতে আমার কঠিন হৃদয় কিছুমাত্র দ্রবীভূত হইল না। আমি আমার পাষাণ হৃদয়কে আরও দৃঢ় করিলাম, এবং কি উপায় অবলম্বন করিলে বিনাক্লেশে উক্ত ত্রিশ হাজার টাকা পাইতে পারি, তাহাই মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম।

 এইরূপে ক্রমে পাঁচ সাতদিবস গত হইয়া গেল; দেখিলাম, সকলের শোকাবেগ ক্রমে মন্দীভূত হইয়া আসিতে লাগিল। এই কয়েকদিবস ভাবিয়া-চিন্তিয়া যে উপায় আমি মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম, সেই উপায় অবলম্বন করিলাম, অর্থাৎ বীমা আফিসে উক্ত টাকার নিমিত্ত আমি প্রথমে একখানি পত্র লিখিলাম। এই পত্রের সারমর্ম্ম এই:—“আপনাদিগের আফিসে ত্রিশ হাজার টাকার নিমিত্ত আমার ভ্রাতার জীবন বীমা আছে। অদ্য ছয় সাতদিবস হইল, তিনি বিসূচিকারোগে আক্রান্ত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছেন। মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনি তাঁহার বীমার স্বত্ত্ব আমার নিকট বিক্রয় করিয়াছিলেন। সুতরাং আইন-অনুযায়ী আমি এখন উক্ত টাকার ন্যায্য অধিকারী। অতএব মহাশয়দিগকে লিখিতেছি যে, আপনারা কোন্ তারিখে উক্ত টাকাগুলি আমাকে প্রদান করিবেন, তাহা লিখিয়া বাধিত করিবেন। আপনাদিগের নিয়মানুসারে উহার মৃত্যুসম্বন্ধে যদি কোন বিষয় জানিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে যে প্রধান ইংরাজ ডাক্তার তাহার চিকিৎসা করিয়াছিলেন, তাঁহার নিদর্শন পত্র (Certificate) পাঠাইয়া দিব।”

 এই পত্র লেখার পর ক্রমে পাঁচ সাত দিবস অতীত হইয়া গেল; কিন্তু তাহার কোন প্রকার উত্তর পাইলাম না। দশম দিবসের দিন উক্ত পত্রের উত্তর আসিল। উহা পাঠ করিয়া আমি একেবারে বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলাম। মনে নানাপ্রকার দুর্ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। পত্রের মর্ম্ম এইরূপ ছিল:—“আমরা শুনিলাম, আপনার ভ্রাতার মৃত্যুতে অনেক গূঢ় রহস্য আছে। সুতরাং বিশেষরূপ অনুসন্ধান ব্যতিরেকে আপনাকে উক্ত টাকা কোনক্রমেই দেওয়া যাইতে পারে না। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার ভার আমরা কোন উপযুক্ত হস্তে অর্পণ করিয়াছি; ফলাফল পরে জানিতে পারিবেন।”

 বীমা আফিস হইতে কি প্রকার সংবাদ আসে, জানিবার নিমিত্ত কিছুদিবস আমার মন নিতান্ত অস্থির রহিল। কিন্তু কোনরূপ সংবাদ না পাইয়া আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। একদিবস স্বয়ংই বীমা আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বীমা আফিসের বড় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া একটু হাসিলেন ও কহিলেন,—“তোমার ভ্রাতার প্রাপ্য টাকার নিমিত্ত আর তোমাকে অধিক বিলম্ব করিতে হইবে না। তোমার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া যে ফল আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহা শীঘ্রই তুমি জানিতে পারিবে।” সাহেবের কথা শুনিয়া তাহাকে অধিক আর কিছুই বলিলাম না। আমার সম্বন্ধে কে অনুসন্ধান করিয়াছেন এবং অনুসন্ধানের ফলই বা কি হইয়াছে, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে আফিস পরিত্যাগ করিলাম। আফিস হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আপনার বাড়ীতে আসিলাম। সেই সময়ে নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া হৃদয়কে অধিকার করাতে দুই তিনদিবস একেবারে বাড়ীর বাহির হইলাম না।

 নানাপ্রকার চিন্তার মধ্যে কখনও মনে হইল, উহারা বুঝি আমার দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়াছে। আমি যে প্রকার অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া উহাদিগকে প্রবঞ্চনাপূর্ব্বক একেবারে ত্রিশ হাজার টাকা হস্তগত করিবার সংকল্প করিয়াছিলাম, উহারা বোধ হয়, তাহার প্রমাণ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হইল, যে বিষয় কেবল আমি ভিন্ন অন্য কেহই অবগত নহে, সেই বিষয়ের বিশেষ অবস্থা উহারা কি প্রকারে সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইবে? এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে বাড়ীতে বসিয়াই প্রায় তিন চারিদিবস অতিবাহিত করিলাম।

 যখন দেখিলাম, আফিস হইতে আর কোনরূপ পত্রাদি পাইলাম না, তখন উহাদিগকে আর কিছু না বলিয়া উক্ত ত্রিশ হাজার টাকা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। কিন্তু আদালতে এই বিষয়ের চূড়ান্ত বিচার হইবার পূর্ব্বেই একদিবস দেখিলাম, কয়েকজন কর্ম্মচারী হঠাৎ আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমার বাড়ীর ভিতর তাহাদিগের হঠাৎ-প্রবেশের কারণ জিজ্ঞাসা করিবার অভিপ্রায়ে আমি যেমন উহাদিগের সম্মুখীন হইলাম, অমনি উহারা আমাকে ধৃত করিয়া উত্তমরূপে বন্ধন করিল এবং সেইস্থান হইতে আমাকে স্থানান্তরে লইয়া গেল। আমি যে কেন ধৃত হইলাম, তখন তাহার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; কিন্তু পরদিবস দেখিলাম, আমি মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে নীত হইলাম।

 মাজিষ্ট্রেট আদালতে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, জমীদার মহাশয়ের অন্নে প্রতিপালিত হইয়া সামান্য অর্থের লোভে তাঁহার অমূল্য জীবনরত্ন হরণ করিয়া আমার নিজেরই ভবিষ্যৎ আশায় পাংশু প্রক্ষেপ করিয়াছিলাম, সেই বঙ্গদেশীয় জমীদার মহাশয়ের কয়েকজন কর্ম্মচারী, কয়েকজন উকীল, প্রভৃতি অনেকে সেইস্থানে উপস্থিত। তাঁহাদিগকে দেখিয়াই প্রথমে আমার হৃদয় হঠাৎ চমকিয়া উঠিল; কারণ, সেই সময় আমি বুঝিতে পারিলাম যে, আমার উপর জালের অভিযোগ আনীত হইয়াছে, জাল করা অপরাধে আমি বন্দী হইয়াছি।

 অকস্মাৎ এই বিপদ্‌পাতে আমি কিছুই কর্ত্তব্য অবধারণা করিতে পারিলাম না। যাহা হউক, মাজিষ্ট্রেট সাহেবের এজ্‌লাসে এই মোকদ্দমার সম্বন্ধে অনেক সাক্ষীর এজাহার গৃহীত হইল, ও পরিশেষে বিচারের নিমিত্ত আমি দায়রায় সোপরদ্দ হইলাম। সেইস্থানে জুরির বিচারে ছয় বৎসরের নিমিত্ত আমার কারাদণ্ড হইয়াছে।

 পাঠকগণ! আপনারা এখন আমার হৃদয়ের মধ্যে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন। টাকার নিমিত্ত আমি যে সকল মহাপাতকের অবতারণা করিয়াছি, তাহা আপনাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া দূরে থাকুক, আপনারা স্বপ্নেও কি কখন ভাবিয়াছেন? সামান্য টাকার লোভে, কে আপন অন্নদাতাকে হত্যা করিতে পারে, কে আপনার প্রাণের ভ্রাতাকে বিনাদোষে শমন-সদনে প্রেরণ করিতে সমর্থ হয়? যাহা হউক, ইহ সংসারেই, জন্মান্তরে নহে—এই জন্মেই, আমি আমার ঘোর পাপের ফলভোগ করিতেছি। কিন্তু জানি না, আমি যেরূপ অপ্রতিবিধেয় দুষ্কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছি, এই শাস্তিই তাহার পক্ষে যথেষ্ট কি না, অথবা পরজন্মে ইহাপেক্ষা কঠিন প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা আমার ভাগ্যে আছে!”