ডিটেক্টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
কেদার বাবুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ আমি বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া বিনা কষ্টে উপরে উঠিলাম। ঐ বাটীর ভিতরের সমস্ত অবস্থা কেদার বাবুর ভালরূপ জানা ছিল বলিয়া বোধ হইল; নতুবা যে প্রকার সোপান-শ্রেণী দিয়া উঠিতে হইল, কোনও নূতন লোক হইলে সেই বাড়ীর লোকের সাহায্য ব্যতিরেকে কখনই উহা খুঁজিয়া লইতে সমর্থ হইত না। কিন্তু কেদারের তাহা করিতে হইল না।
উপরে উঠিয়া দেখিলাম, একটা কক্ষের দ্বারে সেই স্ত্রীলোকটী দাঁড়াইয়া আছে। সে আমাদিগকে দেখিবামাত্র অতিশয় ব্যস্ত হইয়া যত্নের সহিত অভ্যর্থনা করিল ও অগ্রে অগ্রে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। কেদার ও আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘরের ভিতর গমন করিলাম। সে আমাদিগকে বসিতে বলিল।
এই ঘরটী উত্তর দক্ষিণে লম্বা, ছোটও নহে অথচ অতিশয় বড়ও নহে; কিন্তু পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও উত্তমরূপ সজ্জিত। সাদা ধপ্ধপে দেওয়ালের ধারে ধারে সবুজ বর্ণের লতা পাতা ও ফুল দেখা যাইতেছে। আটখানি বড় বড় বিলাতী ছবি ঘরের পূর্ব্ব ও পশ্চিম পার্শ্বে দেওয়ালের গায় সাজান রহিয়াছে, ঘরের মধ্যস্থলে লম্ববান্ প্রজ্জ্বলিত ঝাড়ের আলো উহার উপর পড়িতেছে; বোধ হইতেছে, ছবিগুলি চিত্রকরের হস্তে চিত্রিত নহে, ঈশ্বরের সৃষ্ট চেতন পদার্থ। ঝাড়টী দেখিতে অতি পরিপাটী, ৩২টী ডাল আছে ৩২ রঙ্গের—তাহার মধ্যে ৪টী মাত্র জ্বলিতেছে। উত্তর দিকের দেওয়ালের গায়ে একখানি বৃহৎ আয়না, দেওয়াল ব্যাপিয়া মাথা হেলানভাবে রহিয়াছে; ইহার ভিতর ঐ ঘরের সমস্ত দ্রব্য দেখা যাইতেছে। দক্ষিণ দিকে একটা দরজার মধ্য দিয়া, অন্য আর একটী ঘরের ভিতরস্থিত একখানি খাট দেখা যাইতেছে। উহা একটা পরিষ্কার মশারির দ্বারা আচ্ছাদিত। ঐ দরজার একপার্শ্বে একটা মেহগ্নি কাষ্টের আল্মারি ঝক্ ঝক্ করিতেছে—তাহার উপর কতকগুলি কাঁচের বাসন সাজান রহিয়াছে। লম্বা ঘরের মেজেতে একখানি সতরঞ্চ বিস্তৃত ও উহা একখানি পরিষ্কার সাদা চাদরে আবৃত রহিয়াছে। উহার উপর বড় বড় বালিস সারি সারি সাজান রহিয়াছে, এবং একপার্শ্বে কয়েকটা রূপার বাঁধা হুঁকা পিত্তল-নির্ম্মিত মনুষ্য-প্রতিকৃতির হস্তে বৈঠকের উপর শোভা পাইতেছে। কেদার বাবু সেইস্থানে ঐ সতরঞ্চের উপর একটা বালিসে বামকনুই ভর দিয়া অর্দ্ধশয়িতাবস্থায় বসিলেন; আমিও তাঁহার নিকট নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া রহিলাম। “রামদাস পান নিয়ে এস” বলিয়া একবার ডাকিয়া স্ত্রীলোকটী আমাদের উভয়েরই গা ঘেঁসিয়া বসিল।
ঐ স্ত্রীলোকটীর নাম গোলাপ। গোলাপের রূপ বর্ণন করিবার আমার ইচ্ছা নাই, কারণ পাঠক মহাশয়গণ যে মুখে শত শত প্রাতঃস্মরণীয় রমণীর রূপ-বর্ণন পড়িয়াছেন—সহস্র সহস্র পতিপ্রাণা সাধ্বী স্ত্রীলোকের রূপের মাধুরী কীর্ত্তন করিয়াছেন, সেই মুখে চিৎপুর রাস্তার একটী বার-বনিতার রূপবর্ণন পড়াইয়া তাঁহার রসনাকে কলুষিত করিতে ইচ্ছা করি না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, কেদার ইহার রূপের অতিশয় পক্ষপাতী ছিল। পরে আমিও সকলের নিকট বলিয়াছি, গোলাপের মত সুন্দরী স্ত্রীলোেক কলিকাতায় আর দেখিতে পাওযা যায় না। তখন আমি আমার চক্ষে তাহাকে যদিও অতিশয় সুন্দরী দেখিতাম সত্য; কিন্তু আমার বন্ধুগণ মধ্যে মধ্যে আমাকে বলিতেন,—“গোলাপকে সুন্দরী বলা যায় না, সে সুন্দরী নহে। তাহার বর্ণ ব্যতীত অন্য অঙ্গসৌষ্ঠব কিছুমাত্র নাই। যৌবনের প্রারম্ভে সাধারণতঃ স্ত্রীলোক মাত্রই যেরূপ দেখায়, এও তাই।” এ সকল কথা আমার ভাল লাগিত না, আমি তাহাদিগের উপর অসন্তুষ্ট হইতাম। যাহা হউক, দেখিতে দেখিতে গােলাপের ‘সখের খানসামা’ রামদাস পানের বাটা আনিয়া গােলাপের সম্মুখে রাখিয়া দিল, এবং পার্শ্বস্থিত হুঁকার উপর হইতে একটী কলিকা উঠাইয়া লইয়া তামাক সাজিবার নিমিত্ত বাহিরে গমন করিল। গােলাপ পান তৈয়ার করিয়া প্রথমেই আমাকে দিল। উহার হস্ত হইতে পান লইতে আমার লজ্জা ও ঘৃণাবোধ হইতে লাগিল। আমি সঙ্কুচিত হইলাম, কিন্তু কেদার বাবুর অনুরােধে আমি উহা গ্রহণ করিলাম। কেদার বাবু একটী লইলেন, পরিশেষে গােলাপও আপনাকে ফাঁকি দিল না। রামদাস তামাক সাজিয়া আনিয়া একটী হুঁকা কেদার বাবুর হস্তে দিয়া প্রস্থান করিল। পান চিবাইতে চিবাইতে তিনি অল্পে অল্পে ধূমপান করিতে লাগিলেন। গােলাপ নানাপ্রকার মিষ্ট বাক্যে আস্তে আস্তে কেদার বাবুর সহিত গল্প করিতে আরম্ভ করিল; মধ্যে মধ্যে আমাকেও দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিল।