ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 “গােলাপের স্বর এরূপ মৃদু ও মধুর, এবং কথাবার্ত্তা এরূপ সরল, বােধ হইতে লাগিল যে, কেহই তাহাকে অবিশ্বাসিনী বা কপটাচারিণী মনে করিতে পারে না। আমি তাহার মুখ-নিঃসৃত মিষ্ট মিষ্ট কথাগুলি শ্রবণ করিয়া, মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। এইরূপে প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা অতি- বাহিত হইল, কিন্তু কি নিমিত্ত গোলাপ, কেদার বাবুকে ডাকিয়াছে, এ পর্য্যন্ত তাহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিলাম না। দেখিতে দেখিতে কেদার বাবু উঠিয়া বাহিরের বারান্দায় গমন করিলেন, কিন্তু তাঁহার হস্তস্থিত হুঁকা পরিত্যাগ করিলেন না; গোলাপও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রস্থান করিল। আমি সেই স্থানেই বসিয়া রহিলাম, এবং মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম,—‘বাল্যকাল হইতে আমার দৃঢ় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া রাত্রিদিন আমি যে সকল স্ত্রীলোককে অতিশয় ঘৃণার চক্ষে দেখিতাম—যাহাদিগের ছায়া পর্য্যন্ত স্পর্শ করিলে মহাপাপ সংঘটিত হইবে, ভাবিতাম—যাহাদিগের বাটীর ভিতর এক পদ অগ্রসর হইলে ভয়ানক বিপদ্‌জালে জড়ীভূত হইব বলিয়া বিশ্বাস করিতাম—এখন দেখিতেছি, সেই ভাবনা ও বিশ্বাস সম্পূর্ণ অমূলকমাত্র। যে স্ত্রীলোক এরূপ সরল ও সাধু ভাবে আমাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় করিতেছে—যাহার হৃদয়ের মধ্যস্থিত স্তর পর্য্যন্ত দৃষ্টিগোচর হইতেছে—তাহার নিকট কোন প্রকারেই অনিষ্ট আশঙ্কার সম্ভাবনা নাই।’ আমি এইরূপ চিন্তা করিতেছি ও তাহার ঘরের সৌন্দর্য্য অনিমিষ-লোচনে দর্শন করিতেছি, এমন সময়ে বারান্দা হইতে উভয়েই প্রত্যাগমন করিলেন। কেদার হুঁকাটী রামদাসের হস্তে অর্পণ করিয়া আমাকে কহিলেন, “চল ভাই, অনেক বিলম্ব হইয়াছে।”

 গোলাপ কেদার বাবুকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “কেদার বাবু! আমিও মহাশয়দিগকে আর অধিক কষ্ট দিতে ইচ্ছা করি না। যাহা হউক, অনেকক্ষণ হইতে আপনাদিগকে কষ্ট দিতেছি বলিয়া অসন্তুষ্ট হইবেন না, ক্ষমা করিবেন। স্ত্রীলোেক সহস্র দোষ করিলেও পুরুষের নিকট ক্ষমার্হা বলিয়াই এতদুর সাহসী হইয়াছি, এবং সেই সাহসের উপর নির্ভর করিয়াই পুনরায় বলিতেছি, যদি অনুগ্রহ করিয়া কল্য আর একবার এখানে পদার্পণ করেন, তাহা হইলে বড়ই উপকৃত ও বাধিত হইব, এবং মনে ভাবিব যে, আমার উপর আপনার সাতিশয় অনুগ্রহ আছে।” গোলাপ পরিশেষে আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, “মহাশয়! আপনার সহিত আমার বিশেষ পরিচয় নাই। বিশেষতঃ আমরা যেরূপ নিন্দনীয় পথ অবলম্বন করিয়াছি, তাহাতে মহাশয়দিগের ন্যায় সদাশয় ব্যক্তিগণকে কোন বিষয়ে বিশেষ অনুরোধ করিতে সাহস হয় না; তবে কেদার বাবু মহাশয়ের বন্ধু বলিয়াই এইমাত্র বলিতে সাহসী হইতেছি। অনুগ্রহ করিয়া কেদার বাবুর সহিত কল্য এখানে একবার আসিলে আমি আমাকে নিতান্ত শ্লাঘ্যমনে করিব, এবং আপনাকেও, কেদার বাবুর সদৃশ আমার একজন পরম বন্ধু বলিয়া হৃদয়ে স্থান দিব।” এই বলিয়া আমাদিগকে ৪টী করিয়া পান প্রদান করিলে আমি ও কেদার বাবু সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। গোলাপ নীচের দরজা পর্য্যন্ত আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে আসিল। সেই দিবস আমরা উভয়েই আপন আপন বাটীতে গমন করিলাম। বাল্যকাল হইতে যে বিশ্বাস আমার হৃদয় অধিকার করিয়াছিল, অদ্য হইতে তাহা তিরোহিত হইতে আরম্ভ হইল।

 পরদিন সন্ধ্যার পর কেদারের সহিত পুনরায় গোলাপের বাটীতে গেলাম। অদ্য কেদারকে আর কিছুই বলিতে হইল না, দ্বিরুক্তিমাত্র না করিয়া কেদারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গোলাপের বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। সেদিন গোলাপের মিষ্ট বচনে, সাধু ব্যবহারে ও যত্নে, আরও সন্তুষ্ট হইলাম। প্রায় দুই ঘণ্টাকাল সেইস্থানে অতিবাহিত করিয়া চলিয়া আসিবার কালে, গোলাপ পুনরায় পরদিবস আসিবার জন্য অনুরোধ করিল।

 তৃতীয় দিবস সেইস্থানে গমন করিয়া আরও প্রীত হইলাম। এইরূপে প্রত্যহ গোলাপের বাড়ী যাই, দুই একঘণ্টা সেইস্থানে থাকিয়া নানাপ্রকার গল্প, হাস্য ও কৌতুক করি, এবং প্রত্যহ নানাপ্রকার সুখাদ্য দ্রব্যাদি ভক্ষণ করি। এখন ঘৃণা ও লজ্জা আর নাই, তবে বাটীর ভিতরে যাইবার ও বাহিরে আসিবার সময় বস্ত্র দ্বারা মুখ আচ্ছাদিত করি মাত্র; ভয়—পাছে কেহ দেখিতে পায়। যাহা হউক, গোলাপের বাটী হইতে আসিবার সময় যে দিবস বৃষ্টি হয়, সেই দিবস গোলাপ তাহার নিজ ব্যয়ে গাড়ি করিয়া আমাদিগকে আপন আপন বাটীতে পাঠাইয়া দেয়।

 এইরূপে প্রায় একমাস অতীত হইল, দিন দিন ক্রমে ক্রমে গোলাপের সহিত ভালবাসা বাড়িতে লাগিল, সঙ্গে সঙ্গে আমার বাল্যকালের বিশ্বাস সুদূরে পলায়ন করিল। ক্রমে আরও ছয়মাস কাটিয়া গেল। এক দিবস সন্ধ্যার পর আমি, কেদার ও গোলাপ বসিয়া গল্প করিতেছি, এমন সময় কামিনী নাম্নী আর একটী স্ত্রীলোক অন্য ঘর হইতে আসিয়া আমাদিগের নিকট বসিল এবং কেদার বাবুকে বলিল, “বাবু! আজ আমাদিগকে কিছু খাওয়াইতে হইবে।” কেদার সম্মত হইল, এবং রামদাসকে চুপে চুপে কি বলিয়া দিল। রামদাস প্রস্থান করিল ও দশ মিনিট অতীত হইতে না হইতেই দুইটী বোতল এবং কিছু খাদ্য সামগ্রী লইয়া পুনরায় উপস্থিত হইল। কেদার ঐ সকল দ্রব্য গ্রহণ করিয়া গোলাপ ও কামিনীর সহিত একত্রে মদ্য পান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ বাটীর অপর দুই একটী স্ত্রীলোকও আসিয়া উহাতে যোগ দিল।

 আমি এ পর্য্যন্ত উহার আস্বাদন পাই নাই; কারণ বাল্যকাল হইতে সুরার উপর আমার অত্যন্ত ঘৃণা ছিল। যে স্থানে কেহ সুরাপান করিত, আমি সেইস্থান ঘৃণার সহিত পরিত্যাগ করিতাম। এমন কি, সুরাপায়ী ব্যক্তির ছায়া পর্য্যন্ত স্পর্শ করিতাম না। অদ্য কিন্তু আমার আর সেরূপ মনের ভাব রহিল না। ঐ স্থান ঘৃণার সহিত পরিত্যাগ করা দূরে থাকুক, আমিও তাহাদের সহিত একত্র বসিয়া নিজ হস্তে সকলকে বোতল হইতে সুরা ঢালিয়া দিতে লাগিলাম, সকলে পান করিতে লাগিল; আমি কিন্তু সে দিবস পান করিলাম না।

 দ্বিতীয় দিবস আবার সুরাপানের উদ্যোগ হইল, সুরা আসিল, সকলে পান করিতে লাগিল। আমি সকলের বিশেষতঃ গোলাপের অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া জিহ্বা দ্বারা স্পর্শ করিলাম মাত্র, কিন্তু পান করিলাম না। তৃতীয় দিবস মুখে লইয়া ফেলিয়া দিলাম, চতুর্থ দিবস অল্প মাত্র কণ্ঠদেশ পর্য্যন্ত নামিল, পঞ্চম দিবস উদরস্থ হইল। ক্রমে এক মাসের মধ্যে আমি অন্য সকলের ন্যায় একজন সমান অংশীদার হইয়া উঠিলাম। উহার আনুষঙ্গিক যে যে দোষ হইতে পারে, তাহার সকল গুলিতেই আমার অধিকার জন্মিল। গোলাপকে এত দিবস পর্য্যন্ত যেরূপ ভাবে দেখিতাম, এখন হইতে তাহাকে আরও সহস্রগুণে সুন্দরী দেখিতে লাগিলাম—তাহাকে আরও ভালবাসিতে লাগিলাম। ক্রমে আমার কপাল পুড়িল, লজ্জা, ভয় ও ধর্ম্মের মস্তকে পদাঘাত করিয়া গোলাপ আমার সর্ব্বনাশ করিল। তখন হৃদয় হইতে সমস্ত ভাবনা দূরীভূত করিয়া কেবলমাত্র গোলাপের ভাবনাতেই রাত্রিদিন অতিবাহিত করিতে লাগিলাম।

 এই সময়ে এক দিবস প্রাতঃকালে সোণাগাছিতে অতিশয় গোলমাল শুনিতে পাইলাম। দেখিলাম, পুলিসের কর্ম্মচারীগণ সেইদিকে যাইতেছে, সুতরাং আমিও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। দেখিলাম, একটী দ্বিতল বাটীর প্রাঙ্গনে এক ব্যক্তি মৃত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার হস্ত, পদ ও মস্তক চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আমি তাহার নিকটে গিয়া দেখিলাম, দেখিয়া চিনিলাম যে, আমার সেই পরম বন্ধু,—কেদার বাবুরই এই দশা হইয়াছে। যাহাকে এক দণ্ড না দেখিয়া থাকিতে পারিতাম না, তাহার এই দশা দেখিয়া আমার মনে যেরূপ দুঃখ হইল, তাহা বলিতে পারি না। সেই দিন হইতে এক বৎসরের মধ্যে এমন একদিনও যায় নাই, যে দিন কেদারের নিমিত্ত আমার চক্ষু দিয়া অন্ততঃ এক বিন্দু জলও না পড়িয়াছে। যাহা হউক, উক্ত মৃতদেহ মেডিকেল কলেজে পরীক্ষার্থ প্রেরিত হইলে, পুলিস কর্ত্তৃক তাঁহার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান হইতে লাগিল। পরে শুনিয়াছিলাম, ঐ দ্বিতল বাটীতে কতকগুলি বার-বনিতা বাস করে, কেদার বাবু তাহাদিগের একজনের ঘরে বসিয়া আমোদ প্রমোদ ও সুরাপান করিয়া অতিশয় উন্মত্ত হইয়াছিলেন, এবং কাহারও কথা না শুনিয়া, পক্ষীগণ যেরূপ শূন্যমার্গে উড্ডীয়মান হইয়া থাকে, সেইরূপ উড়িতে চেষ্টা করিয়াছিলেন ও সেইস্থান হইতে পড়িয়া তাহার এইরূপ দশা হইয়াছিল।