ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

 “এখন সন্ধ্যার পর দুই এক ঘণ্টা গোলাপের বাটীতে থাকিয়া আর তৃপ্তি হয় না, ক্রমে দিনমানে যাইতে আরম্ভ করিলাম। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইল। প্রত্যহ স্কুলে যাইবার নিয়মিত সময়ে বাটী হইতে বহির্গত হইয়া, স্কুলে যাওয়ার পরিবর্ত্তে গোলাপের বাটীতে উপস্থিত হই। সমস্ত দিবস সেইস্থানে থাকিয়া, আমোদ আহ্লাদ করিয়া, বৈকালে বাটীতে ফিরিয়া আসি। পিতা মাতা মনে করিতে লাগিলেন, আমি পূর্ব্বমত স্কুলে যাইতেছি, এবং পূর্ব্বমত পাঠে মনঃসংযোগ করিতেছি। কিন্তু আমার যে গুণ বাড়িয়াছে, ইংরাজী শিক্ষকের পরিবর্ত্তে গোলাপ যে আমাকে শিক্ষা দিতেছে, তাহা তাঁহারা মুহূর্ত্তের জন্যও বুঝিতে পারিলেন না। এইরূপে বৎসর অতীত হইয়া গেল, প্রবেশিকা পরীক্ষার দিন আসিয়া উপস্থিত হইল। পরীক্ষা দিতে হইবে, কিন্তু ছয়মাস কাল পুস্তক হস্তে করি নাই, স্কুলের পথে পদার্পণও করি নাই; কিরূপে পরীক্ষা দিয়া উত্তীর্ণ হইব? এই সকল বিষয় একবার ভাবিলাম। মনে মনে একটু আক্ষেপ হইল, অনুশােচনা আসিয়াও উপস্থিত হইল। ভাবিতে ভাবিতে গােলাপের বাটীতে গেলাম। গােলাপ আমার মনের ভাব বুঝিল—আমাকে সুস্থ করিবার চেষ্টা করিল। এক গ্লাস সুরা আনিয়া আমার সম্মুখে ধরিল, আমি পান করিলাম, সকল দুঃখ ও ভাবনা ভুলিলাম। আমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রভাবে পরিশেষে পাস হইবার একটা অতি সহজ উপায়ও বাহির করিয়া রাখিলাম।

 স্কুলের সকলে পরীক্ষা দিল। পরীক্ষার ফল বাহির হইল। আমি সেই সময়ে যে উপায় ভাবিয়া রাখিয়াছিলাম, সেই উপায় অবলম্বন করিয়া দুষ্কর্ম্মের অন্য আর এক সােপানে পদার্পণ করিলাম। পিতাকে বলিলাম, “আমি পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইয়াছি।” তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করিলেন, মনে মনে সন্তুষ্ট হইলেন। সেই সময় পিতা আমার বিবাহের বন্দোবস্ত করিলেন,—আমিও শুনিলাম, আমার বিবাহ হইবে। শুনিয়াছি, বিবাহের কথা শুনিলে সকলে আহ্লাদিত হন, কিন্তু আমার মনে যে কি ভয়ানক দুঃখ আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহা আমিই জানিলাম—আর যদি কেহ আমার মত অবস্থায় কখন পড়িয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনিও বুঝিবেন। কিন্তু কি করি, কিছুই করিতে পারিলাম না; আমার অনভিমতেই বিবাহ হইয়া গেল। প্রতিবেশী গণের নিকট শুনিলাম যে, আমার স্ত্রী পরমা সুন্দরী; কিন্তু গােলাপ অপেক্ষা তাহাকে সুন্দরী বলিয়া আমি বিশ্বাস করিতে পারিলাম না।

 এক বৎসর হইল, গােলাপের সহিত আমার আলাপ হইয়াছে; ইহার মধ্যে গোলাপ আমার নিকট হইতে একটী পয়সাও লয় নাই, অথচ এমন দিন ছিল না যে, সে আমার জন্য একটা টাকাও খরচ না করিয়াছে। সে এক দিবসের জন্য আমার নিকট কিছু প্রার্থনা না করিলেও আমি এখন হইতে তাহাকে কিছু কিছু দিতে আরম্ভ করিলাম।

 পিতা আমাকে এল্, এ (এফ্, এ) পড়িতে বলিলেন। আমিও সম্মত হইলাম। আমার উপর তাঁহার এতদূর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তিনি এক দিবসের নিমিত্ত স্বপ্নেও মনে করিতেন না—আমি তাঁহাকে প্রতারণা করিতেছি। পুস্তকের মূল্য, স্কুলের বেতন, পরীক্ষার ফি, প্রভৃতি আবশ্যকীয় খরচের টাকা যাহা তিনি দিতেন, আমি তাহা লইয়াই গোলাপের নিকট উপস্থিত হইতাম। এইরূপে আরও দুই বৎসর অতীত হইয়া গেল। এক দিবসের নিমিত্ত স্কুলের পথেও পদার্পণ করিলাম না; কিন্তু ক্রমে পরীক্ষার দিন আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিলাম, সকলে পরীক্ষা দিল। ক্রমে পরীক্ষার ফলও বাহির হইল; আমিও দুষ্কর্মের আর এক পদ উর্দ্ধে উত্থিত হইলাম। পূর্ব্বমত পিতাকে বুঝাইলাম, আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছি। তিনি আমার কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিলেন, এবং ডাক্তারি শিখিবার নিমিত্ত আমাকে মেডিকেল কলেজে ভর্ত্তি হইতে বলিলেন। আমি তাঁহার উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিলাম—বুঝিলাম যে, তিনি খরচের টাকা বন্ধ করিবার উদ্যোগ করিতেছেন। কারণ সেই সময়ে মেডিকেল কলেজের নিয়ম ছিল, যে ব্যক্তি এল্, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি শিখিবার নিমিত্ত প্রবেশ করিবে, সে কলেজ হইতে নিয়মিত বৃত্তি পাইবে, এবং বিনাবেতনে অধ্যয়ন করিতে পারিবে। আমি মহাবিপদে পড়িলাম; কারণ আমার খরচের টাকা বন্ধ হইলে আমি গোলাপের আর কিছুমাত্র সাহায্য করিতে পারিব না। অধিকন্তু মেডিকেল কলেজে ভর্ত্তি হইবার সময় এল্, এ, পরীক্ষার প্রশংসাপত্র দেখাইতে না পারিলে, আমার সকল জুয়াচুরি প্রকাশ হইয়া পড়িবে। এই সকল ভাবিয়া আমি অতিশয় অস্থির হইলাম।

 এই সময়ে আমার অন্তঃকরণে পুনরায় অনুশোচনার ছায়া পড়িল। উহাকে শীঘ্র অন্তঃকরণ হইতে বাহির করিয়া দিবার জন্য কোন প্রকার উপায় উদ্ভাবনে নিযুক্ত হইলাম। তখন আমার মন একটু বিকৃত হইল, কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত একটু ভাবনা আসিয়া হৃদয় অধিকার করিল; কিন্তু আমার তীক্ষ্ণবুদ্ধির সাহায্যে তখনই তাহার এক উপায় বাহির করিলাম। জুয়াচুরির অন্য আর এক সোপান ঊর্দ্ধে উঠিলাম।

 অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম—ভবানীপুর হইতে এক ব্যক্তি ঐ বৎসর এল্, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে, তাহার নাম ও আমার নাম একই। মনে মনে স্থির করিলাম, আমি ভবানীপুরে যাইয়া তাহার সহিত দুই এক দিবসের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করিব; ও কৌশলে তাহার প্রশংসাপত্র চুরি করিয়া আনিব। এই পরামর্শ স্থির করিয়া পরদিন ভবানীপুরে গেলাম। সন্ধান করিয়া তাহার বাটীও পাইলাম, দেখিলাম, আমার অভীষ্ট-সিদ্ধির পথ আরও পরিষ্কার হইয়াছে। কারণ দুই তিন দিবস হইল, সেই ব্যক্তির মৃত্যু হইয়াছে। তাহার একমাত্র বৃদ্ধা মাতা পুত্ত্রশোকে অধীরা হইয়া রোদন করিতেছে।

 আমি ধীরে ধীরে বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া বৃদ্ধার নিকট যাইয়া কুটুম্ব বলিয়া পরিচয় দিলাম,—তাঁহার দুঃখে কপট দুঃখ প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিতেও চেষ্টিত হইলাম। এইরূপে নিত্য নিত্য তাহার বাটীতে যাইয়া তাহাকে সান্ত্বনা, এবং তাঁহার আবশ্যকীয় খরচের নিমিত্ত দুই এক টাকার সাহায্যও, করিতে লাগিলাম। ক্রমে পাঁচ সাত দিবসের মধ্যে বৃদ্ধা আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিলেন। এক দিবস তাঁহার ঘরে যত কাগজপত্র ছিল, সমস্ত আনিয়া আমাকে দেখাইলেন ও বলিলেন, “ইহার ভিতর কোন আবশ্যকীয় কাগজপত্র আছে কি না বাছিয়া দাও।” আমার মনােভীষ্ট সিদ্ধ হইল। প্রশংসা পত্রখানি প্রথমেই আপনার পকেটে রাখিলাম। অন্য কাগজপত্র অন্বেষণ করিতে করিতে একখানি ১০৲ দশ টাকার ও একখানি ১০০৲ টাকার নােট পাইলাম। দশ টাকার নােটখানি বৃদ্ধাকে দিলাম, সে আমাকে আশীর্ব্বাদ করিল। অপর খানির বিষয় তাহাকে কিছুমাত্র বলিলাম না, সেইখানি লুকাইয়া আনিয়া গােলাপের হস্তে অর্পণ করিলাম। গােলাপ সন্তুষ্ট হইল; সে দিবস আরও অধিক যত্ন করিল। বৃদ্ধার সহিত সেই দিবস হইতে সম্বন্ধ মিটিল, আর ভবানীপুরের দিকে পদার্পণ করিলাম না।

 পরদিন মেডিকেল কলেজে গমন করিয়া ঐ প্রশংসাপত্র দেখাইয়া কলেজে ভর্ত্তি হইলাম। নিয়মিত বৃত্তি পাইবার আদেশ হইল। এতদিবস পর্য্যন্ত কেবল পিতাকেই ফাঁকী দিয়াছি, অদ্য বিলাতী চক্ষে ধূলিমুষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। পিতা খরচের টাকা বন্ধ করিলেন সত্য, কিন্তু মাসিক বৃত্তির টাকা যে কি করিতেছি, তাহা এক দিবসের নিমিত্তও জিজ্ঞাসা করিলেন না। বলা বাহুল্য, তাহা মাসে মাসে গোলাপের হস্তে অর্পিত হইতে লাগিল। এই সময় আমার আমোদর কিছু ব্যাঘাত জন্মিল; কারণ সমস্ত দিবস গোলাপের বাটীতে থাকিতে পারিতাম না, নিয়মিত সময়ে একবার কলেজে যাইতেই হইত। কোন দিবস কলেজে গমন করিতে না পারিলে সে দিবসের বৃত্তির টাকা পাওয়া যায় না, ইহাই কলেজের নিয়ম; সুতরাং কলেজে গমন না করিলে গোলাপের টাকা কম পড়িত। এই নিমিত্ত প্রত্যহই একবার কলেজে যাইতে হইত; কিন্তু সময় পাইলেই সেইস্থান হইতে অন্তর্হিত হইয়া গোলাপের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইতাম। এইরূপে তিন বৎসর অতীত হইল, কিন্তু পুস্তকের তিন পাতাও উল্টাইতে হইল না, অথচ ডাক্তারি বিদ্যায় পারদর্শী হইলাম।