ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/লেখকের বক্তব্য/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 ছয় বৎসরের নিমিত্ত ডাক্তার বাবু কারারুদ্ধ হইলেন। ভাবিলাম, ছয় বৎসরের মধ্যে ডাক্তার বাবুর ভাবনা আর আমাদিগকে ভাবিতে হইবে না, বা অপর কাহাকেও তাঁহার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া চলিতে হইবে না। কিন্তু আমি যে আশা করিয়াছিলাম, দেখিলাম, এক বৎসর গত হইতে না হইতেই তাহা ভস্মে পরিণত হইল।

 একদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমি গরাণহাটার মােড়ে দাঁড়াইয়া অপর আর এক ব্যক্তির সহিত কথা কহিতেছি, এমন সময় একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ির দিকে হঠাৎ আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম, উহার ভিতর আমাদিগের ডাক্তার বাবু। ঐ গাড়ি দক্ষিণদিক হইতে আসিয়া চিৎপুর রাস্তা বাহিয়া উত্তর মুখে চলিয়া গেল। উঁহাকে দেখিয়া আমার মনে হঠাৎ কয়েকটী ভাবনার উদয় হইল। প্রথম ভাবিলাম, ইনি কি ডাক্তার বাবু? যদি ডাক্তার বাবু হয়েন, তাহা হইলে ইনি কি প্রকারে জেলের বাহিরে আসিলেন? ইনি কি জেল হইতে পলায়ন করিয়াছেন? যদি তাহাই হইত, তাহা হইলে সে সংবাদ আমরা ত নিশ্চয়ই প্রাপ্ত হইতাম? আমার দ্বিতীয় চিন্তা, ইনি পলায়ন করেন নাই, জেলের কোন কর্ম্মচারী কোন প্রকার প্রলােভনে পড়িয়া ইঁহাকে উহার বাড়ীতে লইয়া যাইতেছেন। এখনই আবার জেলে লইয়া যাইবে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হইল, যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ইঁহার পরিহিত জেলের পােষাক কি হইল? গুপ্তভাবে জেল হইতে আসিবার কালে ভদ্রলােকের পরিধানােপযােগী কাপড় ইনি কোথায় পাইবেন? আমার তৃতীয় চিন্তা, ইনি ডাক্তার বাবু না হইয়া, সেইরূপ অবয়ব-বিশিষ্ট অপর কোন ব্যক্তি ত নহেন?

 এই ভাবিয়া সে দিবস আমি সে সম্বন্ধে আর কোন ভাবনা ভাবিলাম না। পরদিবস পুনরায় এই ভাবনা আমার হৃদয় আশ্রয় করিল; সুতরাং এ সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করা কর্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া, আমি ডাক্তার বাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম। সেইস্থানে তাঁহার পিতার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাঁহার নিকট অবগত হইলাম, প্রকৃতই ডাক্তার বাবু বাড়ীতে আগমন করিয়াছেন, সরকার বাহাদুর অনুগ্রহপূর্ব্বক তাঁহাকে মুক্তি প্রদান করিয়াছেন। কেন যে তিনি সেই কঠিন দণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইয়াছেন, তাহা কিন্তু তাঁহার পিতা বলিতে পারিলেন না, বা ইচ্ছা করিয়াই বলিলেন না। ডাক্তার বাবু সেই সময়ে বাড়ীতে ছিলেন না, সুতরাং তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল না, আমি নিজ স্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম।

 গুরুতর অপরাধে যাঁহার কেবল ছয় বৎসরমাত্র কারাদণ্ড হইয়াছে, এক বৎসর গত হইতে না হইতেই তিনি কি প্রকারে জেল হইতে বহির্গত হইলেন, এই বিষয় অবগত হইবার নিমিত্ত আমার মনে নিতান্ত কৌতুহল জন্মিল। উহার প্রকৃত তত্ত্ব কি, জানিবার নিমিত্ত পরদিবসই আমি ‘হরিণবাড়ী জেলে’ গমন করিয়া আমার মনোগত ভাব সেই স্থানের প্রধান কর্ম্মচারীর নিকট প্রকাশ করিলাম। তিনি ডাক্তার বাবু সম্বন্ধে কাগজ-পত্র দেখিয়া আমাকে কহিলেন, “কঠিন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইয়া ডাক্তার বাবু জেলে আগমন করিবার কয়েক মাস পর পর্য্যন্ত তিনি জেলের নিয়মানুযায়ী কর্ম্মকার্য্য প্রভৃতি সমস্তই সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া আসিতেছিলেন। ইহার পরেই তাঁহার মস্তিষ্ক ক্রমে বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। প্রথম প্রথম ক্রমে তাঁহাকে অন্যমনস্ক বোধ হইত, পরিশেষে তিনি মৌনভাবে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতেন। ক্রমে থাকিয়া থাকিয়া তাঁহার মুখে ‘টাকা’ শব্দ বাহির হইতে লাগিল; পরে সর্ব্বদাই তিনি ‘টাকা টাকা’ শব্দে জেলের ভিতর চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন। শয়নে ‘টাকা’ স্বপনে ‘টাকা’ আহারের সময় ‘টাকা’ বিশ্রামের সময় ‘টাকা’, বস্তুতঃ সর্ব্বদাই “টাকা, টাকা টাকা, টাকা” শব্দ করিয়া রাত্রিদিন অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। কয়েক দিবসের মধ্যে তাঁহার এই প্রকার অবস্থা দেখিয়া, আমরা সকলেই স্থির করিলাম যে, উহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া গিয়াছে। এই সময় যদি ইহার উপযুক্তরূপ চিকিৎসা না হয়, তাহা হইলে ইনি একেবারে বদ্ধপাগল হইয়া যাইবেন; এই ভাবিয়া চিকিৎসার নিমিত্ত অবিলম্বেই ডাক্তারকে আমরা পাগলা হাঁসপাতালে প্রেরণ করিলাম। তাহার পর যে কি হইয়াছে, তাহা আর আমরা অবগত নহি।”

 জেলের প্রধান কর্ম্মচারীর নিকট এই সকল অবগত হইয়া পরিশেষে পাগলা হাসপাতালে গিয়া, একটু অনুসন্ধান করা কর্ত্তব্য বিবেচনা করিলাম। হরিণবাড়ী জেল হইতে পাগলা হাঁসপাতাল বহুদূর নহে, সুতরাং জেল হইতে বহির্গত হইয়া সেইস্থানে গমন করিলাম। সেইস্থানে জিজ্ঞাসা করায় তথাকার একজন ডাক্তার কহিলেন, “ডাক্তার বাবু পাগল হইয়া, হাসপাতালে আসিবার পরই ক্রমে তাহার পাগলামী সারিতে লাগিল। ইহার অবস্থা দেখিয়া হাঁসপাতালের প্রধান ডাক্তার কহিলেন, ‘অপরাপর পাগল অপেক্ষা ইহার অবস্থা অন্য প্রকার। ইহাকে যদি আবদ্ধ করিয়া রাখা যায়, তাহা হইলে ইহার পাগলামী ভাল হওয়া দুরে থাকুক, ক্রমে আরও বর্দ্ধিত হইতে থাকিবে। আমার বিবেচনায় ইহাকে স্বাধীনতা দিয়া ছাড়িয়া দিলে শীঘ্র ইহার পাগলামী ভাল হইবার সম্ভাবনা।’ পরে দেখিলাম, এক এক করিয়া হাঁসপাতালের ডাক্তারগণ, মেম্বরগণ, সকলেই ডাক্তার সাহেবের মতে মত দিলেন। এবং এই বিষয় সম্বন্ধে গবর্ণমেণ্টে রিপোর্ট করাও হইল। ছোট লাট দেখিলেন, যখন একজনকে জেল হইতে মুক্তিপ্রদান করিলে সে চিরদিবসের নিমিত্ত সুখে কালাতিবাহিত করিতে পারিবে, তখন তাহাকে মুক্তিপ্রদান করাই কর্ত্তব্য। পাগল হইয়া চিরদিবস একটী লোকের জীবন যাপনের বিষম কষ্ট দর্শন করা অপেক্ষা, তাঁহাকে অব্যাহতি প্রদান করিলে যদি তাঁহার সেই উৎকট-রোগ আরোগ্য হয়, তাহা হইলে কোন্ সদাশয় ব্যক্তি ক্ষমতা স্বত্ত্বে এরূপ দয়াপ্রকাশ করিতে কুণ্ঠিত হইতে পারেন? লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সাহেব তাহাই করিলেন। ডাক্তারগণের প্রার্থনা-অনুযায়ী তিনি তাহাকে ছাড়িয়া দিবার আদেশ প্রদান করিলেন। ডাক্তার বাবু এইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া, আপনার আলয়-অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। শুনিয়াছি, এখন তাহার সমস্ত পাগলামী ভাল হইয়া গিয়াছে, তিনি পুনরায় তাহার পূর্ব্ব অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন।”

 পাগলা হাঁসপাতাল হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া বুঝিলাম, কি প্রকারে ডাক্তার বাবু এই কঠিনদণ্ডের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছেন। ভাবিলাম, গবর্ণমেণ্ট ইহাকে অব্যাহতি দিয়া ভালই করিয়াছেন, রাজার কর্ত্তব্যই করিয়াছেন। কিন্তু পরিশেষে আমি যাহা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম,তাহাতে মনে অতিশয় কষ্ট হইয়াছিল। রাজা প্রজার সম্মুখে বিশেষরূপে বঞ্চিত হইলে সহৃদয় প্রজার মনে যেরূপ কষ্ট হয়, এ সেইরূপ কষ্ট। পরে বুঝিয়াছিলাম, জেল হইতে খালাস হওয়াও ডাক্তার বাবুর জুয়াচুরি কাণ্ডের অপর আর এক অধ্যায়। তিনি পাগল না হইয়াই জেলের ভিতর পাগল সাজিয়াছিলেন। তাঁহার পাগল সাজিবার প্রধান কারণ, যাহাতে কোনরূপে তিনি পাগলা হাঁসপাতালে যাইতে পারেন। কারণ তিনি পাগলা হাঁসপাতালের প্রধান ডাক্তারের বিশেষ পরিচিত, ও আর একজন বড় ডাক্তারের সহিত তাহার বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। ডাক্তার বাবু তাঁহার পরিচিত ডাক্তারকে তোষামোদ বলেই হউক, বা অপর কোন অসৎ উপায় অবলম্বনেই হউক প্রথমেই, বশীভূত করিয়া রাখিয়াছিলেন। এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার পর তাহারই পরামর্শ-অনুযায়ী ডাক্তার বাবু পাগল সাজিলেন, ও ক্রমে পাগলা হাঁসপাতালে আসিলেন। হাঁসপাতালের প্রধান ডাক্তারকে সেই ডাক্তার সাহেব যেরূপ বুঝাইলেন, সেইরূপই বুঝিলেন, ও পরিশেষে পূর্ব্বকথিত উপায় অবলম্বন করিয়া ডাক্তার বাবুকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন।

 আমাদিগের ডাক্তার বাবু এখন আর পাগল নহেন, তিনি কিন্তু এখন কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়াছেন। ডাক্তারি ব্যবসাই তাহার কলিকাতা পরিত্যাগ করিবার কারণ। এখন তিনি কোন চা বাগানের ডাক্তার হইয়া সেইস্থানেই সুখেই দিনযাপন করিতেছেন। জেল হইতে খালাস হইবার পর তাঁহার বিপক্ষে আর কোন অভিযোগ শুনা যায় নাই। ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি, ডাক্তার বাবুর সেই সকল কুপ্রবৃত্তির দিকে আর যেন দৃষ্টি পতিত না হয়।

সম্পূর্ণ।