ডিটেক্টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/লেখকের বক্তব্য/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
সেইদিবস হইতেই বিনােদের সহিত সেইস্থানেই প্রায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিতে আরম্ভ করিলাম। রাত্রির অধিকাংশ সময়ও সেইস্থানে কাটিতে লাগিল। দুই একদিনের মধ্যেই ডাক্তারের সহিত আমার আলাপ হইয়া গেল। সেইস্থানে ডাক্তার আগমন করিবামাত্র আমি তাঁহার নিকট গমন করিতাম, এবং যে পর্য্যন্ত তিনি শয়ন না করিতেন, সেই পর্য্যন্ত আমি তাঁহার সেবায় নিযুক্ত থাকিতাম। তিনি আমার সেবায় ও যত্নে ক্রমে আমার উপর সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন ও ভালবাসিতে লাগিলেন। মদ্য, মাংস, খাদ্য প্রভৃতি যখন যে দ্রব্য তাঁহার আবশ্যক হইতে লাগিল, আমি নিজব্যয়েই তাহা তাঁহার নিমিত্ত সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, ক্রমে ডাক্তার আমার উপর তাহার বিশ্বাস স্থাপন করিতে আরম্ভ করিলেন। এই সুযোগ পাইয়া আমিও ক্রমে তাঁহার সহিত তাঁহার বাড়ী পর্য্যন্ত গমনাগমন করিতে লাগিলাম। তাঁহার পিতা, ভ্রাতা ও দাস-দাসী প্রভৃতি অপর সকলের সহিত ক্রমে আমার আলাপ-পরিচয় হইয়া গেল।
হরির বাড়ীতে গমন করিতে একদিবস আমার রাত্রি একটু অধিক হইয়া গেল। সেইদিবস ইচ্ছা পূর্ব্বকই আমি একটু বিলম্ব করিয়া সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম। আমার পরামর্শ-মত বিনোদ-কর্ত্তৃক সেইদিবস হরির ঘরে সুরাপানের আয়োজন হইয়াছিল। আমি যখন সেইস্থানে গমন করিলাম, তখন দেখিলাম, তথাকার প্রায় সকলেই সুরাপানে উন্মত্ত হইয়াছে। ডাক্তারেরও বেশ নেসা হইয়াছে। আমি সেইস্থানে গমন করিয়া ডাক্তারকে কহিলাম, “কি ডাক্তার! আজ একটী বড় ভাল মাল আনিয়াছি, খাবে কি?” এই বলিয়া আমার নিকট হইতে আর এক বোতল সুরা বাহির করিয়া দিলাম। সেই সময় এক বোতল অতি উৎকৃষ্ট সুরা পাইয়া, ডাক্তার অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং আমার হস্ত হইতে গ্রহণ করিয়া, উহা পান করিতে লাগিলেন। ডাক্তারের যাহা কখন দেখি নাই, আজ তাহাই দেখিলাম; দেখিতে দেখিতে সুরাদেবী ডাক্তারের হিতাহিত জ্ঞান ক্রমে রহিত করিয়া দিল। সময় বুঝিয়া আমিও আজ ডাক্তারের মনের কথা লইতে প্রবৃত্ত হইলাম। নানাপ্রকারের কথা, নানাভাবে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। ডাক্তার অসম্বদ্ধভাবে সমস্ত কথার উত্তর প্রদান করিতে এবং সময়ে সময়ে নিজেও অনেক কথা বলিতে লাগিলেন। ময়মনসিংহে গমন; সেইস্থানে সামান্য টাকার লোভে একজন জমীদারের সর্ব্বনাশসাধন; নিজের প্রভু জমীদারকে কৌশলে বঞ্চনা করিয়া তাঁহার কতকগুলি অর্থ অপহরণ ও পরিশেষে ইহজগৎ হইতে তাঁহাকে অন্য জগতে প্রেরণপূর্ব্বক পূর্ব্বকথিত উকীলের নিকট হইতে আপনাকে রক্ষা করণ; কলিকাতার নিকটবর্ত্তী যে স্থানে ঔষধালয় স্থাপন করিয়াছিলেন, সেইস্থানে নিমন্ত্রিত স্ত্রীলোকদিগের সর্ব্বনাশসাধন; ও পরিশেষে বীমা অফিস হইতে ত্রিশ হাজার টাকা হস্তগত করিবার উপায় প্রভৃতি নির্দ্ধারণ; ইত্যাদি যে সকল বিষয় পূর্ব্বে পাঠকগণ ডাক্তার বাবুর মুখে শ্রবণ করিয়াছেন, তাহার সমস্ত বিষয়ই অসংলগ্নভাবে ক্রমে ক্রমে নেশার ঝোঁকে বলিয়া ফেলিলেন। আমি মোটামুটিভাবে যদিও সমস্ত বিষয় সেই সময় জানিতে পারিলাম, কিন্তু তাঁহার ভ্রাতার মৃত্যু ব্যতীত আর কোন কথাই বিশেষরূপে বুঝিতে পারিলাম না। সমস্ত বিষয় বুঝিতে পারিলাম না সত্য; কিন্তু যাহা শুনিলাম, তাহা স্মৃতির স্তরে অঙ্কিত করিয়া লইলাম।
এই ঘটনার দুই তিন দিবস পরেই আমি একদিবস ডাক্তারকে কহিলাম, “ডাক্তার! আমি দেশ হইতে পত্র পাইয়াছি, বিশেষ কার্য্যোপলক্ষে আমাকে সেইস্থানে গমন করিতে হইবে। বোধ হয়, সেইস্থানে আমার মাসাবধি বিলম্ব হইতে পারে।”
“যত শীঘ্র পার, প্রত্যাগমন করিও”, এই বলিয়া ডাক্তার আমাকে বিদায় দিলেন। পরদিবস আমি কলিকাতা পরিত্যাগ করিলাম। দেশে গমন করিবার পরিবর্ত্তে, গমন করিলাম, ময়মনসিংহে। সেইস্থানে ডাক্তারের সেই পরলােকগত প্রভু জমীদারের পুরাতন কর্ম্মচারীগণের নিকট যে সকল বিষয় শ্রবণ করিলাম, তাহা, ও ডাক্তারের নিজের মুখে বর্ণিত বিষয়, এই উভয় মনে মনে একত্র স্থাপন করিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, প্রকৃত অবস্থা কি?
ময়মনসিংহে প্রয়ােজনােপযােগী অনুসন্ধান সমাপন করিয়া কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম। জমীদার মহাশয়ের কাগজ পত্র যে উকীল বাবুর নিকট ছিল, তাঁহার নাম সেই স্থানেই অবগত হইতে পারিয়াছিলাম। কলিকাতায় আসিয়া সন্ধান করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, এবং যে সকল কাগজ পত্র তাঁহার নিকট ছিল, তাহা সংগ্রহপূর্ব্বক অন্যান্য অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। যত অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, ডাক্তারের বিপক্ষে ততই প্রমাণ সংগ্রহ হইতে লাগিল। সেই কাগজ-পত্রের সমস্তই যে জাল, তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িল।
আমার গুপ্ত অনুসন্ধানের ফল বীমা আফিসে প্রেরণ করিলাম। তাঁহারা জানিতে পারিলেন, জুয়াচুরি করিয়া ৩০০০০৲ ত্রিশ হাজার টাকা হস্তগত করিবার মানসে ডাক্তার তাহার ভ্রাতাকে হত্যা করিয়াছে; সুতরাং ঐ টাকা আর তাঁহাদিগকে প্রদান করিতে হইল না।
এদিকে জালকরা অপরাধে ডাক্তার বাবুকে রাজদ্বারে উপস্থিত করিলাম। সেই সময় তিনি জানিতে পারিলেন, আমি কে ও তাঁহার কিরূপ বন্ধু! এলাহাবাদ হইতে সেই পূর্ব্বকথিত ডাক্তার বাবু আমাদিগের ডাক্তার বাবুর বিপক্ষে সাক্ষীপ্রদান করিলেন। ময়মনসিংহ হইতে সকলেই আসিল, উকীল বাবু আদালতে উপস্থিত হইলেন। বেঙ্গল গবর্ণমেণ্টের সেক্রেটরী এবং পূর্ব্বোক্ত প্রধান ইংরাজ ডাক্তার প্রভৃতি সকলেই আসিয়া কহিলেন, সমস্ত কাগজ জাল, একখানিও প্রকৃত নহে। হাইকোর্টে জুরির বিচারে পরিশেষে আমাদিগের ডাক্তার বাবুর বিচার হইল ও সেইস্থান হইতেই পূর্ব্ব-বর্ণিতদণ্ডে তিনি দণ্ডিত হইলেন।