তরুণের স্বপ্ন/জেল ও কয়েদী
জেল ও কয়েদী
[নিম্নের পত্র দুইখানি শ্রীযুক্ত দিলীপকুমার রায়কে লিখিত]
১
প্রিয় দিলীপ,
তোমার ২৪|৩।২৫ তারিখের চিঠি পেয়ে আনন্দিত হয়েছি। তুমি আশঙ্কা করেছিলে যে, মাঝে মাঝে যেমন ঘটে এবারও বুঝি তেমনি চিঠিখানাকে “double distillation'-এর ভিতর দিয়ে আস্তে হবে; কিন্তু এবার তা হয়নি সেজন্য খুবই খুসী হয়েছি।
তোমার চিঠি হৃদয়তন্ত্রীকে এমনই কোমল ভাবে স্পর্শ ক'রে চিন্তা ও অনুভূতিকে অনুপ্রাণিত করেছে যে, আমার পক্ষে এর উত্তর দেওয়া সুকঠিন। এ চিঠিখানিকে যে আবার “censor"-এর হাত অতিক্রম ক'রে যেতে হবে সেও আর এক অসুবিধা; কেন না, এটা কেউ চায় না যে, তার অন্তরের গভীরতম প্রবাহগুলি দিনের উন্মুক্ত আলোতে প্রকাশ হ'য়ে পড়ুক। তাই এই পাথরের প্রাচীর লৌহ-দ্বারের অন্তরালে বসে আজ যা ভাব্ছি ও যা অনুভব করছি, তার অনেকখানিই কোন এক ভবিষ্যৎ কাল পর্য্যন্ত অকথিতই রাখ্তে হবে।
আমাদের মধ্যে এতগুলি যে অকারণে বা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে জেলে আছি, সেই চিন্তা তোমার প্রবৃত্তি ও মার্জ্জিত রুচিকে আঘাত করবে এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনাগুলি যখন মেনে চলতেই হচ্ছে তখন সমস্ত ব্যাপারটাকে আধ্যাত্মিক দিক দিয়েও দেখা যেতে পারে। এ-কথা আমি বলতে পারি না যে, জেলে থাকাটাই আমি পছন্দ করি—কেন না, সেটা নিছক ভণ্ডামী হ'য়ে পড়ে। আমি বরং আরও বলি যে, কোন ভদ্র বা সুশিক্ষিত ব্যক্তি কারাবাস পছন্দ করতেই পারে না। জেলখানার সমস্ত আবহাওয়াটা মানুষকে যেন বিকৃত ও অমানুষ করে তোলারই উপযোগী এবং আমার বিশ্বাস এ-কথাটা সকল জেলের পক্ষেই খাটে। আমার মনে হয়, অপরাধীদের অধিকাংশেরই কারাবাসকালে নৈতিক উন্নতি হয় না, বরং তারা যেন আরো হীন হয়ে পড়ে। এ-কথা আমাকে বলতেই হবে যে, এতদিন জেলে বাস করার পর কারাশাসনের একটা আমূল সংস্কারের একান্ত প্রয়োজনের দিকে আমার চোখ খুলে গেছে এবং ভবিষ্যতে কারা-সংস্কার আমার একটা কর্ত্তব্য হবে। ভারতীয় কারা-শাসন-প্রণালী একটা খারাপ (অর্থাৎ ব্রিটিশ-প্রণালীর) আদর্শের অনুসরণ মাত্র, ঠিক যেমন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটা খারাপ, অর্থাৎ লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শের অনুকরণ। কারা-সংস্কার বিষয়ে আমাদের বরং আমেরিকার ইউনাইটেড ষ্টেট্স্-এর মত উন্নত দেশগুলির ব্যবস্থাই অনুসরণ করা উচিত।
এই ব্যবস্থার যেটি সব চেয়ে বড় প্রয়োজন, সে হচ্ছে একটা নূতন প্রাণ বা যদি বল, একটা নূতন মনোভাব এবং অপরাধীদের প্রতি একটা সহানুভূতি। অপরাধীদের প্রবৃত্তিগুলিকে মানসিক ব্যাধি বলেই ধরতে হবে এবং সেই ভাবেই তাদের ব্যবস্থা করা উচিত। প্রতিষেধমূলক দণ্ডবিধি—যেটা কারা-শাসন-বিধির ভিতরের কথা বলে ধরা যেতে পারে—তাকে এখন সংস্কারমূলক নূতন দণ্ডবিধির জন্যে পথ ছেড়ে দিতে হবে।
আমার মনে হয় না, আমি যদি স্বয়ং কারাবাস না করতাম তাহ'লে একজন কারাবাসী বা অপরাধীকে ঠিক সহানুভূতির চোখে দেখতে পারতাম। এবং এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ যে, আমাদের দেশের আর্টিষ্ট বা সাহিত্যিকগণের যদি কিছু কিছু কারাজীবনের অভিজ্ঞতা থাক্ত তাহ'লে আমাদের শিল্প এবং সাহিত্য অনেকাংশে সমৃদ্ধ হতো। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা যে তার জেলের অভিজ্ঞতার নিকট কতখানি ঋণী সে কথা বোধ হয় ভেবে দেখা হয় না।
আমি যখন ধীরভাবে চিন্তা করি, তখন আমার নিঃসংশয় ধারণা জন্মে যে, আমাদের সমস্ত দুঃখ কষ্টের অন্তরে একটা মহত্তর উদ্দেশ্য কাজ করছে। যদি আমাদের জীবনের সকল মুহূর্ত্ত ব্যাপে এই ধারণাটা প্রসারিত হয়ে থাকত তাহলে দুঃখে কষ্টে আর কোন যন্ত্রণা থাকত না এবং তাইতেই ত আত্মা ও দেহের মধ্যে আবিরাম দ্বন্দ্ব যুদ্ধ চলেছে।
সাধারণতঃ একটা দার্শনিক ভাব বন্দীদশায়, মানুষের অন্তরে শক্তির সঞ্চার করে। আমিও সেইখানেই আমার দাঁড়াবার ঠাঁই ক'রে নিয়েছি এবং দর্শনবিষয়ে যতটুকু পড়া-শুনা করা গেছে সেটুকু এবং জীবন সম্বন্ধে আমার যে ধারণা আছে তাও আমার বেশ কাজে লেগেছে। মানুষ যদি তার নিজের অন্তরে ভেবে, দেখবার মত যথেষ্ট বিষয় খুঁজে পায়, বন্দী হ'লেও তার কষ্ট নেই, অবশ্য যদি তার স্বাস্থ্য অটুট থাকে; কিন্তু আমাদের কষ্ট ত শুধু আধ্যাত্মিক নয়—সে যে শরীরেও কষ্ট এবং প্রস্তুত থাকলেও, দেহ যে সময় সময় দুর্ব্বল হয়ে পড়ে।
৺লোকমান্য তিলক কারাবাস-কালে গীতার সমালোচনা লেখেন। এবং আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, মনের দিক দিয়ে তিনি সুখে দিন কাটিয়েছিলেন। কিন্তু এ বিষয়েও আমার নিশ্চিত ধারণা যে, মান্দালয় জেলে ছ'বছর বন্দী হয়ে থাকাটাই তাঁর অকাল-মৃত্যুর কারণ।
এ-কথা আমাকে বলতেই হবে যে, জেলের মধ্যে যে নির্জ্জনতায় মানুষকে বাধ্য হয়ে দিন কাটাতে হয় সেই নির্জ্জনতাই তাকে জীবনের চরম সমস্যাগুলি তলিয়ে বুঝবার সুযোগ দেয়। আমার নিজের সম্বন্ধে এ কথা বলতে পারি যে, আমাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের অনেক জটিল প্রশ্নই বছরখানেক আগের চেয়ে এখন যেন অনেকটা সমাধানের দিকে পৌঁছচ্ছে। যে সমস্ত মতামত এক সময়ে নিতান্ত ক্ষীণভাবে চিন্তা বা প্রকাশ করা যেত, আজ যেন সেগুলো স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে উঠছে। অন্য কারণে না হ'লেও শুধু এই জন্যই আমার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্য্যন্ত আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে, অনেকখানি লাভবান হতে পারব।
আমার কারাবাস ব্যাপারটিকে তুমি একটা 'Martyrdom' ব'লে অভিহিত করেছ। অবশ্য ও-কথাটা তোমার গভীর অনুভূতির ও প্রাণের মহত্বেরই পরিচায়ক। কিন্তু আমার সামান্য কিছু 'humour' ও 'proportion'-এর জ্ঞান আছে, (অন্ততঃ আশা করি যে আছে) তাই নিজকে 'Martyr' বলে মনে করবার মত স্পর্দ্ধা আমার নেই। স্পর্দ্ধা বা আত্মম্ভরিতা জিনিষটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে চাই, অবশ্য সে বিষয়ে কতখানি সফল হয়েছি, শুধু আমার বন্ধুরাই বলতে পারেন। তাই 'Martyrdom' জিনিষটা আমার কাছে বড়জোর একটা আদর্শই হ'তে পারে।
আমার বিশ্বাস, বেশী দিনের মেয়াদীয় পক্ষে সব চেয়ে বড় বিপদ এই যে, আপনার অজ্ঞাতসারে তাকে অকালবার্দ্ধক্য এসে চেপে ধরে, সুতরাং এ-দিকে তার বিশেষ সতর্ক থাকাই উচিত। তুমি ধারণাই করতে পারবে না, কেমন ক'রে মানুষ দীর্ঘকাল কারাবাসের ফলে ধীরে ধীরে দেহে ও মনে অকালবৃদ্ধ হয়ে যেতে থাকে, অবশ্য অনেকগুলি কারণই এর জন্যে দায়ী—যথা, খারাপ খাদ্য, ব্যায়াম বা স্ফূর্ত্তির অভাব, সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন থাকা, একটা অধীনতার শৃঙ্খল-ভার, বন্ধুজনের অভাব এবং সঙ্গীতের অভাব, যাহা সর্ব্বশেষে উল্লিখিত হ'লেও একটা মস্ত অভাব। কতকগুলি অভাব আছে যা মানুষ ভিতর থেকে পূর্ণ করে তুলতে পারে, কিন্তু আবার কতকগুলি আছে যেগুলি বাইরের বিষয় দিয়ে পূর্ণ করতে হয়। এই সব বাইরের বিষয় থেকে বঞ্চিত হওয়াটা অকালবার্দ্ধক্যের জন্য কম দায়ী নয়। আলিপুর জেলে ইউরোপীয় বন্দীদের জন্যে সঙ্গীতের সাপ্তাহিক বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু আমাদের নেই। পিক্নিক্, বিশ্রম্ভালাপ, সঙ্গীত-চর্চ্চা, সাধারণ বক্তৃতা, খোলা জায়গায় খেলা-ধূলা করা, মনোমত কাব্য সাহিত্যের চর্চ্চা—এ সমস্ত বিষয় আমাদের জীবনকে এতখানি সরস ও সমৃদ্ধ করে তোলে যে, আমরা সচরাচর তা বুঝতে পারি না এবং যখন আমাদিগকে জোর ক'রে বন্দী ক'রে রাখা হয় তখনই তাদের মূল্য বুঝতে পারা যায়। যতদিন জেলের মধ্যে বেশ স্বাস্থ্যকর ও সামাজিক বিধিব্যবস্থার বন্দোবস্ত না হয়, ততদিন কয়েদীর সংস্কার হওয়া অসম্ভব এবং ততদিন জেলগুলি আজকালকার মত নৈতিক উন্নতির পথে অগ্রসর না হয়ে অবনতির কেন্দ্র হয়েই থাকবে।
এ-কথা আমার লিখতে ভোলা উচিত নয় যে, আপনার নিজের লোকের, বন্ধুবান্ধবের এবং সর্ব্ব-সাধারণের সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা মানুষকে জেলের মধ্যেও অনেকখানি সুখ দিতে পারে। এই দিকের প্রভাবটা নিতান্ত অজ্ঞাতসারে ও সূক্ষ্মভাবে কাজ করলেও নিজের মনটাকে আমি বিশ্লেষণ ক'রে দেখতে পাই যে, এই ভাব কিছুতেই কম বাস্তব নয়। সাধারণ ও রাজনৈতিক অপরাধীদের অদৃষ্টের পার্থক্যের এটা একটা নিশ্চিত কারণ। যে রাজনৈতিক অপরাধী, সে জানে মুক্তি পেলে সমাজ তাকে বরণ ক'রে নেবে, কিন্তু সাধারণ অপরাধীদের তেমন কোন সান্ত্বনা নেই। সে বোধ হয় তার বাড়ী ছাড়া আর কোথাও কোন সহানুভূতিই আশা করতে পারে না এবং সেই জন্যই সাধারণের কাছে মুখ দেখাতে সে লজ্জা পায়। আমাদের yard-এ যে সমস্ত কয়েদীর কাজ করতে হয়। তাদের কেউ কেউ আমাকে বলে যে, তাদের নিজের লোকেরা জানেই না যে, সে জেলে বন্দী। লজ্জায় তারা বাড়ীতে কোন সংবাদও দেয় নি। এ ব্যাপারটা আমার কাছে নিতান্ত অসন্তোষজনক বলে মনে হয়। সভ্য সমাজ অপরাধীদের প্রতি আরও সহানুভূতি কেন দেখাবে না?
আমার জেলের অভিজ্ঞতা বা তার থেকে যে সমস্ত চিন্তা মনে আসে সে সম্বন্ধে পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি কিন্তু একটা চিঠির ত শেষ আছে। আমার বেশী উদ্যম ও শক্তি থাকলে একখানা বই লিখে ফেলার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে চেষ্টার উপযুক্ত সামর্থ্যও আমার নেই।
আমাদের জেলের কষ্ট দৈহিক অপেক্ষা মানসিক বলে মনে করার আমি পক্ষপাতী। যেখানে অত্যাচার ও অপমানের আঘাত যথাসম্ভব কমে আসে, সেখানে বন্দী-জীবনটা ততটা যন্ত্রণাদায়ক হয় না। এই সমস্ত সূক্ষ্মধরণের আঘাত উপর থেকেই আসে, জেলের কর্ত্তাদের এ বিষয়ে কিছু হাত থাকে না। আমার অন্ততঃ এই রকমই অভিজ্ঞতা। এই যে সব আঘাত বা উৎপীড়ন—এগুলো আঘাতকারীর প্রতি মানুষের মনকে আরও বিরূপ ক'রে দেয় এবং সেই দিক দিয়ে দেখলে মনে হয়, এগুলোর উদ্দেশ্য ব্যর্থ। কিন্তু পাছে আমরা আমাদের পার্থিব অস্তিত্ব ভুলে যাই এবং নিজেদের অন্তরের মধ্যে একটা আনন্দধাম গড়ে তুলি, তাই এই সব আঘাত আমাদের উপর বর্ষণ ক'রে আমাদের স্বপ্নাবিষ্ট আত্মাকে জাগিয়ে বলে দেয় যে, মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কি কঠোর ও নিরানন্দময়।
তুমি বলেছ যে, মানুষের অশ্রু দিনের পর দিন কেমন করে সমস্ত পৃথিবীর মাটীকে একেবারে তলা পর্য্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে,—এই দৃশ্য তোমাকে প্রতিদিন গম্ভীর ও বিষণ্ণ করে তুলেছে। কিন্তু এই অশ্রু সব টুকুই দুঃখের অশ্রু নয়। তার মধ্যে করুণা ও প্রেমবিন্দুও আছে। সমৃদ্ধতর ও প্রশস্ততর আনন্দস্রোতে পৌঁছাবার সম্ভাবনা থাকলে কি তুমি দুঃখকষ্টের ছোটখাট অগভীর ঢেউগুলি পার হয়ে যেতে অরাজী হতে? আমি নিজে ত দুঃখবাদ বা নিরুৎসাহের কোন কারণ দেখি না; বরং আমার মনে হয়, দুঃখ-যন্ত্রণা উন্নততর কর্ম্ম ও উচ্চতর সফলতার অনুপ্রেরণা এনে দেবে। তুমি কি মনে কর, বিনা দুঃখ-কষ্টে যা লাভ করা যায়। তার কোন মূল্য আছে?
তুমি কিছুদিন পূর্ব্বে যে সব বই পাঠিয়েছিলে তার সবগুলিই পেয়েছি। সেগুলি এখন ফিরে পাঠাতে পারব না, কারণ তাদের অনেক পাঠক জুটেছে। তোমার পছন্দ যে রকম সুন্দর তাতে এ-কথা বলা অনাবশ্যক যে, আরও বই সাদরে গৃহীত হবে। ইতি—
২
প্রিয় দিলীপ,
আমার শেষ চিঠির পরে তোমার কাছ থেকে সর্ব্বসমেত তিনখানি চিঠি পেয়েছি। চিঠিগুলির তারিখ—৬ই মে, ১৫ই মে ও ১৫ই জুন।
তোমার প্রেরিত বইয়ের শেষ পার্শ্বেলটা পেয়েছি। টুর্গেনিভের Smoke বইটা পাইনি। আফিসে পার্শ্বেলটী খোলা হয়েছিল, সুতরাং সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছি। দরকার হলে কল্কাতায় C. I. D. আফিসে তিনি খোঁজ করবেন। তুমিও D. I. G, C. I. D-কে লিখে এ বিষয়ে তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পার।
Bertrand Russel-এর “Prospects of Industrial Civilisation". খানি বহরমপুর জেলে কয়েকজন কয়েদীর কাছে আছে। আমাদের যখন স্থানান্তরিত করা হয়, তখন অনেকেই সেই বইখানি কাছে রাখবার আগ্রহ প্রকাশ করেন, আর বাস্তবিক একজন তখনও বইটা পড়ছিল। বইখানা তোমার দরকার হবে সে কথা না জেনে সেখানে রেখে এসেছিলাম। রাসেলের বইগুলির আদর এত বেশী যে, একখানা পেলে কেউ শীঘ্র ছাড়তে চায় না। বহরমপুর জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে আজ লিখলাম তিনি যেন তোমার কাছে বইখানা পাঠিয়ে দেন। তুমি তাঁকে লিখতে পার, তাতে কাজটা তাগাদা হবে। তোমার এত দরকারের সময় বইটা আট্কে রাখবার জন্যে দায়ী বলে বিশেষ দুঃখিত, কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ এত অসুবিধার কথা আগে আমি ভেবে উঠতে পারি নি। “Free Thought and Official propaganda” ত আমার কাছে নেই—এ বইটা তুমি আমাকে পাঠাও নি?
বই বেছে দেওয়ার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমরা সকলে আশা করি, তুমি যে কাজ আরম্ভ করেছ ভগবানের ইচ্ছায় তা ভাল ভাবেই চলবে। তোমার লেখাগুলি যে আমি সসম্মানে পাঠ করব সে কথা বিশেষ করে বলবার বোধ হয় প্রয়োজন নেই। বই প্রকাশ করবার সময় প্রচ্ছদপটের দিকে যেন নজর রেখো। এইমাত্র একখানা হালের "বঙ্গবাণী"তে রবীন্দ্রনাথের উপর তোমার লেখা একটা প্রবন্ধ দেখলাম। আমি এখনও সেটা পড়ি নি কিন্তু বিষয়টা চিত্তাকর্ষক বলেই বোধ হল।
তুমি জান আজকের দিনে কিসে আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমার বিশ্বাস আমাদের সকলেরই একই চিন্তা—সে হচ্ছে মহাত্মা দেশবন্ধুর দেহত্যাগ। কাগজে যখন এই দারুণ সংবাদ দেখি তখন এ দুটো চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি। কিন্তু হায়! সংবাদটা নিতান্তই নির্ম্মম সত্য। আমরা সমগ্র জাতিটাই যেন নিতান্ত হতভাগ্য বলে মনে হচ্ছে।
যে সব চিন্তা আমার অন্তরকে তোলপাড় করছে সে সব চিন্তাগুলি বাইরে প্রকাশ করে মনকে লাঘব করতে চাইলেও, আমায় কষ্টের সহিত সংযত হ'তে হবে। যে সব চিন্তা আজ মনে উদয় হচ্ছে সেগুলি এত পবিত্র, এত মূল্যবান যে, অচেনা লোকদের কাছে তা প্রকাশ করা যায় না—censor-দের ত অচেনা অজানা মনে না করে পারি না। আমি শুধু এই কথাই বলতে চাই যে সমগ্র দেশের ক্ষতি যদি অপূরণীয়ই হয়ে থাকে, বাঙ্গলার যুবকদের পক্ষে এ একটা সব চেয়ে বড় সর্ব্বনাশ—সত্যই এটা আমাকে স্তম্ভিত ক'রে দিয়েছে।
আজকের দিনে এত বিচলিত ও শোকাচ্ছন্ন হয়েছি এবং সেই সঙ্গে মনোজগতে সেই স্বর্গীয় মহাত্মার এত কাছাকাছি নিজেকে অনুভব করছি যে, তাঁর গুণাবলী বিশ্লেষণ করে তাঁর সম্বন্ধে কিছু লেখা মোটেই সম্ভব নয়। আমি তাঁর অত্যন্ত কাছে থেকে নিতান্ত অসতর্ক মুহূর্ত্তগুলিতে তাঁর যে ছবি দেখেছিলাম, সময় এলে জগতের সামনে তার কথঞ্চিৎ আভাস দিতে পারব আশা করি। তাঁর সম্বন্ধে আমার মত যাঁরা অনেক কথাই জানেন, তারা, পারলেও, আজ কিছু বলতে সাহস করছেন না, আশঙ্কা হয়, তাঁর মহত্ত্বের সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে না পেরে পাছে তাঁকে ছোট করে ফেলেন।
তুমি যখন ফলতঃ এই কথাটাই বল যে, দুঃখ কষ্ট নয়, তখন আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ এক মত। জীবনে অবশ্য এমন সমস্ত ট্রাজেডি আছে—এই যেমন এখন একটা আমাদের উপর এসে পড়েছে—সেগুলিকে আমি সানন্দে বরণ করে নিতে পারি না। আমি এত বড় তত্ত্বজ্ঞানী বা এত বড় ভণ্ড নই যে, বলব আমি সকল প্রকার দুঃখ কষ্টই আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে বরণ করে নিতে পারি! সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ভেবে দেখতে হয় যে, কতকগুলি এমন হতভাগ্যও আছে—হয় ত তারা সত্য সত্যই ভাগ্যবান—যারা সকল রকম দুঃখ কষ্ট ভোগ করবার জন্যেই যেন নির্দ্দিষ্ট আছে। বেশী কম যাইহোক, যদি কাউকে পাত্রভরে দুঃখ পান করতে হয় তাহলে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দিয়ে পান করা ভাল। এমনি একটা আত্মনিবেদন বা আত্মসমর্পণের ভার চীনের প্রাচীরের মত অদৃষ্টের সমস্ত আঘাত একেবারে ব্যর্থ ক'রে দিতে নাও পারে। কিন্তু এতে নিশ্চয়ই আমাদের স্বাভাবিক সহিষ্ণুতার শক্তি অনেকখানি বাড়িয়ে তোলে। Bertrand Russel যখন বলেছেন যে, জীবনে এমন সমস্ত ট্রাজেডি আছে যার হাত থেকে মানুষ নিষ্কৃতিই পেতে চায়, তখন ত তিনি খাঁটী সংসারী লোকের অভিমতই প্রকাশ করেছেন এবং আমার বিশ্বাস, যে, কেবল নিষ্কলঙ্ক সাধু ব্যক্তি অথবা সাধুত্বের ভাণ করে যে ভণ্ড, সে-ই এ কথার প্রতিবাদ করবে।
যারা ভাবুক বা তত্ত্বজ্ঞানী নয় তাদের যন্ত্রণাটা সম্পূর্ণ নিরবচ্ছিন্ন মনে করাটা হয় ত তোমার ঠিক হচ্ছে না। তত্ত্বজ্ঞানহীনদের (abstract point of view থেকে আমি তাদের তত্ত্বজ্ঞানহীনই বলি) নিজেদেরও একটা idealism আছে। তারা তাকে পূজার সামগ্রী মনে ক'রে শ্রদ্ধা করে ও ভালবাসে; নানাপ্রকার দুঃখ যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময় সেই ভালবাসার উৎস হতেই তারা সাহস ও ভরসা পায়। এখানে আমার সঙ্গে যারা কারাযন্ত্রণা ভোগ করছে, তাদের মধ্যে এমন অনেক আছে যারা ভাবুক বা দার্শনিক নয়, তবুও তারা শান্তভাবে যন্ত্রণা ভোগ করে এবং বীরের মত সহ্য করে। Technical অর্থে তারা দার্শনিক না হতে পারে, কিন্তু তাদের আমি সম্পূর্ণরূপে ভাব-বিবর্জ্জিত মনে করতে পারি না। সম্ভবতঃ জগতের সর্ব্বত্র যারা কর্ম্মী তাদের সম্বন্ধে সাধারণতঃ এ-কথা খাটে।
সাধারণের মনে একটা ধারণা আছে যে, অপরাধীদের যখন ফাঁসিকাঠে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদের একটা স্নায়বিক দৌর্ব্বল্য আসে এবং যারা কোন মহৎ উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য প্রাণ দেয় তারাই শুধু বীরের মত মরতে পারে। এ ধারণাটা ঠিক নয়। এ সম্বন্ধে আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেচি যে, অধিকাংশক্ষেত্রেই সাধারণ অপরাধীরা সাহসের সহিত প্রাণ দেয়, এবং ফাঁসির দড়ি তাদের গলায় বসাবার আগে ভগবানের পায়েই আত্ম-নিবেদন করে। একেবারে ভেঙ্গে মুস্ড়ে পড়াটা বড় একটা দেখা যায় না। একবার এক কারাধ্যক্ষ আমাকে বলেছিলেন যে একজন ফাঁসির কয়েদী তাঁর কাছে স্বীকার করেছিল যে, সে একজনকে হত্যা করেছিল। সে তার কাজের জন্যে অনুতপ্ত কি না জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছিল যে, তার মোটেই অনুতাপ হয় নি, কারণ হত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার ন্যায্য অনুযোগ ছিল। তারপর সে বীরদর্পে ফাঁসিকাঠে উঠেছিল এবং প্রাণ দিয়েছিল, কিন্তু একটী পেশীর সঙ্কোচনও তার বুঝতে পারা যায় নি।
অপরাধীদের মনস্তত্ব আলোচনা করে আমার চোখ ফুটে গেছে। আমার মনে হয়, মোটের উপর তাদের প্রতি যথেষ্ট অবিচার করা হয়। সেবারে অর্থাৎ ১৯২২ সালে যখন আমি জেলে ছিলাম, তখন একটা কয়েদী আমাদের yard-এ ভৃত্যের কাজ করত। সে সময়ে আমি মহাপ্রাণ দেশবন্ধুর সহিত এক কারাপ্রাঙ্গণে একই ঘরে বাস করতাম। দেশবন্ধুর প্রাণটা ছিল খুবই কোমল, তাই সহজেই এই কয়েদীর দিকে তিনি কেমন আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। সে একটা পুরাণ পাপী, আটবার তার সাজা হয়। কিন্তু সেও কেমন নিজের অজ্ঞাতসারেই দেশবন্ধুর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং আশ্চর্য্য রকমের শক্তির পরিচয় দেয়। কারামুক্তির সময় দেশবন্ধু তাকে বলেছিলেন যে, জেল থেকে মুক্তি পেলে সে যেন বরাবর তাঁর কাছে যায় আর তার পুরাণো সহকারীদের ছায়া যেন না মাড়ায়। কয়েদীটি রাজি হয়েছিল ও কথামত কাজও করেছিল। তুমি শুনলে আশ্চর্য্য হবে যে, যে ব্যক্তি এক সময়ে পুরাণো দাগী ছিল, সে এখন উপরোক্ত ঘটনার পর থেকে তাঁর বাড়ীতে বাস করছে এবং মাঝে মাঝে অভদ্র মেজাজ তার দেখা দিলেও সে যে এখন শুধু অন্য মানুষ তাহা নয়, অধিকন্তু বেশ সরল ভাবেই জীবন কাটাচ্ছে; এবং আজ এই ক্ষতি যাদের সব চেয়ে বেশী বেজেছে তাদের মধ্যে সেও একজন। অনেকে বলেন যে, মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ঘটনা দিয়ে তার মহত্ত্বের বিচার, করা উচিত—এ-কথা যদি সত্য হয় তবে তাঁর দেশের কাজের দিকটা বাদ দিলেও স্বর্গীয় দেশবন্ধু একজন মহাপুরুষ ছিলেন।
আমি আমার আসল বক্তব্য থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি, এবং এখন আমার থামা উচিত। তোমার চিঠির জবাব লেখা এখনও শেষ করতে পারলাম না, কিন্তু আজকের ডাক ধরতে গেলে আমাকে এইখানেই শেষ করতে হয়। আমি জানি তুমি আমার খবর পাবার জন্যে উদ্বিগ্ন থাকবে, সুতরাং আজকের ডাক ধরতেই হবে। পরের পত্রে আরও খবর লিখব। ইতি—